গিফ্ট
সাহেবপাড়ায় বরাবরই বেশ লাগে। না আছে গোরা, না আছে তার ঘোড়া। সে নিজেই নেই। তা সত্ত্বেও, আছে ভাবলে মনে ফুর্তি হয়। পুরনোর একটা নিশ্চিন্ত, স্বার্থহীন আরাম আছে, শুধু ওইজন্যই নিউ মার্কেট আমার এত পছন্দের। সুযোগ পেলে চলে যাই। হাঁটতে শুরু করি পার্ক স্ট্রিট থেকে। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢুকে প্রথমে সেই অভিজাত রেস্তোরাঁ। ভেতরে গোল বলের মতো হলুদ আলোর নীচে সবাই ক্ষণিকের জন্য হলেও কন্টিনেন্টাল। লাঞ্চ-ডিনার স্লো-মোশনে। দেখা যায়। বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। কে যেন একবার আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। প্রন ককটেল শুনে ভেবেছিলাম মদে চোবানো চিংড়ি। মোটেই না। ওয়াইন গ্লাসে সার্ভ করা গোলাপি মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম। অবাক একটা ব্যাপার। কিছু পরে আর একটা দোকান, যেখানে ভারি সুন্দর লেসের কাজ, নরম জামা, চাদর, এমব্রয়ডারি করা ফ্যাব্রিক, টেবল রানার, টি-কোজি পাওয়া যায়। এরপর ছিল ডানলপের আপিস। উঠে গেছে। পরের দেওয়ালে একটা ভাতের হোটেল। অমন হলুদ আলুভাজা আর কেউ করে না। একটু এগোলে ব্রাগাঞ্জা। গ্র্যান্ড পিয়ানো। কটেজও পাওয়া যায়। ভাড়াতেও দেয়। একবার ঢুকেছিলাম। একটা স্ট্র্যাটোক্যাস্টার গিটারের তারে হাত বুলিয়েছিলাম। ভাবখানা হল, আসলে তো আমি পারি। ভানু গুপ্ত অথবা এরিক ক্ল্যাপটনের মতো। এর একটু পরে বাঁ-দিকের গলিতে যমুনার বিফ রোল। মেন রাস্তায় একই রকম আর একটা দোকান। পাশে নির্বিঘ্নে শাকাহারি। ওই কলিন লেন চলে গেল রফি আহমেদ কিদোয়াই-এর দিকে। এক কোণে চোখ পিট-পিট করছে খশ, ভিনিসিয়ান ব্লাইন্ডের দোকান। স্কোয়ারফুটে দাম। দেখলেই মন ঠান্ডা। এদিকে ‘স্যাভিল রো’, উত্তমকুমারের স্যুট বানাত ওরা। শুনেছি। এরপর বাংলাদেশি খাবারের দোকান। কিছু লজ, ট্রেন-প্লেনের টিকিট বুকিং, মানি চেঞ্জার, বুদ্ধের চোখ আঁকা ফ্রি টিবেট টি-শার্ট। লন্ডন নয়। প্যারিসও না। কলকাতার মিনি কাঠমান্ডু। কান খোলা থাকলে বাংলাদেশি বাংলা। রিকশায় ফিরিঙ্গি পিসিমা। ডিংকাচিকা অটো। কিছুই সাহেবি নয়। কিন্তু, ওই আর কি!
ফায়ার ব্রিগেডের উল্টোদিকে সারা বছর ক্রিসমাসের সাজসজ্জার ঠেক। ফুটপাথের সিমেন্টে নিশ্চিন্ত ফার গাছ। বাড়েও না, শুকিয়েও যায় না। পুরনো বইয়ের দোকান। আড়চোখে দেখি। ‘প্লে-বয়’, ‘পেন্টহাউস’ রাখে ওরা, জানি। তবে বাইরে নয়। পুরনো যদিও। তা হোক না! একজন কিনে খুব ঠকেছিল। ছবি কাটা ছিল। আমি সস্তায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিনতাম। ভিনাইল রেকর্ডের দোকানে পৌঁছে রেকর্ডের জ্যাকেটগুলোর মধ্যে আঙুল চালাতাম নিবিষ্টমনে। ওখানে কত যে সুর! আর এত-এত গান। বেজায় সস্তায় হট অগাস্ট নাইটের ডবল অ্যালব্যাম, ডি ভি পালুসকার ওখানেই পেয়েছিলাম। এর পাশে দেওয়ালের ফাটলের চেয়ে সামান্য চওড়া ক্যালমানের হাঙ্গেরিয়ান পর্ক সসেজের দোকান। এখন আর নেই। নিউ মার্কেটের দিকে ঘোরার আগে ক্যাথলিনের কেক। কিছু কিনতাম না যদিও। বাবর আলির পাশের গলিতে অনেক কম দামে, ময়দার সঙ্গে প্লাইউডের গুঁড়ো মেশানো বেকারি বিস্কুট, গরম প্যাটিস পাওয়া যায়, জানা ছিল। অথচ ক্যাথলিনের কাচের উইন্ডোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম অনেকটা সময় ধরে। ভেতরে শো-কেসের মধ্যে যা যা থাকত, তা আবছা চোখে পড়ত। জবরদস্ত এসি ছাড়া ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক বাঁচে না। জাস্ট দেখে যেতাম। আক্ষেপ হত না। কালীপুজো পেরোলে বাবা কি ফিলিপস-এর কেক আনত না? ধার-বরাবর বিনুনি করা মাছের কচুরি বাড়িতে হত বইকি! এমন অজস্র না পাওয়ার এবং পাওয়ার মজায় মজে ছিলাম অনেকগুলো বছর। এটা কলকাতার রাস্তা নয়। দিবা স্বপ্নের অন্য কোনো সানসেট বুলেভার্ড।
একদিন যাচ্ছি ওখান দিয়ে। দেখি কোটপ্যান্ট পরা একটা লোক ঢুকেছে ক্যাথলিনে। দোকানের মধ্যে পায়চারি করছে। এমন অনেককে চিনি যারা বিভিন্ন কারণে গরমকালেও এমন জামা পরে। লোকটাকে দেখে মনে হল চিনি। ঢুকে পড়লাম দোকানে। আমাকে দেখে সে বলল, ‘এই দামে জার্মানিতে অসম্ভব।’ আমি কনফিউজড। ‘কী নিই বলো তো!’ উনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। তার মানে আমিও ওঁকে চিনি। ‘নো ওরিস, পারপাসটা বলুন।’ ‘বার্থ ডে।’ ‘কার?’ ‘নাম? ভুলে গেছি। জন্মেছে অনেক বছর হল, এবারে শুনলাম। আমারই দোষ। ইন্ডিয়াতে এসেছি আফটার আ ভেরি লং টাইম।’ পরিস্থিতিটা কব্জা করে নিলাম। ‘ওক্কে, এ ভাই, হ্যাপ্পি বার্থ ডে লিখে দাও। হ্যাঁ লার্জ। থিক ক্রিম। ওপরে সলিড হোয়াইট ফুল-ফুল গুড়-বাতাসা ডিজাইন। মাস্ট রাইজ ওভার দ্য মেইন কেক। মোমবাতি আলাদা।’ ‘হ্যাঁ স্যার।’ এই টাফ কাজটা স্টাইলে করে ফেললাম। একটা মুশকিল হল। উনি পেমেন্ট করতে পারছেন না। কোনও কারণে ওঁর কার্ড রিড করছে না। খুব সপ্রতিভভাবে বললাম, ‘আমি দিচ্ছি, লাকি, আমার কাছে ক্যাশ আছে, পরে দিয়ে দেবেন। তারপর? জার্মানিতে ইউরোর কী হাল?’ মুখচোখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, এই ঘটনায় উনি ভীষণ কৃতজ্ঞ। ইম্প্রেসড। আমি এসে পড়ায় ওঁর খুবই সুবিধে হয়েছে। তাড়া নেই। ক্রিমের আলপনা দিতে সময় লাগবে। এই সময়টা আমার কাছে ক্রুশিয়াল। আমি অলমোস্ট নিশ্চিত, উনি সেই লোক। যিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট নয়, বলবে ফ্র্যাঙ্কফার্ট।’ মনে আছে কী করে?
‘নিউ মার্কেট কি আছে এখনও?’ শুনে উৎসাহ নিয়ে বললাম, ‘যাবেন?’ রাজি হয়ে গেলেন। আগের সেই গ্ল্যামার নেই, ওইসব আক্ষেপ না করে বরং যা যা আছে, যেমন চাম্বালামা, নস্কর, নাহোউম, এ জনসন, এ বোস ফ্লোরিস্ট, আমার চেনা জায়গাগুলো দেখালাম। যখন বললাম যে এখানকার দোকানদারদের একটা অন্যরকম ইজ্জত আছে, এরা পেঁচো ব্যবসায়ী নয়, উচ্চ মান-সঠিক দাম, সহমত হলেন। ঘুরতে-ঘুরতে, গল্প করতে-করতে জানবাজারের সিদ্ধেশ্বরীর ভাতের হোটেল দেখে রিমলেস চশমা খুলে চোখ মুছলেন। নিশ্চয়ই অনেক কথা মনে পড়ে গেছে ওঁর। আসার সময়ে ওঁকে কেউ এ-পাড়ায় ড্রপ করে দিয়ে গেছে। কী করে ফিরবেন বুঝতে পারছেন না। ঠিক করলাম আমি নিজে পৌঁছে দিয়ে আসব। আসলে এই পরিস্থিতির কল্যাণে প্রাপ্ত সুপিরিওরিটিটা উপভোগ করছিলাম। জার্মানি থেকে আসা লোককে কলকাতার লোক লিফ্ট দিতেই পারে। সুভাষকে কি হিটলার দেননি? আশেপাশে টুকটাক আরও কীসব কিনলেন। কেকের দোকানে ফিরে, পেমেন্ট মিটিয়ে, বাক্সটা নিয়ে ট্যাক্সি ধরলাম। ওঁর হাতে একটা বড় প্লাস্টিকের ব্যাগ। ‘জার্মানিতে একে বলে টুটে।’ দরজার লেখা দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রিফিউজাল ট্যাক্সির সঙ্গে এর কী তফাত?’ বললাম, ‘ভাড়া বেশি। ননস্টপ যাবে।’ বিশ্বাস করলেন। এই হল সাহেব। একের পর এক উপকার করতে পেরে খুব গর্ব বোধ করছিলাম। আমরা যাব ভবানীপুরে। ‘ক্যাম্যাক স্ট্রিট ধরবেন।’
রাস্তা একটু গুলিয়ে ফেললেও শেষপর্যন্ত ঠিক বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। উনি বললেন, ‘আজ ভাই তোমাকেও ইনভাইট করলাম।’ এই রে! অচেনা লোকের বাড়িতে আমি আবার কেন? ‘না না, জার্মানিতে আমরা হিউম্যান রাইটসের ওপর খুব জোর দিই, এসো এসো।’ এই অবস্থায় আমার সন্দেহ হচ্ছিল, আমি কি ওঁকে সত্যিই ঠিক চিনেছি? আবার, উনি যে জার্মানিতে থাকেন, তা জানলাম কী করে? উনিও তো আমার সঙ্গে চেনা লোকের মতোই কথা বললেন। আচ্ছা যা হয় হবে! পরে মনে পড়বে। বাড়িতে ঢুকে ড্রইংরুমে পৌঁছে দেখি জন্মদিনের সাজসজ্জা প্রায় শেষ। অনেকে এসে পড়েছে। ‘এসে গেছে, এসে গেছে।’ সবাই ওঁকে ঘিরে ধরল। আমার সম্পর্কে উচ্ছসিত হয়ে কী বলছিলেন শুনতে পেলাম না। তবে, ওখানে কিছুক্ষণ থাকার একটা কারণ তৈরি হল। আমি এক কোণে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কেটে পড়ব, এখন আর সে-উপায় নেই। সাদামাটা চেহারার একজন এসে কেকটা নিয়ে গেলেন। এদিক-ওদিক যাচ্ছেন, আসছেন। আমাকে বললেন, ‘বহুত ঝামেলা হয়ে গেছে।’ ঘর সাজানোর কাজটা উনিই করছিলেন। কী আর বলি! ঘরে নানারকম লাল-নীল কাগজ, চকমকে ঝুরি, ফানুস, বেলুন লাগাচ্ছেন। আমিও সাহায্য করতে লেগে গেলাম। কাজটা ঝটপট নেমে গেল। বুঝলাম ওঁর ছেলেরই জন্মদিন। একটু সাজগোজের সময়ও মেলেনি। আর হাসিখুশি যে-মহিলা সবার সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে গল্প করছেন, তিনি ছেলের মা। আমাকে বললেন, ‘আপনি তো আমাদের ফ্যামিলিরই একজন।’ অতিথিদের মধ্যে নানা বয়সের বাচ্চা আছে। দুরন্তপনা করছে। দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অল্প বকাঝকা করা হচ্ছে। ওদের নজর সিলিং থেকে ঝোলানো কাগজের বলের দিকে। ঠিক সময়ে ওটা ফাটানো হবে। অত্যাশ্চর্য অনেক কিছু পড়বে নিশ্চয়ই। এখনই সেটা হোক, ওদের দাবি। আমি কায়দা করে তাদের নিরস্ত করলাম।
জার্মানি থেকে এসেছেন বলে কথা, একটা এক্সট্রা সম্ভ্রম আছে। উনি সেই টুটে হাতে নিয়ে ঘরের মধ্যমণি হয়ে সবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সবই জার্মানি সংক্রান্ত। ওই বয়েসের আর একজন এলেন। পরিস্থিতি দেখে ইংল্যান্ডের কথা বলতে লাগলেন সবাইকে ডেকে-ডেকে। একজন, বুঝলাম সে হল বার্থ ডে বয়ের কাকা, খোঁচর টাইপ, কাঠি করা ক্যারেক্টার, বলল, ‘তুমি তো বিলেতফেরত। তা তুমি নিজেই ফিরেছিলে? না কি তোমাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল?’ রসিকতাটা একদম পছন্দ করলেন না উনি। মানভঞ্জনও করা হল। ‘বিলেত মানে কিন্তু ইউ.কে., ওনলি ইংল্যান্ড, নো আদার কান্ট্রি। জার্মানিও না। ঠিক যেমন নেপাল নয়। নেদারল্যান্ডও নয়।’ দ্বিতীয় সাহেব খুশি হলেন। এসবের মধ্যে আমি ঢুকিনি। উচিতও নয়। বাচ্চাদের সঙ্গে এটা-সেটা করছিলাম। কানে এল, জার্মানি বলছেন, ‘আমাদের ওখানকার লোকগুলো একদম বাজে। খালি কাজ করে। আর কিছু জানে না।’ পট করে একজন বলল, ‘কী খায়?’ ‘কিস্যু খায় না। একটা দামড়া মাংসের সঙ্গে এক খাবলা আলুসেদ্ধ, আর মাকোম, ব্যাস।’ বলে কী! এটাও ভাবলাম, দেশটা যুদ্ধে ধুলো হয়ে গিয়েছিল, আজ আবার দুনিয়া দাপাচ্ছে। মনে পড়ল, এই লোক অনেকদিন আগে আমাকে বলেছিলেন, কোথায়, এখনও মনে পড়ছে না, অল্প বয়সে পয়সা জমিয়ে ওদেশে চলে গিয়েছিলেন। লেট ফিফটিজে। লেবার হিসেবে। তখন জার্মানির লোক চাই। ওখানেই সেটল করে গেলেন। ওঁর ‘ভি-ডবলু বিটল’ আছে। থাকেন ডুসেলডর্ফে। দুর্গাপুজো হয়। পুরোহিতের কাজ করেন। শান্তির জল ছিটোন রাইন নদী থেকে এনে। ইংল্যান্ড তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। জার্মানি থামছেন না। রিভলভিং পেডেস্টাল ফ্যানের মতো সবার দিকে ঘুরে-ঘুরে বলে যাচ্ছেন। দেশটা যে সর্বশ্রেষ্ঠ, সব ব্যাপারে, সে-কথাই। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। মুগ্ধ হয়ে শুনছে সবাই। বা শোনার ভান করছে। একটা ব্যাপার থেকেই যায়। প্রবাসীরা এলে কিছু না কিছু গিফ্ট জুটে যেতে পারে, এমন আশা প্রায় সবাই করে। আমার মা-কে কে যেন একটা পুটকে সেন্টের শিশি এনে দিয়েছিল, যা প্রাণে ধরে কোনোদিন ব্যবহার করেনি। বাবা বলেছিল, ‘এত আদিখ্যেতার কী আছে? প্লেনে ফ্রি দেয়, আর এরা যত পারে নিয়ে এসে বিলোয়…’ ব্যাস, বাবার সঙ্গে মায়ের ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল।
খোকার সেই কাকা এবারে জার্মানিকে ধরল। ‘খবর পাচ্ছি চারদিকে এখন কুখ্যাত এস.এস. অফিসাররা ধরা পড়ছে, যেগুলো এখনও মরেনি, তাদের নাজি-র বিচার চলছে, তা তোমার কী মত? ইজ ইট ফেয়ার?’ যেন শুনতে পাননি, উত্তর এড়িয়ে গেলেন। কাকা আমাকে বলল, ‘মালটা বড়-বড় বাতেলা করছে এখন। জানেন কী করেছে?’ আজকের প্রধান আকর্ষণকে নিয়ে কথা হচ্ছে। উত্তেজক খবরের গন্ধ পেয়ে চোখ নাচালাম। ‘আমরা কিছু জানি না, বলেওনি, দুনিয়ার লোককে ইনভাইট করেছে এখানে। তারা জার্মান দেখবে, খ্যাটোন হবে, কার অপোগণ্ড ছেলে বার্লিনে পড়তে চায়, তার থাকার ধান্দা করবে, সব এসে জুটেছে। বাড়ি তো আমাদের, এত ব্যবস্থা তো আমাদেরই করতে হচ্ছে। দাদার পক্ষে এটা বড় খরচ। আমরা চাই কি না, সেটা অবধি জিজ্ঞেস করেনি। এক্কেরে বার্লিনের বিভীষিকা।’ আমি খুবই সংকুচিত হয়ে বললাম, ‘আমি কিন্তু আসতে চাইনি।’ ‘না না, আপনাকে বলিনি…’ এসবের মধ্যে একটা ঘোষণা শোনা গেল। ‘আচ্ছা, এবারে সবাই এখানে আসবে। এইবারে হ্যাপি বাড্ডে হবে। সবাই এসো। গোল হয়ে দাঁড়াও।’ ‘শুরু হয়ে গেছে হিটলারি’, কাকা মন্তব্য করল। ছেলের বাবা গম্ভীর মুখে সেই কেক এনে রাখলেন। মা তার ওপর মোমবাতিগুলো পুঁতে দিলেন। ছেলে হাসি-হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়াল। আজ তারই দিন। ‘নাইফ কই? কেক কাটার নাইফ?’ এ-বাড়িতে ছুরি ব্যবহার হয় বলে মনে হয় না। ‘বঁটি দিয়ে, বঁটি!’ কাকা ফের সিন করছে। এই ডামাডোলের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্টু বাচ্চাটা সেই টুটের মধ্যে হাত গলিয়ে দিয়েছিল। আন্দাজ করেছিল, নিশ্চয়ই ভাল কিছু আছে ওখানে। সময়মতো আমি তাকে সরিয়ে আনলাম। ছোটদের মা-রা নজর রাখছিল। তারা যেন অসভ্যতা না করে। বেফাঁস কিছু বলে না ফেলে। ফিসফিস করে তাদের বলা হচ্ছিল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ বলবে কিন্তু।’ সবাই জানে যে আজকের পার্টিটা অন্য লেভেলের। যার জন্মদিন, সে বুঝে গেছে, আজ তার জন্য অপেক্ষা করছে জার্মানির গিফ্ট। এদিকে ইংল্যান্ড বের করল একটা দারুণ দেখতে লাইটার। চারপাশে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘জিপ্পো। পেট্রল। অরিজিনাল।’ ফ্যাস করে জ্বালল। সব ক’টা মোমবাতি ঝলমল করে উঠল। উপস্থিত সবার মুখে ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপিয়ান গোলাপি আভা। ‘সাইলেন্স, সাইলেন্স, এবারে সবাই একসঙ্গে বলবে, রেডি?’ রেডি তো বটেই। মুখ তো শুকিয়ে গেছে ছোটদের। তারপর বোমার মতো জার্মান হুংকার, ‘অ্যালেস গুটেজ জুমগে বুর্তস্ট্যাখ!’
এসব কী? ঘাবড়ে গিয়ে একটা বাচ্চা, আগুনের পরশমণি গেয়ে ফেলেছিল, ‘শিট!’ প্রায় টুঁটি চিপে থামিয়ে দেওয়া হল। কাকা বাংলায় ‘হ্যাপি বাঁড ডে হু হু’ জাতীয় কিছু বলে চ্যানেল ঘুরিয়ে দিল। লাঠি দিয়ে ঝোলানো বল ফাটিয়ে দিতে কুচো কাগজ, রাংতা পড়ল একগাদা। পতিত সব কিছু সর্বাঙ্গে মেখে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল কেকের ওপর। এদিকে, যার জন্মদিন, তার আগেই অন্যরা ফু ফা করে সব মোমবাতি এলোপাথাড়ি নিভিয়ে দিয়েছে। ভয়ংকর অপমান। ভ্যাক করে কেঁদে ফেলেছে সে। সাইরেনের মতো বাড়ছে কান্না। ওদিকে বুর্তস্ট্যাখ যেই না বলেছে, ‘আচ্ছা, সব বাচ্চা লাইন করে দাঁড়াও, ওয়ান লাইন, সবাইকে গিফ্ট দেওয়া হবে।’ অমনি চোখ রগড়ে সে আবার মুডে ফিরে এসেছে। সবার আগে সেই যাবে। আমাদের অভব্য দেশ। এখানে এসব হয় না। বিলেতে সবাইকে গিফ্ট দেওয়া হয়। ওই টুটে ব্যাগের মধ্যেই আছে সব কিছু। লাইনে একটু হুড়োহুড়ি, গোঁতাগুঁতি হচ্ছিল। এর মধ্যে ছেলের মা চারপাশ দেখে হিসেবে করে কেক কেটেছে। অনেক লোক। চিলি চিকেন সাইজের টুকরো হয়েছে। ঝঞ্ঝাটের কাজ। চকোলেট আর ক্রিমের গুলো বাচ্চাদের জন্য। ওপরের রংচঙে, কটকটে, মিষ্টি কীসব, লাল করমচা… খামচে লুঠের চেষ্টা হচ্ছিল। অনেক বাচ্চা একটা খেয়ে আরও বাগাতে চায়। জার্মানির কিন্তু কড়া নজর। আটকে দিয়েছেন। বাধা পেয়ে রেগে লাল হয়ে এরা নিজেদের, অন্যদের মুখে, জামায় যা পেয়েছে তাই মাখিয়ে নরক গুলজার করছে। স্পেশাল গেস্টের উপস্থিতিতে বাবা মা-রা বেধড়ক পেটাই, কানমলা, কিছুই না দিয়ে শিশুখেলা দেখছে টিভি সিরিয়াল ভেবে। একটা বাচ্চা মেঝেতে ছড়ানো রাংতাগুলো থেকে একটা তুলে ক্রিম মাখিয়ে খাওয়ার তাল করছে। আরও অনেক কাণ্ড হতে পারত। গিফ্ট দেওয়ার ব্যাপারটা এসে যাওয়ায় সবাই চুপ করে দাঁড়াল। ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প না কি?’ সেই কাকা আছে, ভিসুভিয়াস হবে-হবে করছে। আমি প্রত্যেক বাবা-মা’কে নজরে রাখছি। যাদের ছানারা আজ অসভ্যতা করেছে, বাড়ি ফেরার পর তাদের কপালে দুর্গতি আছে। একজন চাপা স্বরে তার বউকে বলল, ‘এত লোক বলেছে? বাব্বাহ!’ কম বললে, বড়দেরও গিফ্ট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। চোখ যতই আল্পস পেরোনো পাখির ছদ্মদৃষ্টি হোক, গিভ অ্যান্ড টেকের দুনিয়া। বাচ্চারা লোভ লুকোতে পারে না। পাশের ঘর থেকে ভাজাভুজির গন্ধ আসছে। খাবারের তোড়জোড় চলছে। সাহায্য করতে কয়েকজন মা সেখানে ঢুকেছে। খাবার সাজিয়ে হাতে-হাতে দেওয়া হবে। একজন সম্ভাব্য পরিমাণ আন্দাজ করে বলল, ‘নো ড্রিঙ্কস, নট ইভেন লিমকা’, আর একজন, ‘এহ্, হাই টি। রাতে অনলাইন কিছু আনিয়ে নিও।’
এক নম্বর প্রাপক এগোল। ছেলেটা অদ্ভুত ভাবে হাঁটছে। কুচকাওয়াজের জাঁতাকলে পড়ে গেছে বেচারা। জার্মান জেঠু বললেন, ‘এই নাও তোমার গিফ্ট।’ টুটে থেকে খুব সুন্দর, ঝলমলে একটা ছোট প্যাকেট বেরোল। ‘একে-একে আসবে, সবাই পাবে, নেক্সট।’ এই অবধি বেশ হচ্ছিল। এদিকে প্রথমজন আর থাকতে না পেরে তার প্যাকেট খুলে ফেলেছে। বেরিয়ে পড়েছে একটা লাল-কালো দিশি নটরাজ পেন্সিল, ক্যামেলের ছোট ইরেজার আর পার্লের দুটো অরেঞ্জ লজেন্স। কার্ডবোর্ডের টুকরো দিয়ে গিফ্ট প্যাকের সাইজটা একটু বাড়ানো ছিল। অবাক বিস্ময়ে সে ওই ক’টি জিনিসের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বেরোল না মুখ দিয়ে। ‘এ তো ইস্কুলের বাজে পেন্সিল আর রবাআআট !’ হতাশায় কী করবে বুঝতে পারছে না। বিপদ বুঝে তার মা বলতে লাগল, ‘কী সুন্দর দ্যাখো, জার্মানি থেকে…’ কে কার কথা শোনে! তৎক্ষণে পরের বাচ্চারা বুঝে ফেলেছে সব কিছু। তারা লাইন ভেঙে দিয়েছে। আবার শুরু হয়ে গেছে হুল্লোড়। কাগজ ছোড়াছুড়ি। মট মট করে পেন্সিল ভাঙছে। লজেন্স, ইরেজার উড়ে যাচ্ছে সিলিঙের দিকে। পাখায় লেগে একটা টং করে ছিটকে গেল দরজার দিকে। বড়দের হাতে খাবারের প্লেট এসে গেছে। বেশি নড়াচড়া করা যাচ্ছে না। ‘এরকম করতে নেই’, শুনছে কে? জার্মানিকে দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই যে প্রলয় চলছে। উনি তখনও ‘আর বাচ্চা কই? বাচ্চা?’ বলে এদিক-ওদিক যাচ্ছেন। একটা ছেলে এই মুহূর্তে এরোপ্লেন সেজেছে। প্রবল গতিতে দৌড়চ্ছে লো অল্টিচিউডে। সে টুইন টাওয়ার-টুইন টাওয়ার খেলছে। যাকে পাচ্ছে তাকে ঢুঁসো মারছে। আমার কেটে পড়ার সঠিক সময়। দরজার দিকে এগোলাম ব্যাকফুটে। পায়ের তলায় কেক, ক্রিম, রাংতা, কাগজ, গিফ্টের তুবড়ে যাওয়া প্যাকেট, একটা ভেজিটেবল চপও পড়ল বোধ হয়। মোৎজার্টের দেশ থেকে এলেও প্রবাসীটি খাঁটি ভারতীয়। সস্নেহে বললেন, ‘তুমি খেয়েছ তো?’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র