সুন্দরী তরুণী ধনী মেয়ে জানাল, বুড়ো গরিব নেশাড়ুর সঙ্গে প্রেম করেছে। অমনি হুলুস্থুলু প্লাস পান্ডেমোনিয়াম, শেষে মেয়ের জেদ দেখে বাপ-মা নিমরাজি, তারপর পাত্র বিয়ে করতে এল টলতে টলতে, জামাকাপড়ের অবধি ঠিক নেই। বিয়ের অনুষ্ঠান না স্ক্যান্ডালের ল্যান্ডস্কেপ! এই চিত্রনাট্যে সাধারণত যা হয়: বছর দেড়েক মেয়ে-জামাইয়ের নামটি অবধি উচ্চারণ বারণ, তারপর যেই খবর এল মেয়ের কোল জুড়ে টুকটুকে খুদে অতিথি হাত-পা ছুড়ছে এবং গাগা গ্লুগ্লু বলছে, তখন ওলেবাবালে কোথায় আমার নাতি লে নাতিন লে এবং অবিলম্বে কাট টু: জামাই পায়ের ওপর পা তুলে মাংস প্যাঁদাচ্ছে, মেয়ে সদ্যবাচ্চার প্রতি ‘একে নিয়ে আর পারি না’ মর্মে ছদ্ম-রাগ দেখাচ্ছে, দিম্মা তাকে আহা আহা বলে কোলে তুলে নিচ্ছেন, দাদাই জামাইয়ের জন্যে টি-শার্ট আর নাতনির জন্যে ডলপুতুল কিনে ঘেমেনেয়ে একসা। কিন্তু এই গল্পটা তেমন গড়াল না। মেয়ের কোলে এক এক করে চারটি ছেলেমেয়ে এল, মেয়ে বচ্ছরে একবার বাপের বাড়ি আসা নিয়ম করে ফেলল, তার অপেক্ষায় মা মেনকা কেঁদে ভাসালেন ও বাবা হিমালয় সাইলেন্ট মনখারাপ করলেন, সে এলে পাঁচদিন রোশনাই আর ‘ওর কোনও দোষ নাই’, কিন্তু জামাই কদাপি নট ওয়েলকাম। কেন? ঠিকই, তার সঙ্গে কয়েকটা চ্যালা ঘোরে যাদের চেহারা দেখলেই মনে হয় স্বভাবপত্তর সুবিধের নয়, তাছাড়া শ্বশুরবাড়ি এসেই ছাদে গিয়ে গাঁজা টানবে সে-সিনারি অস্বস্তিময়, কিন্তু তা বলে লোকটা একেবারে ব্যান? বাচ্চাগুলোরও তো বিচ্ছিরি লাগে, বাবা কখনও সঙ্গে আসে না। এখানে যে ভূরিভোজ হয়, তা তার কপালে জোটে না। সময়ের সঙ্গে সব রাগারাগিই কিছু নরম হয়ে আসে, এক সময় এমনকী হাস্যকরও মনে হয়। এখানে কোনও আঁচই জুড়োল না কেন? জামাই কখনও কাজের চেষ্টা করল না, সে অলস ও ক্যালাস, তার ওপর ভয়াবহ বদরাগি, যখন যাকে পারে দু’কথা শুনিয়ে দেয়, এইজন্য? তার চুলে জট পাকিয়ে আছে, গা দেখলে মনে হয় ছাইভস্মের মধ্যে পড়ে থাকে, প্রতিবেশীদের কাছে প্রেজেন্টেবল নয়, এইজন্য? নিজের অবস্থার জন্যে মোটে ক্ষমাপ্রার্থী নয়, বরং দেখলে মনে হয় কোনও অজানিত গর্বে চব্বিশ ঘণ্টা মটমট করছে, এজন্য?
বহু বোদ্ধা-লোক বলে, ওই জটভরা মাথাটির মধ্যে এমন তুলনাহীন চিন্তাস্রোত বয়ে যায়, মনে হবে ওখানে একটা চিরকালীন চাঁদ ফিট করা আছে, আচ্ছা আধচাঁদই সই, আর তার জ্যোৎস্নার সঙ্গে গঙ্গার তরঙ্গ মিশে এক অলৌকিক মিক্সচার কুলকুল, যা মর্তে নামলেই সর্বতাপহর, পারো যদি স্নান করো। অনেকে বলে, ও স্বরে এমন উগ্র বাণী বেরোতে পারে, যেন মনে হবে বিষধর সাপ ভোকাল কর্ড বেষ্টন করে আছে, আবার এমন গাঢ় সুরেলা নাদ তা থেকে নিঃসৃত হয়, যা শুনলে মনে হবে এ লোকটা সর্বসঙ্গীতের দেবতা, এ ডমরুর তাল রাখে, তাই মহাকাল অনর্গল প্রবাহিত হয়। তার পা টললে দেখেশুনে হিমালয়ের পাড়ার লোকেরা হেসে লুটোতে পারে বটে, কিন্তু সেই পা এমন আশ্চর্য নৃত্যের তাল ধারণ করতে পারে, যা পৃথিবীকে নিয়ত নতুন ছন্দের পাঠ দেবে। হ্যাঁ, তার ছবি পেজ-থ্রি’তে বেরোয় না, তার দোরে হত্যে দিয়ে পড়ে না কোনও প্রকাণ্ড প্রযোজক, কিন্তু বুঝতে হবে, তার শিল্পধারণা এমন যুগভাঙা ও ছকভাঙা, এমন আনকোরা ও ভিনগ্রহী, এমন বেপরোয়া ও সর্ব-অবাধ্য, তা গ্রহণ করতে গেলে যোজন-যোজন সমঝদারি চাই, তা নইলে মনে হবে এই রে অ্যাদ্দিনের সব জগদ্দল দিগন্ত গুঁড়িয়ে গেল ভাইসব, ভিত টলোমলো, ধরো ধরো সাপটে জাপটে ধরো নইলে তাবৎ মূর্তি হুড়মুড়িয়ে। সেইজন্যেই এর কোনও বস্তুগত সাফল্য নেই, তাকে করতলে বা ক্রোড়ে টেনে নেওয়ার আধারই তৈরি হয়নি আটপৌরে পানসে গণজনের, উল্টে তার তেজ দেখে সব বিস্ময়ে আকুল হয়, ত্রাহি ত্রাহি পালায়, আর কয়েকটা বোদা বিদ্রুপ দিয়ে অস্বস্তি ঢাকার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, এ-মাস গেলে বাড়িতে টাকা আনে না প্রায় কিস্যুই। বন্ধুবান্ধব মাঝেসাঝে ধরেবেঁধে কিছু দেয়, গুণমুগ্ধ কেউ নানা ছুতোয় হাতে গুঁজে পালায় সামান্য উপঢৌকন, সেগুলো নিয়ে এ-বাড়িতে এলে অনেকে ভিক্ষুক বলেও গঞ্জনা দিয়েছে। কিন্তু এ-জামাইয়ের আশ্চর্যতম গুণ, কে কী বলল, তাতে তার সামান্যতম হেলদোল ঘটে না। তাকে রাজরাজেশ্বর বললেও ঠিক আছে, ভিক্ষুনিকৃষ্ট বললেও ভুল নেই। ফেসবুকে তাকে ট্রোল করা হলে জুতসই উত্তর দেবে কী, ফেসবুকই খোলে না। এটাই বোধহয় শ্বশুর-শাশুড়ির সবচেয়ে বেশি বুকে বাজে। এমনিতে যাকে-তাকে যাচ্ছেতাই বলছে, প্রতিষ্ঠিত গ্ল্যামারবাজদের ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিচ্ছে, ওদিকে নিজেকে যারা টিটকিরি মারল তাদের ডেকে বিরিয়ানিও খাইয়ে দিতে পারে। সৃষ্টিছাড়া লোকটা তবে কি পাগল, এলোপাথাড়ি?
পার্বতীর যেটা ভাল লাগে: তার মানুষটা কোনো ছকই মানে না। তুমি অনেক ভেবেচিন্তে চারটে আঁক কষে ভাবলে এবার একে ধরেছ, কিন্তু পরের দিনেই সে এমন অন্য একটা লোক হয়ে উঠবে, তাকধাঁধা লেগে যাবে। হাঁটতে গিয়ে পায়ে সর্ষেদানা ফুটলে বা ঘাড় বেঁকিয়ে চিন্তা করার সময়ে কেউ একগোছা চাবির আওয়াজ করলে এমন প্রলয়ঙ্কর রেগে উঠবে যে সামাল দিতে সহস্র সৈন্য আনাও, আবার টানাটানির সংসার থেকে ভুল করে গুচ্ছের টাকা খোয়া গেলে তা নিয়ে হইচই তো করবেই না, বরঞ্চ কাঁচুমাচু মুখ দেখে পোয়াটাক আদরও করে দিতে পারে। ছেলেমেয়ের জন্মদিনে উপহার দেওয়ার রীতি মানে না, অ্যানিভার্সারির কথা বোধহয় একশো বছরের মধ্যে একবার মনে থাকে, বাচ্চারা ইস্কুলে কে কী রেজাল্ট করল জীবনে জিজ্ঞেস করেনি, এমনকী কেউ জ্বরে কোঁকাচ্ছে দেখে গেলে রাত্রে এসে অবধি একবার কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে না কেমন আছো, কিন্তু বাড়ির কোনও বিপদ-আপদ হলে তার এক ডাকে ছুটে আসে পাড়ার যতেক অটো-ড্রাইভার রিকশাওয়ালা সবজিওলা মাছওলা ক্লাবের-ছেলে নতুন-ব্যান্ডের-লোক রক্তদান-শিবির-উদ্যোক্তা, তারা প্রত্যেকে ওর জন্যে এখুনি বুক চিরে হৃৎপিণ্ড উপড়ে দিতে রাজি। এই লোকের ওপর রাগ করা যায়, কিন্তু অনুরাগ থামানো যায় না। কারণ এই লোকটার মতো আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেউ নেই। এ একটা লোকই না, একটা আইডিয়া, একটা ছায়াপথ, যার মধ্যে বহু দীপ্তির পুঞ্জ আর অনেক সর্বনাশের আঁধার। অনেক বড়লোক অনেক তরুণ অনেক রূপবান অনেক গুণবান দেখা আছে, কিন্তু তাদের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝে ফেলা যায়, অঃ, ত্রিভুজ কখগ। আর এর দিকে চেয়ে চেয়ে মনের আঁখি ফেরে না।
হ্যাঁ, বাপ-মা’র কাছে যাওয়ার সময় মনটা টনটন করে, তার মানুষটাকেই ওরা অবহেলা করছে, একবার ফোন করে কথা বলে না, লৌকিকতা করেও বলে না এবারটা তুমিও চলে এসো ওদের সঙ্গে, সুটকেস গোছানোর সময়ে এক-একবার মনে হয় ছুড়ে ফেলে দিই, এবার যাওয়া ক্যানসেল। কিন্তু তাকে দ্যাখো, হো-হো করে হেসে বলবে, সে কী হে, আমার এমন স্বাধীনতা তুমি ক্ষইয়ে দেবে? এই পাঁচদিন যে নন্দীদের বাড়িতেই আসতে বলে দিলাম, আবার ক্যারম টুর্নামেন্টও একটা ঠিক করে রেখেছি। প্লিজ তোমার হাত থেকে মুক্তির এমন সুযোগ কেড়ে নিও না। আর সত্যিই ধরাধরি করে সব্বাই দাবড়া একপিস ক্যারমবোর্ড দিয়ে গেল, আলোও ফিট করা হল তার ওপরে। অনেক রাত্রে ফিকফিক করে হেসে বলল, ঘুমোচ্ছ না যে, অ্যাদ্দিন পর আমায় নিয়ে এত ভাবার কী আছে? লোকটার বোধহয় কপালে একটা চোখ জ্বলজ্বলায়, যা দিয়ে মুখ পড়ে না, মন পড়ে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, শোনো, তোমার বাপ-মা যদি আমায় মেনে নিত, তাইলেই বরং হার্ট অ্যাটাক হত। এত বোদা লোকেরা আমার মূল্য বুঝে ফেলল? তবে তো কিছু গোড়ায় গলতি হয়ে গেছে। শেষে নেক-টাই না পরতে হয়। এবার আর পার্বতীর না হেসে উপায় কী, খালি গায়ে টাইয়ের বহর ভেবে? ঢাকঢোলঢ্যাঁড়ার শোরগোল দেখতে দেখতে প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, মর্তের লোকেরা উপেক্ষা করে? তাদের দেখে কাঁসরঘণ্টা বাজায়, কোমর দোলায়, হাতজোড় করে, আর যে-লোকটা পরিবারের কর্তা, যে তাদের ভ্রমণপথ চকখড়ি দিয়ে এঁকেছে, তাকে একবারও পোঁছে না? না-ই করল। ডেকে নিয়ে এসে অনাদর করা, বা না-বুঝে সমাদর করার চেয়ে তা ঢের ভাল। এদের জ্ঞানগম্যি নাহয় ছেতরে গেছে, স্মৃতিশক্তিও কি নেই? যে-লোকটা গুচ্ছের অপ্রিয় কথা চেঁচিয়ে বলে আদায় করেছে নীচুতলার মানুষের অধিকার, যে-লোকটার গলায় এখনও মারের দাগ নীল হয়ে আছে, যে-লোকটার জন্যে অমৃতের স্বাদের দিকে এরা ঢলে পড়তে পারছে বারবার, তার কথাই ভুলে থাকা যায় এত অনায়াসে? তারপরেই বুকের মধ্যে শুনতে পায় তার স্বর, ধুস, এ নিয়ে কেউ ভাবে? হাততালির জন্যে কেউ কাজ করে? তুমি তো ভোলোনি, ব্যাস, মিটে গেল। আড়চোখে চেয়ে যেন মনে হয়, চালচিত্রের ওপরদিক থেকে মিটমিট হাসছে। তাহলে কি উপেক্ষাকে কাঁচকলা দেখিয়ে সে আছে, সারাক্ষণ, পাশেই? কে জানে? পার্বতীর মনটা মিহিন ভিজে আসে। ভাবেন, রেড-টা ফেলতে পারে যেন টুর্নামেন্টের ফাইনালে, নইলে যা গাঁকগাঁক করে চেঁচাবে, বাব্বা!
ছবি এঁকেছেন দেবাশীষ দেব