উত্তম না সৌমিত্র, রঘু রাই না রঘুবীর সিং— কে শ্রেষ্ঠ এই বিষয় নিয়ে ছবির দুনিয়া তর্ক করতে ভালোবাসে, বাঙালি তো বটেই! গ্রেটদের নিয়ে উত্তেজক বিশ্লেষণের আসল উদ্দেশ্য হল, সবাইকেই সম্মান জানানো। সেলিব্রিটি বাঙালি পেশাদারদের নিয়ে এই আলোচনা ঘুরতে থাকে আর্ট কালচারের গলিতে, রাজপথে। যদিও অঙ্কনচিত্রের পাশে আলোকচিত্রকে নিয়ে হইচই কমই হয়। আমাদের সৌভাগ্য যে, এর ব্যতিক্ৰম আছে। দুর্ভাগ্য, যাঁর কাজ নিয়ে আমরা একটু কথা বলব, তিনি সদ্য প্রয়াত। তিনি বঙ্গদেশের চিত্র-সাংবাদিকতার জগতের আনডিস্পিউটেড অতি উজ্জ্বল এক তারকা। তারাপদ ব্যানার্জি।
ছবির মানেটাই উনি বদলে দিয়েছিলেন ষাটের দশকের শেষাশেষি। প্রাক্-তারাপদ যুগে কাগজের ছবি ছিল অনেকটাই স্থবির। একটা সম্ভ্রমপূর্ণ দূরত্ব থেকে ছবি তোলা হত কিঞ্চিৎ ধীর মেজাজে। আগেকার ১২০ ফিল্ম ক্যামেরার প্রযুক্তি এর অন্যতম কারণ। লোকজনের ছবি তোলার সময়ে ‘সেফ’ থাকার জন্য সরাসরি ফ্ল্যাশ ব্যবহার করাই ছিল রীতি। ব্যাপারটা পছন্দ হত না তারাপদ ব্যানার্জির। তুলে নিয়েছিলেন ৩৫এমএম ক্যামেরা, দ্রুত কাজের জন্য আদর্শ, মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে। ব্রাহ্মমুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করতে সিদ্ধহস্ত, ক্ষিপ্র এই মানুষটির তোলা ছবিগুলো আজও এক বিস্ময়ের কারণ। ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সের ব্যবহার, ওঁর ট্রেডমার্ক স্টাইল। যে-কোনও ঘটনা বা তার মূল চরিত্রটি শুধু নয়, সামগ্রিক পরিবেশ ও ডিটেলিং ছবিকে যে উত্তরণের জায়গায় উন্নীত করতে পারে, তা প্রায় ছয় দশকের কর্মজীবনে দেখিয়ে গেছেন উনি। বিরতিহীনভাবে। বস্তুত, আজকের চিত্র-সাংবাদিকতা ওই একই পথে হেঁটে চলেছে। ওঁর ছবি স্রেফ ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রামাণ্য দলিল হয়ে থেমে থাকেনি। এতে পাওয়া যেত শিল্পসুষমার টাটকা সুগন্ধ। এমন আধুনিক কম্পোজিশন, স্বাভাবিক আলোর ব্যবহার ফিল্মযুগের খুব কম মানুষকেই করতে দেখা গেছে। তারাপদ ব্যানার্জি মানেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। উনি কীভাবে হয়ে উঠলেন এমন এক শিল্পী? সিনেমাপাড়ায় ছবির কাজ করতে-করতে কাগজে চলে আসা। সত্যজিতের রাডারে ধরা পড়া। তারপর বিচিত্র, উত্তেজনাপূর্ণ, অবাক করা ছবি, বছরের পর বছর ধরে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিতর্ক। এই মুহূর্তে কলকাতার তিনজন অতি পরিচিত, নামী প্রেস ফোটোগ্রাফারের কাছে ‘তারাদা’-র ব্যাপারে শুনছিলাম। এঁরা প্রত্যেকেই কাজের সূত্রে ওঁকে পেয়েছেন, দেখেছেন খুব কাছ থেকে। বিকাশ দাস, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস। অ মানেই অমিত ধর, আ মানেই ‘আজকাল’। জয়ন্ত সাউ, ‘বর্তমান’, রয়টার্স, ‘এই সময়’। স্মৃতিচারণে শুধুমাত্র হেভিওয়েট কাগজের নামী ফোটোগ্রাফার হিসেবে নয়, কাজের বাইরের মানুষটা সম্পর্কে এঁদের উচ্ছ্বাস, শ্রদ্ধা, বিস্ময় ঝরে পড়ছিল বার বার। প্রত্যেকের জবানিতে একটি ব্যাপার স্পষ্ট। ডাকাবুকো এই মানুষটি বাংলায় চিত্র-সাংবাদিকতার জগতে ক্যান্ডিড ছবির পথিকৃৎ। ওঁর ছবিগুলো লেন্স নয়, তৈরি হত মাথা দিয়ে।
বিকাশ দাস বলছিলেন, ‘সেবারে প্রিন্স চার্লস নিজে প্লেন উড়িয়ে নেমেছেন কলকাতায়। ৫ ডিসেম্বর, ১৯৮০। দমদম বিমানবন্দর। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু টারম্যাকের ওপর অপেক্ষা করছেন। সিঁড়ি দিয়ে যুবরাজ নামছেন হাসতে-হাসতে। জ্যোতিবাবুও হাসিমুখে। একপাশে চিত্র-সাংবাদিকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। অভ্যর্থনা চিত্রটি তোলা হবে। সে-সময়ে যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলেও আজকের মতো পরিস্থিতি ছিল না। হঠাৎ তার মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে একদম সামনে চলে এলেন তারাদা। ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স লাগানো ক্যামেরা। এদিকে জ্যোতিবাবু বাড়িয়ে দিয়েছেন হাত। প্রিন্স চার্লস করছেন নমস্কার। এই অপ্রত্যাশিত, দুর্লভ মুহূর্ত ততক্ষণে ছবি বন্দি হয়ে গেছে। পরের দিন আনন্দবাজারে বেরোল সেই ছবি। ছবির বিস্তারিত ক্যাপশনের শেষ লাইন, ‘ছবিতে নেই : উভয়ের করমর্দন, যা একটু পরেই ঘুচিয়ে দেয় ‘সাহেবিয়ানা’ বনাম ‘বাবুয়ানা’র প্রশ্নটি। ছবি— তারাপদ ব্যানার্জি।’ অপার্চুনিস্ট ফোটোগ্রাফারের এই ছবিটি আজও বিখ্যাত। কুখ্যাত বললেও ভুল বলা হবে না। এথিক্সের প্রশ্ন অনস্বীকার্য। আবার এক্সক্লুসিভ, অভাবনীয় ছবি তোলার জন্য বুদ্ধিমত্তার, ক্ষিপ্রতার দুর্ধর্ষ উদাহরণও বটে। শুধুমাত্র এই ছবিটি নয়, তারাপদ ব্যানার্জি মানেই কিছু-না-কিছু ঘটবে, সবাই জানতেন। বাংলার চিত্র-সাংবাদিকতার জগতে সদ্য প্রয়াত এই চরিত্রটিকে নিয়ে আলোচনা কোনোদিন শেষ হবে না।’
‘কালীঘাটে মানুষ। ছবির শুটিং তো পরে, তারাদা ছিলেন জাতীয় স্তরের রাইফেল শ্যুটার। ওঁর স্ত্রী-ও তাই। আমরা কাগজে তারাদার পদকপ্রাপ্তির ছবি দেখেছি একাধিকবার। ধর্মতলার মোড়ে একটা টোটা, বন্দুকের দোকানে আসতেন। আড্ডা হত। আমিও যেতাম। তখন এর-ওর কাছে ক্যামেরা চেয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম আমি। খবর আসত নানারকম। শুনলাম পুলিশ ছবি তোলার কাজের জন্য লোক নেবে। তারাদা নিজেই উদ্যোগ নিলেন। বলে দিলেন। দরখাস্ত, ইন্টারভিউ সবই হল, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে, সাতাত্তরে, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সরকারের অবসান হল। ওই ডামাডোলে সেই চাকরির ব্যাপারটাও চাপা পড়ে গেল। এই সময়ে তারাদার ছবি প্রথম দেখি। বিশাল করে ছাপা ছবিটা পাতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নিজের অফিস, প্রচুর ভিড়, খালি চেয়ার ফেলে রেখে ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এত বড় স্প্যানে, প্রচুর ডিটেল সঙ্গে নিয়ে দিগন্তপ্রসারী মানসিকতার এমন ছবি সে-সময়ে আর কেউ তুলতেন বলে মনে পড়ে না।’
নিউজ ছবিতে শিল্পসুষমা বজায় রাখা কঠিন কাজ। তারাদা বার বার সেটাই করে দেখিয়েছেন। টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়ায় ওঁর তোলা ছবি বেরোত ‘উল্টোরথ’, ‘সিনেমা জগৎ’-এ। সিনেমা তৈরির আবহে, ক্যামেরা, লেন্স আলোর ব্যবহারটা রপ্ত করেছিলেন। কাঁচা ফ্ল্যাশের বদলে বাউন্স পদ্ধতিতে কাজ করতেন ঝুঁকি নিয়ে। পরবর্তীকালে নিজেই এই স্টাইলকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন। ‘আনন্দ’র ফ্যাশনবিপণিতে তারাপদ ব্যানার্জির তোলা বাহারি ধুতির কোঁচা মেলে ধরা উত্তমকুমারের ছবিটি অনেকেই মনে রেখেছেন। সে-যুগের ব্যতিক্রমী ফ্যাশন শুট। ‘অপুর সংসার’-এর সময়ে এলেন সত্যজিৎ রায়ের সংস্পর্শে। মানিক দ্রুত চিনে নিলেন আর এক মাণিক্যকে। শুরু হল আর এক অধ্যায়। ফিল্মের যুগ, প্রধানত সাদা-কালো, ছবি তুলে কন্ট্যাক্ট প্রিন্ট দেখে বাছাই করাই রীতি। সত্যজিৎ মুখিয়ে থাকতেন সেসব দেখার জন্য। নির্ভর করতেন তারাদার অথেন্টিক ডকুমেন্টেশনের ওপর। নিজের সিনেমা তৈরির সময়ে মাথায় রাখতেন সেসব রোজকার মিটিং-মিছিল-টিয়ার গ্যাসের বাইরে একেবারে অন্য ঘরানার এত ছবি কী করে তুলে গেছেন, তা বিস্ময়ের ব্যাপার। লিখেছেন বই। ‘মুহূর্তরা মুহূর্তের কাছে ঋণী’। সত্যজিৎকে নিয়ে তোলা প্রচুর ছবি। আরও দুটি বই রয়েছে। ‘সত্যজিৎ রায় : আ পোর্ট্রেট ইন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’, সঙ্গে সত্যজিতের একটি লেখা, রঘুবীর সিংয়ের ভূমিকা-সহ। আর একটি বই ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত, ‘দ্য মায়েস্ত্রো ইন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’।
বকখালি ট্যুরিস্ট লজে একটা দারুণ ছবি ছিল। জমির ওপরের মাচায় কটেজগুলো, তার পিছনে চাঁদ উঠেছে। তারাপদ ব্যানার্জির ছবি, বলাই বাহুল্য। এসব অনেকদিন আগের কথা। বকখালিতে বিশেষ কেউ যেত না তখন। নিরিবিলিতে একটা মডেল শ্যুট করার জন্য গিয়েছিলেন অমিত ধর। সেখানেই প্রথম আলাপ। ‘আজকালের অমিত ধর না?’ হৃদ্যতা জমে উঠল। কাজের বাইরের মানুষটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলেন। ‘দক্ষিণবঙ্গের প্রতি তারাদার একটা আকর্ষণ ছিল। এতটাই যে, জমি কিনে ঘর বানিয়ে থাকতে উৎসাহী ছিলেন। মদ-সিগারেটে আসক্তি ছিল না, এদিকে মুরগি পেলে বেজায় খুশি। কাজের স্পটে তারাদার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়ে যেত। কম কথার লোক। একটা অস্থিরতা। সারাক্ষণ ভাবছেন। ছবি ‘হান্ট’ করছেন। অতি দ্রুত ডিসিশন নিয়ে ঠিক কোথায় পৌঁছলে সেরা ছবিটি ধরা পড়বে, তা বোঝার বিরল ‘সেন্স’ কাজ করত। তিন বিঘা করিডরে, আগরতলায় একসঙ্গে কাজ করেছি। একবার কোথাও একটা কিছু ঘটেছে, তার ছবি তুলেছি। অন্য কাজ সেরে পরে তারাদা এসেছেন হয়তো খবর পেয়ে, ‘দেখি দেখি, কী পেয়েছ? আমাকে বললে না কেন আগে?’ কী ভয়ংকর ছবির খিদে, ডেসপারেশন, ছেলেমানুষি, রাগারাগিও। কারণ খুঁজে লাভ নেই। তারাদা ওইরকমই। জিএনএলএফ-এর ঝামেলার সময়ে তারাদার সঙ্গে আমি। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি, তার মধ্যেই ঢুকে পড়তে হল। এদিকে জিপের সামনে বোল্ডার ফেলছে, ওঁর ভয়ডরের ব্যাপার নেই। একবার লালকৃষ্ণ আদবানিকে ম্যাসাঞ্জোরের কাছে একটা গেস্ট হাউজে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল। এলাকায় যথেষ্ট টেনশন।পাহাড়ি, জঙ্গুলে জায়গা। মাছি গলার সুযোগ নেই। অলোক মিত্র আর তারাদা কিছুটা গাড়ি চালিয়ে, বাকিটা হেঁটে, সিকিউরিটির চোখে ধুলো দিয়ে, জেমস বন্ডের স্টাইলে ঢুকে পড়েছিলেন স্পটে। বারান্দায় আদবানিকে দেখামাত্র ছবি তুলে ফেলেছিলেন। অন্য মজার ঘটনারও শেষ নেই। মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী তারাদাকে খুব ভালোবাসতেন। ছবি তোলাতেন। একবার গঙ্গাসাগরে ওঁর একটা ছবি, মন্ত্রী গরুর লেজ ধরে বৈতরণি পার হচ্ছেন, খুব শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। এসব তারাদারই কাণ্ড। শুধুমাত্র নিউজ নয়, বিচিত্র পোর্ট্রেটও তুলেছেন অনেকের। গৌরকিশোর ঘোষ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ তো বটেই! গঙ্গা নিয়ে কাজ করছিলেন, ডার্করুমটা সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। এই কাজেও তিনি মাস্টার। আর বলতে হয় তারাদার ঈর্ষণীয় ফিটনেসের কথা। কোথা থেকে ননস্টপ কাজ করার এত স্ট্যামিনা পেতেন কে জানে!’
জয়ন্ত সাউ বলছিলেন, ‘পণ্ডিত রবিশঙ্করের শেষ বিয়েতে ছবি তোলা নিয়ে খুব মুশকিল হয়েছিল। তারাদা তুলবেনই, রবিশঙ্কর ধরা দিচ্ছেন না কিছুতেই। সেই নিয়ে রাগারাগি। অনুরোধ বদলে গেল হুমকিতে। পরে ওই সব ঘটনা শুনে অন্যেরা হেসে গড়িয়ে পড়েছে। তার মধ্যে অন্যতম সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। স্ত্রী বিজয়া রায়কে ডেকে বলেছিলেন, ‘ওই শোনো, রবিশঙ্কর আবার বিয়ে করেছে, তারাপদকে কী হেনস্থা করেছে শোনো!’ এদের দুজনের পারস্পরিক আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা ছিল অসাধারণ। বত্রিশ বছর ধরে এক নাগাড়ে তারাদার ক্যামেরায় কত যে ক্যান্ডিড সত্যজিৎ হয়েছে কেউ জানে না। তারাদাকে বলতে শুনেছি, সিনেমা বানালে সত্যজিৎকেই নায়ক করতেন। এমন উচ্চস্তরের অভিনেতা বাংলা কমই পেয়েছে। সত্যজিৎ শুধু নামী প্রতিষ্ঠিতদের নয়, সাধারণ মানুষকে নিজে অভিনয় করে দেখিয়ে, শিখিয়ে, পড়িয়ে বহু দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স বের করে নিয়েছেন। ফলে, সবারই অভিনেতা সত্যজিতের প্রতি একশো এক মুগ্ধতার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রসঙ্গত, মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক বিরল উচ্ছ্বাসপূর্ণ মুহূর্তের ছবি দেখে নিতে পারেন একটু নেট সার্চ করে। এই সম্পর্কগুলো ‘সেন্স’ করে অভাবনীয় ছবি সব তুলেছেন তারাদা। তার অনেক কিছু হয়তো আজও কেউ দেখেনি। দেখতে পাবে কি না, তাও বলা মুশকিল। আমার অল্পবয়সে, আনন্দবাজারের সুবিখ্যাত ফোটোগ্রাফি বিভাগে প্রচুর আড্ডা হত, আমিও যেতাম। শুধু সেই দুরন্ত কথোপকথনগুলো নিয়ে একটা আলাদা বই হতে পারে। আবার এটাও সত্যি যে, ওপরওয়ালারা বহু ক্ষেত্রে ওঁর ন্যাচারাল লাইটে, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল-এ তোলা ছবি নিয়ে আপত্তি করেছেন। এদিকে সরাসরি ফ্ল্যাশ মেরে ছবি তোলায় তারাদার ঘোর আপত্তি। এভাবেই চলে গেছে অনেকগুলো বছর। পুলিশকে নিয়ে তোলা একটা ছবি, সামনে পুলিশের পা, ছেঁড়া জুতো পরা, লো অ্যাঙ্গেল, ব্যাকগ্রাউন্ডে কলকাতার রাস্তা। কেউ ভুলবেন না। তারাদা বলতেন, ‘ফোটোগ্রাফার একবার যদি দেখে নেয়, বুঝে যায়, এটাই ছবি, তাহলে সে তুলবেই, তাকে তুলতেই হবে। না হলে সে ফোটোগ্রাফারই নয়!’ নিজে সেটাই করতেন। জামাকাপড়ের দিকে খেয়াল থাকত না, ছবির জন্য কী না করতে পারতেন, রাস্তায় ধুলোয় শুয়ে পড়ে হাওড়া ব্রিজে… ঘটনার শেষ নেই। বলতেন, বাধা তো আসবেই। মাঝে মাঝে বাধা এসে হাজির হয়েছে মৃত্যুদূতের মতো। কলকাতার হাজরা মোড়ে গুন্ডাদের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায় (তখন বিরোধী দলের নেত্রী), ভয়ংকর আঘাত লেগেছিল মাথায়। জ্যোতিবাবুর আমল। এর কিছু পরেই আক্রান্ত হন তারাপদ ব্যানার্জি। হাত ভেঙে দিয়েছিল লালু আলমের বাহিনী। প্রেসের ওপর আক্রমণের নজিরবিহীন ঘটনা। আর, ছোটখাট ব্যাপার তো লেগেই থাকত। একবার শম্ভু মিত্র, বেশ খারাপ মেজাজে, মুখে রাজ্যের বিরক্তি, দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন, ওই অবস্থাতেই হয়ে গিয়েছিল ‘ছবি’। তারাদার একটা নিকনেম চালু ছিল। ‘টর্পেডো।’
ছবি তুলতেন বাঘের মতো। অথচ কিছু ব্যাপারে ছিলেন একেবারে উদাসীন। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে নিজের কাজটা ঠিকমত সংরক্ষণ করা, এক ধরনের ডিসিপ্লিন, এসব ছিল না। খুব একটা মেশামেশি, আড্ডাতে থাকতেন না। থাকলেও, ছবি ছাড়া আর কোনো কথা নয়। আবার কাজের সময়ে সতীর্থদের ঠিক পরামর্শগুলো আসত ওই তারাপদ ব্যানার্জির কাছ থেকেই। অনেক ব্যাপারে একবগ্গা, ব্লাইন্ড। যে-লোকটা এক সময়ে নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছে অজস্রবার, অ্যাহেড অফ টাইম, পরে সেই লোক কিছু ব্যাপারে আপগ্রেড করতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। কেন, বলতে পারব না। নিজের তালে, নিজের স্টাইলে, নিজের ইচ্ছেতে চললেন জীবনভর। এটাই বড় কথা। পুরো মানুষটাকে বোঝা দায়, এই কথাটা সকলেই বলেছেন। রিটায়ারমেন্টের পরের মানুষটা আগের চেয়ে অনেকটাই আলাদা হয়ে গেলেন। কথা আরও কম বলতেন। হয়তো, প্রায় সর্বক্ষেত্রে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিগুলো একেবারেই মেনে নিতে পারছিলেন না। রণক্লান্ত এক বিদ্রোহীকে কিছুটা পেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল সময়। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল জরা, দমিয়ে দিতে পেরেছিল সেই দিগন্তব্যাপী অদ্ভুত দ্যুতিকে। হ্যাঁ, ছাত্রদের নিয়ে ঘুরছেন, বোঝাচ্ছেন, অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত মানুষটাকে এভাবেই দেখা গেছে।’ জয়ন্ত সাউয়ের ফেসবুক পেজে ওঁর নেওয়া তারাপদ ব্যানার্জির একটি ইন্টারেস্টিং সাক্ষাৎকার রয়েছে। টুক করে দেখে নিতে পারেন।
তারাপদ ব্যানার্জির রিস্কি কাণ্ডকারখানার অনেক গল্প আছে। যথারীতি বিতর্ক-ও প্রচুর। সব কিছুই হয়তো একদিন সামনে আসবে। যেমন এটি। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ভয়ংকর পরিস্থিতিতে একাধিক ভারতীয় চিত্র-সাংবাদিক গিয়েছিলেন কভার করতে। শেষদিকে, ঢাকাতে অশান্তি অব্যাহত, লাশ পড়ছে অহরহ। পাক সেনা খুনোখুনি, আগুন, হিংসা ছড়িয়ে চলেছে শেষবারের মতো। ভারতীয় সেনা পরিস্থিতির দখল নিচ্ছে। বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে মুজিবর রহমান ফিরে এসেছেন। কিন্তু তাঁর নিরাপত্তার প্রশ্নটি তখনও দোদুল্যমান অবস্থায়। তারাপদ ব্যানার্জি গিয়েছিলেন এই সময়ে। এক্সক্লুসিভ ছবি চাই। মুজিবের বাসভবনে ঢোকা অসম্ভব। কোন কৌশলে সবার নজর এড়িয়ে তারাপদ ব্যানার্জি সেখানে ঢুকে পড়েছিলেন, কেউ জানে না। নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন একটা বাথরুমে। ইন্সটিঙ্কট বলছিল, মুজিব আসবেনই। ঘরে পায়ের আওয়াজ পাওয়ামাত্র বুঝতে পেরেছিলেন এসেছেন বঙ্গবন্ধু। সঙ্গে স্ত্রী। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন এক অভাবনীয় দৃশ্য…। তারপর কী হয়েছিল, সেটা কলকাতার প্রেসমহলের সিনিয়ররা, কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই জানবেন। বলবেন। কাউকে না কাউকে তারাপদ ব্যানার্জি বলে গেছেন, এটুকু আন্দাজ করা যেতে পারে। সেসব তাঁদের কাছেই শোনা যাবে না হয়।
এত কিছুর পরে, তারাপদ ব্যানার্জি গ্রেট ফোটোগ্রাফার হওয়া সত্ত্বেও, ওঁকে নিয়ে বিতর্কগুলো থামবে না। সবাইকে টপকে প্রিন্সের সামনে পৌঁছে যাওয়ার ঘটনা, আরও অনেক কিছুই, কেউ ভুলতে পারবে না। আজ তাহলে, আপাতত, ফাইনাল ভার্ডিক্ট কী দাঁড়াবে? ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র চিফ ফোটোগ্রাফার দেশকল্যাণ চৌধুরীর সাম্প্রতিক স্মৃতিচারণে এর ইঙ্গিত রয়েছে— ‘পরে চিত্র সাংবাদিককুলের কাছে যদিও এই ছবির জন্য অনেক শাপশাপান্ত শুনেছি তারাদার উদ্দেশ্যে, কিন্তু জো জিতা ও হি সিকান্দার, এই আপ্তবাক্য মাথায় রেখে ওই সব গল্প বরং আজ তোলা থাক।’
ছবি সৌজন্যে : লেখক