তরুলতা
তরুকে দেখাশোনা পর্ব শেষ হলে, হবু জামাই তরঙ্গনাথদের রওনা করিয়ে দিতে, তার বাবা সদরের দিকে এগোতেই, একলাফে সেই ঘরে ঢুকে এল আরও এক কিশোরী; তরুর সই ঊষাময়ী। ফ্রকের ওপর গিঁট দিয়ে বাঁধা রেশমের কাপড়খানি একটানে গা থেকে খুলে তরু আর ঊষা ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেল তাদের বাড়ির ন্যাড়া ছাদে। তখনও সন্ধে নামেনি। পড়ন্ত বিকেলের আলোতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বদুর হাত ধরে তরুর বাবা কালীপদ চলেছেন আগে আগে; আর তাঁকে অনুসরণ করে তরঙ্গনাথ এবং তার দাদা। তরঙ্গনাথ একবার পিছন ফিরে তাকাতেই ঝুপঝুপ করে বসে পড়ল তরু এবং ঊষা, আলসে না থাকলেও আমগাছের ছড়ানো ডালপালাগুলো আড়াল করে দিল ওদের; বাঁ দিকে ঘুরে গেলে এবার চোখের আড়াল হয়ে যাবে তরঙ্গনাথ। হয়তো সেটা আন্দাজ করেই আবার একবার পিছন ঘুরে কী যেন দেখে নিল সে; এবার সে চোখ রাখল আমগাছের আড়াল পেরিয়ে একেবারে সরাসরি সেই দিকে, যেখানে চোখ পেতে বসে আছে ঊষা আর তরু। তবে রাস্তাটা স্টেশনের দিকে বাঁক নিতেই, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাদের দৃষ্টির আওতা থেকে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল তরঙ্গনাথ সমেত সকলেই। শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঊষা বলল, ‘তোর বর পুলিশ কী রে! এ তো একেবারে পাকা ডাকাত! অন্ধকারেও সব দেখতে পায়!’
‘কী হবে! দুষ্টুমি করলে আমাকেও যদি হাজতে পোরে?’
‘ধ্যাৎ! বিয়ের পর মেয়েরা আবার দুষ্টুমি করে নাকি! বাড়ির সবাই মিলে তোকে পোষ মানিয়ে ছাড়বে; দেখিস না আমরা যখন ফ্রক পরে খেলে বেড়াই, আচার চুরি করি, আগানে বাগানে ঘুরে নোনা আর বনকুল পেড়ে খাই, বউদি কেমন শাড়ি জড়িয়ে আমার মায়ের পাশে বসে রান্নার যোগাড় দেয়!
‘তা হলে কী হবে! নদীতে নেমে সাঁতার আর চিন্তামণিদের কলাই খেতে ঢুকে শুঁটি ভেঙে চুরি করে খাওয়া!’
‘সে সব করবি তো, তবে নিজের বাড়িতে এসে; আর তখন এটা হয়ে যাবে তোর বাপের বাড়ি। দাদা তো কবেই চুপিচুপি আমাকে বলেছে যে, বাপের বাড়ি গিয়ে বউদি নাকি ফ্রক না পরেও কাপড় পরেই দুরন্তপনা করে; আর দাদাকেও নাকি সাঁতারে হারিয়ে দেয়। তবে এসব কথা মায়ের কানে ওঠেনি।’
‘যা তালঢ্যাঙ্গা আমার পুলিশ-বর! আমাকে হয়তো পাঁজাকলা করে, জলের ওপর হেঁটেই পুকুর পার হয়ে যাবে!’
‘ভাল সাঁতারও জানে বলেই তো মনে হয়। ওদের বাড়িটাও তো গঙ্গার পাড়েই। আর গঙ্গা নাকি মস্ত একটা নদী! আমাদের এই চূর্ণীর চেয়ে তিনগুণ চওড়া। ভাঁটার পর বিরাট শব্দ করে বান আসে। তখন ঢেউ খেলে সেই জোয়ারের জলে। পেনিটির মেয়ে আমার জেঠিমা এসব গপ্পো আমার মায়ের কাছে করেছে। পেনিটিও তো তোর শ্বশুরবাড়িরই পাড়া।’
‘আর দেখেছিস, ওর গায়ে কী রকম জোর?’
‘দেখলাম তো! নিজের দাদাকে কেমন এক-হ্যাঁচকায় পিঁড়ি থেকে তুলে একেবারে খাড়া করে দাঁড় করিয়ে দিল!’
‘হয়তো এ-ও দেখবি যে ওর বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলে উঁচিয়ে, পাঁচিল টপকে বনেবাদাড়ে ছুঁড়েই ফেলে দেবে আমাকে!’
‘কেন রে! এই বরকে তোর বুঝি পছন্দ হয়নি? নাকি দেখেই ভয় পেয়ে গেলি? শুনিসনি, মেয়েদের মতো গানও গাইতে পারে তোর বর! একেবারে বাজনা বাজিয়ে! ইয়া বড় পাকানো গোঁপ, কিন্তু তার কথা বলার আওয়াজেও কোনই হুকুমদারি নেই। আমার তো মনে হয় যে তোকে কখনই বকবে না।’
‘ভেবেছিলাম যে, কাকিমা ঠিক চেপে ধরে একটা গান অন্তত ওর কাছে শুনে ছাড়বে; কিন্তু আমাকে দেখবার আগেই জানলার দিকে তার চোখ পড়তেই কেমন যেন আঁটোসাঁটো হয়ে গেল লোকটা। আমি না হয় সেখানে থেকে একটা সড়সড়ে আওয়াজ আগেই পেয়েছিলাম; কিন্তু কোথাও কোনও টুঁ-শব্দ ছাড়া এই পুলিশটাই বা বুঝল কী করে যে গাছপালার আওশায় দাঁড়িয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে নিশ্চিত তাকেই যে নজর করছে কেউ!’
‘তুই কি ভেবেছিস যে পুলিশ মানে, আমাদের থানার টুলে বসে ঝিমনো ওই বিটু চৌকিদার! এ হল মস্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, নিজের জুতোশুদ্ধু পা-দুটো টেবিলে তুলে রেখে, একেবারে সেই পা-নাচানো অফিসার। সাধে কী আর স্বদেশিরা ওদের যমদূত বলে!’
‘আর কেষ্টদা, সুশীলদা বা বটা এরাই বা কী করে জানল বলতো, যে আমার পুলিশ-বর আমাকে দেখতে আজই এ বাড়িতে আসছে?’
‘সে আবার কী! এ খবর তো সারা পাড়া জানে যে, পাকা-দেখায় পাত্র নিজে আসছে তোকে দেখতে।’
তরুর কাছে আরেকটা কথা আর ভাঙলই না ঊষাময়ী; সেই-ই শুধু জানল যে, বটাকে দিয়ে সুশীলদাকে ডাকা করিয়ে, তার বউদি নিজে থেকেই কী ভাবে নিরস্ত করেছে তাদের। সুশীলদাকে বউদি যে ঠিক কী বলেছে সেটা অবশ্য ঊষার জানা নেই; তবে দাদার ঘরে ধুনো দিতে এসে ঊষা দেখেছে যে, দাদার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বউদি তার নিজের মুখটা দাদার একেবারে কানের গোড়ায় নামিয়ে কেমন ফিসফিসিয়ে বলে চলেছে কেষ্টদা আর সুশীলদার সম্পর্কে। তাদের পাড়ার আর কেউ আঁচ না করলেও ঊষাময়ী জানে যে, বিপ্লবী দলের এই ছেলেগুলোকে বিশেষত তার মা আর বউদি কত রকম ভাবেই না মদত যোগায়; বাবা এসব পছন্দ না করলেও রাগারাগি কিছু করে না কখনও; দাদাও সরাসরি না জড়ালেও, বউদির হাত দিয়ে সমানেই টাকা, বইপত্র এবং খবরের কাগজ এ সবও চালাচালি করে।
ঊষা নিজে কানে দাদার কাছে বউদিকে বলতে শুনেছে যে, তরুর বাবা কালীপদ কাকার প্রথম মেয়ের বিয়ে; হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হিসেবে এত পসার অথচ এতটুকু অহঙ্কার নেই। গরিব-দুঃখীদের বিনা পয়সায় ওষুধ দিয়ে কত সাহায্য করেন; ওঁদের বাড়ির পেছনে বিপ্লবীদের যে গুপ্তঘাঁটি গড়ে উঠেছে তা জেনেও ভয় পেয়ে পুলিশ ডাকার কথা কোনও দিন মনেও আনেননি তিনি; তরুর মা-জেঠিমারাও তো মুখে কিছু না বলে কত রকম ভালো-মন্দ খাবার ওই ছেলেগুলোর নাম করে ঊষাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন! বউদির কথা যেটুকু যা ঊষা বুঝেছে তা হল সাহেব পুলিশ হলে না হয় কথা ছিল; কিন্তু পুলিশ শুনেই গুলি চালিয়ে দেওয়াটা কোনও কাজের কাজ নয়। তা ছাড়া তরঙ্গনাথ যদি উর্দি পরে, তল্লাশি চালিয়ে তাদের পাকড়াও করতে আসত তখন না হয় তাকে শায়েস্তা করা যেত। আজকে তো সে এসেছে এ পাড়ার অতিথি হয়ে!
এত কথা এক নিঃশ্বাসে ঊষাময়ী তড়বড় করে বলে গেলেও, তরুর যে সবকিছু মাথায় ঢুকল তা নয়; তার মনের মধ্যে ছ্যাঁতছ্যাঁত করে কেবলই জেগে উঠতে লাগল তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তরঙ্গনাথের ওই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা। আর মনে পড়তে লাগল, তরুকে পার করে জানলা ভেদ করে বাগানের দিকে তাকিয়ে তরঙ্গনাথের সেই স্থির বসে থাকা। তরু যে তার দিকে আড়চোখে দেখছিল, সে দিকে কি খেয়াল ছিল তরঙ্গনাথের! উঠোন থেকে মায়ের গলা পেয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল তরু; তাই দেখে ঊষাও পোঁ ধরল; তরুলতাকে জড়িয়ে ধরে ঊষাময়ী বলল, ‘লবঙ্গ ফুল! আমরা না সই পাতিয়েছি দুজনে! আমাদের দুজনেরই বিয়ে হয়ে যাবে; শ্বশুরবাড়ি চলে যাব। কিন্তু তা বলে সইকে কি ভুলে যাব! বাপের বাড়ি এলেই তো দেখা হবে।’
‘তোকে ছাড়া আর কাউকে এমন লবঙ্গ বলে ডাকতেও তো পারব না সই!’
‘ডাকবি কেন! এতো শুধু আমাদের নাম! শ্বশুরবাড়িতে আর কারোর নাম লবঙ্গ হলে তাকে না হয় ‘ফবঙ্গ’ বলেই ডাকিস…’
‘ও পাড়ার গঙ্গামণি বউদিকে, তোর বউদি যেমন সংজ্ঞামণি বলে ডাকে!’
‘ঠিক ঠিক। বউদির সইয়ের নাম যে ‘গঙ্গা’!’
চোখের জল মুছে, হাসতে হাসতে দুজনেই ছাদ থেকে নীচে নেমে এল।
২.
সপ্তাহ খানেক পরে বন্ধ খামে, ডাকে একটা চিঠি এল বাবার নামে; তরুর শ্বশুরমশায়ের কাছ থেকে। পত্রখানি পড়ে তরুর বাবা সেটি পড়তে দিলেন তরুর বড় জ্যাঠামশাইকে।
শ্রী শ্রী রাধাকান্তঃ স্মরণম
সুখচর
তাং ১৬ই ফাল্গুন, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ
শ্রীল শ্রীযুক্ত কালীপদ ভট্টাচার্য মহাশয় সমীপে—
মান্যবর বেয়াইমশাই,
আমার জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীমান তরঙ্গনাথের সহিত আপনার জ্যেষ্ঠাকন্যা সুকল্যাণী তরুলতার বিবাহ, আগামী বৈশাখ মাসেই স্থির করিব, এমতই মনস্থ করিয়াছি। শুভস্য শীঘ্রম— এই আপ্তবাক্য মানিয়া আপনার সম্মতির প্রত্যাশায় এই পত্র পাঠাইতেছি; বিবাহ অনুষ্ঠান বিষয়ে আমাদিগের দুই পক্ষের মধ্যেই বিশদে কিয়ৎ আলোচনা হইবার আশু প্রয়োজন বোধ করিতেছি; সেটি দেনা-পাওনা বা বরপণ-জনিত দাবি ভাবিয়া আশঙ্কার কারণ নাই। এতদ্বিষয়ে আমরা একেবারেই দাবিহীন। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কিছু বিষয় অনুধাবন করিয়া সঠিক পথ অবলম্বনের হেতু আমাদের মধ্যে সাক্ষাতে বাক্যালাপ অতীব জরুরি বোধ হইতেছে। কালক্ষয় না করিয়া দু-একদিনের অবসরেই আপনি আমাদের বাটিতে আগমন করিলে বাধিত হইব।
লোকবলের অভাব হেতু পত্রদ্বারা আপনাকে আমন্ত্রণ জানাইতেছি বলিয়া, আশা করিব যে ক্ষুণ্ণ হইবেন না। আপনি আমার অনুজ ভ্রাতার ন্যায়। সেই অধিকারেই অগ্রজ দাদার নিমিত্ত এই ক্লেশটুকু বহন করিতে যে অসম্মত হইবেন না, এমত আশা করিতেই পারি। কল্যাণমস্তু।
সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনায়
ইতি
ভবদীয়
বনমালী চট্টোপাধ্যায়।
তরুর জ্যাঠামশাই চিঠিটি জোরে জোরে পড়লেন বলে, তরুর মা, জেঠিমা বা কাকিমারাও তা শুনতে পেলেন। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে, এমনকী সে সম্পর্কে জানতে পারল তরুও। রাতের খাবার যোগাড় শুরু হওয়ার আগেই, সকলে মিলে এই সিদ্ধান্ত হল যে, তরুর বাবা, জ্যাঠা এবং কাকা তো যাবেনই; সেইসঙ্গে যাবেন ঊষাময়ীর বাবা এবং তার দাদাও। দল বড় হয়ে যাবে ভেবে তরুর কাকা জানালেন যে তিনি না হয় পরের দফায় যাবেন; এই দলে চারজন গেলেই যথেষ্ট। সেই মতো ভাবনা শুরু হল যে ‘নিরাপত্তা’ বলতে শ্রী বনমালী চট্টোপাধ্যায় ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন। তরুর বালিকা-জ্ঞানে এ-টুকুই ঠাওর হল যে, তার বর একজন খুব বড় দরের পুলিশ। এমন ভাবনাও তার মনে দৃঢ় হল যে, সেদিন নিশ্চিত ‘উনি’ কেষ্টদা, সুশীলদা বা বটা, এদের মধ্যেই কাউকে একটা দেখতে পেয়েছিলেন। না হলে হবু বউকে না দেখে, খোলা জানলার শিক ভেদ করে, জঙ্গলের দিকে কেউ কি অমন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে! আবার ভয়ে বুক কেঁপে উঠল তরুর। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েও বিছানায় হিসি করে ফেলল সে। ফলে বিছানা ভেজাবার লজ্জা আর নতুন বরকে দেখে ভয়— দুই-ই জবরদস্ত চেপে ধরল তরুকে।
পরদিন ইস্কুল গেল না তরু। তার খোঁজ নিতে তার লবঙ্গ-সই ঊষা যখন বিকেলবেলায় তাদের বাড়িতে এল, তরুর তখন ধুম জ্বর। শুধু যেন বেহুঁশ হয়ে ঘুমোতেই চাইছে তরু। তার বাবার দেওয়া হোমিওপ্যাথির পুরিয়া, মাথার কাছে বসে মায়ের পাখার বাতাস, সমানে মাথায় জলপট্টি, পথ্য হিসেবে দুধ-সাবু— এসব সমানে চললেও জ্বর ছাড়ল আরও দু’দিন পরে। মা-জেঠিমার নির্দেশে তরুর ইস্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও, বাবা কিন্তু নিদান দিলেন যে তরু যেন রোজ ইস্কুল যায়; বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে বলে ইস্কুল যাওয়া বন্ধ হবে কেন! তরুর শরীরে বল ফিরতে লাগল। তবে আগের মতো নদীতে নেমে সাঁতার আর গাছে-গাছে হনুমানপনা করে বেড়ানোর ইচ্ছেটাই যেন চলে গেছে তরুর। সব সময় তার মনে হয়, এইসব গাছপালার আড়ালে কেষ্টদা, সুশীলদা বা বটার মতো এমন আরও অনেক বিপ্লবীরা লুকিয়ে আছে; তার বর একজন পুলিশ বলে হয়তো তাকেও তারা মেরে ফেলবে। মনে মনে যেন ভারী জব্দ হয়ে গেল তরু। তার সেই সই লবঙ্গ-ফুল ঊষাময়ী বা ঊষার বউদি কারোর বোঝানোতেই মনের গোপন-গুহায় কোনই আশ্বাস পেল না তরু। তরুর ইচ্ছে হল বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে এমন কোথাও থাকতে, যেখানে কেষ্টদা, সুশীলদা, বটা বা তাদের মতো কোনও বিপ্লবী নেই; এমনকী নেই তার পুলিশ-বরটিও!
৩.
তরুর শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে ফিরে এসে জ্যাঠামশাই, বাবা, কাকা সকলেই গুম মেরে গেলেন। শেষ অবধি ঊষার দাদা যেতে না পারায় তরুর কাকা গিয়েছিলেন; ফিরে এসে কেউ কিছু আলোচনা না করায় শুধু তরু কেন, তার মা-কাকিমা বা জেঠিমা এঁরাও আর কেউ কিছু আন্দাজই করতে পারলেন না। ঊষার বাবা তো এমনিতেই কম কথা বলেন; ফলে ঊষাও কিছু জানতে পারল না তার বউদি বা মায়ের কাছ থেকে; কিছু একটা বুঝে তার দাদাও কেমন চুপ মেরে গেল। পরদিন থেকে তরু আর ঊষা আবার ইস্কুল যেতে লাগল। তরুও ক্রমে স্বাভাবিক হল আগের মতো তার খেলে-বেড়ানোয় ফিরে গিয়ে।
মাস খানেক এ ভাবে কেটে গেলে বাবা জানালেন যে, সকলে মিলে কাশী বেড়াতে যাওয়া হবে। এ-ও ঠিক হল যে ঊষাও যাবে তরুদের সঙ্গে; সমস্ত বাঁধাছাঁদা শেষে, তরু আর ঊষা তাদের পুতুলের পুঁটলি গুছিয়ে বড় একটা গরুর গাড়িতে চড়ে রওনা হয়ে গেল স্টেশনের পথে। শিবনিবাস থেকে ট্রেনে শেয়ালদায় নেমে, ঘোড়ার গাড়ি করে তারা চলে গেল হাওড়া স্টেশন। ঊষার বাবা হাওড়া অবধি এসে বেনারসের গাড়িতে চড়িয়ে দিলেন তাদের। এতটা রাস্তা কলকল করতে করতে এসে, রাতের গাড়িতে উঠেই, তরু আর ঊষা একটু ঝিমিয়ে পড়ল। একটা বেঞ্চিতেই জড়াজড়ি করে শুয়ে তারা ঘুমিয়েই পড়ছে দেখে মা তাড়াতাড়ি করে ওদের খাইয়ে দিলেন; বাড়ি থেকে বানিয়ে আনা মোহনভোগ আর লুচি খেয়ে বাকিরাও শোয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন। বাবা আর কাকা মিলে বিছানা পেতে দিলেন রিজার্ভ বেঞ্চিতে। মাঝরাতে হিসি পেয়ে যাওয়ায় ঘুম থেকে উঠে তরু দেখল যে, মা, জেঠিমা আর কাকিমা অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লেও, জ্যাঠা, কাকা আর তার বাবা, তিনজনেই একটা বেঞ্চিতে জেগে বসে আছেন। কামরা শুদ্ধু লোক সবাই যে যার মতো ঘুমোচ্ছে। আবার সেই পুরনো ভয়টা চেপে ধরল তরুকে; হিসি করতে না গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল তরু।
সকালবেলা স্টেশনে নেমে তরু আর ঊষা অবাক হয়ে গেল সকলের মুখে অন্যরকম ভাষা শুনে। কাকা বলল এই ভাষার নাম ভোজপুরি; যাকে সাহেবরা বলে ‘হিন্ডি’। এখানে অনেক বাঙালি থাকলেও এ অঞ্চলের বেশিরভাগ লোকই হিন্দিভাষী। ছোট ছোট ঘোড়ায় টানা কাঠের বাক্স বসানো গাড়িগুলোকে বলে ‘এক্কা’। এরকমই কয়েকটা গাড়ি ভাড়া করে, মালপত্র সমেত তারা এসে পৌঁছল বাঙালিটোলার ‘পাঁড়ের হাউলি’ বলে একটা মস্ত বাড়িতে। কাকা বললেন, এর নাম আসলে ‘পাঁড়েজি কা হাভেলি’; নতুন চুনকামে বাড়িটা ঝকঝক করছে। কয়েকজন দেহাতি লোক ছুটোছুটি করে জিনিসপত্র সরিয়ে বাঁশ বেঁধে একটা মন্ডপ তৈরি করছে; মালপত্র তোলার আগেই মা বললেন, ‘এটা কি ধর্মশালা? এখানে তো আর কোনও যাত্রীই নেই!’
একজন ম্যানেজার গোছের লোক বলে উঠলেন, ‘বিয়েবাড়ি। আপনাদের জন্যই সাজানো হচ্ছে।’
জেঠিমা আর কাকিমা প্রায় একসঙ্গেই বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চাইলেন, ‘বিয়েবাড়ি? কার বিয়ে?’
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কাকা বললেন, ‘কেন তরুর! কাল বাদে পরশু! সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বর এসে গেলেই বিয়েটা হয়ে যাবে।’
তরুর বাবার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়েই, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন তরুর মা। কিছুতেই ভেবে পেলেন না যে, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন সকলকে আড়াল করে, এই বিভুঁইয়ে এসে তরুর বিয়ে হচ্ছে কেন! ভেবে পেলেন না যে, তার স্বামীও কেন তাঁকে কিছুই জানালেন না! খুব মন খারাপ হয়ে গেল এ কথা ভেবেও যে, তাঁর এবং তাঁর দুই জায়ের বাপের বাড়ির কেউই বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবে না ভেবেও। ঠিক কোন দিক থেকে হাল ধরতে হবে আন্দাজ করতেই যেন, চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে নিলেন তরুর মা। ভাবলেশহীন মুখে তরুর বাবা আর জ্যাঠামশাই দুজনেই, হাতল দেওয়া দুটি ইজিচেয়ারে স্থাণুবৎ বসে রইলেন। সেই ম্যানেজার মতো লোকটার সঙ্গে হাত লাগিয়ে যাবতীয় যা ব্যবস্থা, সে সবই করতে লাগলেন তরুর ছোটকাকা। তাঁদের জিনিসপত্র সমেত একটা ঘরে গিয়ে মা-কাকিমা আর জেঠিমা তো দোর দিলেন। জ্যাঠামশাইয়ের নির্দেশ মতো তরু, ঊষা এবং তরুর তিন বোন লটরপটর করতে করতে অন্য একটা ঘরে গিয়ে কী যে করবে ভেবেই পেল না। তরুর ছোটভাই এই সুযোগে একা একাই খেলে বেড়াতে লাগল, উঠোন লাগোয়া বাড়ির বাগানে। পাঁচিল এবং গাছে গাছে বুড়ো-বাচ্ছা এবং ধাড়ি হনুমানদের লাফালাফি দেখে তরুর বাবা তাকে কাছে ডেকে কোলে নিয়ে বসে রইলেন। তরু আর ঊষা একে অপরের মুখের দিকে না তাকিয়ে, রাস্তার দিকে মুখ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল পেল্লায় দুটো জানলার শিক ধরে।
আমি তরুলতা। আমার পরিচয় তো আগেই দিয়েছি। শিবনিবাসের বাইরে এই যে আমার কাশীতে আসা হল, সে আর থামল না। বিয়ের পর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি কথাটা শেখার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরে বেড়াতে হল আমার বরের নানা কর্মস্থলে। বদলি-চাকরিতে যে এত ঘোরাঘুরি, সেটাও তো জানলাম এই প্রথম। তবে বিয়ে আমার একটা হল বটে! এতদিন শুনেছি যে বিপ্লবীরা তাদের সব কাজ লুকিয়ে করে। আর সেই বিপ্লবীদেরই চোখে ধুলো দিয়ে, বিভুঁইয়ে এসে কী না নিজের বিয়েটা সেরে ফেলল আমার পুলিশ-বর! মনে মনে তখন বড় কষ্ট পেয়েছিলাম; এখন সেসব ভেবে বেশ মজাই লাগে। বর বলেছে একে নাকি চোখে ধুলো দেওয়া বলে না; একে বলে ‘অ্যাডভেঞ্চার’!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র