হরশঙ্কর – দুই
এ কথা ঠিকই যে শেয়ালদার সেই মেসঘরে হরশঙ্কর আর টানা থাকে না; এককালীন কিছু টাকা, কয়েক মাসের আগাম ভাড়া বাবদ বাড়িওয়ালার হাতে দিয়ে এসেছে বলে, ওই ঘরটা এখনও হরশঙ্করের নামেই আছে; তবে বেশিরভাগ সময়ই তা তালা বন্ধই থাকে। কোথায় যে থাকে, সে হদিস কেউ জানে না। এমনকী তার মা-ও নয়; মায়ের কাছ থেকে এখন তাকে আর টাকা নিতেও হয় না, কারণ মেডিকেল জার্নালের চাকরিটা সে ছাড়েনি। ম্যালেরিয়ার ধাক্কা সামলাতে সাহেবরা একেবারে ল্যাজেগোবরে হচ্ছে; তাই পাবলিক হেলথ্ বিষয়ে তাদের বিশেষ নজরদারি; হাসপাতাল-ডাক্তার-নর্দমা এবং মশার ব্যাপারে দেদার ব্যবস্থা নেবার টাকা ছড়াচ্ছে তারা; ক্রমাগত লিখে যাওয়ায়, হরুর হাতেও টাকা আসছে; তাই রাতে সে যেখানেই থাক না কেন, যে ভাবেই হোক, নিয়মিত লেখা ও সম্পাদনার কাজটা চালিয়ে যাচ্ছ হরু। কিন্তু ডালহৌসির আশপাশ থেকে শুরু করে, বিশেষত এই শেয়ালদা-বউবাজার অঞ্চল জুড়ে শুরু হয়ে গেছে এক অন্য ধরনের প্রতিবাদের ধারা। শিক্ষিত যুবকেরা সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে সশস্ত্র প্রতিরোধের দিকে। হরশঙ্করের সম্যক ধারণা নেই যে কী ভাবে কোনও একটা দল গড়ে ওঠে। বিশেষত যেখানে এত বিভাজন! এই কলকাতা শহরটা বড় অদ্ভুত! একদিকে বাবু কালচারে বখে যাওয়া যুবকরা, অন্য দিকে ব্রিটিশদের দেওয়া পদে সরকারি চাকরিজীবী; পিওন থেকে আমলা– কে নেই এই দুরাচারী বৃত্তে! থিয়েটার সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠছে নানা রকম সভা-সমিতি; ঢাকার ‘অনুশীলন সমিতি’ বা কলকাতার ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠী ছাড়াও আরও নানা গোষ্ঠী; যেমন সম্প্রতি সে জেনেছে ‘আত্মোন্নতি সমিতি’ বা ‘মুক্তি সঙ্ঘের’ কথাও।
এ-রাস্তা ও-রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে, তার যাতায়াতের পথেই, হঠাৎই সে আবিষ্কার করেছে পতিতাপল্লী হাড়কাটা গলি; এখানে নাকি নেপালি, চিনে এমনকী জুইশ পতিতারাও থাকে। আর দেখেছে বড় বড় গোডাউন মানে গুদাম। সেই সব ব্যবসায়ীদের উত্থানও চোখে পড়ার মতো, যাদের ভাষা বাংলা নয়। আপাত শান্ত শহুরে বাড়িগুলোর অন্দরে তৈরি হচ্ছে বিপ্লবী মনোভাব; সারপেন্টাইন লেন, মলঙ্গা লেন, অক্রুর দত্ত লেন, অভয় হালদার লেন বা লালবাজারের পিছনে ছাতাওয়ালা গলি— সব যেন বারুদ ঠাসা এক একটা গোপন আস্তানা। একটু কান পাতলেই শোনা যায় অনুকুল মুখুজ্জে, গিরিন বাঁড়ুজ্জে, কালিদাস বসু বা কালিদাস মুখুজ্জে এমন সব নাম। বিপিন বিহারি পাল, রণেন গাঙ্গুলি, শ্রীশচন্দ্র পাল, খগেন দাস, হরিদাস সিকদার, ভূজঙ্গভূষণ ধর— এরাও নাকি এক একজন নির্ভীক ‘স্বদেশী’।
ইতিমধ্যে যে দুজন মানুষের উপস্থিতি হরশঙ্করকে কলকাতায় টেনে এনেছিল তাঁরা হলেন, বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ। এঁদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি না জড়ালেও, তাঁদের ভাবনাচিন্তার ঢেউ যেন নানা ভাবে আপনিই এসে লাগে চেতনার জঠরে। ঠিক যে সময় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দানা বাঁধছে, সেই উত্তাল সময়ে দেহ রাখলেন বিবেকানন্দ। কিন্তু তাঁর ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ এবং শিষ্যা মার্গারেট নোবেল দ্বিগুণভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবে; সক্রিয় সহায়তায় এগিয়ে এলেন সশস্ত্রবাদীদের মদত দিতে। শোনা যেতে লাগল, রাজনারায়ণ বসুর মেয়ের ঘরের দুই নাতি অরবিন্দ এবং বারীণ ঘোষের কথাও। তবে যে মানুষটির ওপর প্রবল আকর্ষণ জন্মাল হরশঙ্করের, সে হল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য; যেখান থেকে যেমন পায়, এই ছেলেটির লেখা নিষিদ্ধ ইস্তাহার পড়ে ফেলে সে। খবর নিতে নিতে জেনেছে যে ছেলেটি একেবারে তার দাদা তরঙ্গনাথের বয়সি। ব্রিটিশদের নজরে থাকা যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মন্ত্রশিষ্য হলেও এর ধরনটা যেন কিছু আলাদা; অন্ধ আনুগত্যের বদলে স্বয়ং নেতা হয়ে ওঠার মতো ক্ষমতা ধরে এর মনন। আরও একজনের কথা শুনতে পেল হরশঙ্কর; সাউথ আফ্রিকা থেকে আসা, বছর পঁয়ত্রিশের এক তরুণ ব্যারিস্টার– মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কংগ্রেস দলে যোগ দিয়ে প্রতিবাদ ও রাজনীতির কথাটা পাড়লেন তিনি। বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ এঁদের দুজনের থেকেই বয়সে কিছু ছোট। আর এমন এক সময়েই মারা গেলেন, ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের এক বড় সমর্থক শিল্পপতি জামেশদজি টাটা।
২
শেয়ালদার কাছে, এক ডাকঘরের পোস্টমাস্টারের সঙ্গে ভাব জমিয়েছে হরশঙ্কর। বয়সে তার থেকে বেশ খানিক বড়ই হবে। রানাঘাটের ছেলে, এখানকারই আর একটা মেসে থাকে; বয়সে বড় হয়েও হরশঙ্করকে শ্রদ্ধা করে, তার নামে নানা ইংরেজি পত্রপত্রিকা আসার বহর দেখে। এর কাছেই গোপনে মায়ের চিঠি আসে; নিশানাথ নিয়মিত দিয়ে যায়; রাজার ছাপ দেওয়া পোস্টেজ ছাড়াই ব্যক্তিগত ডাক। শেষ যে চিঠিটা, মা তাতে লিখেছেন;
জয় জয় কালীমাতা সহায়ঃ
বাবা হরু , ১০ আগস্ট, ২০০৪
সাবধানে থাকিও; কোনও কিছুতে জড়াইয়া পড়িবার পূর্বেই শতেকবার ভাবিও; অল্প বয়সে উন্মাদনাই চালিকা শক্তি। মনে রাখিও থানা-পুলিশ-জেল-হাজতের ব্যাপারে ‘তাহারাও’ উন্মাদ। চারিদিকে যে আগুন জ্বলিতেছে, তাহার আঁচে সব চাইতে বড় হয়ে যাহা দেখা দিয়াছে, তাহা হইল পরস্পরে নিয়ত সন্দেহ; কেহ আর কাহাকেও ভাই বা স্বজন বলিয়া বোধ করিতেছে না। বেটনের মারে এ আগুন নিভিবে বলিয়া আশা করি না; এ আগুন জ্বালানো হইয়াছে, ছারখার করিবার জন্যই; নিভাইবার জন্য নহে। উচ্চ আদর্শ এবং সাহসের সঙ্গে আরও এক বোধ তোমার সন্নিকট যাহা আশা করিব তাহা হইল, দায় লইবার সক্ষমতা। যে কাজই করিবে, তাহার পরিণাম মনোমতো না হইলেও, তৎ ব্যাপারে পশ্চাতে যেন কাহাকেও দোষারোপ না করিতে হয়; এমনকী জীবন-সংশয় হইলেও নহে।
এদিককার খবর আশানুরূপ না হইলেও চলনসই।
ইতি
আশীর্বাদিকা
মা।
মায়ের মনের কোনও তল পায় না হরু। ইচ্ছে করে সব চিঠিগুলি একটা খাতার মতো করে বাঁধিয়ে রাখবার; কিন্তু গোপনীয়তার কারণেই দু-একবার পড়ার পরেই তা পুড়িয়ে ফেলতে হয়; মাকে লেখা হরুর চিঠিগুলোর পরিণতিও তাই হয়। মা এবং দাদার মুখ চেয়ে নিশানাথও এ কাজটা পটুত্বের সঙ্গেই করে চলেছে। তবে হরুর সঙ্গে দেখা করে না নিশানাথ। মায়ের লেখায় ওই আগুন জ্বালাবার কথাটাই যেন পাক খেতে লাগল হরুর মনে।
৩
বঙ্গভঙ্গ আইন পাশ করে ভাগ হয়ে গেল দুই বাংলার সঙ্গে আসাম এবং উড়িষ্যাও। কারোর কোনও মতামতের ধার ধারল না ব্রিটিশ সরকার। মুখে বলল বটে, বিভাজনের উদ্দেশ্য সুষ্ঠু প্রশাসন; আসলে তারা বিভেদ তৈরি করল মিলেজুলে থাকা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে। দিনেদুপুরে চলতে লাগল হত্যালীলা, মিটিং, মিছিল, সমাবেশ; এবং বিদেশি কাপড় আগুনে পোড়ানোর উন্মাদনা। বয়কট নীতিতে বাদ গেল না ইস্কুল-কলেজ ছেড়ে গুপ্ত সমিতিতে নাম লেখানো। কুস্তির আখড়া এবং সাধুসন্তদের আশ্রমগুলো হয়ে উঠতে লাগল এই সব কাজের আঁতুড়ঘর। ধরপাকড়ও চলল সেই হারে। শুধু কি গঙ্গার পাড় ধরে কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর, কালনা, কাটোয়া, বর্ধমান! পদ্মার ওপারে টাঙ্গাইল, যশোর, খুলনা, বরিশাল বা রাজশাহীও বাদ রইল না। ‘বন্দে মাতরম’ যেমন রাস্তায় রাস্তায়, তেমনই ফাঁসির মঞ্চেও। ধুতি পরা, হিলহিলে চেহারার বাঙালি ছেলেদের নিয়ে মশকরা করে সেই যে তাদের ‘এফিমিনেট’ বলা, সে পরিহাসও একরকম বন্ধ হয়ে গেল, সাহেবদের দিকে শানানো তাদের আক্রমণের বহর দেখে। বঙ্গবিভাগ রুখে দিতে তখন মরিয়া এই যুবার দল; আর তাদের মেরে নিশ্চিহ্ন করতেও বদ্ধপরিকর কার্জন-বাহিনী। তেষট্টি বছরের শাসনের পর ‘কুইনে’র মৃত্যুতে ভিক্টোরিয়া যুগেরও অবসান হয়েছে। ব্রিটিশদের নয়নের মণি ‘Empress of India’র সৌধ তৈরির জন্য নতুন আইন পাশ হয়েছে, ‘Victoria Memorial Act 1903’। নতুন রাজা হয়েছেন, অ্যালবার্ট এডোয়ার্ড। এ দেশের লোকে তাঁকে চেনে সপ্তম এডোয়ার্ড বলে; সাহেব-ভক্ত নেটিভদের ঘরের দেওয়ালে ঠাকুর-দেবতার সঙ্গে এবার তাঁর ফোটোটিও ঝুলবে। এই পালাবদলের সময়তেই ব্রিটিশ-বিরোধী উত্তাল আন্দোলনে ব্যাপক ধাক্কা খেয়ে টলে গেল সাহেবদের কায়েমি মসনদ– ‘Curzon’s India’।
এখানে যেমন চলছে নিষ্ঠুর দমননীতি, অন্যদিকে তুমুল ঝড় উঠেছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও। জবাবদিহি পর্ব চলছে, ‘Indian public opinion’কে অগ্রাহ্য করে, তাকেই আবার ‘machine-made opinion’ বলায়। এই প্রতিবাদী ব্রিটিশরা চাইছেন বঙ্গবিভাগের আইন প্রত্যাহার করে নতুন ভাবে সাজানো হোক ঔপনিবেশিক প্রশাসন। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছেন, এখানকার নরমপন্থীরা; এই দ্বিতীয় গোত্রের ব্রিটিশদের বন্ধু বলে ধরে নিয়ে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মধ্যস্থতায় আইন পাশ করার যা কিছু কথাবার্তা, তারা চাইছেন একটু নরমে-গরমে চালিয়ে যেতে; এতেই যেন আরও খেপে উঠেছে চরমপন্থী যুবকের দল। হরশঙ্করের কাছেও এসে পৌঁছে যায় এমন কিছু আর্টিকেল, যেখানে ব্রিটিশদের এমন প্রতিক্রিয়াও সে জানতে পেরেছে যে ‘Indians are over-governed.’
একখানা কাগজ এসে পৌঁছল হরশঙ্করের হাতে। হাউস অফ কমন্স-এ আলোচনার একাংশ।
‘Bengal was the premier province of India. Considerations arose of race, language, intellectual development, historical associations, national aspirations. All those things had combined to create in the mind of the people of Bengal an intense pride in the land of their birth. They were proud of the capital—Calcutta—which was not only the capital of Bengal but the metropolis of India; and they saw in this division of the province a blow at the fame of their city. This question of partition could not be looked upon from one standpoint alone. It must be remembered that it was but the culmination of a series of measures which, say what they liked, were interpreted by the people of India to mean a desire on the part of the Government to repress, curtail, and prevent future agitation. It was thought that that was the motive which underlay this Order’.
এসব লেখা তাকে টেনে নিয়ে যায় বিশ্ব-রাজনীতির আঙিনায়; তার মনে পড়ে রবি ঠাকুরের লেখা ‘নষ্টনীড়’ গল্পটি। ‘সাধনা’ পত্রিকায় তিনি তখন একের পর এক গল্প লিখছেন। নায়ক ভূপতি আর তাঁর ভাই অমলের চোখে যে ব্রিটিশদের ছবি, সেটাই যেন এখানকার নরমপন্থীদেরও মনোভাব। তবে অন্যভাবে ফুঁসে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। একদিকে বঙ্গবিভাগ আর অন্যদিকে বয়কট-আন্দোলনের নামে বিদেশি জিনিস পোড়ানো। কোনওটাতেই সমর্থন নেই তাঁর। পাতিসর, সাজাদপুর, শিলাইদহের জমিদারি সামলে সবে কলকাতা ফিরেছেন তিনি। সেখানে দেখেছেন দরিদ্র মুসলমান চাষিদের অবস্থা। সাহেব এবং অন্যান্য জমিদারদের বিরুদ্ধে তাদের ভয়ানক রোষ থাকলেও, সপরিবার রবীন্দ্রনাথের জীবনে কোনও অঘটন ঘটায়নি তারা। সেই রবীন্দ্রনাথ পথে নেমেছেন; মানুষ শুনতে পাচ্ছে তাঁর ভাষণের পর ভাষণ। অনায়াসে ইন্ডিয়া–ইংল্যান্ড যাতায়াত করা ঠাকুর পরিবারে, দ্বারকানাথের নাতি, এই রবিবাবুকে চটায়নি ইংরেজ। যদিও নানা রকমের দমননীতির ঘোষণাতেও বিরাম নেই তাদের। তাঁর ভাগনি সরলা দেবীও ঝুঁকেছেন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের দিকেই। তবুও রোধ হল না বঙ্গভঙ্গ আইন। ১৯০৫ সাল স্মরণীয় হয়ে রইল আরও এক কারণে। হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীর বার্তা দিতে ‘রাখী-বন্ধন’ উৎসব করলেন রবীন্দ্রনাথ। পথে নেমে গান গাইলেন; অনুসরণকারীর অভাব হল না। সাধারণ মানুষের বাক-স্বাধীনতা এবং সভা-সমাবেশের অধিকারে সরকার হস্তক্ষেপ করলেও, রবীন্দ্রনাথকে কিন্তু জেলে ভরে দিল না ব্রিটিশ পুলিশ। স্বদেশি-ভাবনা সংঠনের প্রয়াসে ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভায় তাঁকে গান গাইতে বলা হলে যেন মুখোশ পরা নেতাদের উদ্দেশেই তিনি গাইলেন,
‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না’
…………………………………………………………
‘কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ, কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ-
কাতরে কাঁদিবে, মায়ের পায়ে দিবে সকল প্রাণের কামনা?’
তবে প্রতিবাদ থেকে যে সরে এলেন এমন নয়। কিন্তু তাঁর মন তখন ডুবেছে একটি ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্নে— বিশ্বভারতী-শান্তিনিকেতন। মনে এক গভীর প্রশ্নও জেগেছে What is Nationalism! কারণ বাংলা অভিধানে তো এমন শব্দই নেই যার সাহায্যে ব্যবহার করা যায় Nationalism এই শব্দটিকে। ফলে আঁতিপাঁতি করে ভাবতে বসলেন যে এমন একটি ইংরেজি শব্দ দিয়ে ইংরেজ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের মুখপাত হবে কী করে?
আর ঠিক এই বছরেই মারা গেলেন তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৪
তবে, হরুর মনে আর এক ভাবনা। আদুড় গায়ে মাটি-জল মেখে, খোলা মাঠে চাষ এবং বাস করে খাওয়া একটা দেশের মানুষকে ব্রিটিশরা কেমন অদ্ভুত এক ইউনিফর্ম পরিয়ে, ঘাড় হেঁট করে টেবিল চেয়ারে বসিয়ে দিল! গোটা দেশটাই ভরে গেল দালালে! সেই সঙ্গে বাধ্য করল, মুক্তকণ্ঠের মতামতকে চেপে মেরে, গুপ্তঘাতক চিহ্নে বাধ্যত তাদের দেগে দিয়ে, দলে দলে জেলে পুরতে! দ্বীপান্তরের নামে নির্বাসন দিতে! সক্রিয় কোনও সমিতিতে যোগ না দিয়েও, হরুর জীবনও হয়ে উঠল প্রায় অন্তরিন এবং ঠিকানা-লোপাট এক অস্তিত্ব। তার মাথার দাম ঘোষণা না হলেও, সে জানে যে, সব ধরনের যুবকদের গতিবিধির ওপরেই কড়া নজর আছে সরকারের। সহস্র চোখের নজরদারির আশঙ্কার মধ্যেও তাই তার মনে জেগে থাকে, তার নিজের মায়ের সেই দুটি অদৃশ্য চোখ। এই চোখদুটির শক্তি এমনই, যা তাকে নিয়ত সুরক্ষা দেয়। হরু অনুমান করতে পারে এই বোধই হয়তো স্বদেশ-প্রেম। স্ব-ভূমির প্রতিও এরকম-ই এক নেই-আঁকড়া ভালবাসা।
‘বন্দে মাতরম’– সঙ্ঘবদ্ধ এই উল্লাস পথেঘাটে শুনতে শুনতে, হরু এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে শুরু করল প্রয়াত বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা পুরো কবিতাটি,
‘…………সুখদাং বরদাং মাতরম’।।
আমি হরশঙ্কর। কেবলই মনে হচ্ছে যে, কেমন যেন গা-বাঁচিয়ে চলছি না! তনুদা তো এমন পারছে না! কোনও দিন আবার এমনটা হবে না তো যে, সন্ত্রাসবাদীদের হাতে প্রাণ গেল তনুদার! মায়ের চিঠিতে হরু জেনেছে যে বালিকাবউকে অষ্টমঙ্গলায় তার বাপের বাড়ি রেখেই, সে রাতেই তাকে নাকি ফিরে যেতে হয়েছে কাটিহার; সেখানেও আগুন জ্বলছে শহরে ও গ্রামে। এদিকে তনুদার শ্বশুরবাড়ির গ্রাম শিবনিবাস পড়ে গেল পূর্ব বাংলায়। ময়ূরভঞ্জ আর বালেশ্বর যাতে পশ্চিম বাংলায় না চলে যায়, তার জন্যও লড়ছে উড়িয়া লোকেরা। পুব বাংলার সঙ্গে আসামকে জুড়ে দিয়েই বা পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে! ইতিমধ্যেই ভাঙন ধরেছে ন্যাশনাল কংগ্রেসেও; তার সঙ্গেই আবার জন্ম নিল আরও এক নতুন পার্টি – ‘মুসলিম লীগ’। ‘র্যাডিকাল’, ‘সোশাল’ না ‘সত্যাগ্রহ’– কে জানে সরকারের বিরোধিতায়, কোন দিকে যে বাঁক নেবে এ দেশের এই মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলি!
তবে একটা জিনিস লক্ষ না করে পারছি না যে, চালানি বন্দুকের ব্যবসা কেমন রমরমিয়ে বেড়ে উঠছে কলকাতায়! বরানগরের কাছে কাশীপুরেই তৈরি হয়েছে সরকারি Ordinance Factory। দেখতে দেখতেই, কলকাতা শহরটা যেন নিজেই একটা বিস্ফোরক হয়ে উঠল। হয়তো এরপরই শুরু হবে বোমা-মামলা এবং অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। সেই সঙ্গে বাড়বে জেল এবং কোর্টের সংখ্যাও।
আমি বুঝেছি যে, আমার ভূমিকা বিদুরের। দূর থেকে দেখা। তাই আমার কাজ হল যুক্তিসঙ্গত ভাবে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানো; বিশেষত যেখানেই দানা বাঁধছে বিরোধ এবং অসন্তোষ!
এই ব্রিটিশ সাহেবদের আর মোটেই সহ্য হচ্ছে না আমার।
ভাবছি যে, তনুদাও না সাহেব মেরে জেলে যায়!
তনুদা কি শুনতে পেল রবি ঠাকুরের ওই গানটা…
‘বাংলার মাটি বাংলার জল… পূর্ণ হউক হে ভগবান’!
গুনগুন করে গাইতে গাইতেই বুঝলাম যে, ‘ভগবান’ও ভাগ হয়ে যাচ্ছেন হু হু করে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র