ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সুনন্দর বাড়িঘর : পর্ব ২


    শ্যামলী আচার্য (May 11, 2024)
     

    পর্ব ১

    পুকুরের ওইদিকের ঘাটে ছিপ ফেলে একটা গোটা দুপুর। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা ফাতনার দিকে। একটা মোটা হিজল গাছ হেলে পড়েছে জলের ওপরে। জল ছুঁয়ে আছে তার পাতা। গাছে গাছে আড়াল করা পুকুর। সেখানেই বসে মাছ ধরত কানাইকাকা। পাশে চার নিয়ে, মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে খাঁদু। খাঁদুর ছিল মৃগীরোগ। সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হত তাকে। কাকা তাকে পাশে নিয়েই বসে থাকতেন দিনভর। সে-ও চুপটি করে বসে থাকত। বিনবিন করে মশা আসত। গাছের ডালে ডেকে উঠত অধৈর্য কোনও কাক। কুবো পাখি দূর থেকে দেখে যেত ওদের। সাত ভাই ছাতারে পাখিরাও ঝগড়া বাধাতে এসে পালিয়ে যেত দূরে। কানাইকাকা বসে থাকত গম্ভীর হয়ে। যেন ধ্যানী সন্ন্যাসী।     

    সুনন্দর পকেটে মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। কেউ একজন ফোন করছে। ইছামতী কলিং। ইছামতী! কে ইছামতী? সুনন্দর একেবারে মনে পড়ে না। সুনন্দর কেবল মনে হয় কেউ একজন ঘুরে চলেছে। নদীর মতো বয়ে যায়নি। ঘুরে চলেছে। ইছামতী কি ঘুরেছিল কোথাও? মাথায় শোলার মুকুট আর অনেক গয়না পরে রানির মতো ঘুরছিল। কার চারপাশে ঘুরেছিল মনে নেই। শুধু ওটুকুই মনে পড়ে। ও পকেটে ফোন ঢুকিয়ে রাখে। ইছামতী ডাকতে ডাকতে এক সময়ে চুপ করে যায়। যেমন রাজু ডাকছিল। হাবুডুবু খেতে খেতে দু-তিনবার। দু’বার না তিনবার… তার বেশিও হতে পারে। ‘বাঁচা আমায়, ডুবে যাচ্ছি রে’, রাজু আর্তনাদ করে উঠল একবার, তারপর খাবি খেতে লাগল। সুনন্দ চেঁচাচ্ছিল, আরও কে কে। সবাই ঝাঁপ দিল। সুনন্দ দাঁড়িয়ে রইল পাড়ে। শ্যাওলাধরা ঘাটের ওপর এনে শুইয়ে দেওয়া রাজুর শরীরে সাড়া ছিল না। সাদা শরীর। কোথাও কোনও চিহ্ন নেই। মৃত্যুর চিহ্ন নেই। ঘুমিয়ে পড়ল রাজু। সাপে কাটার পর প্রণবকাকা যেমন ঘুমিয়ে পড়ল একটু একটু করে। ওর শরীর নীল হয়ে গেল। নীলচে শরীর, মুখে ফেনা, কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কোথা থেকে কে ডেকে আনল ওঝা। কত কিছু মন্ত্র, কত বাঁধন দিল সারা শরীরে। ওই গিঁটের দাগ নিয়ে প্রণবকাকা মরে গেল। সকলে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখল। লঙ্কাপোড়ার ঝাঁঝালো গন্ধে নাক জ্বলে যায়। সাপ কি ভূত, যে লঙ্কা পোড়াবে? তবু…       

    সিমুই ওর পাশে দাঁড়ানো। হাত মুঠি করে ধরে।

    ‘ইশ, অত বড় লোকটা ধড়ফড় করে মরে যাবে?’  

    ‘বোধহয়। আচ্ছা, ও কি বুঝতে পারছে ও মরে যাবে?’

