ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • কলিকাতার চড়ক গুলজার


    সুশোভন প্রামাণিক (April 15, 2023)
     

    চৈত্রমাস মানেই, ব্যোম ভোলে, ঢাকের বাদ্যি, সন্ন্যাসীদের মামন মাঙা, গাজন আর শিব-শিব রব। মাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তিতে এক চেনা ছবি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। চৈত্রশেষের বিকেলে চড়কতলায় বাজছে ঢাক, ঢোলের বাদ্যি। ভিড় করেছে অজস্র লোক। কাঠের প্রকাণ্ড খুঁটির উপরে, অনেক উঁচুতে, ঝুলে থাকা মানুষ, ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছেন। সে কাল থেকে এ কাল— চড়কের আকর্ষণ খুব একটা বদলায়নি। গ্রামবাংলায় আজও চৈত্রের শুরু থেকেই ধ্বনিত হয়, ‘বাবা মহাদেবের চরণে সেবা লাগি’।

    কলকাতায় এখনও চড়ক পুজো হলেও, সং সেজে পথে-পথে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য বেশ বিরল। তবে কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন চড়ক এবং মেলা এখনও বিদ্যমান, বিডন স্ট্রিটের ছাতুবাবুর বাজারে। অথচ যার নামে এই রাস্তা, সেই বিডন সাহেব থেকে শুরু করে বাঙালি বাবুরা এককালে অশ্লীলতার দায়ে কলকাতা থেকে চড়ক ব্যাপারটাকেই তুলে দিতে চেয়েছিলেন। সং ব্যাপারটিও হয়ে উঠেছিল তাঁদের দু’চক্ষের বিষ। সেই সময়ের সমাজচিত্রে ধরা রয়েছে চড়ক নিয়ে নানা ছবি। এক-এক করে আমরা কয়েকটি সমাজচিত্র খুঁজে দেখি, কলকাতায় পুরনো সময়ে চড়ক কেমন ছিল! আর ঠিক কোন কারণে সেই চড়ক বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে কথা হয়েছিল!

    শিব মূলত অন্ত্যজ ও অনার্যদের দেবতারূপে বিবেচিত। কলিকাতা শহরে না ছিল বিশেষ চাষবাস, না সেরকম অন্য ভূমিজ কোনও ক্ষেত্র, তদ্‌সত্ত্বেও কলিকাতা শহরে শিবকে কেন্দ্র করে উন্মাদনা কম দেখা যায়নি। কলিকাতা শহরে শিবের মন্দিরের সংখ্যাও যথেষ্ট। শিবের গাজনের প্রথাও বেশ প্রাচীন। সেই সাক্ষ্য মেলে, প্রাণকৃষ্ণ দত্ত-র রচনা, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, ফ্যানি পার্কস-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত ইত্যাদিতে। স্বামীজির সহোদর, শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা, ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’তে তিনি কলিকাতার প্রাচীন সময়ের নানা ঘটনা নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলেন। সেই বইয়ে, ‘চড়ক’ ও ‘চড়কপূজার উৎপত্তি’ শিরোনামে দুটি লেখা রয়েছে। ‘চড়ক’ নামক লেখায় তিনি লিখেছেন—

    ‘আমাদের জন্মের কিছু পূর্ব পর্যন্ত অথবা আমার জ্ঞান হইবার পূর্ব পর্যন্ত বাণ ফোঁড়ার প্রথা ছিল। চড়ক যেদিন হইবে, সেই দিন প্রাতে গাজনের সন্ন্যাসীরা কালীঘাট যাইত। যে কজন লোক বাণ ফুঁড়িবে তাহারা তৈয়ারী হইত। কে একজন বিশিষ্ট বলবান লোক ছিল সে গাজনের সন্ন্যাসীর পিঠে জোরে এক কিল মারিত, মারিলে পিঠ ফুলিয়া উঠিত। তখন বাঁ-হাতে পিঠের চামড়া টানিয়া ধরিয়া ডান-হাতে ধারাল বঁড়শির মত হুক বিঁধাইয়া দিত। পিঠে এইরূপ দুইটা বঁড়শি বিধাইত ও রক্ত বাহির হইত। কিন্তু সেই স্থানে গাওয়া ঘি গরম করিয়া মালিশ করিলে রক্ত পড়া বন্ধ হইত। আবার কেহ কেহ বা জিভেতে ফুটো করে এক বিঘত, দেড় বিঘত অশ্বত্থচারা শেকড়শুদ্ধ সেই জিভের ফুটোতে বসাইত।’

