আপনি বলছিলেন যে, শিক্ষণপদ্ধতির ক্ষেত্রে ইংরেজি এবং বাংলা ভাষার ছাত্রছাত্রীদের সামাজিক অবস্থানের একটা বড় ফারাক রয়েছে; ঠিকই, কিন্তু সামনে এমন দিন আসছে, যেদিন সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতেই দলিত সাহিত্য পাঠ্য হয়ে উঠবে। অন্যদিকে শরণকুমার তাঁর বইতে লিখেছেন, আমি আপনার অনুবাদ পড়ছি, ‘উচ্চবর্ণীয় সমালোচকরা অকুণ্ঠভাবে দলিত লেখকদের প্রশংসা করেছেন। তাঁদের উৎসাহিত করেছেন। দলিত লেখকদের পথ দেখাতে নতুন-নতুন সাহিত্যিক বিচারপদ্ধতিও তৈরি করেছেন। তাদের সমালোচনা আশ্রয়দাতার মতো, অনেকটা দেখানো। এই সমালোচনা অগভীর পাঠ থেকে তৈরি, গভীর অনুধ্যান তাতে নেই।’ প্রশ্ন এটাই যে, যেদিন সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে দলিত সাহিত্যের প্রবেশ ঘটবে— কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভৌগোলিক-সামাজিক অবস্থানের ভেদাভেদ কিন্তু মাথায় রাখতে হবে— ক্ষমতাটা কি একক ভাবে তথাকথিত বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে চলে আসবে না?
একেবারেই তাই। সেটাই উঠে আসবে। আমরা দেখব, যখন কোনও প্রতিরোধ ঘোষণা করা হয়, সেই প্রতিরোধগুলোর মধ্যে বিশেষ ভূমিকা নেয় বড়-বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা। কারণ তাদের নিরাপত্তা অনেক বেশি। তারা প্রতিবাদের কেন্দ্রে থাকলে সঙ্গে-সঙ্গে পঁচিশটা মিডিয়া চলে আসে এবং এদের প্রাক্তনীরা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত। এবং এই প্রাক্তনীদের মধ্যে একটা সংঘবদ্ধতার বোধ কাজ করে। ফলত সবসময়ে একটা বাড়তি সুবিধে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা পেয়েই থাকে। ছোটখাট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের এইসব ক্ষমতার কিছুই নেই। ফলত কেন্দ্র এবং প্রান্তের এই ক্ষমতার সমীকরণের বিভেদটা চিরকাল থেকেই যাবে। আরও একটা বিষয় হল, আমরা যখনই কোনও প্রতিরোধের বয়ানের কথা বলি, সেই বয়ানটা কিন্তু শেষ অবধি একটা স্মার্ট-ঝকঝকে বয়ান হয়ে ওঠে। আমি আমার একটা লেখায় এই তর্কটা তুলেছিলাম যে, দলিত সাহিত্য দলিত ছাড়া কেউ লিখতে পারবে না এ-কথা বলি বটে, কিন্তু দলিত চেতনা কেবল দলিতরাই তৈরি করে না, তা উচ্চবর্ণের বয়ান দিয়েও তৈরি হয়। এর কারণ, যে-সাহিত্য পড়ে আমাদের মধ্যে দলিত চেতনা তৈরি হচ্ছে, সেই সাহিত্য আসছে উচ্চবর্ণের হাত দিয়ে। সমীক্ষা করলে দেখা যাবে, দলিত সাহিত্য দলিতরা লিখলেও তার অধিকাংশের অনুবাদকই ব্রাহ্মণ, তার পরে থাকে অন্যান্য উচ্চবর্ণ। লিম্বালের ‘দলিত নন্দনতত্ত্ব’-ই সবচেয়ে ভালো উদাহরণ, ইংরেজি অনুবাদটি একজন ব্রাহ্মণের করা! রোহিত ভেমুলা-পরবর্তী সময়ে যে-আন্দোলন তৈরি হয়েছে, তা তো আর কেবল দলিতের আন্দোলন থাকেনি; তাতে এসে মিশেছে আরও নানান আন্দোলন। অনেক বয়ান মিশে গিয়ে তৈরি হয়েছে অন্য একটা প্রতিরোধের বয়ান।