    ‘জানি না রে। জানিস, আমার না মরে যেতে খুব ভয় করে…’ সিমুই বলেছিল। সুনন্দ সিমুইকে বলেনি, ওর ভয় করে বেঁচে থাকতে। বেঁচে থাকার অনেক জ্বালা।

    মানুষ কী ভাবে মরে যায়, সুনন্দ তার আগে জানত না। লাট্টুকে ও চোখের সামনে মরে যেতে দেখেনি।  সুনন্দ অনেক কিছুই জানত না।  

    সুনন্দ শরীরের গোপন খবর জানত না। ফণিদা শিখিয়েছিল। চটি বই খুলে পড়িয়েছিল। ছবি এঁকে, আঙুল ছুঁইয়ে বুঝিয়েছিল। ফণিদা খুব মন দিয়ে বলত। প্রতিটি প্রত্যঙ্গের ভাল নাম, ডাকনাম, উপকারিতা, প্রয়োজনীয়তা, সব। ফণিদা নোংরা লোক নয়। একটু ক্ষ্যাপাটে। তাই সুনন্দর খারাপ লাগেনি, বরং মনে হয়েছিল ক্লাস সিক্স-সেভেনে জননতন্ত্র পড়ানোর সময়ে, সাধারণ ফুলের পরাগমিলন শব্দে ক্লাসে কেমন ফিসফাস হাসাহাসি হত। গর্ভাশয় নিয়ে কত আলোচনা! হিলহিলে পুংদণ্ড আর সামান্য চ্যাপটা পরাগধানীর ছবি আঁকা হতে লাগল ভূগোল খাতার পিছনের পাতায়। সে পথ খুঁজছে ওই গর্ভাশয়ের। সুনন্দ সব বুঝতে পারত না। এসব আলোচনার সময়ে ক্লাসে সবাই তাকে এক কোণে ঠেলে রাখত। বলত, ‘তুই তো দুদুভাতু’। কিন্তু ক্লাসের অন্তু যখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিসি করার সময়ে ইশারা করছিল, সুনন্দর গা শিরশির করছিল। এক-মাঠ কুয়াশার মধ্যে একা দাঁড়িয়ে নিজের গোপন অঙ্গ সিমুইয়ের গালে ছুঁইয়ে দেবার ইচ্ছে নিয়ে স্খলিত হয়ে পড়ত সুনন্দ। একা-একাই চলত তার কঠিন থেকে কোমলভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ার খেলা। খেলাই তো। এসব খেলা গভীর গোপন একা-র। সিমুই জানলে কী ভাববে! ছিঃ। কথাই বলবে না আর কোনও দিন। চোখ তুলে তাকাবে না আর, ঘরে ঢুকতে দেওয়া তো দূরস্থান। ওর পাশের বাড়ির মণিদা, যাকে ওরা সবাই দাদার মতো ভাবত, সে ওর বুক ছুঁয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, কাউকে বলব না, একদিন দেখতে দিবি? সিমুই সিঁটিয়ে গিয়েছিল ভয়ে।   

    অষ্টমীর সকালে তখন অঞ্জলি দিতে গেছে সবাই। সিমুই ডুরে পাড়ের নতুন শাড়ি জড়িয়ে মণিদার মা’কে ডাকতে গিয়েছিল। সেই সময়ে মায়েরা যেমন হয়, ‘এই চায়ের কাপটা দোতলায় মনুর ঘরে একটু দিয়ে আসবি মা, আমি ততক্ষণ কাপড়টা পরে নিই… তুই চা দিয়ে নামতে নামতেই বেরুব অখন’ বলে গরম চায়ের কাপ স্টিলের থালায় বসিয়ে ধরিয়ে দেয় সিমুইয়ের হাতে। সিমুই কাপড় সামলে ধীরে ধীরে ওঠে দোতলার অগোছালো ঘরে। ব্যাটাছেলের ঘর। সোঁদা গন্ধ, নোংরা, ময়লা জমে আছে ঘরের কোণে। কালচে মশারিটা ফরসা দেওয়ালের পেরেক থেকে ঝুলছে যেন জলভরা মেঘ নেমে আসছে কদমতলার মাঠের ধারে।     

    মণিদা ঘুম-জড়ানো চোখে শাড়ি-পরা সিমুইকে সামনে দেখে কী ভেবেছিল কে জানে! প্রথমে থতমত খেয়ে ‘রাখ এখানে’ বলে দেখিয়ে দেয় খাটের একটা ফাঁকা অংশ, যে-অংশে ওর পা দুটো গুটিয়ে যাওয়া পাজামার ভেতর থেকে বেরিয়ে আড়াআড়ি করে রাখা ছিল এতক্ষণ। ঘুমের ঘোরে যেমন থাকে। তারপর ‘ও মা, শাড়ি পরেছিস…’ বলে ওর হাতটা চেপে ধরে। সিমুইয়ের নজর ছিল চায়ের কাপ, এক ফোঁটা যেন চলকে বিছানায় না পড়ে, তাই আর লক্ষ করেনি বাঁ-হাতের সঙ্গে কেমন করে আঁচলটাও টেনে ধরেছে মণিদা আর ওর ঢোলা ব্লাউজটাও কাঁধ থেকে খসে গেছে কতটা।    

    সরে যাওয়া আঁচল, অনেকটা অনাবৃত কিশোরী কাঁধে নিষিদ্ধ হাতছানি আছে। তাই বোধহয় মণিদার হাত অবাধ্য হয়ে ছুঁয়েছিল ওর অস্ফুট স্তনবৃন্ত। চেয়েছিল দৃষ্টিসুখ, বলেছিল, ‘কাউকে বলব না সিমুই, একদিন দেখতে দিবি তোকে… আমি কক্ষনও দেখিনি রে কাউকে…’ আরও কী কী বলে যায় বা বলে না পুরোপুরি, বলতে চায়… কিন্তু সিমুই ততক্ষণে হাত ছাড়িয়ে আঁচল সরিয়েছে এক ঝটকায়। আর শিকারি টিকটিকির চটচটে দৃষ্টি থেকে ছিটকে পালিয়েছে। ভীরু পতঙ্গের মতো প্রাণ ফিরে পাওয়ার উত্তেজনায় হুড়মুড় করে নেমেছে সিঁড়ি দিয়ে।   

    অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে ওর কষ্ট হচ্ছিল। ওর নিজেকে মনে হচ্ছিল বাসি কাপড় না-ছাড়া এক অপবিত্র মেয়ে। মা কি ওর হাতের ফুল নেবে আর? প্রাণপণে মনে মনে বলতে থাকে রূপং দেহি জয়ং দেহি আর দু’দিন পরে ভাসান দিতে গিয়ে সব বলে ফেলে সুনন্দকে। ওই সময়ে বলা যায়। চারদিকে ঢাক বাজে, হইহই করে নাচানাচি চলছে। ঠাকুরকে লরিতে তোলার ব্যস্ততা। কলরব ভরপুর। তার মধ্যে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেছিল সব।  

    ‘তুই মণিদার মাকে বলে দিলি না? বাড়ি গিয়ে তোর মাকেও বলতে পারতি…’

    ‘তুই কি পাগল নাকি রে। এসব কথা কেউ কাউকে বলে?’

    ‘তবে আমায় বললি যে?’

    সুনন্দর প্রশ্নের উত্তরে তাকায় সিমুই। এসব প্রশ্ন দিয়ে হারিয়ে যাবার পথ কাটা হয়, জানত না সিমুই।

    ৪.
    হারিয়ে যাওয়া তারাদের খোঁজে আকাশের দিকে তাকায় সুনন্দ। রাত নয়, এখন দুপুর। আকাশ সাদা। রোদের নরম আঁচ যেন পালক-কম্বল।    

    দুটো ছাদ পাশাপাশি ছিল। ঘুড়ি ওড়ানোর ভারী সুবিধে। তার আগে বেশি সুবিধে দুই ছাদ মিলিয়ে আড়াআড়ি সুতো খাটিয়ে মাঞ্জা দেওয়া। পকাই গুঁড়ো করে আনত কাচ। নারকেলের মালায় করে কাচের গুঁড়ো এনে ঢেলে দিত। ঝুলনের সময় পকাই আনত শ্যাওলা। সুশিদের ভাঙা পাঁচিলের ওপর থেকে চেঁছে নিয়ে আসত এক চাঙড় শ্যাওলা। মাঠ হবে। খেলনা মাঠ। মাঠে মাটির গরু, প্লাস্টিকের খেলনা ছাগল পাশাপাশি। দূরে তুলোর পাহাড়। রাংতার বরফ। নুড়ি পাথরের রাস্তা। নীল মার্বেল পেপার কেটে নদী। পাহাড় থেকে সমভূমি সব একাকার হয়ে যেত, সেজে উঠত ঝুলনের খেলনা শহর।