    এই অংশের সমাজচিত্রে সন্ন্যাসীদের কৃচ্ছ্রসাধনের ইচ্ছে ও প্রক্রিয়ার বেশ প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে বাণফোঁড়ার যে-প্রথা, তাকে কেন্দ্র করে কালীঘাট যাত্রার উল্লেখও পাওয়া যায়। মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, ছাতুবাবুর বাজারে যে চড়কের মেলা আজও বেঁচে আছে, সে তখনও ছিল। ছাতুবাবুর মাঠ ছিল প্রকাণ্ড, সেখানে তিনি বাল্যে খেলেছেন। মাঠের উত্তর-পূর্ব দিকে শান-বাঁধানো চাতালওয়ালা একটা বড় পুকুর ছিল। সেখানেই চড়কের গাছ ভেজানো থাকত। মহেন্দ্রনাথ চড়ক ছাড়াও ঝাঁপান বা ঝাঁপ উৎসব নিয়ে বিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন। সেখানে তিনি ঝুলঝাঁপ, বঁটিঝাঁপ, আগুনঝাঁপ-এর প্রক্রিয়া ও বর্ণনা দিয়েছিলেন। কিন্তু চড়কপ্রথার উৎপত্তি কোথা থেকে?

    পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ ও রঘুনন্দনের ‘তিথিতত্ত্ব’-এও এ-পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এ চৈত্র মাসে শিব ঠাকুরের আরাধনা, নাচ-গানের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু সরাসরি এরকম কোনও প্রথার কথা সেখানে বলা নেই। অনেকেই তাই বলেন, এই প্রথার সঙ্গে নাকি জুড়ে রয়েছে বাণরাজার উপাখ্যান! ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বাণরাজার এক ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে বাণরাজার পক্ষ নিয়েছিলেন, স্বয়ং ভগবান শিব। সেই যুদ্ধ, হরি-হরের যুদ্ধ নামে পরিচিত। বাণ ছিলেন ভগবান শিবের এক অতিনিষ্ঠ ভক্ত। শিবের তাণ্ডব নৃত্যের সময়ে তিনি সহস্র বাহু দিয়ে মৃদঙ্গ বাজিয়েছিলেন। বাণের এই ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে বর প্রদান করেছিলেন, যে-কোনও পরিস্থিতিতে তিনি তাঁকে রক্ষা করবেন। বাণের কন্যা ঊষার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ-পৌত্র অনিরুদ্ধের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাণকে না জানিয়ে, তাঁরা গান্ধর্ব মতে বিবাহ করেন। সেই ক্রোধে বাণ অনিরুদ্ধকে বন্দি করে রাখেন। কৃষ্ণ অনিরুদ্ধকে মুক্ত করতে আসায় এক প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ সংগঠিত হয়। কৃষ্ণ বাণাসুরের দুটি হাত রেখে বাকি সমস্ত হাত কেটে নেন। তিনি কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা চান। সেই যুদ্ধে মহাদেবের থেকে বর প্রত্যাশায় তিনি নিজের শরীরের শোণিত নিবেদন করেন। দেবাদিদেবকে তুষ্ট করার জন্য নাকি নাচ ও গান করেন। শিব এই বর দেন যে, যদি কোনও শিবভক্ত এই রূপ শোণিতাক্ত কলেবরে সরল মনে নিষ্ঠাচারে-নিরাহারে থেকে এমনি নৃত্য করে, তবে সে শিবের পুত্রবৎ হবে। বাণরাজার সেই নৃত্যের তিথিকেই নাকি গাজনের তিথি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গাজনের একটি অবশ্য অঙ্গ চড়ক।

    ছবিতে চড়ক উৎসব : এক

    এই কাহিনি মেলে হিন্দুশাস্ত্র ‘ধর্মসংহিতা’য়ও। যে-নগরীতে এই যুদ্ধ হয়েছিল, সেই থেকেই নগরীর নাম হয়, তেজপুর। অহমিয়া ভাষায় তেজপুর শব্দের অর্থ, রক্তের নগরী। তেজপুর নামকরণের জন্য যেসব কাহিনিগুলি প্রচলিত, এইটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এখানেও তো খটকা কাটে না। অসমের নগরীর সঙ্গে কি বঙ্গের শিব উপাসনায় কৃচ্ছ্রসাধনের বিশেষ যোগ রয়েছে বা থাকা উচিত!

