নাভালনি জানতেন
রাশিয়ার জেলখানায় মারা গেলেন আলেক্সেই নাভালনি। ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে উজ্জ্বল নিন্দুক, জনপ্রিয় প্রতিবাদী নাভালনিকে একসময় পুতিন সরকার গ্রেফতার করার সাহস পেত না তাঁর জনপ্রিয়তার জন্য। সরকারের তরফে তাঁর নামে বহু মামলা করা হত, যাতে তিনি নির্বাচনে লড়তে না পারেন। নাভালনি রাশিয়ার সরকারের দুর্নীতি নিয়ে লাগাতার কথা বলতেন, দলের সঙ্গে মিলে সেই বিষয়ে লেখা প্রকাশ করতেন, আন্দোলন করতেন। তারপর ২০২০-র অগস্টে সাইবেরিয়া থেকে প্লেনে ফেরার সময় কে বা কারা তাঁকে মারাত্মক বিষ দেয়, বিমানচালক আপৎকালীন অবতরণ না করলে তিনি মারাই যেতেন। বার্লিনে নিয়ে গিয়ে তাঁর চিকিৎসা করা হয়, তিনি বেঁচে যান। কিন্তু ক’মাস পরেই, ২০২১-এর জানুয়ারিতে, ঠিক করেন, রাশিয়ায় ফিরবেন। বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, তারপর এতদিন বিভিন্ন জেলে ছিলেন। তাঁর সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় উগ্রপন্থার অভিযোগে, আর তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয় ২০৩৮ অবধি। মারা যাওয়ার আগের দিনের ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, হাসছেন, রসিকতা করছেন (বিচারককে বলছিলেন, আপনার বিশাল মাইনে থেকে কিছু আমায় দিন, নইলে আপনারই সিদ্ধান্তের ফলে আমার যে আর্থিক দুরবস্থা তা তো কাটার নয়)। পরেরদিন নাকি কিছুটা হেঁটে, ফিরে তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়েন ও মারা যান।
সারা পৃথিবী পুতিনকে খুনি বলছে, নাভালনিকে এভাবে হত্যার নিন্দা করছে। কিছু পুতিন-পন্থী বলছেন, নাভালনি তো নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছিলেন, তাঁর তো আর কোনও রাজনৈতিক গুরুত্বই ছিল না, তাহলে ভোটের কদিন আগে শুধু শুধু পুতিন একাজ করতে যাবেন কেন? এতে তো বরং পুতিনের বিরোধীদের, রাশিয়া-বিরোধী পাশ্চাত্য দেশগুলোর সুবিধে হল। নাভালনির সমর্থকেরা রাশিয়া জুড়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, তাঁদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। অনেকেই একটা তালিকা বের করে বলছেন, এটা কি খুব আশ্চর্য ব্যাপার নয়, পুতিন-বিরোধীরা প্রায়ই অপঘাতে মারা যান? কেউ গুলি খান, কাউকে সাংঘাতিক বিষ দেওয়া হয়, কারও বিমান ভেঙে পড়ে, কেউ দিব্যি ছিলেন কিন্তু কিছুটা হেঁটে আচমকা অজ্ঞান হয়ে যান এবং আর তাঁর জ্ঞান ফেরে না? মোটামুটিভাবে একথা সবাই বোঝে যে প্রতিবাদী এক মানুষকে জেলবন্দি করে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধিতার সম্ভাবনাকে নিশ্চিহ্ন করেছিল পুতিন সরকার, একথাও সন্দেহ করা হয় যে ২০২০-তে নাভালনিকে খুনের চেষ্টাও করেছিল এই সরকারই। তাহলে এই আচমকা মৃত্যু এমনিই ঘটে গেছে, তা বিশ্বাস করতে লোকের কষ্ট হবে বইকি।
কিন্তু যে ব্যাপারটা আরও চমকে দেয়: নাভালনি জানতেন তাঁকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন তা করেছে পুতিন সরকার। তারপর কোনওমতে বেঁচে গিয়ে, তিনি তাঁর হিতৈষীদের পইপই বারণ না শুনে, রাশিয়ায় ফিরলেন। যে লোকটা একবার তোমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে, এবং যে এতখানি প্রবল যে তার ক্ষমতা-খর্বতার বা শাস্তির কোনও সম্ভাবনাই নেই, তুমি সেধে তার আওতায় ফিরবে কেন, কোন বুদ্ধিতে? ২০১১-য় একবার নাভালনি ‘আপনার ভয় করে না?’ প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, ‘আমার সঙ্গে আপনাদের পার্থক্য এখানেই। আপনারা ভয় পান, আমি পাই না।’ তার চেয়ে বড় কথা, তিনি মনে করেছিলেন, মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল জেনেও, এমনকী প্রায় নিশ্চিত জেনেও, তাঁকে ফিরতেই হবে, কারণ তিনি তাঁর দেশের কল্যাণকাজ করতে চান। তাঁর জীবনের একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে, এবং সেটির সাধন না করলে নিজ শ্বাসসমষ্টি তাঁর কাছে কোনও অর্থ বহন করবে না। পরাধীন দেশে স্বাধীনতা আনার লড়াইয়ে বহু মানুষ প্রাণ দেন। কিন্তু একটা আপাত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ফলে খুন হওয়ার উপক্রম হলে সাধারণত লোকে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে, সেখান থেকে প্রতিবাদ জারি রাখেন। বই লেখেন, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনুরাগী ও দেশীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, ইউটিউবে বারেবারে বক্তৃতা দেন, তাঁদের কাছে একরকম ভাবে উপস্থিত থাকেন। মরে যেতে হবে, বা বেঁচে থাকলেও সারা জীবন জেলে পচতে হবে জেনে ফিরে আসা সহজ কথা নয়। নাভালনিকে জেলেও খুব সুবিধের জীবন যাপন করতে দেওয়া হত না, বারবার একটা কুঠুরিতে একলা রেখে দেওয়া হত, সেখানে অসহ্য কনকনে ঠান্ডা, মাঝেমাঝে কীসব ইঞ্জেকশন দেওয়া হত (অনেকেরই মতে, তাঁকে ‘স্লো পয়জনিং’ করা হয়েছে), কিন্তু তাঁর মুখে হাসির অন্ত ছিল না। তিনি কী ভাবছিলেন? তাঁকে কোনও কাজ করতে দেওয়া হবে না, তাঁর সংগঠনকে মুছে দেওয়া হবে, তিনি সত্তর বা পঁচাত্তর বছর বয়সে যদি-বা জেল থেকে বেরোতে পারেন তাঁর আর আন্দোলনের ক্ষমতা থাকবে না, তবু তিনি রাশিয়ায় এসে মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন, দেশকে পরিত্যাগ করে যাননি চরম ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের ভয়েও— এই সান্ত্বনা তাঁকে শান্ত রাখবে? না কি ভেবেছিলেন পুতিনের স্বৈরাচার বেশিদিন চলবে না, মানুষ একদিন রুখে দাঁড়াবেই এবং তারা কিছুটা হলেও প্রেরণা সংগ্রহ করবে নাভালনির প্রতিবাদ থেকে, আত্মত্যাগ থেকে, তাই তাঁকে নিজেকে বিনাশ করেও উদাহরণ স্থাপন করতে হবে? না কি তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁকে বেশিদিন জেলে রাখা যাবে না, সারা পৃথিবীর মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং সদিচ্ছাময় রাষ্ট্রদের নাগাড়ে তিরস্কার ও উপরোধের চোটে একদিন পুতিন তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন? তিনি কি মনে করেছিলেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ? বা আশাবাদ মানুষের অবশ্যপালনীয়? তিনি কি ভাবছিলেন, দেখাই যাক না একটা লোক যদি শুভ-র পক্ষে দাঁড়ায় তাহলে শেষ অবধি কী হয়? তিনি কি ভেবেছিলেন একজন মানুষ যখন নিজের অস্তিত্বের চেয়েও তার দেশের মানুষকে বেশি ভালবাসে তখন সে সেই প্রেমের জোরেই অপরাজেয় হয়ে যায়? তিনি কি সত্যিই মনে করেছিলেন মৃত্যুটা এমন কিছু ব্যাপার নয়, লড়াইটা তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তিনি শেষ হয়ে গেলেও তাঁর লড়াইটা রয়ে যাবে?
কিন্তু তা রয়ে যায় তো সত্যিই? এই আদর্শ-দ্রব কথাগুলো রচনা-টচনায় লেখা যায়, কিন্তু বাস্তবে ঘটে? নাভালনিকে কজন মনে রাখবে আজ থেকে দশ বছর পরে? তার চেয়ে তিনি যদি জার্মানি বা আমেরিকায় থেকে যেতেন এবং আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ পৃথিবীতে তীব্র পুতিন-বিরোধিতা করে যেতেন, (যেন মনে হত তিনি রাশিয়াতেই আছেন), আখেরে তাতে বেশি লাভ হত কি? না কি এই যে তিনি তুড়ি মেরে বাঘের হাঁয়ের সম্মুখে ফিরে এলেন, এবং তার ফলে তাঁর মৃত্যুও হল, এই আশ্চর্য নির্ভীকতায় যদি তিনটে লোকও দীক্ষিত হয়, তার দাম অনেক বেশি? প্রকৃত আগুন কোথাও না কোথাও তার স্ফুলিঙ্গ বপন করে যাবেই? একথাও মনে রাখতে হবে, পুতিন-পন্থীরা নাভালনি সম্পর্কে বলছেন, ধুর, লোকটা তো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছিলই। রাষ্ট্র বা প্রকাণ্ড ক্ষমতা এই ব্যাপারটা ঘটাতে সক্ষম বটে, সে বিরোধীকে বুটের তলায় চিপে এমন নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে যে একটা সময়ে তার কোনও বাস্তব অবদান আর থাকে না। যদি লোকটা যম-কুঠুরিতে বন্দি থাকে, তাহলে আর আন্দোলন করবে কী করে, নতুন কোনও কুকীর্তির বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে কী উপায়ে? একজন প্রতিবাদীর সবচেয়ে বড় ভয় এই নির্বিষ, তাৎপর্যহীন হয়ে যাওয়া। নাভালনি সেই ভয় নির্ঘাত পাচ্ছিলেন, সারাক্ষণ নিশ্চয়ই তাঁর মনে হত, কীভাবে তিনি চারটে নিরেট দেওয়ালের দম-চাপা খেতে খেতে রাশিয়াকে নতুন পথ দেখাবেন। তিনি জেলে বহুদিন ধরে বুড়ো হলে আর এই দীপ্ত ও জন-আগুন-জাগানিয়া নাভালনি থাকতেন কি? তাহলে কি একজন চির-লড়াকুর পক্ষে এ-ই ভাল হল, মরে যাওয়া এবং শহিদ হিসেবে ইতিহাসে স্থান? অনেকদিন পর জেল থেকে বেরিয়ে ‘ওহো, এই সেই লোক না? কী যেন করেছিলেন না?’ মার্কা মিডিয়া-মনোযোগ পাওয়ার চেয়ে, এমনকী নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে, এমন একজন মানুষের পক্ষে অধিক কাম্য নয় কি এই সহসা মৃত্যু, যা আজ পুতিন-সংহারের বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা হচ্ছে?
প্রশ্নচিহ্নের ছড়াছড়ি পড়ে গেলেও এমন একজন লোকের লাভ-ক্ষতিকে মাপার দিকে সহজে এগোনো যায় না। ‘আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগো রে সকল দেশ’ উচ্চারণ খুব শক্ত। তার জন্য জনজাগরণের প্রতি (জনতার জাগ্রত হওয়ার ক্ষমতার প্রতি), এবং নিজের প্রতি বিশ্বাসে অটল থাকতে হয়। এই ভাবনার বশবর্তী হয়ে যিনি নিজেকে বিলোপ করলেন, তাঁর জীবন ও চিন্তার ঝাঁঝ অনঃস্বীকার্য। রাশিয়া বহুদিন ধরে প্রায়-স্বৈরাচারে ছটফট করছে, এমন এক বিপ্লবীর কাহিনি থেকে কিছু প্রতিরোধ-রসদ সংগ্রহ হবেই। এখন নাভালনির মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি চলছে, কর্তৃপক্ষ তা প্রিয়জনদের দিচ্ছেন না, বলছেন তদন্ত সম্পূর্ণ হয়নি। নাভালনি-পক্ষীয়রা বলছেন, এ হল প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা। কিন্তু দেহ বা দেহে সম্ভাব্য আঘাত-চিহ্ন বড় কথা নয়। বড় কথা নাভালনির ওই মাতৃভূমিতে ফেরার সিদ্ধান্ত, সেই অলৌকিক মুহূর্ত, যখন নাভালনি আজকের এই পরিণামের সম্ভাবনা ওজন করে দেখেছিলেন এবং তাঁর মনে হয়েছিল বিদেশে নিরাপদে প্রিয়-সান্নিধ্যে ঘুরে বেড়ানো ও দোকান করার চেয়ে এই দৈহিক নিশ্চিহ্নতা তাঁর কাছে বেশি কাম্য। যখন তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর মৃতদেহ তাঁর জ্যান্তদেহের চেয়ে দৈর্ঘ্যেপ্রস্থে হবে অনেক বিশাল, তা ঢেকে ফেলবে রাশিয়ার আকাশের বহু অঞ্চল, এবং তার কথা বলার সময় জিভ থেকে ঝরে পড়বে নক্ষত্র। যখন তিনি মনে করেছিলেন মিছিলে জীবিতদের সঙ্গেই হাঁটে মৃতেরা, এবং মৃতের লাইন লম্বা হলে মিছিলও হয়ে ওঠে সর্পিল ও অন্তহীন, মৃতেরা তাদের অভিজ্ঞতার বশে তীব্রতর স্লোগান ফিসফিসিয়ে বলে দেয় কানে কানে, আর নশ্বর কণ্ঠধারীরা তার প্রতিধ্বনি করে। এবং স্বৈরাচারীরা কখনও কখনও মৃতদের বেশি ভয় পায়, কারণ তাদের কোনওমতেই আর মারা যাবে না।