    বর্ষায় বদলে যেত আকাশের রং। কখনও ধূসর, কখনও সাদাটে। বৃষ্টি কমলেই শরতের নীল শামিয়ানায় উড়ে বেড়াত ছোট ছোট চৌকো ঘুড়ি। কত রং, কত বাহার।   

    ‘এবার এমন প্যাঁচ কাটব, দেখে নিস!’ সাবুদানা শিরীষ আর ভাতের মাড় একসঙ্গে জ্বাল দেয় পকাই। তারপর সুতো ডুবিয়ে দেয়। সুতোর এক কোনা লাটাইয়ে পেঁচিয়ে রাখা। আর এক কোনা থেকে কাচের গুঁড়ো লাগিয়ে দেবে সুনন্দ। সুনন্দ আর পকাই মিলে সারা দুপুর। একবার এর হাতে লাটাই, তো একবার ওর হাতে। ‘দেখি ওরা এবার কত টানতে পারে!’ পকাই বলে। ‘ওরা’ মানে লাট্টু, সোনাই আর মিতুল। লাটাই যেদিন বোঁ বোঁ করে ঘোরে, সুতো টানে পকাই। পকাই ছিল আইডল। ও অনেক দূর অবধি ঘুড়ি বেড়ে টেনে প্যাচ খেলতে পারত। ভোকাট্টা বলে চেঁচিয়ে উঠত সুনন্দ। কিংবা পকাই।  

    ‘তুই কেমন করে পারিস পকাই? আমি তো পারি না।’  

    ‘মন দে। মন দিলেই পারবি।’  

    সুনন্দ বুঝত পারে না সে কোথায় মন দেবে, ঘুড়িতে ফুটবলে না আলপনায়। না কি বসে থাকবে মাছ ধরার ফাতনার দিকে তাকিয়ে।  

    ‘অমন বকের মতো ঘাড় গলিয়ে দেখিস না। মন দিয়ে শেখ। ঘুড়ির খেলায় আসল হল মাঞ্জা।’ 

    ভোররাতেও পকাই আসত। সুনন্দ ঘুরে বেড়াত ওর পাশে। হাঁ করে দেখত ওকে। ও কেমন করে লাটাই ধরে, কেমন করে সুতো টানে। ও যেন সর্বশক্তিমান। ও একটা হিরো। চিলেকোঠার ঘরে ঘুড়ি-লাটাই-সুতো-মাঞ্জা রাখার নারকেলের মালা ফিসফিস করে ডাকে। সুনন্দ চোখ বুজলে সব শুনতে পায়। সব। পকাইয়ের ডাক, ঘুড়ি ওড়ানোর হাঁক, ভোকাট্টা চিৎকার। চোখ খুলে সুনন্দ পকাইকে আর খুঁজে পায় না।        

    সুনন্দ সেই নালাটাও খুঁজে পায় না, যে-নালায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল সুহাসকাকা। পিঠের গোল ফুটো থেকে রক্তের স্রোত বেয়ে মিশে যাচ্ছে নালার ময়লা জলে। ভনভন করছে মাছি। একটা কুকুর পাহারা দিয়েছিল বডি। শুধু পাহারা। চিনত না সুহাসকে। সুহাস তখন নিছক একটা ডেডবডি। পুলিশ মেরেছে, পুলিশই তুলবে। পুলিশ মেরে চলে যেত বা পুলিশের হয়ে অন্য কেউ। রটে যেত অন্য কোনও গল্প। পাড়া থমথম করত। দু-চারদিন সব চুপচাপ। ফিসফাস। আবার সব স্বাভাবিক। যেন কোথাও হয়নি কিছু।  

    সুনন্দ সুহাসের চোখের দিকে তাকায়। সারা রাত ধরে ওরা কথা বলে।  

    ‘কেন গেলে সুহাসকাকা?’

    ‘ওরে অমন বলে না। দল যা নির্দেশ দেবে…’

    ‘কোন দল?’

    ‘চুপ, চুপ। তুই এখন ছোট, তোর এসব কথা না শোনাই ভাল।’ 

    ‘ছোট? ছোট কোথায় সুহাসকাকা? আমার তেরো। আমি কলেজে যাব ক’দিন পরে।’

    ‘তাতে কী হয়েছে? কলেজে গেলেই কি সব লায়েক হয়ে যায় নাকি! তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস দেখলে বউদি খুব বকবে।’   

    ‘মা? মা কক্ষনো বকবে না। মা বলে, সুহাস দিন বদলানোর স্বপ্ন দেখে। দিন কেমন করে বদলাবে সুহাসকাকা?’    