    ইতিহাসে তেমন প্রামাণ্য সাক্ষ্য মেলে না। তবে বহু আলোচনা এবং লেখা থেকে জানা যায়, এই পৌরাণিক কাহিনি স্মরণে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুর চড়ক অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। এও শোনা যায়, যেসব কৃষকরা বছর শেষে খাজনা শোধ করতে পারতেন না, বিশেষত যাঁদের বহু বছরের খাজনা জমে যেত, তাঁদের নাকি পিঠের চামড়া ফুটো করে বঁড়শিতে ঝুলিয়ে এইভাবে গাছে বেঁধে ঘোরানো হত।

    মহেন্দ্রনাথ দত্ত যদিও চড়কের উৎপত্তি বিষয়ে খুব স্পষ্ট কথা বলতে পারেননি। তিনি জানিয়েছিলেন,

    ‘… নিম্নশ্রেণীর লোকেরা—হাড়ি বাগদীরাই করিত। যাহোক উচ্চবর্ণের লোকেরা কখনও চড়কগাছে ঝোলে না বা পিঠে কাঁটা ফোঁড়ে না।’

    তিনি এই স্থলে পুরাণকারদের ব্যাপারে বেশ শ্লেষমিশ্রিত উক্তি করেছেন, এবং জানিয়েছেন ধর্মঠাকুরের পূজার খানিক অংশ এই চড়কে রয়েছে। এইখানে অন্তত ‘ধর্মসংহিতা’র সঙ্গে শিবপূজার খানিক যোগসূত্র রচিত হয় বলেই আমাদের ধারণা। 

    ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’র প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘কলিকাতার চড়ক পার্ব্বণ’। সেখানে হুতোম ওরফে কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখছেন—

    ‘এদিকে দুলে বেয়ারা হাড়ি ও কাওরারা নূপুর পায়ে উত্তরি সুতা গলায় দিয়ে নিজ নিজ বীরব্রতের ও মহত্বের স্তম্ভস্বরূপ বাণ ও দশলকি হাতে করে প্রত্যেক মদের দোকানে বেশ্যালয়ে ও লোকের উঠানে ঢাকের সংগতে নেচে ব্যাড়াচ্চে। ঢাকীরা ঢাকের টোয়েতে চামর, পাখির পালক, ঘণ্টা ও ঘুমুর বেধে পাড়ায় পাড়ায় ধাক বাজিয়ে সন্ন্যাসী সংগ্রহ কচ্চে; গুরু মশায়ের পাঠশাল বন্দ হয়ে গিয়েছে—ছেলেরা গাজনতলাই বাড়ি করে তুলেচে; আহার নাই, নিদ্রা নাই; ঢাকের পেচোনে পেচোনে রপ্টে রপ্টে ব্যাড়াচ্ছে; কখন ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব’ চিৎকারের সঙ্গে যোগ দিচ্চে…’

    এই বর্ণনা থেকে দুটি জিনিস বেশ স্পষ্ট, সেই সময়েও এই ‘সন্ন্যাসী ধরা’, এবং চড়কের আগের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নিম্নবর্গীয়দের অবস্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। ‘বৃহৎধর্মপুরাণ’ অনুযায়ী, ডুলি বহনকারী যে-জাতির উল্লেখ ছিল, তাঁরাই পরবর্তীতে ‘দুলে বেয়ারা’। হড্ডি যে-জাতির পূর্বনাম, তাঁরাই ‘হাড়ি’। কাওরা, ক্যাওরা বা কেওড়া নামেও পরিচিত। এঁরা প্রত্যেকেই অন্ত্যজ পর্যায়ের উপবর্ণ, অস্পৃশ্য, বর্ণাশ্রমের বর্ণব্যবস্থার মধ্যে এঁদের কোনও স্থান ছিল না। এবং সন্ন্যাসী বিষয়ে এত উন্মাদনা তৈরি হত যে, গুরুমশায়ের পাঠশালা বন্ধ করে ছেলেপুলেরা গাজনতলাকেই বাড়ি বানিয়ে দিনরাত্রি একেবারে ভক্তির নেশায় মেতে উঠেছিল।

    চড়কের সঙ্গে, সম্পৃক্ত বিষয় ছিল সং ও সঙের গান। সং ও চড়ক ছিল একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সঙে অংশগ্রহণকারীদের মূল অংশ ছিল অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষেরা। তাঁদের শ্লেষবাণে বিদ্ধ করতেন তথাকথিত কলিকাতার বাবুদের। চড়ক বন্ধ করার ক্ষেত্রে যত প্রচেষ্টা ছিল, সঙের ক্ষেত্রেও প্রায় একই। সেই সময়ে চড়কে প্রায় কিংবদন্তীতুল্য জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, জেলেপাড়া এবং কাঁসারিপাড়ার সং। এই অঞ্চলের নিম্নজ এবং গরিব মানুষেরা এই সঙের প্রধান ভূমিকায়। নেপথ্যে ছিলেন কাঁসারিপাড়ার বিখ্যাত তারকনাথ প্রামাণিক। তাঁদের শ্লেষের মূল বিষয় ছিল, বড়লোক বাবুর ধার্মিক ভণ্ডামি। এই চিত্র আমরা হুতোমের নকশায় বার বার ফিরে পাই। এমনকী ওই প্রথম অধ্যায়েই।

