ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়াবাজি : পর্ব ২১


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (January 9, 2024)
     

    স্বাধীনতার শিস দাও

    কিছু কিছু সিনেমা নিজের তালে নিজের চালে এগোয়, এই মনে হচ্ছে এখানে কমেডিই প্রধান, এই মনে হচ্ছে দর্শন, এই সে যাচ্ছিল থ্রিলারের দিকে ওই বেঁকে গেল প্রেমের গল্পে। এবং এগুলো সে করে এমন আলগোছে, ক্যাজুয়াল ভাবে, আমরা অবাক হই, আরে, এ কি মনে করে না, একটা ছবি একই ঘরানায় হতে হবে? আর্জেন্টিনার ছবি ‘দ্য ডেলিনকোয়েন্টস’ (চিত্রনাট্য ও পরিচালনা : রদরিগো মোরেনো, ২০২৩) এই গোছের ছবি, এরকম ছবি হয় না তা নয় (সাম্প্রতিক বিখ্যাত ছবি ‘টাইটেন’ এভাবেই এক ঘরানা থেকে অন্য ঘরানায় লাফ দেয়), কিন্তু কম হয়। একটা ছবির গোড়াতেই যদি দেখানো হয় এক ব্যাংক-কর্মী ব্যাংকের অনেক টাকা সরাচ্ছে, আমরা ধরে নিই এটা চুরি ও তদন্তের কাহিনি। এই ছবিতে মোরান নামে একজন যখন টাকা চুরি করে, ভাল করেই বোঝে, সিসিটিভি ক্যামেরা নজর রাখছে। তারপর সে দেখা করে এক সহকর্মীর সঙ্গে, তার নাম রোমান। মোরান প্রস্তাব দেয়, রোমান এই চুরির টাকা লুকিয়ে রাখুক। কারণ রোমান সেদিন গেছিল ডাক্তার দেখাতে, তাই ব্যাংক আর যাকেই সন্দেহ করুক, তাকে করবে না। আর, সে যদি মাত্তর তিন সাড়ে-তিন বছর টাকাটা লুকিয়ে রাখে, তাহলেই আধাআধি বখরা পাবে। তিন সাড়ে-তিন বছর পর কী হবে? কেন, মোরান জেল থেকে ছাড়া পাবে। অর্থাৎ, মোরানের প্ল্যান, সে আত্মসমর্পণ করবে, তারপর জেলখানায় যদি ভাল ব্যবহার করে, তাহলে ছ’বছরের দণ্ডটা নেমে দাঁড়াবে সাড়ে তিন বছরে। যে-টাকা সে চুরি করেছে, তার অঙ্ক অ্যাক্কেবারে হিসেব মেপে ততটা, যতটা সে আর রোমান আগামী ২৫ বছর (যদ্দিন তাদের চাকরি বাকি আছে) রোজ ব্যাংকে গেলে রোজগার করত। আর রোমান যদি এই চুক্তিতে না রাজি হয়? তখন মোরান পুলিশের কাছে মিথ্যে বলবে যে, রোমান ছিল এই কাজটায় ওর সহকারী। রোমান ভেবেচিন্তে টাকাটা রেখে দেয়।

    ‘মোরান’ আর ‘রোমান’ নামদুটো যে একই অক্ষর-রাশি এদিক-ওদিক করে তৈরি, তা কাকতালীয় নয়। পরেও রোমানের সঙ্গে এমন লোকেদের আলাপ হবে যাদের নাম ‘মোরনা’, ‘নোরমা’, ‘রামোন’। আর আলাপ হওয়ার পরেই দেখা যাবে, কমিক্স-বই পড়ে আছে, যেখানে সুপারহিরোর নাম ‘নামোর’। ছবিটা কৌতুকভর্তি ইঙ্গিত করে, পৃথিবীটা একই লোকে ভর্তি। টাকাটা চোরেরা রাখতে পারল, না পুলিশরা খুঁজে বার করল, তাতে ছবিটার কিচ্ছু যায়-আসে না। ছবিটা মোরানের মুখ দিয়ে বলে, ‘২৫ বছর ব্যাংকে কাজ, না সাড়ে তিন বছরের জেল?’ এই হল আসল প্রশ্ন। কাজ মানে কী? বছরের পর বছর একই সময়ে একই উর্দি পরে একই চাকরি (বা ব্যবসা) করে চলার মধ্যে যে অসহনীয় দৈন্য, তার চেয়ে কি অপরাধ করেও বাইরে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা বাঞ্ছনীয় নয়? ছবিটা প্রায়ই ব্যাংকের কাউন্টারের গরাদের ওদিক থেকে লোকগুলোকে দেখায়, যেন জিজ্ঞেস করে, আরে, ব্যাটাদের ঠিক কয়েদি মনে হচ্ছে না, যাবজ্জীবন বন্দি টাইপ? মোরানকে জেলখানায় যে প্রধান মস্তান অত্যাচার করে, তার চরিত্রে তিনিই অভিনয় করেছেন, যিনি ব্যাংক ম্যানেজারের অভিনয় করেছেন, যে ম্যানেজার কিনা রোমানকে ব্যাংকে অত্যাচার করে। ম্যানেজার বলে, ‘আমরা তোমার নামে কিছুই প্রমাণ করতে পারব না রোমান, কিন্তু তোমায় কাজ থেকে ছাড়িয়েও দেব না। তোমার জীবনটা আমরা নরক করে দেব।’ মানে, কাজ থেকে ছাড়িয়ে না-দেওয়াই (এবং কাজ করাকালীন নানাভাবে উত্ত্যক্ত করাই) হচ্ছে চরম শাস্তি। যে অফিস যাওয়াটাকে, যে কাজ করাটাকে আমরা জীবনের একটা আবশ্যিক ও প্রার্থিত অঙ্গ বলে মনে করি, এই ছবি বলে, ধুর, সেটা থেকে না বেরোলে মানুষ আবার বাঁচতে পারে না কি? ব্যঙ্গ করে এ কথাও মোরানের মুখ দিয়ে বলানো হয়, দেখবে, শহুরে মানুষ আরেকটা মানুষকে দেখলেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কী করেন?’ এই ছবির মতানুযায়ী, স্বাধীনতা হল, নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার স্বাধীনতা। অন্যের (বা সমাজের) ইচ্ছেমতো কাজ করে টাকা রোজগারকে পরাধীনতা বলে।

    ঘোড়ায় চড়ে মোরান যখন পাহাড়ি পথে ঘুরতে থাকে, তখন নেপথ্যে গান বেজে ওঠে: ‘স্বাধীনতা কোথায়? আমি সারাক্ষণ নিজেকে সেই প্রশ্নই করি। হয়তো সেটা এমন কোথাও আছে, যেখানে আমাদের যেতে হবে।’

    আর সেজন্যই মোরানের নির্দেশ মেনে টাকাটা লুকিয়ে রাখতে গিয়ে রোমান একটা জায়গায় এসে পড়ে, যেখানে পাহাড় হ্রদ উপত্যকা মিলিয়ে অপূর্ব রূপকথা বিছিয়ে আছে। সেখানে তার আলাপ হয় দুজন মেয়ে আর একজন ছেলের সঙ্গে। তাদের দেখলে মনে হয়, তারা অনন্ত পিকনিকে বসবাস করছে। পাহাড়ে ঘোরে, মুরগি পালে, যখন খুশি সাঁতার কাটে, গান চালিয়ে নাচে, মদ খায়। ওরা ওখানেই থাকে, তিনজন মিলেই একটা সিনেমা তোলার চেষ্টা করে, ঘরভাড়া দিয়ে যে রোজগার করে তাতেই চলে যায়। তাদের ব্যবহার ভাল, তারা অন্যের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেতে আগ্রহী, তাদের মধ্যে এক মেয়ে রোমানের প্রতি মুগ্ধও হয়। রোমান বাসে উঠে শহরে ফিরে যাওয়ার সময় মেয়েটি গভীর চুম্বন করে, রাত্রিবাসের প্রস্তাবও দেয়। মানে, রোমান গিয়ে পড়েছিল স্বর্গোদ্যানে, যেখানে ইভ আপেল খায় এবং নির্বাসিত হয় না। পরে এই মেয়েটি রোমানের আমন্ত্রণে শহরে আসে, কিন্তু শহর তার ভাল লাগে না। তারপর আচমকা একটা কাহিনি-মোচড়ে জানা যায়, এর আগে, টাকাটা যখন প্রথম লুকোতে গিয়েছিল মোরান, সে ঘরভাড়া নিয়েছিল এদেরই কাছে, আর প্রেম করেছিল এই মেয়েটিরই সঙ্গে। কিন্তু একসময় মোরান পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য তাকে ছেড়ে চলে আসে। মোরান মেয়েটিকে ভুলতে পারেনি, তাই এখন রোমানের হাত দিয়েই চিঠি পাঠাচ্ছে, তুমি কি আমার জন্যে তিন বছর অপেক্ষা করবে? এইবার আমরা বুঝতে পারি, কেন ছবির একদম প্রথমে ব্যাংকে হইহই পড়ে গেছিল, যখন দেখা গেছিল এক গ্রাহকের সঙ্গে অন্য এক গ্রাহকের সই হুবহু মিলে যাচ্ছে। কেউ ভাবতেই পারছিল না, একটা মানুষ অন্য একটা মানুষের মতো হয়। কিন্তু মোরান রোমান সকলেই মোরনার প্রতিই অনুরক্ত হয়, তার কাছেই আনন্দ আর সার্থকতা যাচনা করে, কারণ সকলেই বদ্ধ জীবন ত্যাগ করে স্বস্তি শান্তি নির্মলতা চায়। যদিও মোরনা রোমানকে ছেড়ে চলে যায়, কারণ তার মতে মোরান অপরাধ করেছে, সে পাগল, আর রোমান সহায়তা করেছে, সে বুদ্ধু। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, সিনেমার শেষে, মোরান যখন জেল থেকে ছাড়া পায়, মোরান ও রোমান আলাদা আলাদা ভাবে ওই অঞ্চলটায় গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, (রোমান কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে আগুন জ্বালায়, আর মোরান ঘোড়ায় চড়ে ঘোরে) টাকা ভাগ করে নেওয়া ও বাকি জীবনটা সুখে কাটানোর জন্য। মোরান খোঁজ করেও মোরনা-দের বাড়িতে কাউকে দেখতে পায় না। তাদের অস্তিত্ব আর জরুরি নয়, প্রেমটা আর হবে কি না, হলে কার সঙ্গেই বা হবে, এসব কিচ্ছু জরুরি নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল: স্বাধীনতা। গুরুত্বপূর্ণ হল: নির্লোভ হওয়া। মনে রাখতে হবে, মোরান ইচ্ছে করলে আরও অনেক টাকা সরাতে পারত, কিন্তু সরিয়েছে একেবারে হিসেব করে তার ও রোমানের কর্মজীবনের মাইনের যোগফল। মানে, সে বৃহৎ বড়লোক হতে চাইছে না, শুধু একটা চলনসই জীবন বাঁচতে চাইছে, অন্য ব্যক্তি বা সংস্থার দাসত্ব না করে। ঘোড়ায় চড়ে মোরান যখন পাহাড়ি পথে ঘুরতে থাকে, তখন নেপথ্যে গান বেজে ওঠে: ‘স্বাধীনতা কোথায়? আমি সারাক্ষণ নিজেকে সেই প্রশ্নই করি। হয়তো সেটা এমন কোথাও আছে, যেখানে আমাদের যেতে হবে।’ মানে, স্বাধীনতার দিকে রওনা হতে হবে। একটা ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সেই যাত্রায় শামিল হতে হবে, শুধু বসে বসে আকাঙ্ক্ষা বুনলে চলবে না।

    এই চরিত্রেরা স্বাধীনতার স্টেশনের দিকে যেভাবে রওনা হয়েছে, তা উদ্ভট। শহর থেকে দূরে পাহাড়ি অঞ্চলে গেলেই স্বর্গ খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে প্রকৃতি আর পবিত্রতা আছে, দুঃখের পাতকুয়ো নেই— সে ভাবনাও অতিশয় স্টিরিওটাইপ। কিন্তু ছবিটা যেহেতু বাস্তব-মাফিক থাকার খুব তোয়াক্কা না করে প্রায় প্রতীকী ভাবে এগুলোকে এনে ফেলেছে, মেজাজটা মন্দ লাগে না। ছবিটায় খুব আঠা আছে, তা নয়, একটু একঘেয়ে। তবু এর শিথিল বয়নের মধ্যে আবেদন আছে। যেন, অতটা দায় নেই, কোনও কাঠামোর মধ্যেই থাকার। কৌতুক আছে, সপ্রতিভতা আছে, আবার ‘ধুর, অত চৌকাঠের তোয়াক্কা করে কে? ছাড় তো!’ শিস দেওয়া আছে। মাঝখানে বেশ অনেকক্ষণ কবিতা শোনানো হয়, জোলখানায় বসে মোরান তা একটা বই থেকে পড়তে থাকে। এই যে ‘এবার কিছুক্ষণ কবিতা শুনুন’ বলে সিনেমার দর্শককে বসিয়ে রাখা হল, বা প্রথম আধঘণ্টা ‘এটা থ্রিলার হচ্ছে মশায়’ বলে জপিয়ে, পরের কিছুক্ষণ ‘উঁহু, ইহা হইল রোমানের প্রেমকাহিনি’ বলে আগ্রহ জাগিয়ে, তারপর হঠাৎ ‘ওহো, এটা মোরানেরও প্রেমকাহিনি, একই মেয়ের সঙ্গে’ বলে ধাঁধা লাগিয়ে, আর তারপর ‘মেয়ে কোথায় গেল জানি না, কিন্তু এই দুটো শহুরে আধুনিকতার কয়েদি ছাড়া পেয়েছে এটুকুই কি ভাল নয়?’ বলে শেষ করে দেওয়া হল, এতে সিনেমার চলনেরও একটা স্বাধীনতার খোঁজ আছে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook