মেদিনীপুর কারেকশনাল হোম থেকে বেরিয়ে এল রুমকি। কাঁধে আধময়লা-মুখখোলা ঝোলাব্যাগ, ফ্যাকাসে মেরুন রঙের একটা জামার হাতা উঁকি মারছে। প্রথমেই ওপর দিকে তাকাল— হালকা মেঘ, রোদের তেজ তেমন নেই। বড়-বড় দুটো চোখে খুশির ঝিলিক। জোরে একটা শ্বাস নিল। বাঁ-হাত দিয়ে ফুলছাপ ফ্রকটা বার বার টানছে। একটু অস্বস্তি হচ্ছে, হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে। সেই তিন বছর আগের জামা। এর মধ্যে খানিকটা লম্বাও হয়েছে। চত্বরে কয়েকটা লোক ঘোরাঘুরি করছে। সবারই নজর ওর পায়ের দিকে। রুমকি একটু কুঁজো হয়ে দু’পা এগিয়ে এল। এদিক-ওদিক ভাল করে দেখল, কই! বাবা-মা-দিদিদের কাউকেই তো চোখে পড়ছে না। মা নিশ্চয় রান্না নিয়ে ব্যস্ত, রুমকি এতদিন পর বাড়ি যাবে! বুঝেছি, চিংড়ির মালাইকারি হচ্ছে। কিন্তু বাবা? বাবা তো চলে আসতে পারত! ওহ্, আমিও যেমন! বাবাও নিশ্চয়ই সকাল থেকে ঘুরে-ঘুরে আমার পছন্দমতো বাজার করেছে, এবার শেভ করে স্নান সেরে আসতে, একটু তো সময় লাগবে, না কি? রুমকি খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে, পা-দুটো চেপে-চেপে হেঁটে সামনের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসল। এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট নিল। হোমে টুকটাক কাজ করে কয়েকটা টাকা জমেছে। বাড়ি ফিরে বড়দি-ছোড়দিকে টাকাগুলো ভাগ করে দেবে ঠিক করল। পর পর অনেকগুলো বাস-ট্রেকার চলে গেল, বাবা এখনও এল না। আচ্ছা, স্নান সেরে এই আড়াই ঘণ্টার রাস্তা আসতে এত সময় লাগে না কি! হঠাৎ রুমকির বুকটা খালি-খালি লাগছে, বাবা ভুলে যায়নি তো আজ রুমকির ছুটি হবে!
বেশ মেঘ করে এসেছে, হাওয়াও দিচ্ছে। জামাটা খালি-খালি উড়ে যাচ্ছে, রুমকি সমানে হাত দিয়ে চেপে ধরছে। সেইদিকে তাকিয়ে দোকানদার জিজ্ঞেস করল, ‘কী খুকি তোমার বাড়ি থেকে এখনও কেউ এল না? আর দুটো বিস্কুট খাবে?’ চারপাশের লোকগুলো তখন মুচকি-মুচকি হাসছে।
রুমকি একটু সিঁটিয়ে এল, বেঞ্চির এমাথায়। ‘আরে, ভয় পাচ্ছ কেন? আমার দোকান রাত বারোটা অবধি খোলা থাকবে। তুমি অপেক্ষা করো, যতক্ষণ খুশি! আমরা তো আছিই।’
বিকেল শেষ হয়ে আসছে, অপেক্ষাও। বাবা আসবে না, আমাকেই বাবার কাছে যেতে হবে। বিড়বিড় করতে থাকে— বাবা, আমি আসছি, এখনই আসছি।
রুমকির শরীরটা ক্রমশ ছোট হতে থাকে। হতে-হতে একটা ছাই-ছাই রঙের বিড়াল হয়ে যায়। তারপর নিঃশব্দে বেঞ্চি থেকে উঠে, ট্রেকারের সিটের তলায় বসে পড়ে। ওঠার আগে ভাল করে দেখে নিয়েছে ঘোড়াঘাটা যাবে, প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার। আড়াই ঘণ্টা মতো লাগবে। রুমকি সিটের তলায় হাত-পা ছড়িয়ে একটা হাই তুলে নিশ্চিন্তে ঘুম দিল।
তুমুল বৃষ্টি নেমেছে, সেইসঙ্গে মুহুর্মুহু বাজ। রুমকির নরম তুলতুলে শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠছে। কুঁকড়ে একেবারে কোনায় সেঁধিয়ে আছে। একে অন্ধকার, তার ওপর ধোঁয়ার মতো বৃষ্টি— বাইরেটা কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ড্রাইভার বাজারের কাছে একটা স্ট্যান্ডে ট্রেকারটা দাঁড় করাল। এখনও ঘোড়াঘাটা পৌঁছোতে দশ কিলোমিটার বাকি। রুমকি এক চোখ খুলে সিটের তলা দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু লোকের পায়ে আড়াল হয়ে আছে। কী আর করে, আবার চোখ বন্ধ করল। বাড়ির কথা মনে হতেই শীত-শীত ভাবটা অনেকটা কেটে গেল। আচ্ছা, মা নিশ্চয় ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করবে। আর বড়দি-ছোড়দি তো ওকে ছাড়তেই চাইবে না। এই তিন বছরের সব গল্প এক রাতে শুনে তবে ছাড়বে। রুমকি নিজের মনে হেসে ফেলে। উফ, ছেলেটা তখন থেকে জুতো দিয়ে ধাক্কা মারছে। রুমকির পেটে এসে লাগছে। খুব রাগ হয়, তারপর অবশ্য নিজের মনেই হাসে। ও তো আর জানে না রুমকি এখানে চুপটি করে শুয়ে আছে। আচ্ছা, বাবা নিশ্চয় অফিস থেকে ফিরে শসা-মুড়ি খেয়ে বরেন জেঠুর বাড়ি তাস খেলতে গেছে। ফিরে এসে যখন রুমকিকে দেখবে! তিন বোনের মধ্যে বাবা সবচেয়ে বেশি ভালবাসত তো ওকেই। যেমন চটপটে, তেমনি অঙ্কে মাথা রুমকির। কিন্তু বাবা আজ কেন এল না! হোমের হেড দিদিমণি তো বলল, তোমার বাবা আসবে নিতে। তাহলে? বাবা কি ওকে ভুলে গেল! রুমকির আবার শীত-শীত করছে। ট্রেকারের ভিতর জলের ছাঁট আসছে। সেই জল গড়িয়ে রুমকির বুকের তলায় জমছে। প্রথমদিকে বাবা-মা ঘন ঘন আসত। তারপর ধীরে-ধীরে আসা কমে গেল। দিদিদের কোনওদিনই নিয়ে আসেনি। গত এক বছর কেউ আসেনি। প্রতিদিন বিকেল হলেই মনে হত, বাবা আজ নিশ্চয়ই আসবে। কিন্তু না, বাবা আসেনি। রুমকি বোঝে, বাবা-মা ওর ছায়া দিদিদের ওপর পড়তে দিতে চায় না। কিন্তু রুমকির কী দোষ? ও তো কিছু বুঝতেই পারেনি, কখন ছুরিটা তপনদার বুকে ঢুকে গেছে! রুমকি তো শুধু ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। একটু-আধটু ক্যারাটে জানত, এই যা রক্ষে। বাবাকে কতবার বলেছে, পুলিশকে বলেছে, কোর্টে বলেছে। তবু যে কেন বাবা ওর সঙ্গে এমন দূর-দূর করছে! রুমকির দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বৃষ্টিটাও ধরে এসেছে। ড্রাইভার পান চিবোতে-চিবোতে স্টার্ট দিল।
ঘোড়াঘাটার মোড়ে ট্রেকারটা থামতেই এক লাফে বেরিয়ে এল সিটের তলা থেকে। লোকজনের পা-ব্যাগ মাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটিতে, তারপর চোঁ-চাঁ দৌড়। মহেশতলা দিয়ে গেলে কিছুটা শর্টকাট হবে ঠিকই, তবু সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়লেও আট-দশ মিনিট লেগে যাবে ওদের রেলকলোনির কোয়ার্টারে পৌঁছোতে। রুমকি দৌড়চ্ছে। দৌড়তে-দৌড়তে বাড়ির কাছাকাছি যত আসছে, ওর শরীরটা বড় হচ্ছে। হতে-হতে ও আবার পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চির রুমকি। গলিতে একটাও লোক নেই, এখনও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। রুমকি গেট খুলে কলিংবেলটা টিপতে যাবে, মায়ের কান্নার আওয়াজ। মা ডুকরে-ডুকরে উঠছে। বাবা, হিসহিস করে মা-কে সাবধান করছে, ‘এসব ন্যাকা কান্না বন্ধ করো। মনে রেখো, তোমার আরও দুটো মেয়ে আছে।’ দরজার বাইরে থেকে রুমকি বুঝতে পারে, মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। বাঁ-দিকে দিদিদের ঘরে ডিমলাইটের আলো। ওরা মনে হয় চোখ বন্ধ করে আমার কথাই ভাবছে। কলিংবেল থেকে হাতটা সরিয়ে নিল। ছোট হয়ে যাচ্ছে রুমকি। হতে-হতে আবার সেই ছাই-ছাই রঙের বেড়ালটা হয়ে গেল। বাবা একবার পাঁউরুটি কিনতে বেরিয়েছিল, সেই ফাঁকে ঢুকে পড়েছে ঘরে। সটান দিদিদের ঘরে। মানে একদিন যেটা ওর ঘরও ছিল। যাক গে, পড়ার টেবিলের আড়ালে বসে দিদিদের দেখছে। ওরা খাটে শুয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে।
‘হ্যাঁ রে বড়দি, রুমকিটা এখন কী করছে বল তো?’
‘আমার কী মনে হয় জানিস চুমকি, ও এখন ট্রেনে করে বম্বে রওনা দিয়েছে।’
‘কী, কীইইই যাতা বলছিস। ও অত টাকা কোথায় পাবে!’
‘আারে, রুমকির অনেক বুদ্ধি। ও ঠিক ম্যানেজ করে চলে যাবে। তারপর দেখিস, একদিন নায়িকা হবে, নামডাক, টাকাপয়সা সব হবে। রুমকিটা বেঁচে গেল রে। এ-বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হবে না আমাদের মতো। বাবা আমার গানটাও বন্ধ করে দিল।’
রুমকি টেবিলের তলা দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সত্যি তো, বড়দির হারমোনিয়াম আর তবলা-ঢাকা কাপড়টার ওপর পুরু ধুলো জমেছে। তার ওপর মুড়ি আর বিস্কুটের কৌটো রাখা। রুমকির খুব ইচ্ছে করে রিডগুলো একবার বাজিয়ে দিতে। উঠবে না কি এক লাফ দিয়ে… না থাক, যদি কৌটোগুলো পড়ে যায়, আর এক কাণ্ড হবে।
‘ঠিক বলেছিস বড়দি, বাবা কত পালটে গেছে! আমার টেবিল টেনিসটা কেমন জোর করে বন্ধ করে দিল! সেদিনও কলেজ থেকে ফেরার সময়ে অশোককাকু বার বার বলল, ‘আবার শুরু কর, তোর হবে।’’
‘তুই কী বললি?’
‘কী আবার? বললাম, বাবা দেবে না।’
‘কলেজ থেকে ফিরতে আধঘণ্টা দেরি হলে, বাবা পাঁচবার ফোন করে। অভীক তো বলেই দিল, ‘তোকে আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে না। তোর বাবার সঙ্গে গল্প কর গে যা। আমার তোকে দরকার নেই।’’
‘ধুর, ভাল্লাগে না…’
রুমকি ডানদিকের দেওয়ালে তাকের দিকে দেখল। ছোড়দির ব্যাটগুলো কভারের ভিতর। চারিদিক থেকে মাকড়শার জাল ঘিরে ধরেছে। আর ঝুড়ির ভিতর হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশির তলা থেকে বলগুলো উঁকি মারছে। রুমকি সবই বুঝতে পারে। গলার কাছে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে, ছোড়দির হাতে ব্যাট ধরিয়ে খাটের ও-মাথায় দাঁড় করায়। তারপর দু’মাথায় দুজনে মিলে ঠকাস-ঠকাস। না থাক, ওরা মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রুমকি এবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কতদিন পর বড় আয়না। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি শরীরটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার দেখে। আশ যেন মিটতেই চায় না। বড়দির কথাটা মনে পড়তে, ফিক করে হেসে ফেলে। সাবধানে খাটের দিকে তাকায়, ওরা আবার জেগে গেল না তো! নায়িকা হলে মন্দ হয় না কিন্তু! দেওয়াল-আলমারি থেকে বড়দির একটা ছাপার শাড়ি বের করে পড়ল। ব্লাউজটা ফিট করেনি। যা হোক করে সেফটিপিন দিয়ে ম্যানেজ করল। চুলটা কতদিন কাটা হয়নি, প্রায় কোমর ছুঁই-ছুঁই। এক টানে খুলে দিল। আবছা নীলচে আলোয়, আয়নাটা চুম্বকের মতো টানছে।
দরজাটা একটু ফাঁক করা ছিল। মা’র কান্নার আওয়াজ, থেমে-থেমে, খুব সন্তর্পণে কাঁদছে মা। পাড়াপ্রতিবেশী, জগৎ-সংসারে কেউ যেন টের না পায়। রুমকি নিঃশব্দে বাবা-মা’র ঘরের খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। পর্দা ভালো করে টানা।
মা কাঁদতে-কাঁদতে বলছে, ‘আমরা তো মেয়েটাকে নিয়ে অন্য কোনও শহরে চলে যেতে পারতাম। পারতাম না, বলো?’
‘না, তা হয় না কাবেরী। আমার চাকরি এখানে। তিনটে মেয়ে নিয়ে তুমি একা-একা…! পারবে? পারবে তুমি বাকি মেয়েদুটোর বিয়ে দিতে? বলো? বলো আমাকে? তুমি কী ভাবছ? আমার কষ্ট হচ্ছে না? আমিও তো বাবা! আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে না!’ কাবেরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুভেন্দু। ‘একটাকে বাঁচাতে পারলাম না, বাকি দুটোকে তো বাঁচাতে হবে। তুমি শক্ত হও কাবেরী, আমার মতো শক্ত হও।’ পর্দার বাইরে থেকে রুমকি অস্পষ্ট দেখতে পায়, মা বাবাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। রুমকির ব্লাউজটা ঢিলে হয়ে যাচ্ছে, আঁচলটা মাটিতে খসে পড়েছে। রুমকি ছোট হয়ে যাচ্ছে। হতে-হতে একটা ছাই-ছাই রঙা বিড়াল হয়ে গেল রুমকি।
‘মা, মা, দ্যাখো, কী সুন্দর একটা বিড়াল! আগে তো কখনও দেখিনি!’
‘তাই তো! এই আপদটা আবার কোথা থেকে জুটল! একে নিজের জ্বালায় বাঁচি না! তাড়া ওটাকে শিগগির।’ কাবেরী গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে।
এত সব কথাবার্তায় রুমকির ঘুম ভেঙে গেছে। প্রথমে বাঁ-চোখটা খুলে দেখল, সজনে গাছটার ফাঁক দিয়ে তেরছা আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। বড়দি মাথার পাশে দাঁড়িয়ে। ওকে ফিসফিস করে বলল, ‘শোন, তুই খুব সুইট। মা যাই বলুক, তুই আমার ঘরে থাকবি, বুঝলি। মা’র সামনে বেরোবি না একদম।’ রুমকিকে যত্ন করে কোলে তুলে নিজের ঘরে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিল ঝুমকি।
রুমকির তো কোল থেকে নামতেই ইচ্ছে করছিল না। বড়দির কোলটা বড্ড মায়ের মতন!
আজ মনে হচ্ছে রবিবার। সাড়ে আটটা বাজে, বাবা এই সবে উঠল। ছোড়দি একটা হাতকাটা নাইটি পরে উঠোনে আচারের শিশিটা রোদে দিতে নেমেছিল। বাবা কলতলা থেকে দেখতে পেয়েছে। ব্যস, অমনি হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ছুটে এল, ‘তোমার আস্কারা পেয়েই মেয়েগুলো এমন নির্লজ্জ হয়েছে! আর যেন কখনও ওদের এসব পরতে না দেখি।’
মা ছোড়দিকে ইশারা করল। ছোড়দি ঘরে গিয়ে সালোয়ার কামিজ পরল।
রুমকির খুব কষ্ট হচ্ছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমাদের বাড়িটা তো এমন ছিল না! গরমকালের রাতে ওরা সবাই মিলে বাগানে চেয়ার পেতে বসত। পাশের কোয়ার্টারের কাকিমা-কাকু-সন্তুও আসত। সবাই মিলে কত গল্প-গান। আর দুর্গাপুর থেকে জেঠুরা এলে তো কথাই নেই, কী মজা! কী মজা!
দুপুরে সবার খাওয়ার পর, রুমকি নিঃশব্দে রান্নাঘরে ঢুকে এঁটোকাঁটা যেটুকু ছিল খেল, খুব খিদে পেয়েছিল। কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। বড়দি অবশ্য দুটো বিস্কুট খাইয়ে দিয়েছিল। বাবা বাথরুমে, আর মা উঠোনে জামাকাপড় তুলছে। এই ফাঁকে রুমকি মায়ের ঘরে ঢুকে পড়ল। টেবিলের ওপর বাবার তাসের প্যাকেটটা নেই। এদিক-ওদিক তাকাল, কোথাও চোখে পড়ল না। তার মানে বাবা তাস খেলা ছেড়ে দিয়েছে। বিছানার ওপর ‘গীতা’। পেজ মার্ক করা। বাবা তো আমাকে বলেছিল, রিটায়ার করার পর আয়েশ করে ধর্মগ্রন্থ পড়বে, তাহলে?
চোখ আটকে গেল আলনায়। রুমকি আলনায় ভাঁজ করা মায়ের শাড়ির গায়ে খুব করে মুখ ঘষছে, খসখস শব্দ হচ্ছে। কাবেরী তখনই ঘরে ঢুকল। হাতে ডাঁই করা জামাকপড়, মুখ অবধি ঢাকা পড়েছে। শব্দটা কোথা থেকে আসছে? কাপড়চোপরগুলো বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলল।
‘এ মা! কাচা শাড়িটা নোংরা করে দিল গো! যা যা, বেরো এখান থেকে, বেরো বলছি…’
হাতের কাছে বিছানা। ঝাঁটাটা নিয়ে মারতে যাবে, ঘাড়ের কাছে মোটা ব-এর মতো কালো জন্মদাগটা না! হাতটা থেমে গেল কাবেরীর। মেয়েটার ঘাড়ের কাছেও ঠিক এমনটাই…। বিড়ালটা ফিক করে হেসে ফেলে। মনে-মনে ভাবে, নিজের মেয়েকে চিনতে পারবে না তাও কি হয় গো মা!
রুমকি এক লাফে মায়ের কোলে উঠে পড়ে। কাবেরী আর রাগ করতে পারে না, ঘাড়ের কাছটায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
শুভেন্দু ঘরে ঢোকে, কাবেরীর কোলে বিড়ালটাকে দেখে ভীষণ রেগে যায়। ‘নামাও, নামাও ওটাকে। কোথাকার রাস্তার এক বিড়াল। ঘরে ঢুকল কী করে? আবার কোলে নেওয়ার কী হয়েছে তোমার! যত্ত সব বাড়াবাড়ি। রোদ পড়লে লাইনের ওধারে ছেড়ে দিয়ে আসবখন। শাড়ি ছেড়ে হাতে সাবান দাও।’
ছোড়দি রুমকিকে বাজারের ব্যাগে ভরে দিল। মা আর বড়দি একদৃষ্টে রুমকির দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে কোনও কথা নেই। বাবা বেরিয়ে গেটটা লাগিয়ে দিল। রুমকি ব্যাগের ভিতর ছটফট করছে। বাবা কেন আমার জন্মদাগটা দেখতে পেল না? পুজোর সময়ে সবচেয়ে ভালো জামাটা তো বাবা আমাকেই কিনে দিত, তবে? রুমকির জ্বর হলে, বাবা তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে আসত। গল্পের বই পড়ে শোনাত। ইচ্ছে করছে, চিৎকার করে বলে, বাবা আমি রুমকি, দেখো, দেখো আমার ঘাড়টা। কিন্তু গলা দিয়ে ঘরঘর করে ম্যাও ছাড়া আর যে কিছুই বেরোচ্ছে না!
গলির মোড়ের কাছে আসতেই, ব্যাগের ভিতর থেকে দেখতে পেল বাচ্চুদা-সমীরদা-আবুলদা-নোটনদারা অশ্বত্থ গাছটার তলায় বোর্ড পেতে ক্যারাম পেটাচ্ছে। হা হা করে হাসছে। বাবাকে আবার বলল, ‘কী নিয়ে যাচ্ছেন কাকু, ব্যাগটা এত নড়ছে কেন?’
বাবা তাড়াতাড়ি মাথা নীচু করে ওদের পেরিয়ে এল।
রুমকির ইচ্ছে করছে নখ দিয়ে আঁচড়ে-কামড়ে ওদের ফালাফালা করে দেয়। সেদিন টিউশন থেকে ফেরার পথে ওরা জোর করে লাইনের ধারে নিয়ে গিয়েছিল। সবাই মিলে চেপে ধরেছিল। তখন নিরুপায় হয়ে বাঁচার জন্য কয়েকটা পাঞ্চ মেরেছিল মাত্র। ও তো বুঝতেই পারেনি তপনদার হাতে ছুরি আছে। কীভাবে যেন তপনদার বুকে ঢুকে গেল। সবাই দুদ্দার করে পালাল। অন্ধকারের মধ্যেও তপনদার চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। চারিদিক শুনশান, রক্তে ভিজে যাচ্ছে। কী করবে বুঝতে না পেরে রুমকি ছুরিটা বের করার চেষ্টা করছিল। তারপর আর কী! অনিচ্ছাকৃত খুনের দায়ে তিন বছরের জন্য হোমে যেতে হল। রুমকি আর ছটফট করছে না, মনটা শান্ত আর শক্ত হয়ে এসেছে। বাবা ওকে লাইনের ধারে ফেলে আসার জন্য নিয়ে যাচ্ছে, রুমকির কানে ক্ষীণ ভেসে আসছে বাচ্চুদা-নোটনদাদের হাসির আওয়াজ।
রেললাইন ছাড়িয়ে আরও দু’কিলোমিটার দূরে জনশূন্য ঝিলের পারে উবু হয়ে বসে আছে। জামাপ্যান্ট শতছিন্ন। গায়ে ব্যথা, নখের আঁচড়। সারারাত কতগুলো শিয়াল-কুকুরের সঙ্গে লড়াই করতে-করতে আর পারেনি, হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন তো ক্যারাটের পাঞ্চও সব ভুলে গেছে, কী করে পারবে অতগুলোর সঙ্গে?
সবে ভোর ফুটতে শুরু করেছে। রুমকি ভাবে ঝিলের ওই ঠান্ডা জলে ডুবে যেতে পারলে, চিরশান্তি। আর কোনও ব্যথা থাকবে না। তখনই জলের ভিতর থেকে উঠে এল দুটো তীক্ষ্ণ চোখের আলো। সাঁতরে-সাঁতরে পাড়ের কাছে আসতেই সেই ছাই-ছাই রঙের বিড়ালটা। এক’পা দু’পা করে রুমকির ভিতরে ঢুকে পড়ল। রুমকি আবার দেড় ফুটের বিড়াল।
বাজারহাট সব খুলতে শুরু করেছে। সাইকেলে করে আড়ত থেকে মাছ যাচ্ছে। আঁশটে গন্ধ। চোখদুটো জ্বলে উঠল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল রুমকি। ওকে টানছে মাছের বাজার, আঁশটে গন্ধ। রুমকি দৌড়চ্ছে। দৌড়তে-দৌড়তে বড় হচ্ছে। হতে-হতে পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চি। রুমকি ঢুকে পড়ল বাজারের ভিতর।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র