    ছবিতে সঙের দল

    ১৮৬৮, ১৩ এপ্রিলের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ খবরের কাগজের একটি রিপোর্ট থেকে জানতে পারছি, সেবার সঙের বহর ছিল অন্তত এক মাইল। সকাল ছ-টায় শুরু হয়ে সেই সং চলেছিল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত, প্রায় ন-ঘণ্টা ধরে। গান-বাজনা-মশকরা-পুতুলনাচ-মূকাভিনয় কী ছিল না সেই সমাবেশে! যে-এলাকা থেকে যখন এই সঙের সমাবেশ পেরিয়েছে, প্রতিটি বাড়ি, বারান্দা, জানলা, ছাদ, সবখানেই উৎসুক জনতার ভিড়। সেখানে আট থেকে আশি। পুরুষ থেকে মহিলা সবাই দর্শক।

    ধীরে ধীরে সংবাদপত্রের পাতায় চড়ক সম্বন্ধে নানা কথা লেখা হতে থাকল। সেগুলি সত্যি-মিথ্যে কি না জানা নেই। তবে সেসবের মধ্যে মূলত এখনকার ভাষায় ‘নেগেটিভ জার্নালিজম’-এর ছায়া দেখা দিল। খানিক খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই অন্ত্যেবাসীদের আনন্দ উদযাপন অথবা বাবুদের প্রতি ক্রমাগত শ্লেষ, ভদ্রসমাজে বেশ খানিক সমস্যা তৈরি করেছিল।

    ‘সমাচার দর্পণ’-এ প্রকাশিত একটি খবরে একটু নজর রাখা যাক :

    (২১ এপ্রিল ১৮২৭। ৯ বৈশাখ ১২৩৪)

    চড়ক পূজার সময় সন্ন্যাসিদের মধ্যে কেহ২ মত্ত হইয়া পথেতে এমত কদর্য্যরূপে নৃত্যাদি করে যে তাহা দর্শন করিতে ভদ্রলোকেরদের অতিশয় লজ্জা হয় অতএব তাহার নিবারণ করিতে কলিকাতাস্থ মাজিস্ট্রিট সাহেব লোকেরা নিশ্চয় করিয়াছেন এবং গত চড়কপূজার সময় এইরূপ অতিনির্লজ্জ তিন চারি জন সন্ন্যাসিকে পুলিসে ধরিয়া লইয়া গিয়াছেন ইহার পর এমত কর্ম্ম যে তাহারা কিন্বা অন্ত লোক শহরের মধ্যে আর না করে এই নিমিত্তে তাহারদের শান্তি হইবেক…। হরকরা প্রকাশক লিখিয়াছেন ষে এরূপ কর্ম হিন্দুদের শাস্ত্রসিদ্ধ নয় তথাপি যদি কর্তব্য হয় তবে যাহার তাহাতে অনুরাগ হয় সে কোন নির্জন স্থানে বনে কিম্বা নিজ ভবনে গিয়া তাহা করুক কিন্তু এরূপ ভদ্রলোকের সন্মুখে না করুক।

    এই খবর থেকে বেশ কয়েকটি জিনিস বেশ স্পষ্ট; সন্ন্যাসীদের অনেকেই মদ্যপান করে বেশ ‘ভাবুক’ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কতটা সেই বিষয়ে স্পষ্ট কথা পাওয়া যায় না। মাতাল সন্ন্যাসীদের নৃত্য ‘কদর্য’। সেই নৃত্য দেখতে ভদ্রলোকেদের অতিশয় লজ্জা। সেই লজ্জা নিবারণে একেবারে কলিকাতার ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ পাঠিয়ে সন্ন্যাসীদের তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। এই ঘটনা আশ্চর্য এবং বিরল। এমনকী এই সন্ন্যাসীদের চড়ক উৎসব আদতে শাস্ত্রসম্মত নয় এবং প্রকাশ্যে এরকম আমোদপূর্ণ কোনও কার্যকলাপ করা যাবে না, সে-বিষয়ে রীতিমতো সাবধানবাণী ঘোষণা করছেন, ‘হরকরা’ নামের একটি সংবাদপত্র।

     ‘বেঙ্গল হেরল্ড’-এ প্রকাশিত একটি খবরে চড়কে ঝোলার সময়ে, একটি দুর্ঘটনার বিবরণ রয়েছে। তারিখ ২২ এপ্রিল, ১৮৩৭, বাংলা সন ১২৪৪। খবরে প্রকাশ :

