কয়েকটি কবিতা
১.
অপেক্ষা তোমার ছায়াকে দীর্ঘতর করেছে। যেন কবরখানা থেকে উড়ে আসা কবুতর, যেন ওয়াইনের পাত্রে এলিয়ে থাকা রোদ, যেন ধাতব পাতের গা দিয়ে গড়িয়ে পড়া বয়স। এখানে কেউ কারও জন্য দাঁড়ায় না, তুমি জানো। যুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে সকলের ঘড়ি সাড়ে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে গেছে, যাতে মৃত ভাই বা বন্ধুর পোশাক তারা তুলে নিতে পারে কাঁধে। কিন্তু দাঁড়ায় না কেউ। বুড়ো ফেরিওলাকে সময় জিগ্যেস করার সাহস কেউ পায় না এখানে। স্টেশনের বাইরে থেকে উড়ে উড়ে আসে বরফকুচি আর দু’দিনের বাসি খবর, ভেসে আসে দূর কারখানাদের ঘোষণা আর প্রেমিক-প্রেমিকাদের মেকি সংলাপ। মাথার ওপরে ছুটে যাওয়া তার, ট্রেনের কেটে ফেলা শিরা, তোমাকে টানে। অপেক্ষা, দীর্ঘতর করেছে তোমার ছায়াকে। তুমি দাঁড়িয়ে আছ কবে থেকে, সেই ট্রেনের জন্য, যে চলে গেছে।
২.
দীর্ঘতম কবরখানার রোদ উঠেছে আজ। দু’পাশে পাথরের ফলকদের দাঁড় করিয়ে রেখে পরিবারেরা ছুটে চলেছে খুশির পিকনিকে। এমন বাতাসের দিনে গায়ে কিছু রোদ লাগানো চাই বৈকি। বনেটের উপর ঝুঁকে আসতে চাওয়া গাছেদের গায়ে পাতা নেই। যেন দূরের গরিব লোকজন সব। আর এমনই দিনে তোমার মনে পড়ছে নাটকের খসড়া লেখার শব্দ, শুকনো বৃদ্ধের আইসক্রিম বিলি করা, আর ছোটবেলার জামাকাপড় শুকোতে দেবার সুগন্ধ। পিকনিকের পথে পথে জেগে উঠছে রোদ্দুর আর মৃতদের নাম, বেলুন-বিক্রেতার ক্যালেন্ডারে আজ লাল তারিখ। তোমার কেবলই ইচ্ছে করছে কবরখানার ঘাসে ঘাসে ছটফটে মিঠে খরগোশের পিছু নিতে। এক দিবাস্বপ্নের মধ্যে, দীর্ঘতম রোদের এই শীতল করবরখানায় তুমি তাকে খুঁজছ, তাড়া করবে বলে। পিকনিকের পিচ ফল আর চিজ গড়িয়ে যাচ্ছে জলের দিকে, তুমি খুঁজছ নেহাত একখানা খরগোশ। কিন্তু সে, সম্ভবত জীবিত।
৩.
এমন মেঘলা দিনে, প্রার্থনায় যাবার বদলে পানশালায় ঢুকে পড়তে থাকে সকলে। কাঠকয়লার আগুনে পুড়ে যেতে থাকে মাছ ও তার জীবাশ্ম, বয়স্কা ও সম্পন্ন মহিলারা পছন্দ করেন গোলাপি সুরা ও চেরি। ছুটির দিন নয়, এ কোনও ছুটির দিন নয়। তবু পুরনো রেকর্ডের দোকানে সস্তায় মিলে যায় সিনাত্রা ও এলভিস, ছোট ছোট বাড়ির জানলায় টাঙানো হয় কুরুশের কাজের নতুন পর্দা। সফেদ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আজ কেউ কাউকে খুন করার মতলব নিয়ে ঘুরছে না এখানে, কেউ ভাবছে না দরদামে বাজার করে ফেরবার কথা। আজ বুধবার, তুমি দেখতে এসেছিলে থিয়েটার, এক তরুণীর প্রেম ও দুঃসময়ের বিপ্লবের গাথা। কে তোমাকে বলে দেবে, চারপাশে চলমান এই শহরই আসলে সেই থিয়েটার নয়? ঘুমন্ত বাচ্চা কোলে উড়ে যাওয়া পরিচারিকা আসলে নন কোনও চরিত্র? এমন মেঘলা দিনে, কে তোমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে ফুরফুরে এক কাহিনির মধ্যে। সময় থাকতে, সংলাপ মনে করে রাখো।
৪.
বিমান, যখন উড়ে যেতে চায়, আটকানো যায় না। বেঁধে রাখা যায় না তার দু’ডানা থেকে চুঁইয়ে পড়তে থাকা বাতাসের খিদে, যা নাকি সম্মোহনের মতোই মনে হয় তোমার, মাঝেমধ্যে। এ শহরে তুমি এসেছিলে কাজে। হয়তো বা লিফলেট বিলি, হয়তো বা রাজনৈতিক প্রচার, কিংবা নেহাতই কোনও নাটকের দলের সঙ্গে, বেহালাবাদক হিসেবে। এখন, এই কড়া কফির সুগন্ধে, তোমার মনে পড়তে চাইছে না কিছুই। এ শহরও তোমার মধ্যে এসেছিল, খবরের কাগজের তাড়া, গোলাপের প্যাকেট আর কেকের স্তব্ধ কারখানা হয়ে। সে-ছাপ, তুমি খুঁজলে, পাবে অবশ্যই। কেবল এই যে বিমান দাঁড়িয়ে আছে টারম্যাকে, তুমি জানো না, সে যাবার, না ফেরার। আকাশে সাজানো আছে গোলাপি আলোর মাংস, সরু করে কাটা। সকাল, না সন্ধের রক্ত লাগা ওতে, কে বলবে আজ…
৫.
তোমাকে পাওয়া যাবে কোনও এক নিরিবিলি জ্যাজ পাব-এ, এমনটা আমি জানতাম। যখন আকাশে উড়ে যাচ্ছে রোগীদের শান্ত প্রার্থনা আর পুলিশ জিপের গায়ে সাঁটা হচ্ছে বিপ্লবের টাটকা লিফলেট, তখনই তুমি মাফলার জড়িয়ে ঢুকে পড়ছ সেখানে। সস্তা স্যাক্সোফোন আর বিষণ্ণ চেলো’র মাঝখান দিয়ে যে-অলীক রাস্তা, সেখানে তোমার জন্য চেয়ার পাতা, আমি জানতাম। আলগোছে যে-মেয়েটি পানীয় বিলি করছে, তার আসল নাম এখানে কেউ জানে না। সম্ভবত সে নিজেও মৃতা মায়ের কবরে তার নাম চাপা দিয়ে কাজে এসেছে। ওর সঙ্গে যখন দুটো কথা বলছ তুমি, তখন তোমার শহরতলির ছোট ঘর তছনছ করে দিচ্ছে গোয়েন্দা দফতর। তারা সম্ভবত খুঁজছে কোনও নিষিদ্ধ দলিল, কিন্তু পাচ্ছে একটা পুরনো কবিতার খাতা। তারা হয়তো উদ্ধার করতে চাইছে গত কয়েকদিনের টেলিফোনিক সংলাপ, কিন্তু পেয়ে যাচ্ছে উডি অ্যালেনের পোস্টার। কত ছলনা এভাবে বিছিয়ে থাকে রাতের শহরে, কত মিথ এভাবে বিক্রি হয়ে যায় সহজে, আমরা টের পাই না। মেয়েটি তোমার পানীয়ের গ্লাস ভরে দিতে থাকে আবার।
৬.
আশ্চর্য ব্যাপার হল এই যে, হাসির কারখানা চলছে। মিঠে হাসি, খোনা হাসি, দমফাটা হাসির ঝলকে মিইয়ে যাচ্ছে শহরের আকাশ। হোমরা চোমরাদের বাড়ি বাড়ি বিলি হচ্ছে চড়া দামের হাসি, গরিবদের মধ্যেও কি পৌঁছচ্ছে না মুচকি হাসির কিছু ত্রাণবাক্স? তারই মধ্যে এক ট্যুরিস্ট তার পাথরভর্তি পিঠব্যাগ ও স্মৃতিহীন সারমেয়টিকে নিয়ে খুঁজছে আস্তানা। অবিলম্বে তার দরকার কিছু খাদ্য, একটু দুধ ও খবরের কাগজ, গত শতকের। যুদ্ধের ক্ষতগুলো সে মিলিয়ে দেখতে চায় তারিখের সঙ্গে, মৃতদের তহবিল জরিপ করতে চায় শিরোনাম প’ড়ে। এই হো হো হাসির প্রখর রোদের গনগনে গালফোলা শহরে কেউ তাকে দরজা খুলে দেবে বলে মনে হয় না। শব্দের ঝনঝনাৎ-এর সামনে তার তল্লাশি নেহাত হার মানবে বলেই মনে হয়। তবু, এই দুপুরের হাসি-লাগা চওড়া সুনসান রাস্তায় সে ভেসে চলেছে এক আলোকরেখার মতোই। আশ্চর্য ব্যাপার হল এই যে, তারও ঠোঁটে লেগে আছে, মৃদু এক হাসি।