    ‘যেদিন সবাই খেতে পাবে, সবার মাথার ওপর ছাদ থাকবে, সেদিন।’

    পকাইদের ষাট বছরের পুরনো বাড়ির চিলেকোঠায় সবাই আসত। বিড়ি খেত। ভুখা মানুষের পেটের ভাত নিয়ে কথা হত। আধপোড়া সুতলি ছিল, দড়ি দিয়ে পাকানো বলের মতো জিনিস ছিল, গুঁড়ো বারুদ ছিল, নিষিদ্ধ ইশতেহার ছিল। ইস্কুলের পাঁচিলে একদিন দাগ বসে গেল। ওটা নাকি বোমার দাগ। অনেক রাতে গলির মোড়ে লাল আগুনের বিন্দু মানে ঘরের মানুষ ঘরে ফিরছে না সংশোধনবাদীর দল নিকেশ করে দেবে অপর পক্ষকে, কে কার অপেক্ষায়, বোঝা মুশকিল। সন্ধে হলে ঘরের আলো নিভিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। লাটাই-ঘুড়ির পাশে বোমা বাঁধার কাঁচামাল। কেউ বুঝবে না, কোনটা কীসের মাঞ্জা। ঘুড়ির প্যাঁচ না রাজনীতির মারপ্যাঁচ…।

    এক-মাঠ কুয়াশার মধ্যে একা দাঁড়িয়ে নিজের গোপন অঙ্গ সিমুইয়ের গালে ছুঁইয়ে দেবার ইচ্ছে নিয়ে স্খলিত হয়ে পড়ত সুনন্দ। একা একাই চলত তার কঠিন থেকে কোমলভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ার খেলা। খেলাই তো। এসব খেলা গভীর গোপন একা-র।

    জোতদার খতম করার হাতিয়ার বানাতে বানাতে নিজে কখন খতম হয়ে গেল সুহাসকাকা। সেদিন দুপুরে ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখা বন্ধ হয়ে গেল মা-জেঠিমার। গাঢ় গোলাপি দোপাটি ফুল রঙের টিকিটদুটো বাতিল ছেঁড়া কাগজ। ভাল ‘বই’ দিয়েছিল পদ্মা হলে। পয়সা জলে গেল।  

    মা কাঁদছিল। স্বীকার করেনি। দু-একবার জিগ্যেস করাতে বলল, ‘চোখে কী পড়েছে বোধহয়। কড়কড় করছে।’

    বাবা চাপা গলায় জিগ্যেস করল, ‘সুহাস তোমায় দিয়ে যায়নি তো কিছু? কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখোনি তো? ভাল করে ভেবে বলো। পুলিশ টের পেলে ধনেপ্রাণে মারা যাব…’

    মা চুপ করে থাকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। যেন সুহাসকে চেনে না, দেখেনি কোনও দিন।

    সুনন্দ বিড়বিড় করে আরও অনেক প্রশ্ন করে যায়। উত্তর দেয় সুহাস। বা সুহাসের বডি। কিংবা পুলিশের ভাষায় লাশ। রক্ত শুকিয়ে লেগে আছে জামায়। পায়ের গোড়ালিতে কাদা। সুনন্দ ভোররাতে খালি পায়ে বাগানে গেলে ঝুরোমাটি দুব্বোঘাস লেগে থাকে। তেমনই। কেঁচোর মাটি গুটিয়ে পাকিয়ে ছাপ রেখে যায় নরম হয়ে। সুনন্দ পা টিপে টিপে গুঁড়ি মেরে এগোয়। কেউ ওকে দেখতে না পায়। পুলিশ দেখতে পেলেই গুড়ুম।

    সুহাস মরে যাওয়ার পরে দিনকাল সব বদলে যায়। ওরা যেভাবে সব পালটে দেবে ভেবেছিল, সেভাবে নয়। অন্য পথে। কিন্তু বদলে যায়। চোরাগোপ্তা খুন আর হানাহানি শেষ হয়ে শান্তিকল্যাণ।

    ওরা নতুন রাস্তায় নামে। সুনন্দর পাশে সুহাস হাঁটে, সুহাসের পাশে সুনন্দ। সুনন্দর পাশে গোপাল, গোপালের পাশে লাট্টু, লাট্টুর পাশে খোকন। সবাই যেন এক-একটা মুখোশ। কেউ আস্ত লোক নয়।

    ৫.
    আস্ত লোকের ভিড় হত লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরি ছিল একটা। বেশ বড়। পাকা ছাদ, লোহার আলমারি। একজন লাইব্রেরিয়ান। একজন দারোয়ান। ভেতরে সার সার সাজানো বই। নীল কাপড়ে বাঁধানো, কালো কাগজে মোড়া। সাদা ছোট্ট চৌকো কাগজে নম্বর লেখা। নাম নেই। বইয়ের গায়ে সব নম্বর। ড্রয়ারে ক্যাটালগ। বইয়ের নাম, লেখকের নাম। নামগুলো আবছা মনে পড়ে। লাইব্রেরি খোঁজার জন্য সুনন্দ হাঁটতে হাঁটতে যায়। কিছু নেই কোথাও। লাইব্রেরিটাও কি নেই? হারিয়ে গেছে?  

    মজে যাওয়া খাল, বুজে যাওয়া নয়ানজুলি, মুছে যাওয়া বাগান, ভাগ হয়ে যাওয়া রাস্তা, ভেঙে যাওয়া বাড়ি, হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্মৃতির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়ে ভাঙাচোরা বাড়িটা। আরে! ওই তো সেই লাইব্রেরি! জোরে পা চালায় সুনন্দ। ইটবালিতে গাঁথা নীলচে চুনকামের থাম, বর্ষাকালে উপচে উঠত কাঁচা ড্রেন। এখন শুকনো। লাইব্রেরি ঘরের দরজা হাট করে খোলা। চালের ওপরে লতিয়ে উঠেছে জুঁই। পাশে নয়নতারা গাছ। বারোমেসে ফুল। গোলাপি আর সাদা তারা হয়ে ফুটে আছে ফুল। আহ্লাদে হাসিমুখে গলে পড়েছে যেন। সন্ধ্যামালতীর ঝোপটি আগের মতোই। ওই ফুলকে নন্দদুলাল বলে কেউ। ওরা নিজেরাই নিজেদের দেখেশুনে রাখে। এক গাছ মরলেও মাটিতে ঝরে পড়া কালোপানা বীজ থেকে আবার মাথা তোলে আরও। নিজেরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। হলুদ-গোলাপি-সাদা ফুল। কোনও ফুলে ছিটে ছিটে দাগ। মোজেইকের মতো। রঙে রঙে মিলেমিশে ছিটেফোঁটা আবার রেখা টানা কত রকমের। ঠিক যেন জীবন এক।   

    পড়ন্ত বিকেলে দরজার মধ্যে দিয়ে লাইব্রেরির মধ্যে ঢুকে দাঁড়ায় সুনন্দ। আলমারিগুলো একই রকম। মোটা মোটা বই। বাঁধানো। কেউ নেই কোত্থাও। কেউ বলছে না, বইতে হাত দিও না। বারণ করার কেউ নেই। কেউ নেই বকুনি দেবার। ফাঁকা ঘরে একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছে বইয়ের আলমারি। খোলা আলমারি। হাসিমুখে বইগুলোর সামনে নিয়ে দাঁড়ায় সুনন্দ। দূরপাল্লার ট্রেন যেমন নিঃশব্দে মাঝরাতে এসে দাঁড়ায় কোনও নির্জন জ্যোৎস্নাঢালা প্ল্যাটফর্মে, তেমন। ওর চেনা পরিসর। এতক্ষণে ফিরে পাওয়া গেল অস্পষ্ট অতীত। বা নানান ভয়ে-ভালবাসায় জীর্ণ কৈশোর। মুখে হাসি মাখিয়ে বিষণ্ণতা সঙ্গী করে সুনন্দ একটা বই তুলে নেয় হাতে।    

    প্রথম বইটাই কী আশ্চর্য! উলটে যায় পাতা। আরে! এই বইটা গোবিন্দ। প্রথম পাতাতেই গোবিন্দর হাসিমুখ। গোবিন্দ ইস্কুলে যাচ্ছে। গোবিন্দর সাইকেল। গোবিন্দ খেলার মাঠে। গোবিন্দ গাছ বেয়ে উঠছে। গোবিন্দ পড়ে গেল পেয়ারাগাছ থেকে। শব্দ হল ধুপ। কাদামাটিতে পা গেঁথে গেল গোবিন্দর। গোবিন্দ গোলপোস্টের জালে পাঠিয়ে দিল ফুটবল। কী মজা! এই বইতে ভর্তি গোবিন্দ। পরের বইটা টেনে নেয় সুনন্দ। কী কাণ্ড! এই বইটা তো সিমুই বই। সিমুইয়ের চিঠি, সিমুইয়ের ছেলেবেলা, সিমুইয়ের চোখের জলের দাগ। ওর হাসির আওয়াজ ভেসে আসে রিন রিন করে। ওর আঁচলের গিঁটে বাঁধা আমড়া আর করমচা। যত পাতা উলটোয়, ওর বইয়ের এক পাতায় কয়লার গুঁড়ো, এক পাতায় ধান ঝাড়ার শব্দ। 

    সুনন্দ পাগলের মতো গিয়ে আরেকটা বই খোলে। কে আছে, কে? সুহাসকাকা, পকাই, ফণিদা। পকাইকে ঘুড়ির মতো দেখতে লাগছে। বইভর্তি রংচঙে ঘুড়ি। মাঞ্জা-সুতো-লাটাই। ঝুলনের পাহাড়-মাটি-আকাশ। মাটির পুতুলের দল স্থির। নড়ে না, কথা বলে না। অনাহত অক্ষত সুহাসকাকার হাতে কাস্তে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে কাস্তে বেয়ে। সুহাসকাকা একগাল হেসে বলে, আমাদের সংগ্রাম চলছে, চলবে। পোস্টার, স্লোগান, বারুদ, ইস্পাত আর গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার প্রতিশ্রুতি। সুনন্দ দেখে বইয়ের মধ্যে ধানের গোছা হাতে নিয়ে সুহাসকাকা হেঁটে যাচ্ছে আলপথ বেয়ে। রাজু আর প্রণবকাকা কত কথা বলে যায়। বেঁচে থাকার কথা। ডুবে যাওয়ার কথা। মরে যাওয়ার কথা। রাজুর বইয়ে জলের দাগ। প্রণবকাকার বইতে সরীসৃপ শীতলতা। চেরা জিভ দিয়ে কে যেন লেহন করে নিতে চায় অস্তিত্ব। একটা করে বই যেন একটা করে মানুষ হয়ে উঠছে। সুনন্দর হাতের মধ্যে তাদের ঘাম লেগে যায়, জুড়ে থাকে শরীরের উষ্ণতা, হৃৎস্পন্দন টের পাওয়া যায় স্পষ্ট। কারও চোখের জল পড়ে টপ টপ করে। হাসি বেজে ওঠে। গান গেয়ে ওঠে কেউ। হাঁক দেয় জোরে, ওরে আয় রে।    

    সুনন্দ সেই বইটা খুঁজতে থাকে। ওর বই। নেই। কোত্থাও নেই। সুনন্দ নামে কোনও বই নেই। একের পর এক বই উলটে দেখছে সুনন্দ। কত নাম! বইয়ের ওপর মুখোশের মতো ভেসে ওঠে এক-একটা মুখ। সে-মুখ ওর নয়। সুনন্দর নয়। আচ্ছা কী করে এমন হতে পারে? সকলে আছে, সকলের বই আছে। আর শুধু ও বাদ? তাহলে কি সুনন্দ নামটাই হারিয়ে গেল!                       

    পায়ের তলায় আয়াপানের লতা। ছুটে পালাল একটা কাঠবিড়ালি। ভিজে পথে দল বেধে হেঁটে যায় নালসে পিঁপড়ে। যে যার মতো। জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে একটা। কতদিন আগের জোনাকি ও? এক বছর, পাঁচ বছর না বারো-চোদ্দো বছর? এক যুগ? সুনন্দ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ওর মিটমিটে আলোতে লুকিয়ে আছে বিস্মরণ। ও জ্বলবে। ধীরে ধীরে নিভে যাবে ঠিক। মুছে যাবে ওর স্মৃতি। ভেসে যাবে গাঢ় সন্ধ্যার অন্ধকারে। পড়ে থাকবে ওর মুখোশ। আলোর মুখোশ।      

    বাইরে লোকজন ভিড় করে।

    ভাঙাচোরা পোড়ো বাড়িটার মধ্যে কে রে? 

    কে ও? রুক্ষ চুল উড়ছে মাথায়, মুখের রং যেন আগুনপোড়া, গায়ে ছেঁড়াফাটা পাঞ্জাবি, পাজামার হাঁটু পর্যন্ত শুধু কাদা আর ময়লা।

    ঠিকানা আছে? নাম কী? দেখ তো পকেটে কাগজপত্র আছে কি না। আরে এই লোকটা যে সকাল থেকে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ দেখছিস না কাকে চাইছে? ভরদুপুরে পাড়ার মধ্যে হাঁটছে, পুলিশের খোঁচড় না ছিনতাইয়ের মতলব, কে জানে! হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে নির্ঘাত পাগল। রাস্তা ভুলেছে। এই পাড়ায় এল কী করে? হাতে আবার একটা হদ্দ পুরনো মোবাইল নিয়ে ঘুরছে। অচল। ভাঙাচোরা। আদৌ ওটাতে কোনও নম্বর-টম্বর আছে, না ওটাও ভাঁওতা? থানায় একটা খবর দিলে হত না?     

    ‘হ্যাঁ ভাই, কে আপনি? কাকে খুঁজছেন?’     

    সুনন্দ সামনের লোকটার দিকে ভাল করে তাকায়। সামনে একটা জটলা। ওরা কেউ সুনন্দ নয়। সুনন্দ ওদের চেনে না। কিন্তু খুব চেনা লাগে। ওইরকম বয়স, ওইরকম হাসি, ওই একই রকম সংশয় চোখেমুখে। সুনন্দ আর সুনন্দর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ানো লোকটা ক্রমশ মিশে যেতে থাকে দুজনের মধ্যে। পেনসিলে আঁকা একটা আবছা ছবি মিশে পুরনো জীবন থেকে উঠে আসে কেউ।

    একটা রিকশা থেকে নামল কে একজন। আলুথালু চুল। ছাপা শাড়ি। ছুটে এসে কাঁধে হাত রাখে। চাপ দেয় পিঠে, ‘ঘরে চলো সুনন্দ।’  

    ‘কে তুমি?’

    ‘আমি… আমি ইছামতী। ঘরে চলো। সকলে অপেক্ষা করছে।’ বলতে বলতে ছাপা শাড়ি পরা মহিলা এদিক-সেদিক তাকান, ‘একটু সাহায্য করবেন, ঘরে নিয়ে যাব… বুঝতেই তো পারছেন সব… অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছি।’

    গুঞ্জন শোনা যায়। আহা রে। ইশ… ভাগ্যিস…

    ‘কে অপেক্ষা করছে?’

    ‘সবাই। সিমুই এসেছে, সুহাসকাকা, গোবিন্দ… সবাই এসে বসে আছে।’

    সুনন্দ একগাল হেসে বলে, ‘আচ্ছা সুনন্দ নামের কোনও বই কি আছে তোমার কাছে?’

    আমরা শুনতে পাচ্ছি সুনন্দ ফিসফিস করে বলছে, আর পাশে ওকে শক্ত করে ধরে বসে থাকা ইছামতী বলে, ‘আছে আছে সব আছে। একবার চলো না, গেলেই দেখতে পাবে, এই তো একটুখানি রাস্তা, ও দাদা, তাড়াতাড়ি চালান একটু…’

    রিকশার চাকা ঘোরে। পচা খালে জলের বদলে উজানে বইছে সময়ের স্রোত। অগম সেই পথে কোন খেয়ালে অভিসারে বেরিয়েছে সুনন্দ। সন্ধের আকাশে লাল আভা।

    পাশে বসা ইছামতী বলে, ‘ওই বইটা তুমি ফেলে এসেছ, চলো, গেলে দেখবে প্রত্যেক পাতায় কত ছবি-কত লেখা! সব সুনন্দ। তোমাকে বইটা দেখাব বলেই তো নিয়ে যাচ্ছি।’   

    (সমাপ্ত)    

    ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook