থামলেই আউট
অফিসটাইমের দৌড়, বাসে ওঠা, বাস থেকে নেমে অটো, অটো থেকে আবার কিছুটা হাঁটা, সময় না থাকলে রিকশা, তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে অফিস পৌঁছে বসের কিছুটা গালিগালাজ শুনে কাজে লাগা— এরকম একটা মলিন বিরক্তিময় খিচখিচে ব্যাপার নিয়ে ছবি করা যায় না কি? আর সেই ছবিকে কি ঢেলে নেওয়া যায় থ্রিলারের মতো রুদ্ধশ্বাস ছাঁচে? ফরাসি ছবি ‘ফুল টাইম’ (চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: এরিক গ্র্যাভেল, ২০২১) দেখে অবাক হতে হয়, একেবারে প্রথম থেকে পেছনের বাজনা শুনে মনে হয় একটা থরথরে থ্রিলার হচ্ছে, কিন্তু তারপরে বোঝা যায়, একজন একা-মা’র ভোরে অ্যালার্ম বাজতেই উঠে নিজে তৈরি হয়ে, দুই বাচ্চাকে তৈরি করে, বাচ্চাদের এক প্রবীণার কাছে জমা দিয়ে, ট্রেন ধরে বাস ধরে অফিস যাওয়াটাই এটার কাহিনি, এক সাধারণ মানুষের কাছে এই জিনিসই প্রাত্যহিক একটা অ্যাডভেঞ্চার, ট্রেনটা সে দৌড়ে ধরতে পারবে, না কি সেটা তার নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যাবে— এটাই তার কাছে হিচককীয় সাসপেন্স। ছবিটায় দেখানো হয়, দেশজুড়ে বিরাট ধর্মঘট চলছে, প্যারিসে রোজই আন্দোলন মিছিল লেগে আছে (এসব বোঝানো হয় টিভির খবরের মাধ্যমে, যা বহু সময়ই বেজে চলেছে ব্যাকগ্রাউন্ডে), আর সেজন্যেই যখন-তখন যানবাহন বাতিল হয়ে যাচ্ছে। হয়তো পঞ্চাশটা ট্রেনের একটা চলছে, হয়তো চল্লিশটা বাসের দুটো। সমস্ত যাত্রীর প্রাণ ওষ্ঠাগত, কোথাও ট্রেন বলছে এই স্টেশনে নেমে যান এরপর আর যাবে না, তারপর লোকে বাসের জন্যে লাইন দিয়েছে কিন্তু কোন বাস কোথায় যাবে কেউ জানে না কোনও ঘোষণা নেই, রাস্তায় শয়ে শয়ে লোক দাঁড়িয়ে, নায়িকা কখনও কোনও গাড়ির কাছে লিফট নিচ্ছে, কখনও গাড়ি ভাড়া করছে, কখনও ট্যাক্সি পাচ্ছে, কখনও হেঁটে-দৌড়ে কিছুটা যাওয়ার চেষ্টা করছে। এদিকে সে কাজ করে একটা হোটেলে, সেখানে দেরিতে পৌঁছনোর প্রশ্নই ওঠে না, কারণ সে-ই ঘরগুলোকে অতিথির জন্য প্রস্তুত রাখার বন্দোবস্তের প্রধান দায়িত্বে। সে পড়েছিল অবশ্য অর্থনীতি, এখন একটা সেই-সংক্রান্ত কাজের জন্য ইন্টারভিউও দেবে ভেবেছে, কিন্তু ডিউটি ছেড়ে ইন্টারভিউতে যাবে কী করে? কাউকে একটা বলে যায়, একটু ম্যানেজ করে নিস, কিন্তু তা ধরা পড়ে যায়, এবং কর্ত্রী ডেকে কড়া ধমক দেন, আমি শুনছি তুমি চাকরি খুঁজছ, এদিকে অফিসে আসতেও তো দেরি হচ্ছে। সে বলে, স্ট্রাইক চললে আমি কী করব? কিন্তু কে সে-কথা শুনবে? প্যারিসে থাকলে হয়তো অনেকটা সুবিধে হত, কিন্তু সে থাকে বেশ দূরে, তার মনে হয় ঘিঞ্জি শহরের তুলনায় খোলামেলা জায়গায় বরং ছেলেমেয়ে মানুষ হবে ভাল। তার দেরি হলে যাকে তার কাজ করে দিতে হয়, সেই সহকর্মীও বাজে ব্যবহার করছে। আবার যে-প্রবীণা তার ছেলেমেয়েদের দেখেন, তিনি বলছেন, রোজ এত দেরি করে ফিরছ! অতক্ষণ আমি ওদের রাখতে পারব না, ছেলেটাও সন্ধের পর থেকে খুব দুরন্তপনা করে, আমার মেয়ে বলেছে মা তুমি এই বয়সে এত ঝামেলা ঘাড়ে নিও না। তুমি বাপু অন্য কাউকে দেখে নাও। নায়িকা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, আমি কী করব। আমার তো কোনও উপায় নেই। তার ডিভোর্স হয়ে গেছে, স্বামীকে প্রাপ্য খোরপোশের জন্য যতবারই ফোন করে, ফোন বলে ভয়েস মেসেজ দাও। সে ছবিজুড়ে বারবার বলে, সংসার চলছে না টাকা পাঠাও, কিন্তু কোনও উত্তর আসে না। অর্থকষ্ট, নিজের গুণপনার সঙ্গে বিযুক্ত চাকরি করা— তা বিচ্ছিরি লাগা, বাচ্চাগুলোকে সময় না দিতে পারার অপরাধবোধ, প্রবীণা সত্যিই আপত্তি জানালে তাদের কার কাছে রেখে যাওয়া যাবে সে বিষয়ে কোনও ধারণাই না থাকা, এবং নতুন চাকরিটা হবে কি না তার অনিশ্চয়তা— এত গন্ডগোলের মধ্যে এসে পড়েছে এই স্ট্রাইক, যার ফলে প্রতিদিন শহরে যাওয়া এবং সেখান থেকে আসাটাই একটা মহাকাব্যিক সংগ্রাম।
সব মিলিয়ে নায়িকা একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে, সে দুঃস্বপ্ন দ্যাখে জলে ডুবে যাচ্ছে, তার দম বন্ধ হয়ে আসে। প্রচুর ছোট ছোট শট ও দৃশ্যে ছবিটাকে ভেঙে নেওয়া, এবং সরাসরি একটা ‘chase’-এর আবহসংগীত মাঝেমাঝে মন্তাজের পিছনে লাগিয়ে দেওয়া— এই অস্ত্রগুলো কাজে লাগিয়ে স্রষ্টারা পুরো ছবিটাকেই একটা টানা দৌড়-এর তারে বেঁধে দিয়েছেন। নায়িকা যখন ঘুমোয়, আর তারপরেই অ্যালার্ম বেজে ওঠে, আমাদেরও যেন একটা আতঙ্ক তৈরি হয়, এই রে, আবার তো শুরু হয়ে গেল দিন, আজকে কী করে ট্রেন পাওয়া যাবে? আজ আবার লেট হবে না তো? অ্যালার্মের আওয়াজ যে নাগরিক জীবনে কতটা আতঙ্ক-ধ্বনি, কী ভয়াল ঘোষণা তার মধ্যে গর্জাচ্ছে— ফের তোমাকে জুতে যেতে হবে এক অনিচ্ছা-অধ্যুষিত ক্লান্তিময় স্রোতে, যেখানে শুধু দায়িত্ব আছে কর্তব্য আছে লোকে তোমার কোথায় ভুল হল দেখার জন্য চোখ রাঙিয়ে আছে, আর কোত্থাও এতটুকু ক্ষমা নেই প্রশ্রয় নেই সজলতা নেই— সেই কথাটা এ-ছবি বারবার বলে, ছবি শুরুই হয় একটা গাঢ় ঘুমের শ্বাসের শব্দ দিয়ে আর অ্যালার্মে তা ভেঙে যাওয়া দিয়ে। নায়িকা কিন্তু এই জীবন নিয়ে, তাড়া নিয়ে, ছুট নিয়ে খুব বিলাপ করে না। সত্যি বলতে তার বিলাপ করার সময়ও নেই। আলাপ করারও নেই। একদিন এক বান্ধবীর বাড়ি থেকে সে ছেলেমেয়েদের আনতে যায় (প্রবীণা সেইখানে ওদের দিয়ে, নিজের মেয়ের সঙ্গে তার বাড়ি চলে গেছিলেন), সেখানে পার্টি হচ্ছে, বন্ধু বারবার বলে একটু থাক না, মদ খা, একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, তোর ভাল লাগবে। কিন্তু নায়িকা বলে, কিচ্ছু করতে হবে না, ওদের দিয়ে দে, বাড়ি চলে যাই। যদিও একজনের সঙ্গে তার সামান্য অনুরাগ হয়েছিল, সে নায়িকাকে গাড়িতে লিফট দিয়েছিল, পরে দেখা যায় তার ছেলেও নায়িকার ছেলের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। লোকটি নায়িকাকে খুব সাহায্য করে, নায়িকা তাকে নিভৃতে একটা চুমুও খায়, কিন্তু লোকটির দিক থেকে কোনও সাড়া মেলে না।
ইন্টারভিউটা দিয়ে নায়িকা পরের ধাপের ইন্টারভিউতে নির্বাচিত হয়, সেটাও দেয়, কিন্তু যেদিন জানানো হবে বলা হয়েছিল, সেদিন তার কোনও ফোন আসে না। পরের দিনও না। ধীরে ধীরে তাকে সংকট একেবারে চেপে ধরে, সে যখন একটা গাড়িতে লিফট নিয়ে যেতে যেতে প্যারিসের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধোঁয়া উঠতে দ্যাখে (আগুন জ্বলছে আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে), বোধহয় তার নিজের জীবনের দহনের কথাই মনে হয়। এক-আধবার সে রেগে যায়, যখন কিছুতেই গাড়ি না পেয়ে সে বোঝে হয়তো রাতটা তাকে প্যারিসেই থেকে যেতে হবে। বা, যখন তার পয়সার ভাঁড়ার প্রায় শূন্যে ঠেকেছে, সে দুশ্চিন্তায় ফুটছে, আর বাচ্চারা হুটোপাটি করছে। কিন্তু বাকি সময় তার মুখে একটা সর্বকালীন উদ্বেগ ছাড়া আর কোনও আবেগই দেখা যায় না। ছোট্ট বাচ্চাটা ট্র্যাম্পোলিনে লাফাতে গিয়ে পড়ে যখন হাত ভেঙে ফ্যালে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, পরের দিন সকালে মুখে মেক-আপ লাগাতে লাগাতে নায়িকাকে কাঁদতে দেখা যায়। তারপর আবার দৌড়, আক্ষরিক অর্থে প্যারিসের এরাস্তা-ওরাস্তা দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে। তারপর আরও ঝামেলা। আজকের এক গড় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন যে একটা টানা আর্তনাদ বই আর কিছু নয়, এ-ছবিটা সে-কথাটাকে অবয়ব দেয়। যে-ব্যাপারগুলোকে আমরা ‘ও তো হবেই’, ‘সেটা তো জীবনে আছেই’ বলে ধরে নিই, তা যে একটু রেগুলেটর এধার-ওধার ঘোরালেই প্রাণান্তকর হয়ে উঠতে পারে, সেই সহজবোধ্য কিন্তু মনে-না-আসা কথাটা ধাঁ করে উন্মুক্ত করে দেয়। আমাদের অনেকের, বহু কর্মীর, জীবনের গোটা সময়টাই যে শুধু রোজগার করতেই ব্যয় হয়ে যায়, বাৎসল্যের অবকাশ অবধি থাকে না, অফিসের দূরত্বের মতো নীরস কেজো ব্যাপার যে মানুষের নৈকট্যের বীজেই ছাই ঢেলে দেয়, সেই গণিত সামনে ফেলে দেয়।
সিনেমা কতরকম ক্রাইসিসকে ঘিরে হয়, কিন্তু কোনও ছবিই বোধহয় এর আগে অফিসযাত্রাকে এভাবে প্রোটাগনিস্টের মূল ক্রাইসিস হিসেবে উপস্থাপিত করেনি। শুধু যানবাহনের অনিশ্চয়তার ফলে যে একটা লোকের জীবনটা তছনছ হয়ে যেতে পারে, এভাবে আমরা ভাবি না। নায়িকাকে শুধু এই সিস্টেমের সরলা ভিকটিম হিসেবে দেখানো হয়নি, নায়িকা হোটেলে একজন নবাগতা কর্মীকে বলে যায় তুমি আমার কার্ডটা বেরোবার সময় পাঞ্চ করে দিও, কিন্তু ধরা পড়ার পর ওই কর্মীর চাকরি যায়। তারও দুটো সন্তান, সেও একা-মা। কিন্তু তাকেই সাহায্য করতে গিয়ে তারই মতো একজনের সর্বনাশ হল, একথা শুনে নায়িকার কোনও হেলদোল দেখা যায় না। আবার এই যে এতবড় একটা স্ট্রাইক চলছে, সেই স্ট্রাইকের সে পক্ষে না বিপক্ষে, তা নিয়ে গোটা ছবিতে একটাও কথা নেই, ইঙ্গিতও তেমন নেই। বোধহয় তার সমবেদনা বা সচেতনতা দেখানোর অবকাশ নেই, হয়তো অনবরত দৌড় তাকে শুকিয়ে দিয়েছে, অথবা সে খুব ভাল লোক নয়। কিন্তু তার মুহূর্তগুলো যেভাবে চলে, তার থিমটা হল: ওসব ভাল-খারাপ পরে হবে ভাই, যেভাবে হোক আগে টিকে থাকতে হবে। আর বাচ্চাগুলোকে বুঝতে দেওয়া যাবে না, দোকান যাওয়ারও টাকা নেই, ভাঁড় ভেঙে (পিগি ব্যাংক) শেষ সম্বল বের করতে হয়েছে। কান্নাকাটি, নিজের ছায়ায় বসে নিজের সঙ্গে কথা বলা, দীর্ঘশ্বাসের গিঁট পাকানো, ওসব শৌখিন শখ চুলোয় যাক। সমস্যাগুলো এত চেনা, চমকে উঠে মনে হয়, আমি যে একটা ছবি দেখার সময় পাই, বা ওয়েব সিরিজ, এবং তা নিয়ে বসে বসে ভাবতে পারি, সেটা কত বড় বাড়তি পাওনা, হিসেব করেছি কি?