ঠিক ঠিকানা কথাটা কোথা থেকে এল শুনি? ভুল ঠিকানার রহস্য সর্বজনবিদিত। আচ্ছা, ওইসব নয়, নম্বরের সেন্স ননসেন্সে ঘুরি বরং। বাড়ি কোথায় বললে শেষে এখানেই এসে থামতে হয়। থামার পর শুরু হয় অনেক কাণ্ড। ঢুকে পড়ে নম্বরের প্রতিবেশীরা। চিটে মিষ্টি আমের চাটনির সঙ্গে যেমন তেল চপচপে ভাজা পাঁপড়, ঠিক তেমনই বাড়ির নম্বরের সঙ্গে কখনও সিমেন্টে, কখনও পাথরের ফলকের ওপর খোদাই করে লেখা থাকে বাড়ির নাম। দুটো একসঙ্গে পড়লে এক ধরনের অনুভূতি হয়, যা স্রেফ নম্বরে সম্ভব নয়। এই যেমন, ‘বাবার পায়ে’ বারো। নম্বর থাকা সত্ত্বেও অনেকে ঠিকানা বোঝাতে অন্য রাস্তা ধরে। এই যেমন আমি। ‘কোথায় থাকিস?’ জিজ্ঞেস করলে আমি অবধারিতভাবে বলি, ‘উত্তমকুমারের আদি বাড়ি চেনো? তার থেকে জাস্ট একটু।’
শুধু নামটুকু দৃশ্যমান হলে অনেক বিপদ আছে। ‘উর্বশী’ বাড়িতে যে-মেয়েটি থাকে, সবে কলেজে ঢুকেছে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে যে একটু শান্তিতে চুল শুকোবে তার উপায় নেই। শুধু নম্বর থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে, তাও নয়। লেক গার্ডেন্সে দেখেছি একটা পাড়ায় বাড়ির নম্বরগুলি অভিনব। অন্তত তিন সংখ্যা দিয়ে শুরু। মোটামুটি নতুন কলকাতা। বাড়ির হাবেভাবে প্রচুর মিল। একদিন নজরে এল, চারশো উনিশ নম্বর বাড়ির পরেরটি কিন্তু চারশো একুশ। মাঝখানে একচিলতে হাঁটাহাঁটির অযোগ্য গলি। তাই সেখানে কেউ বাড়ি তুলতে পারেননি। ভাগ্যিস।
একটু ইতিহাস আউড়ে নিই। স্বদেশির সময়ে অনেক কাণ্ড হত। বিপ্লবীরা খুঁজে খুঁজে অত্যাচারী লাট সায়েবদের হত্যা করার চেষ্টা করতেন। বোমা টপকে দিতেন। তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হত অনেক কারণে। একটি ইউনিক কারণের জন্য ঘটে যাওয়া ঘটনা আজও লোকের মুখে-মুখে ঘোরে। অষ্টআশি নম্বরের বাড়িকে চুয়াল্লিশ ভাবায় গোলমাল হয়। কেউ হতাহত হননি। গেজেটে নাকি এই ঘটনার উল্লেখ আছে। এর চেয়ে কম মর্মান্তিক ঘটনাও শোনা যায়। বাড়ি খুঁজে না পাওয়ায় একটি পার্সেল পোস্ট অফিসে ফিরে আসে। অন্য উপায় না থাকায় পাড়ায় মাইক নিয়ে জানানো হয়, এগারো নম্বর বাড়ির লোক এসে, প্রমাণ-সহ, পোস্ট অফিস থেকে যেন পার্সেল সংগ্রহ করেন। পরের দিন আটজন দাবিদার আসেন। এনারা এগারোর এ থেকে এইচ বাড়ির মালিক। এর সঙ্গে কিছুটা সম্পৃক্ত আর একটি ঘটনার উল্লেখ করা উচিত। চিটিংবাজ বিক্রেতা আর বুদ্ধিহীন ক্রেতাদের কাহিনি। জলের দামে বাড়ি বিক্রির নাম করে একটা বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর বেচে দিয়েছিল একজন। যথাস্থানে ঘুষ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে প্রত্যেক ঘরের আলাদা নম্বরের এনামেল করা নেমপ্লেট-ও লাগিয়ে দিয়েছিল। ক্রেতারাও নিজের বাড়ি হওয়ায় খুশি ছিল। শুধু তাই নয়, টবে একটিমাত্র তুলসী গাছ জেগে থাকা ছাদকে কমন গার্ডেন স্পেস হিসেবে মান্যতাও দিয়েছিল।
বাড়ির নম্বর যেখানে, যেভাবে লেখা থাকে তা দেখলে সেই বাড়ি সম্পর্কে একটা চিত্রনাট্য পাওয়া যায়। মার্বেলের ওপর পেতলের একটি ‘৭’ ভার্সেস সিমেন্টের পলেস্তারা খসা জমিতে প্রায় আবছা, রংচটা, ম্রিয়মাণ ‘৫’ যথেষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। প্রথমটির দম্ভ, পরেরটির মিনমিনে চেহারা বুঝিয়ে দেয় বাসিন্দাদের আর্থিক পরিস্থিতি। রুচি স্পষ্ট হয়ে যায় একটুকরো কাঠের ওপর পাতলা শেরিফ হরফে, ইটালিক্সে ‘৩’ আর লাল-নীল-হলুদ-সবুজ ঝিকমিক আলো-জ্বলা বাক্সে ব্যাকলিট ‘৪২’ দেখলে। ইউরোপের ফ্যাশনেবল শহরগুলোয় বাড়ির নম্বরপ্লেটের বাহার নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। শুনেছি মোটা দামে স্থানীয় কর্পোরেশনের কাছে আগেই রিজার্ভ করা থাকে কিছু নম্বর। লন্ডনে ‘১০’-এর খুব দাম। নেপল্সের পুরোনো পাড়ায় চোখে পড়ে ‘০০৭’। কলকাতাতেও খুঁজলে কোনও কোনও দরজায় ইউরোপের ছোঁয়া পাওয়া যাবে। শ্যামপুকুর স্ট্রিটের কাছে একটি দরজার পাল্লায় টপ-টু-বটম কাঠের ওপর খোদাই করা পেল্লায় ‘১৭’ ও ‘বি’ নজরে এসেছে। অনেক বাড়ির নম্বর লেখা থাকে শুধুমাত্র লেটারবক্সে। ছোট করে রাস্তার নাম-ও। একজন নগরচরিত্র বিশারদ আমাকে বলেছিলেন, ‘এরা অতিথি পছন্দ করে না। তবে চিঠিতে আপত্তি নেই।’ লেটার পাওয়ার বা লেখার রোম্যান্স কবেই ফুরিয়েছে। ইমেলের কোনও নির্দিষ্ট নম্বর হয় না। চ্যাটেও তথৈবচ।
একদিন সন্ধেবেলা রামু ফন্ডনবীস লেন দিয়ে যাচ্ছি। চারপাশ মদের গন্ধে ম-ম করছে। রাস্তায় সবাই হাসি-হাসি মুখে ঘুরছে-ফিরছে। শান্তিময় পাড়া। এই ধরনের পরিস্থিতিতে গ্রাউন্ড রিয়ালিটি বুঝতে হয়। কুকুর বোঝে। দেখি একটা কুকুর আড়াআড়ি রাস্তা পেরোল শুঁকে-শুঁকে। একটা দরজায় দাঁড়াল। তারপর আবার রাস্তা পেরোল একইভাবে। পৌঁছল আর একটা দরজায়। জুটে গেল আরও ক’টা। কুকুরদের একটা ক্রমবর্ধ্মমান ব্যাটেলিয়ন চলল লাইন করে। তাদের সঙ্গে আমি। বেশ কয়েকবার রাস্তা ক্রিসক্রস করার পর লিডার কুকুর দল-সহ দাঁড়িয়ে পড়ল একটা বাড়ির দরজার সামনে। একজন ডেলিভারি বয়কে পাওয়া গেল। কী একটা জিনিস দিতেই সেটা ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি একটু ঘন হয়ে দাঁড়ালাম। নিজের বিশাল ব্যাগ কাঁধে তুলে হাঁটতে শুরু করার আগে আমাকে সে বলল, ‘রাম, হুইস্কি, ভদকা, অনলাইন পে করে দেবেন, আমরা সব ডেলিভারি দিই।’ মদের গন্ধের কারণ বুঝলাম। কিন্তু এভাবে এতবার আড়াআড়ি রাস্তা পেরোনো কেন? ‘এ-পাড়ায় সবাই খায়, আজ প্রায় সব বাড়িতে অর্ডার ছিল। ঠিকানা নিয়ে একটু মুশকিল হচ্ছিল। রাস্তার একদিকে জোড় অন্যদিকে বিজোড়, বুঝলেন?’ বলে সে দ্রুত ভেপোরাইজ করে গেল।
এবারে আরবান ওয়াইল্ডলাইফের ব্যাপার। ফ্ল্যাট থ্রি-বি-র পাশে ফ্ল্যাট থ্রি-এ। আলাদা পরিবার। আলাদা রান্না। আমি দেখতে পাই আমার জানলা দিয়ে। ওই দুই ফ্ল্যাটের তলায় টু-বি আর টু-এ-র আলাদা জানলার কমন কার্নিশ। সেখানে এসে জুটেছে একটা ছাই বাদামি, আর একটা সবুজ কালো মুশকো পায়রা। থ্রি-বি-র গ্রিলের মধ্যে একটা পাত্রে দানা দেওয়া হয়। থ্রি-এ-তে দেয় পানি। ওই কার্নিশে পায়রাদুটোর আলাপ। ইনস্ট্যান্ট প্রেম। ভাবখানা হল, প্রেম কোথায়? জাস্ট নেবার আমরা। একজন অন্যের পিছনে ট্যাপট্যাপ থ্যাপথ্যাপ করে এগোলে অন্যজন টুকটুক পুটপুট করে চলে ফলো করে। প্রথমজন উল্টোমুখো হলেই পরের জন ঘুরে তার পিছন-পিছন। প্রথম ফ্ল্যাটে তুমুল ঝগড়া চললে দুটিতে মুখ তুলে দেখে। ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে হাসাহাসি করে। গ্রিলে চাদর শুকোতে দিলে তার থেকে টুপটাপ ঝরে পড়া জলে একসঙ্গে ভেজে। দ্বিতীয় ফ্ল্যাটে হাসাহাসি হলে ওরা মহানন্দে পরনিন্দা-পরচর্চা করে। সব দেখি আমি। কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না। কেন? ট্যাক্স, ইএমআই, বাচ্চা মানুষ করার চাপ নেই যে! সুখের ঠিক ঠিকানা থাকে না কি?
ভাল লাগে শহরতলি পেরিয়ে একটু গ্রামে ঢুকলে। বাড়ির রোল নম্বরের বালাই নেই। মানুষের জমিভিটে, হ্যাঁ হ্যাঁ, দলিল-টলিল আছে, সবাই জানে কার কোনটা, কতটুকু। রাষ্ট্রের চাপানো নম্বরে কী বা কাম? গাবু কোথায় থাকে রে? সাঁওতালপাড়ায়। সহজ ব্যাপার। ঘুরতে-ঘুরতে চোখে পড়ে যেতে পারে উঁচু পাঁচিল, গেটের ওপর ভেনেস্তা বা বোগেনভেলিয়ার বৈভবের তলায়, জাঁদরেল গেটের পাশে সুললিত নেমপ্লেট। ‘রোবিন্নিলয়’। অথবা ‘খোয়াই-খোয়াব’। বোঝাই যাচ্ছে শান্তিনিকেতনের অদূরে কোনও শহুরে বাবুবিবির বাগানবাড়ি। নম্বর নেই কিন্তু। গুরুদেবের জায়গা। কান পাতলে মাঝে মাঝে নম্বর নিয়ে অপূর্ব এক আবৃত্তি শুনতে পাবেন প্রান্তিক রেলস্টেশনের ওভারব্রিজে দাঁড়ালে। স্টেশনঘরের নয়, প্ল্যাটফর্মের কিন্তু নম্বর থাকে। ‘গণদেবতা এক নম্বরে দাঁড়িয়ে আছে। দু’নম্বরে থ্রু গাড়ি যাবে… তিন নম্বর লাইন, দু’নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ওখানে হাওয়ায় শুকনো পাতা উড়ছে।’
হোটেলের ঘরের নম্বর থাকতেই হবে। বাড়ি, ওয়ার্ডেরও। শহরগঞ্জের পিনকোড। রাজ্যের কিছু নেই। দেশেরও নয়। ঠিকানায় অঙ্কের বিভীষিকা নেই। আছে নিশ্চিত অবস্থানের স্বস্তি। আজকের দুনিয়ায় নম্বরের সন্ধানে গুগল মানচিত্রের রমরমা। নম্বর জানা থাকলে মুকুন্দপুরে বসে লিভারপুলের পেনি লেনের একটি বিশেষ বাড়ির সামনে উড়ে এসে জুড়ে বসা যায়। বিপদও আছে। ভুল সবারই হয়। ফোনে বুক করা গাড়ি বা মোটরবাইক মাঝে মাঝে পড়ে বিপদে। একজন ড্রাইভার আমাকে দুঃখ করে বলেছিল, ‘যেখানে দেখিয়েছে সেখানেই এসে দাঁড়িয়েছিলাম। এদিকে সে কী গালাগাল! বলে না কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। আমিও তো চিনি না। বারবার বলছে লোকেশনে আসতে। যেতে তো চাই, কিন্তু কী করে যাবো? জানেন স্যার, শেষে গালি দিতে লাগল। বলল, আমি কমোডে বসে থাকলে ওখানেই পৌঁছতে হবে… অ্যাড্রেস ভুল দেখালে আমার দোষ?’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র