সন্ধ্যায় অফিসফেরত ময়দানের অন্ধকার। নবনীতা কিছুদিন হল পদ্মে পুরোপুরি আত্মনিবেদিতা।
‘ডিভোর্সের পর কী করবে, পদ্মদা?’
‘তুমি তো আছ!’
‘কিন্তু কীভাবে?’
‘তোমার সংগৃহীত ‘হন্টেড হাউস’-এ একত্র কালাতিপাত করব। যেমন একমাস ধরে চলছে। সপ্তাহে দু-দিন। সত্যি, একটা জুটিয়েছ বটে!’
‘ন-ন্-না। বিয়ে করব ভাবছি তোমাকে। তোমাকে।’
‘কেন?’
‘আরে আমার জন্য… আমার ছেলেটার জন্য দরকার আছে। কিচ্ছু বুঝতে চাও না তুমি। না কি বুঝেও না বোঝার ভান করো!’
পদ্মের মানস-গণ্ডে একটা বরফ-থাপ্পড় পড়ে যায়। … ওরে বাবা! বিয়েটা তাহলে… অন্য কারোর ছেলে এবং অন্যের ছেলের মায়ের জন্য!
‘দেখি। ডিভোর্সটা তো এখনও হয়নি। ঢের দেরি।’
‘উঃ! বড্ড বোর করছ। তাড়াতাড়ি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো। এবার চলো, চক্ররেলে উঠি।’ রোমান্টিক-চলন্ত-ফাঁকা চক্ররেল বড় প্রিয় স্থান।
ময়দান থেকে ট্যাক্সিতে প্রিন্সেপ ঘাট। তারপর চক্ররেল। ফাঁকা বগি। মুখোমুখি দুজন। সামনের সিটে নবনীতার দু-পায়ের ফাঁকে পদ্মস্থাপন পদ্মের। যোনি ও পদাঙ্গুলির বিদ্যুত-সংযোগ। নবনীতার ‘আঃ’ ধ্বনি শেষ হয়নি, তক্ষুনি পদ্মের কলার ধরে নিল কয়েকটা ভ্যাগাবন্ড। কোথায় অদৃশ্য হয়ে ঘাপটি মেরে ছিল ব্যাটারা কে জানে! শুরু হয়ে গেল চড়-থাপ্পড়। খিস্তিখামারি। ভ্যাগাবন্ড হলেও ওরা প্রকাশ্যে দেহলীলা করতে দেবে না। পদ্মনাভের ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছিল।
‘তবে রে বেজন্মা বজ্জাতের দল!’ হুংকার উঠল বেঁটেখাটো জবরদস্ত শরীর চিরে। আর সেই বাটখাড়া-সদৃশ গোটা শরীরটাই যেন অস্ত্র বনে গেল। শুধু ফিজিক্স আর ফিজিওলজি দিয়ে জিতে গেল সে। এই গল্পটাই পরের দিন অফিসের আড্ডায় রঞ্জনদের কাছে হয়ে উঠল লেহ্যপেয়। এই না হলে পদ্মনাভ!
*
প্রতি রাতে হাওড়ার এক ঘরের ভাড়ার বাসাটা ধর্ষণে-ধর্ষণে প্রকম্পিত হয়। দেওয়াল কাঁদে… সিলিং কাঁদে… বিছানা কাঁদে আর কাঁদে বুগলি। হাতে একটা টাকাও নেই। পালাবে কি না তাও বুঝতে পারে না। শরীরে কোনও জোরই নেই। সারাদিন শুধু বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা। বাইরে থেকে কেনা খাবার পদ্মই নিয়ে আসে। রান্নাবান্নার পাট নেই। কে জানে কিছু মেশায় কি না! আচ্ছন্নভাবে ভাবতে চায় বুগলি। পুরোপুরি পরাস্ত, বিধ্বস্ত ও বিভ্রান্ত এক শরীর। পদ্মনাভের ট্রিটমেন্ট-আক্রান্ত প্রাণীটা তার বিস্রস্ত ন্যাকড়াচোকরার তলা থেকে বেরিয়ে আসা নগ্ন দুই ঊরুর উপরে বেছানো শক্ত বড় আর্টের বইটার উপরে মেলে রাখা ডিভোর্স পেপারে সই করে দেয়। কিছু বোঝার বা ভাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না।
‘আঃ! হিপ হিপ হুররে! জিতে গেছি, রঞ্জন! জিতে গেছি। সই করে দিয়েছে বুগলি। এবার চটপট বাকিটা সারতে হবে।’
‘কী যে একটা করলে… ছি ছি… তুমি একটা যা-তা। এতটা না করলেও পারতে, বস!’
যথা সময়ে বিবাহবন্ধনে আইনকানুনে ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু পদ্মের এস-এল-আরে (SLR) তোলা বুগলি-সুন্দরীর আবক্ষ সাদাকালো ছবিটি পাতি ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে ঝুলতে থাকে দেওয়ালে। স্বল্প-পরিচিত কেউ যদি ছবিটাকে দেখিয়ে জানতে চায়, ওটা কার ছবি? পদ্ম দশ হাত বুক ফুলিয়ে বলে, ‘আমার এক্স ওয়াইফের।’ এই উক্তি করতে পারলে বেজায় পরিতৃপ্তি বোধ করে সে। ঠিক একই রকম সুখানুভূতি হয়, যখন আয়নার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে জেমস বন্ডের মতো পদ্ম বলে, ‘আমি পদ্ম। পদ্মনাভ।’
মানিপেনি আবার ফিরে এসেছে খাবারের প্লেটের কাছে। প্রশ্রয়ের স্নেহহাস্য জেগে ওঠে পদ্মের মুখে। বেড়ালিনী এসে শুয়ে পড়ে কেঠো পুরুষের কোলের মধ্যে। ওর কানের পাতার ক্ষতগুলোতে ওষুধ লাগানো হয়েছে।
এদিন রাতেই যে এমন একটা সংঘর্ষ ঘটবে তা ভাবা যায়নি। খাওয়া-দাওয়া সেরে অনেক রাত করেই ঘরে আসছে পদ্ম। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে শোনে, ‘ফ্যাঁস্-স্-স্।’
ছানার জলের মতো জ্যোৎস্নাভাসা ঘরে বড় টেবিলটার ওপর মানিপেনিকে ভয়ংকর থাবায় ঠেসে ধরেছে গামা বেড়াল। স্বজাতির সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহে ক্ষতবিক্ষত সেই পাষণ্ড হুলোটা। গামা নামটা পদ্মেরই দেওয়া।
‘হুস্-স্-স্।’
মানুষের দাবড়ানি শুনেও সে মানিপেনিকে ছাড়ল না। পদ্মের দিকে মুখ ফেরাল মাত্র। ওর দেহভঙ্গির ভাষাটা এমন, যেন পদ্মকে বলতে চায়, কী রে কিছু বলবি? এই অবজ্ঞায় মানুষটার মাথায় ক্রোধের বিস্ফোরণ হল।
আমার দেওয়া নাম নিয়ে ঘুরছিস শালা, এত মস্তানি তোর! তুই কার হাতে পড়েছিস তুই দেখবি? দেখ তাহলে!
… সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল গামা বেড়ালের উপর। চৌকাঠের সামনে পাপোশ করে রাখা চটের বস্তাটা বাঁ-হাতে নিয়েই ঝাঁপিয়েছিল। ডান হাত দিয়ে চেপে ধরেছে ওটার ঘাড়। প্রাণীটা এবার মানিপেনিকে ছেড়ে থাবা চালিয়েছে পদ্মকে। ততক্ষণে বস্তাবন্দি ব্যাটা। বস্তার মুখ অবশ্য শুধুমাত্র হাতেই মুঠো করে ধরা, দড়ি বাঁধার অবকাশ মেলেনি। এই অবস্থায় বস্তা শূন্যে ঝুলতে-ঝুলতে চলেছে বাঁধানো উঠোনে। কলতলায়। তারপর বস্তাহস গামাকে প্রবল আছাড়। আছাড়ের পর আছাড়। এখানে ওখানে। পাঁচিলে মেঝেতে, দমাদ্দম, ধপাস ধাঁই। … বস্তার ভেতরে লড়াকু শক্তিপুঞ্জ এক। রবারের মতো, স্প্রিং-এর মতো, ইস্পাতের মতো। সঙ্গে ‘আঁও আঁও’ গর্জন। একে কি আর ধরে রাখা যায়? বেধড়ক্কা ধ্বস্তানোর মধ্যে হঠাৎই হাত ফস্কে বস্তাসুদ্ধ গামা বেড়াল ছিটকে পড়ল পাঁচিলের গায়ে। পালাল ব্যাটা। এবং দেখা গেল পদ্মের হাত ও আঙুল ক্ষতবিক্ষত, রক্ত পড়ছে। ইনজেকশন নিতে হল। আমায় তুই হেঁচড়েছিস, কামড়েছিস! তোকে তো আমি বাঁচতে দেবই না! খুন করেই ছাড়ব তোকে। আমার উপর মস্তানি?
হাতের অবস্থা দেখে অফিসে তো সবাই থ।
‘এ কী! এটা কী করে হল?’
‘গামা বেড়ালের সঙ্গে লড়াই।’
‘বলো কী? বেড়ালের সঙ্গে মানুষের লড়াই?’
‘হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।’
‘ওরে বাবা! তুমি অরকম জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিও না আমাদের দিকে! আমরা কেউ লড়ব না তোমার সঙ্গে!’
দূর থেকে নবনীতা তাকিয়ে ছিল চোখ সরু করে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর বুক চিরে— ‘ও মাই গড!’
টিফিনের সময়ে নবনীতা জানতে এল আহত পদ্মের জন্য কিছু টিফিন কিনে আনতে হবে কি না।
‘জানো পদ্মদা, আজ একটা নতুন ছেলে জয়েন করল। হেব্বি হ্যান্ডসাম, বুঝলে। আমার পাশেই সিট দিয়েছে ওকে।’
নিজের হাতের ক্ষতগুলো পরখ করতে করতে পদ্মের প্রশ্ন, ‘বয়স?’
‘আমার চেয়ে পাঁচ বছরের জুনিয়ার।’
‘বাঁচা গেল। ম্যাচিং নয়।’
‘কী যে বলো না! ভাল্লাগে না।’
‘নবনীতা, আজ কোথায় যাব? ভিক্টোরিয়া?’
‘নাহ্। ঘুরে-ঘুরে আমি ক্লান্ত। হন্টেড হাউসেও যাব না। তোমার যা হাতের অবস্থা, তুমি পারবে না।’
‘কী পারব না?’ ঘোরালো চোখে পদ্মের প্রশ্ন।
‘যাও! তুমি না একটা জন্তু!’ হাসতে-হাসতে চলে যায় নবনীতা।
নতুন ছেলেটা বসে আছে নবনীতার পাশের সিটে। পবিত্র, নবীন মূর্তি।
পদ্ম তার বেয়াল্লিশের হালকা টাক-পড়া মাথা, জঙ্গুলে দাড়ি-গোঁফ, আর ঘোরালো দৃষ্টি নিয়ে গিয়ে বসল ওদের মধ্যে। কী একটা কথায় নবনীতা তখন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল। খুব প্রাণবন্ত আর ফ্রেশ লাগছে ওদের।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র