দলিত সাহিত্যের ক্ষেত্রে লিম্বালে যখন বলছেন, উচ্চবর্ণের সমালোচকরা দলিত সাহিত্যের প্রশংসা করলেও তারা তা তলিয়ে দেখেনি— এর মধ্যে একটা অধিকারবোধের জায়গাও রয়েছে। অর্থাৎ শুধু ফিল্ডওয়ার্ক করলেই হবে না, এথনোগ্রাফিক রিসার্চ প্রয়োজন। এই রিসার্চে কোনও নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষজনের সঙ্গে বোঝাপড়া অনেক স্বতঃস্ফূর্ত, কেননা সেই নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে একজন গবেষককে দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে। গেলাম, জায়গাটায় ঘুরে চলে এলাম— এতে সেই শ্রেণি সম্পর্কে কোনও ধারণাই গড়ে ওঠে না। সাক্ষাৎকার নেওয়া কিংবা দলিতদের নিয়ে সেমিনার করেও ওই ধারণা তৈরি হয় না। সাহিত্যের লোকেরা এই এথনোগ্রাফিক রিসার্চটা করে না। লিম্বালেজির আপত্তি এখানেই। এই ক্ষমতার বৈষম্যের জায়গাটা থেকেই যাবে, যতদিন না বিপুল পরিমাণে ইন্টেলেকচুয়ালরা এইসব প্রান্তিক গোষ্ঠীর ভেতর থেকে উঠে আসবে। এখন অবশ্য পরিস্থিতিটা ক্রমশ অন্যদিকে যাচ্ছে। বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক এলিটের পাশাপাশি নতুন দলিত ইন্টেলেকচুয়ালের স্বরও উঠে আসছে, যারা নানা দিক থেকে উচ্চবর্ণের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে।
দলিত সাহিত্যতত্ত্বের তাত্ত্বিকতার সামনে একটা বড় বাধা কিন্তু সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ। একটা উত্তর হতে পারে যে, সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের তাত্ত্বিকেরা যত না নিম্নবর্ণের কথা বলেছেন, তার চেয়ে বেশি বলেছেন নিম্নবর্গের কথা। তবু নিম্নবর্ণ-র সচল সামাজিক জীবনকে কীভাবে পাঠ করা হবে, তার একটা কাঠামো তাঁরা দিয়েছেন। প্রচলিত মার্কসবাদী পঠনপাঠন পদ্ধতি থেকে আলাদা তাঁদের অবস্থান। বঙ্গদেশের অ্যাকাডেমিক স্তরে এই চর্চার যে বিরাট প্রভাব, নিম্নবর্ণকে নিয়ে তাদের যে-চিন্তাভাবনা, সেখানে দাঁড়িয়ে দলিত সাহিত্য আন্দোলন কোথায় পৃথক হয়ে ওঠে? লিম্বালের বইয়ের ভূমিকাতেও আপনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ এনেছেন…
নিম্নবর্গের যে ইতিহাসচর্চা, তার যে তাত্ত্বিক কাঠামো, এটা দলিত সাহিত্যের ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে অনেকগুলো তর্কের জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ। যেরকম চেতনার প্রশ্নে পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা বলছেন যে, দলিতের চেতনা আসলে উচ্চবর্ণের ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে থেকেই গড়ে ওঠে। পার্থবাবুর কথা আমি আমার ভূমিকায় বলেছি তার কারণ, তিনি দেখিয়েছেন, ষড় গোস্বামীরা বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে কীভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদকে নিয়ে এসেছেন। আমরা বার বার বলি, পশ্চিমবঙ্গের জাতপাতের প্রশ্নটা খুব লঘু কারণ আমাদের দীর্ঘদিনের একটা বৈষ্ণব আন্দোলন রয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয়, তাহলে ‘জাত বৈষ্ণব’ বলে আলাদা শ্রেণি গড়ে উঠত না। বৈষ্ণবধর্ম মানেই সমানতার ধর্ম— আমি এই মিথটাকে ভাঙতে চাই। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের এই যে প্রশ্ন, ‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?’— সেটা তো এইজন্যেই যে, তাঁরা বিশ্বাস করেন দলিতের চেতনা উচ্চবর্ণের ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে থেকেই গড়ে ওঠে; কিন্তু এই জায়গায় এসে দলিতরা একটু অস্বীকার করছেন। তাঁরা বলছেন, দলিতের চেতনা কেবল উচ্চবর্ণের বা শোষকের কাঠামোর মধ্যে তৈরিই হয় না, এই কাঠামোর বাইরে গিয়েও তৈরি হয়। তার কারণ, একজন দলিত তার যে লাঞ্ছনাকে অনুভব করে, সেটা আসলে তার মানসিক ক্ষতর জায়গা থেকে। এখানেই নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা থেকে দলিত সাহিত্য চেতনা আলাদা।
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা উপন্যাসে ওরা’ নামক যে-বই লিখেছিলেন, সেখানে ‘অপর’-এর প্রসঙ্গ বারে বারে এসেছে। সেটা মাথায় রেখেই সতীনাথের ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ পড়লে দেখতে পাই, সতীনাথ সেখানে নিম্নবর্ণের মানুষের সঙ্গে মুসলমানের উৎসবের কথা বলেছেন। পাশাপাশি আবার তিনিই লিখছেন, ‘মেথরানীটাকে মুসলমান করে বিয়ে করা জিনিসটা, ধাঙররাও পছন্দ করে না। তারা নিজেরা হিঁদু কি না, এ নিয়ে কখনও মাথা ঘামানোর দরকার মনে করেনি; তবে তারা যে মুসলমান নয় এ-কথা তারা জানত, এই মেথরানীর বিয়ের ব্যাপারটা তাদের হিঁদু জাতির উপর জুলুম করা হচ্ছে।’ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন দেশে রামমন্দির হয়, তখন সেই উগ্র উৎসবের উদযাপনে উচ্চবর্ণ এবং নিম্নবর্ণ— উভয়েই সামিল হয়। যদি বলি, উচ্চবর্ণ তার নিজের স্বার্থে গৈরিক রাজনীতির সঙ্গে থাকতে চায়, তাহলে নিম্নবর্ণ কোন স্বার্থে এই রাজনীতির সমর্থক? ওরা ভুল করছে, এইরকম কোনও মন্তব্য আমি করছি না। আপনি এই প্রসঙ্গটাকে কী চোখে দ্যাখেন?
আমাদের দেশের বৃহৎ অংশের দলিত এবং আদিবাসী উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, এ-কথা ঠিক। তবে আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে, এর যৌক্তিক কাঠামোটা কী। প্রত্যেকের একটা নিজস্ব যুক্তি আছে। খেয়াল করলে দেখব, ঝাড়খণ্ডের যত অনুন্নত এলাকা, সেখানে অনেক দশক আগে থেকে কিন্তু আরএসএস প্রবেশ করেছে। রাজনৈতিক ভাবে তখন তাদের কোনও চিহ্নই নেই। গুটিগুটি পায়ে তারা ঢুকে যেমন স্কুল তৈরি করেছে, তেমনই পাশাপাশি একটা হনুমানমন্দিরও বানিয়েছে। বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য ডেকেছে, আবার প্রসাদ খাওয়ার জন্যও ডেকেছে। এবারে প্রশ্নটা হচ্ছে, যে আমাকে এত সুযোগ-সুবিধে দিল, ভালবাসা দিল, আমি তার বিরুদ্ধে যাব কোন স্বার্থে? এই ঘটনাটাই কিন্তু ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটেছে। মজার ব্যাপার হল, আদিবাসীদের মধ্যে কিন্তু রামমন্দির গড়া হয়নি, গড়া হয়েছে হনুমানমন্দির। হনুমান মানে ভক্ত। আনুগত্যের প্রতীক। ফলত সে রামের ভক্ত হবে। আর এই মানবকল্যাণের মডেলটাও তো আজকের নয়, এটা আরএসএস পেয়েছে মিশনারিদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক উচ্চবর্ণ এবং সামাজিক উচ্চবর্ণের মধ্যে অ্যাপ্রোচের পার্থক্য আছে। সামাজিক উচ্চবর্ণ দলিতদের চিরকাল দূরে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক উচ্চবর্ণ আশ্বাস দিয়েছে ক্ষমতা প্রদানের। দলিতরা সামাজিক উচ্চবর্ণের প্রতি রাগে এবং রাজনৈতিক উচ্চবর্ণের প্রতি বিশ্বাসে নিজেদের হিন্দু বলছে। মজাটা এখানেই!
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে। বামপন্থা প্রাথমিক ভাবে যে-প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যে-সুদিনের কথা বলেছিল, তাতে মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে, এ-কথা সবই সত্যি— কিন্তু কোথাও আমাদের দেশে বামপন্থার প্রয়োগের মধ্যে দেশীয় ঐতিহ্যের অভাব ছিল, যেটা সুদীপ্ত কবিরাজরা বার বার বলেছেন। শরণকুমার তাঁর বইতে বারংবার বলেছেন, দলিতদের লেখালিখির প্রতি সবসময়ে একটা অশ্লীলতার প্রসঙ্গ উঠেছে যৌনতার সূত্রে; অন্যদিকে বামপন্থীরা সচেতন ভাবে সেই যৌনতার প্রশ্নটাকেই চিরকাল এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। দলিত জীবনযাপনের এই নানাবিধ উদযাপন কি আসলে ভারতীয় সংস্কৃতির শেকড়ে পৌঁছে দেয় না? দলিত চেতনার হাত ধরে কি কোথাও আপনি বামপন্থার বিকল্প ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখেন?
দলিত প্যান্থার মুভমেন্ট যখন হচ্ছে, তা কিন্তু দলিত মার্ক্সিস্ট-আম্বেদকারাইট আন্দোলন। রাজা ঢালে, জে বি পাওয়ার এবং নামদেও ধাসাল, এই তিনজনের মধ্যে— ধাসাল ছিলেন বামপন্থী। মহারাষ্ট্রের রামচন্দ্র বাবাজী মোরে ছিলেন একজন দলিত কমিউনিস্ট নেতা। পরবর্তীকালে সাংগঠনিক নানা কারণে দলিত প্যান্থার আন্দোলন তার গতি হারাতে থাকলেও, বামপন্থার সঙ্গে এই সংযোগটা কিন্তু লক্ষণীয়। আর একটা বিষয় হচ্ছে, বামপন্থার এই সাফল্য বা ব্যর্থতাকে আমরা ঠিক এইভাবে বিচার করতে পারব না। আমার এই বিশ্বাসটা কখনওই জন্মায় না যে, একদিন গোটা ভারতে বামপন্থীরা শাসন করবে। সবসময়েই হয়তো তারা খুব অল্প পরিসরে শাসন করবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সারা ভারতে বামপন্থীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। সভ্যতার বহু ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বামপন্থী দর্শন তৈরি এবং নিরন্তর সভ্যতা, জাতি, গোষ্ঠী পাঠের মধ্যও দিয়ে তা নিয়ত ঋদ্ধ হয়। অস্তিত্ব ও ক্ষমতার প্রশ্ন সবসময়ে আসন, শাসন আর সিংহাসনের প্রশ্নের সঙ্গে সমানুপাতিক নয়। পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা-বিধানসভায় বামেদের ফলাফল যাই হোক না কেন, ব্রিগেডে তাহলে এত মানুষের সমাগম কোন সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় বহন করে? এটা ভাবার বিষয়। আরেকটা কথা হল, দক্ষিণপন্থীরা সেই সব বিশ্বাস নিয়েই মানুষের কাছে পৌঁছায়, যেসব বিশ্বাস আমরা জন্মাবার পর থেকেই অর্জন করি এবং লালন করি। ফলত দক্ষিণপন্থীর যে-আইকন, তা অনেক বেশি দৃশ্যমান। অন্যদিকে বামপন্থীদের আইকন কিন্তু দৃশ্যমান নয়। যে-কারণে তারা সাধারণ মানুষকে কোনও কিছু বোঝতে এত ব্যর্থ হয় অনেক সময়ে। তবে মনে রাখতে হবে, একটা রাজনৈতিক দল, যার আপাতভাবে কিছুই দেওয়ার নেই— সে এত মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে কী উপায়ে! আরও একটা বিষয় আমার যেটা মনে হয়, ভারতবর্ষে বামপন্থী আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে, যদি প্রবলভাবে বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠীর একটা সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। এই বৃহত্তর ঐক্য ছাড়া কোনওদিন দক্ষিণপন্থার মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সফল করা সম্ভব নয়।
এবং যৌনতার প্রসঙ্গে লিম্বালেজির কথাটা তুমি বললে, লিম্বালেজির এই কথাটা বলার কারণ রয়েছে। উনি পঁচিশ বছর বয়সে ওঁর যে-আত্মজীবনী লেখেন, তার নাম ‘অক্করমাশি’, যার অর্থ ‘বেজন্মা’। ওঁর মা দলিত সম্প্রদায়ের ছিলেন, কিন্তু বাবা তা ছিলেন না। এক প্রকার জোরপূর্বক মিলনেই যে লিম্বালেজির জন্ম, সে-কথা তিনি ওঁর ওই বইতে লিখেছেন। নিজের পরিবার সম্পর্কে স্পষ্ট করে অনেক কথাই বলেছেন— যা পরিবার, আত্মীয়স্বজন, সমাজ মেনে নিতে পারেনি। লিম্বালেজিকে অনেক কথা শুনতে হয়। আরও একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে, এক ধরনের বামপন্থী আন্দোলন, মূলত পরিচালনা করেছে উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোকেরা, এই ভদ্রলোক সামাজিক ও রাজনৈতিক। এবারে এই যে ভদ্রলোক পরিকাঠামো, সেখানে সবসময়েই প্রকাশ্যে যৌনতার উচ্চারণকে অন্যায় হিসেবে দেখা হয়েছে। এটা যে শুধুমাত্র বামপন্থীদের সমস্যা তা নয়, এটা বৃহত্তর বাঙালি ভদ্রলোক-সমাজের সমস্যা, ফলত সেখানে সমস্ত রাজনৈতিক মতাদর্শ রয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক ভদ্রলোক কিন্তু অন্যরকম, বামফ্রন্ট সরকারই তো যৌনশিক্ষা চালু করতে চেয়েছিল একটা সময়ে, পারল কি? বিপুল রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, সমাজের ভদ্রলোক সংস্কৃতি বাধা হয়ে দাঁড়াল। তার ক্ষমতা আরও অনেক বেশি, এবং এই যে ভদ্রলোক মন বাধা দিল তাতে অন্যান্য সমস্ত রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ আছে।
শেষ প্রশ্ন। আপনার আগামীদিনের কাজের পরিকল্পনা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
কিছুদিন হল আমি একটা কাজ শুরু করেছি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে, যার নাম দিয়েছি ‘ক্লাসরুম কোলাবোরেটিভ ট্রান্সলেশন’। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে অনুবাদ করানো। ক্লাসে কন্নড় দলিত সাহিত্যিক সিদ্দালিঙ্গাইয়া-র A Word with You, World পড়াতে-পড়াতে একদিন মনে হল, পরীক্ষার ইন্টারনালে ছেলেমেয়েদের এ-বইয়ের এক-একটা অংশ অনুবাদ করতে দিলে কেমন হয়? ওরাও রাজি হল। অনেকে মিলে অনুবাদ করেও ফেলল। যৌথ অনুবাদ প্রকল্প। তারপর সম্পাদনা করে মান্দাস প্রকাশনী থেকে ‘আমারও কিছু বলার আছে’ নামে সে-বই বেরোয়। এ-বছরও একজন খাসি কবি, কিংফাম সিং নংকিংরি-র The Yearning of seeds বইটা আমরা এভাবে অনুবাদ করেছি। ‘জীবন্ত শিকড়ের সেতু’ নাম দিয়ে বইটা প্রকশিত হবে। এই কবিতার বইটা মেঘালয়ের জাতীয় কাব্যের মতো হয়ে গেছে। কারণ কবির নির্ভীক কণ্ঠস্বর। আমি আজকাল বাংলা কবিতায় এই নির্ভীক কণ্ঠস্বরের খুব অভাব বোধ করি। এই ধরনের কাজগুলো আমি ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে করাতে চাই আগামীদিনে। এটা কেবল একটা টেক্সটের বিষয় নয়, এই ধরনের চর্চা একটা টেক্সটের গভীরে যেতে উৎসাহিত করে। এছাড়াও অনুবাদকর্মের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এবং অল্পবয়সেই নিজেদের নামে একটা করে বই থাকায় ছাত্রছাত্রীরা খুবই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা যেটা, আমি এই কাজটা করে যেতে চাই যাতে এই বিষয়টা একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া হিসেবে আমাদের চর্চায় থেকে যায়। আজ আমি যা করছি, আমার ছাত্রছাত্রীরাও আশা করি ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে! কেননা মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে কিন্তু অনুবাদ আসলে একটি পরম্পরা!
(সমাপ্ত)