    চড়কপুজার অতিঘৃণ্য ব্যবহার ১২ তারিখে দৃষ্ট হইল। ওই দিবসীয় অপরাহ্ন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টাসময়ে দক্ষিণ ইটালির রাস্তার পশ্চিম দিগবত্তি প্রথম গলির মধ্যে রাধাকান্ত মুন্সীনামক এক ব্যক্তির ভূমিতে চড়কগাছ প্রোথিত হইয়াছিল তৎসময়ে ওই স্থানসমূহ সর্বজাতীয় দিদৃক্ষু লোকেতে পরিপূর্ণ হইয়া অতিযুব এক ব্যক্তিকে পাক খাইতে দেখিতেছিল এবং তৎকালে ঐ মুনসীর চাকরবাকর ও অন্যান্য অত্যন্ত কলরব করিতেছিল কিন্তু যে রজ্জুতে সন্ন্যাসী ঘুরিতেছিল তাহা দৈবাৎ ছিঁড়ে যাওয়াতে ঐ ব্যক্তি বেগে গিয়া ৬০ হাত দূরে পড়িল পরে উঠাইয়া দেখা গেল যে শরীরটা একেবারে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে মুখখান পিণ্ডাকার প্রায় কোন অঙ্গ অবিকল ছিল না। উত্তর ইটালির রাস্তার দক্ষিণ পশ্চিম পাশ্বস্থ গারদের নিকটে অপর একজন সন্ন্যাসী পিঠ ফুড়ে ঘুরিয়াছিল অন্য এক সন্ন্যাসী মদ্যপানে মত্ত হইয়া জঙ্ঘাতে বাণ বিদ্ধ করত প্রায় তিন পোয়া ঘণ্টাপর্যন্ত ঘূর্ণায়মান ছিল পরে তাহার অবরোহণসময়ে হুঁশ হইয়া কহিল যে অত্যন্নকালমাত্র আমি পাক খাইলাম বোধ হয়।

    এই খবরগুলি পর পর পড়লে বেশ বোঝা যায়, সেই সময় শহুরে শিক্ষিত উচ্চবর্ণ বাঙালি হিন্দু, শাসক ইংরেজ, এমনকী শৌখিনবাবুরা কেউই এই অন্ত্যজ মানুষদের ভক্তি, আমোদ, উদযাপন এইগুলির মধ্যে কোনও সারবত্তা খুঁজে তো পাচ্ছেনই না, উল্টে যে-কোনও ঘটনাকে ‘অশ্লীল’ ঠাউর করছেন। ইংরেজ শাসকরা এইসব নেটিভ মানুষদের ভক্তির উদযাপনকে ‘Barbaric’, ‘Crime’ ইত্যাদি আখ্যা দেওয়া শুরু করেছেন। সেই সঙ্গে বাবুদের হয়ে সংবাদপত্রগুলির বেছে বেছে নেগেটিভ প্রচার অনেক ক্ষেত্রেই চোখে পড়ার মতোই।

    যদিও ১৮৩১-এর ৩০ এপ্রিল সমাচার দর্পণ-এ চিঠি লিখছেন একজন। তাঁর আকুতি, যদি সম্পাদক এই চিঠি প্রকাশ করেন (আপনার দর্পণে অর্পণ করিয়া) এবং মান্যগণ্যদের মত নেন, তাহলে তিনি চিরকাল তাঁর এই উপকার স্মরণে রাখবেন।

    চিঠির লেখক কালীঘাটের এক জনৈক পুরোহিত। তিনি এই বিশেষ সময়ে বাণফোঁড়া থেকে যে-প্রাপ্য পান, সেই দিয়ে তাঁর সংসার প্রতিপালন করেন। এভাবেই তাঁর বংশ প্রতিপালিত হয়ে চলেছে। তিনি শুনেছেন, কোনও একটি ইংরেজি কাগজে (রিফর্মার) কোনও সায়েব শিক্ষায় শিক্ষিত, এক হিন্দু ছেলে, সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছেন, এইসব পাশবিক জিনিস বন্ধ হোক। তাই তিনি লিখতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি অনুরোধ করছেন, কেবল একজনের মত কেন, বিশিষ্টদের নিয়ে সভা ডাকুন, সবাই মত দিক। যিনি শিক্ষিত, তাঁর মত, সন্ন্যাস ছোটলোকেদের বিষয়। কিন্তু পুরোহিতের মন্তব্য, সেই সন্ন্যাস গাজন চড়কে হিন্দু বড়লোক বাবুরা তো একেবারে লুটোপুটি খান আর নব্য শিক্ষিত বাবুরা এত লায়েক হয়েছেন যে তাঁর বাপ-ঠাকুর্দার সংস্কার একেবারে ভুলতে বসেছেন। তিনি বা তাঁরা কি এই প্রমাণে মরিয়া যে, তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দা একেবারে উজবুক ছিলেন! কেউ রাস্তায় নাচ-গান-আহ্লাদ করেন, তাতে অন্যজনের গাত্রদাহ কেন হবে! পার্বণ উপলক্ষে বচ্ছরভর একদিন আহ্লাদ করা অনুচিত নয়, বরং অনুচিত অন্যের রুচিকে গুরুত্ব না দিয়ে, অন্ধ নিন্দা করা। চিঠির শেষে তাঁর নাম নেই, তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন— কালী পুরোহিতস্য।

    সঙেদের বিরুদ্ধে শুধু বাবুদের নয়, খ্রিস্টান মিশরনারিদের রাজরোষ কম ছিল না। ১৮৩৮ নাগাদ, চাউর হয়, সঙের দল, চড়কের সঙ্গে এই দেশের মিশনারিদের নিয়ে আপত্তিকর জিনিস দেখিয়েছে। সরকার রীতিমতো তদন্ত করে দেখে, যে-খবর চাউর হয়েছিল, একেবারে সঠিক বলা চলে না। বরং এই অন্ত্যজ হিন্দুরা তাঁদের পৌরাণিক দেবতা সাজতে দু’দণ্ড দ্বিধা করে না তবে ওই সমাবেশে তাঁরা খ্রিস্টানদের কোনও অপমান ইত্যাদি করেনি। কিন্তু ইংরেজ সাহেব সেসিল বিডন, হঠাৎই সংস্কৃতির ধ্বজা হাতে মাঠে নামেন। তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনকে লেখেন—

    Whether the time has not come when the practice of hook swinging may properly be prohibited by the magistrates under the provisions of the code of Criminal Procedure as a practice dangerous to human life and safety and as an annyonace to all educated and right-thinking persons.

    ছবিতে চড়ক উৎসব : দুই

    একবার লাইনগুলি পড়ে, ভাবুন, একজন বিদেশি তিনি হঠাৎই এমন একটি সংস্কৃতির অংশকে ‘অপরাধমূলক প্রক্রিয়া’ বলে সাজা ঘোষণা করতে চাইছেন। এই অভ্যেসে অন্যের জীবনহানি হতে পারে অথবা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এই আশঙ্কাও রয়েছে। কিন্তু যা সবচেয়ে আপত্তিকর, এই চিঠির শেষ লাইন, ‘সমস্ত শিক্ষিত এবং চিন্তাশীল ব্যক্তির জন্য বিরক্তির কারণ বা জ্বালাতন’, এই বাক্যবন্ধটি।

    এই চিঠির উত্তরে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন নিদান দেয় :

    হ্যাঁ ঠিকই, চড়ক উৎসব উপলক্ষে এইভাবে শরীর ফোঁড়ার এই বর্বর অভ্যাস অত্যন্ত নির্মম এবং একেবারে অধঃপতনের ফল। সবচেয়ে বড় কথা হিন্দুধর্মে এর বিশেষ উল্লেখ নেই। এই প্রথা একেবারেই অন্ত্যজ হিন্দুদের। এঁরা জনগণের মধ্যে এইসব প্রদর্শন করে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, সেই সঙ্গে নিজেদেরও খানিক মান্যতা দিতে চায়। অতএব একে রদ করার জন্য তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত, শাস্ত্রবিশারদ, বাবু, জমিদার নানা সম্প্রদায়ের থেকে মত নেওয়া হল।   

    কমিটি প্রচুর আলোচনা করে রিপোর্ট পেশ করে। সেখানে জানানো হয়—

    প্রথমেই বলে রাখা ভাল, কমিটি অনেক অনুসন্ধান করে জেনেছে, শাস্ত্রে এরকম কোনও প্রথার উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত, শিক্ষিত, ভদ্র, রুচিশীল এমনকী উচ্চবর্ণের কোনও হিন্দুর মধ্যে এই প্রথার দেখা মেলে না। কলিকাতা তথা বাংলার জনগণ যদি এর মধ্যে ধর্ম এবং আমোদ খুঁজে পায় তাতে কমিটির আপত্তি নেই। তবে শরীরে বাঁণফোড়া ব্যতিরেকে চড়ক উদযাপন করতে হবে। কমিটি তাতে আপত্তি করবে না, বাধাও দেবে না। কমিটি জানতে পেরেছে, মাদ্রাজে এরকম প্রথা রয়েছে, সেখানে গাছে একইভাবেই মানুষ ঝোলে, পাক খায়, তবে সেখানে বেতের ঝুড়ির মধ্যে বসে ঘুরণ চরকি হয়।

    এই রিপোর্ট পেশের পর, ১৮৬৫-এর ১৮ এপ্রিল, পুলিশ কমিশনার V.H. Schalch একটি ছয় দফা নির্দেশিকা জারি করেন। সেখানে জানানো হয় :

    সং, গাজন গান অথবা যে-কোনও শোভাযাত্রা করার জন্য, আগে থেকে অনুমতি চাইতে হবে। কোন এলাকা থেকে ক-টার সময়ে সেই শোভাযাত্রা যাবে সেই বিষয়েও বিস্তারিত পুলিশকে জানাতে হবে।

    তিনি এই বিষয়ে আলোচনার জন্য তাঁর অফিসে একটি মিটিং ডাকেন। সেখানে শহরের গণ্যমান্য বাবুদের তিনি আমন্ত্রণ জানান। সেই তালিকায় ছিলেন, রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, অপূর্বকৃষ্ণ দেব বাহাদুর, কমলকৃষ্ণ দেব বাহাদুর, কুমার রুক্মিণী বল্লভ, রানি উমাসুন্দরী, বাবু মাধবচন্দ্র সিকদার, ভগবানচন্দ্র ভট্টাচার্য, মন্মথ দেব, চারুচন্দ্র ঘোষ, হীরালাল শীল, দুর্গাচরণ রাহা, কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীমোহন সুর, রাজকুমার শেঠ, রাজেন্দ্র মল্লিক, কিষ্টমোহন বসাক, দর্পনারায়ণ বসাক, প্রাণনাথ ঘোষ, গোবিন্দচন্দ্র দত্ত, হ্যারিমোহন বিশ্বাস, দুর্গাচরণ মান্না এবং হরুনাথ মল্লিক।

    যাঁদের জমি বা মাঠে এতদিন শলাকা বিঁধিয়ে চড়কের উৎসব হত, তাঁদের জানানো হয়, পুলিশ এবং কর্পোরেশনের অনুমতি ছাড়া মাঠ ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। কর্পোরেশন চায়, এই প্রথা রদ হোক। মাঠ ব্যবহার করতে গেলে, যাঁদের অধীনে মাঠ রয়েছে এবং কর্পোরেশন দু’তরফের অনুমতি নিতে হবে। যেখানে জমায়েত হয়ে মেলা বসবে, সেখানে শর্তসাপেক্ষে এই অনুমতি দেওয়া হবে, কিন্তু শর্ত এই যে, কিছুতেই যেন বাণফোঁড়া না হয়, তাহলে সেখানে মোতায়েন করা পুলিশ যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেবে। এই আয়োজনে নাকি সেবার আইন অমান্য করার দরুন পাঁচটি চড়কের আয়োজন বন্ধ করা গিয়েছিল। একুশজনকে এই বাণফোঁড়া চড়কে ঝোলা থেকে বিরত করা গিয়েছিল।

    বাবু এবং ইংরেজদের হঠাত এতো মাথা ব্যাথার কারণ চড়কের মতো একটি প্রথা কেন হয়ে উঠল জানা নেই। হুতোম তাঁর বর্ণনায় দেখিয়েছেন, কোনও-কোনও বাবু আধুনিক সমাজের চাপে চড়ক অপছন্দ করেন, কেউ-কেউ নিজে ব্রাহ্ম হয়েও ‘সাত পুরুষের ক্রিয়াকাণ্ড’ বলেই চড়কে আমোদ করেন!

    যতই আইন দিয়ে চড়ক বন্ধের চেষ্টা করা হোক, কিন্তু সব কিছু তো আইন মেনে হয় না, মানুষের ধর্মাচারণ, আবেগ এবং সর্বোপরি চাপিয়ে দেওয়া আইন সবকিছু রুখতেও পারে না। কোথাও না কোথাও বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ঠিকই জ্বলে ওঠে। এমন দুটি ঘটনা ঘটেছিল, যার জন্য পুলিশ কমিশনার V.H. Schalch তাঁর বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন; সেই বিবৃতিতে তিনি জানান—

    ‘বলতে বাধ্য হচ্ছি, এত আইন-আয়োজন সত্ত্বেও দুটি অনভিপ্রেত ঘটনা শহরের বুকে ঘটেছে। অন্তত, তিনজন তাঁদের নিজেদের শরীরে বাণ ফুঁড়েছিলেন। তবে ঘটনাদুটি ঘটেছে, ঠিক শহরে নয়। শহরে হলে, আমরা হয়তো সঙ্গে-সঙ্গেই রদ করতে পারতাম। নজরদারিও ছিল যথেষ্ট। ঘটনাদুটি ঘটেছে, শহরতলির দুই জনপদে। পুরনো বালিগঞ্জ এবং বেলতলাতে। আমরা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ লোক পাঠাই। যার জায়গায় এই আয়োজন হচ্ছিল, তাঁকে আদেশ দেওয়ায় তিনি চড়ক গাছ তুলে ফেলেন। অন্য একজন জমির মালিক নাকি এই বিষয়ে বিশেষ জানতেন না। এঁরা হলেন, বাদুড়বাগানের জগন্নাথ দত্ত এবং বেলতলার রামপ্রসাদ সিংহ। তবে অত্যন্ত শ্লাঘার সঙ্গে জানাচ্ছি, এইবার শহরতলিতে সতেরোটা চড়ক অনুষ্ঠান হয়েছে, এই তিনজন ব্যতিরেকে সাতচল্লিশজন মানুষ, পিঠে কাপড় বেঁধে, গাছের সঙ্গে ঘুরেছেন।’

    এর মাঝে কিছুদিন খানিক চুপচাপ থাকলেও, তলে তলে বোধহয় অন্ত্যজদের এই উৎসবের প্রতি ঘৃণা জমছিল। ১৮৭৪ নাগাদ কলিকাতার সেই সময়ের ক্ষমতাসম্পন্ন বাবুরা সকলে একযোগে গেলেন নগরপাল, পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ-এর কাছে। তাঁদের দাবি, সং বেরনো বন্ধ করতে হবে। এ একেবারে অশ্লীল ব্যাপার। অ্যাদ্দিন সারা শরীর ফুঁড়িয়ে, মদ খেয়ে, নেচে গেয়ে আমাদের সভ্য সংস্কৃতিকে এঁরা একেবারে ডকে তুলে দিচ্ছে। পুলিশের নির্দেশিকা প্রকাশ পেল, কিন্তু কাঁসারিপাড়ার মানুষদের রোখে কে! তাঁরাও নাছোড়! দিব্যি তাঁরা সং বের করলেন, সঙ্গে নতুন গান!

    ততদিন অবধি শুধু খবরের কাগজগুলি সং আর চড়কের বিরুদ্ধে তোপ দাগছিল, এইবার আসরে নেমে পড়ে ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাও। তবে তাতে সঙের দলের বিশেষ কিছু যায় আসেনি। তাঁরা আরও সদর্পে সোচ্চারে রাজপথে এসে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। উল্টে সঙের দল জানাল, ‘যদি আপনাদের মনে হয় যে এইসব সমাজের জন্য খুব খারাপ, তাহলে আপনারা আপনাদের স্ত্রীদিগকে ঘরের মধ্যে রেখে দিন।’ (যাতে তাঁরা এইসব অশ্লীল জিনিস দেখতে না পারে)

    এরপর বিডনের আদেশানুসারে কলকাতায় চড়ক বন্ধ করার তোড়জোড় হয়। ১৮৬৫-তে আইন করে, বাণ ফোঁড়া, কাঁটাঝাঁপ দেওয়া ইত্যাদি বন্ধ হয়। অনেকে বলেন একদিনে নয়, বরং আইন, পুলিশ, ধরপাকড় সব মিলিয়ে ১৮৬৩-’৬৫ এই দুই বছরের মধ্যে চড়ক বন্ধ করার প্রভূত চেষ্টা হলেও সেভাবে চড়ক বন্ধ হয়নি, বন্ধ হয়েছিল বাণ ফোঁড়া, ঝাঁপ ইত্যাদি।

    উত্তর কলকাতার বিখ্যাত চড়ক, ছাতুবাবুর চরক, এখনও বহাল তবিয়তে আছে। এটিই কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন এবং বহমান চড়ক। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে খানিক জৌলুস কমলেও, কখনও এখানে চড়ক বন্ধ হয়নি। ছাতুবাবু বাজারের চড়কের প্রারম্ভ হয়েছিল, রামদুলাল সরকারের মাধ্যমে। রামদুলালের দ্বিতীয় পত্নী ছিলেন, নারায়ণী দেবী। তাঁর বাপের বাড়ি ছিল বাগবাজার। সেখানে বিশাল এক চড়ক হত, যা ষোল চরকির চড়ক বলে পরিচিত। কোম্পানির আমলে নানা কারণে সেই চড়ক বন্ধ হয়ে যায়। তিনি রামদুলালের কাছে চড়ক করতে অনুরোধ জানান। রামদুলালে অধীনে ছিল বিরাট-বিরাট মাঠ। তিনি এমনিই ধনী মানুষ। সেই সময়ে কোম্পানি বাগান নামে যে-মাঠ, যা এখন রবীন্দ্রকানন বলে পরিচিত, সেখানে চড়ক শুরু করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা চড়ক রদের জন্য বোধহয়, সেখানে একটি স্থায়ী পালকি স্ট্যান্ড তৈরি করেন। সেখান থেকে রামদুলাল চড়ক সরিয়ে নিয়ে যান বিডন স্ট্রিটের মাঠে, যা এখন ছাতুবাবুর বাজারের মাঠ বলে পরিচিত। ১৮৭০ থেকে এখানে চড়ক চলে আসছে। হয়তো এ এক আশ্চর্য সমাপতন, যে-বিডন চড়ক বন্ধ করেছিলেন, সেই তাঁর নামাঙ্কিত রাস্তায় চড়ক এখনও কলকাতা তথা বঙ্গ বিখ্যাত। কোনও আইন, কোনও শাসন, কোনও চোখরাঙানি কলকাতার এই প্রাচীন চড়ককে বন্ধ করতে পারেনি!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook