শেষ অঙ্ক
খুব সম্ভব এটাই রোনাল্ডোর শেষ বিশ্বকাপ, এদিকে তিনি তেমন ভাল খেলতে পারছেন না, বরং সতীর্থর গোল নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তার ওপর তাঁর এখন কোনও ক্লাব নেই, এহেন ভব-সিনারিওতে কিনা, কোচ রোনাল্ডোকে বসিয়ে দিলেন। নামানো হল এক ২১ বছরের ছেলেকে। কমেন্টেটরদের অবধি চক্ষু ছানাবড়া। এ ছেলে তো নবিশ হে, হুইসল শুনলেই পা কাঁপবে। বিশ্বের এক সেরা খেলোয়াড়ের প্রক্সি দেওয়ার চাপে চ্যাপ্টা, মামা-পাপা লয়ে যা ধাপা। ওরে রোনাল্ডো নেই দেখেই তো প্রতিদ্বন্দ্বীর মনোবল মনুমেন্টে। রোনাল্ডোও নিশ্চয়ই ভাবছিলেন, তবে আয়, কোটি-কোটি লোকের সামনে প্রমাণিত হয়ে যাক আমি অপরিহার্য, প্রি-কোয়ার্টার নয় বুদ্ধুর কার্য, বাপ-বাপ বলে ভাঙা দলের হাল ধরতে আমাকে নামাতে হোক। সে তো হলই না, বরং দল খেলতে লাগল দুরন্ত ও মসৃণ, অনাড়ষ্ট ও আনন্দিত, দাপুটে ও লাবণ্যময়, আর ১৬ মিনিটের মাথায়, তাঁর বদলি সেই খেলোয়াড়টিই দিয়ে বসলেন অলৌকিক গোল। তারপর এক সময় পর্তুগাল ছ’গোল দেবে, নতুন ছেলেটি বিশ্বকাপ-অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করবেন। রোনাল্ডো যদিও নামবেন, ৭৪ মিনিটের মাথায়, কিন্তু তার কোনও অর্থই থাকবে না, কারণ ততক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে, আসন্ন প্রেস কনফারেন্সের থিম রাগত স্বরে ‘রোনাল্ডো খেললেন না কেন!’ নয়, উল্টে গদগদ বিস্ময়ে, ‘এই ছেলেটি অ্যাদ্দিন খ্যালেননি কেন!’
যে-কোনও মানুষেরই নিজের প্রতি ভালবাসা বাড়াবাড়ি রকম, আর খ্যাতনামাদের অহং-এর যন্ত্রপাতি ভিনগ্রহী হর্সপাওয়ারে কাজ করে, লাগাতার সাফল্য এবং অবশ্যই নিজ প্রতিভার প্রতি বিশ্বাস তাঁদের চোখের সামনে একটা জ্যোতি-ঝক্কাস সেলফি ঝুলিয়ে রাখে। কোনও মহাতারকা ভাবতেই পারেন না, তাঁর ক্ষেত্রটিতে কেউ কোনওদিন তাঁকে ছাড়িয়ে যাবেন। পিকাসোর সামনে একজন ব্রাক-এর ছবির প্রশংসা করায় পিকাসো হোটেলের টেবিল থেকে সব ফেলে ভেঙে দিয়েছিলেন। বিভূতিভূষণের দিনলিপি গ্রন্থাকারে প্রকাশ হচ্ছে জেনে তারাশঙ্কর বলেন, ‘বিভূতির ডাইরি ছাপছ কেন? বিভূতি কি রামকৃষ্ণ পরমহংস বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়েছে?’ রোনাল্ডো বা মেসি বহু বিরাটের চেয়েও অনেক বিরাট, কারণ তাঁরা কত বছর ধরে কত ম্যাচে নিজেদের অতিলৌকিক প্রমাণ করে আসছেন, তার ইয়ত্তা নেই। লোকে একটা ব্যালন ডি’অর পেলে বর্তে যায়, রোনাল্ডো পেয়েছেন পাঁচটা। সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাঁর চেয়ে বেশি গোল কেউ দেয়নি। তাঁর সব খেলা দেখেটেখে বিরোধী দল পাল্টা-ছক কষে রাখে, বল ধরামাত্র ঝাাঁপিয়ে পড়ে, তা সত্ত্বেও কোন জাদুতে তিনি মোক্ষম মুহূর্তে গোল দেন। পৃথিবীজুড়ে ভক্তরা তাঁর নাম লেখা জার্সি কেনে, পোস্টারে ধূপধুনো দেয়।
সেই লোকের অহং স্বাভাবিকভাবেই হবে গ্র্যানাইট পাহাড়ের মতো ধাঁইপেয়ে ও স্ফটিক-ঝাড়লণ্ঠনের মতো আলতুয়া, কেউ একবার ওষ্ঠ বেঁকালেই তাঁর হৃদয়ের ভুরু কুঁচকে সেকেন্ড ব্র্যাকেট। তাঁকে বাদ দিয়ে তাঁর দলকে মাঠে নামানো যায়, এ-কথা কিছুদিন আগের বিশ্বে অভাবনীয় ছিল, প্রায় বেআইনি, তারপর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের কোচ সে-কাণ্ড শুরু করেন। পৃথিবী জুড়ে পেল্লায় হট্টগোল হয়, রোনাল্ডো ইন্টারভিউয়ে বলেন তিনি এই কোচকে শ্রদ্ধা করেন না, তারপর দল ছেড়ে দেন, আচমকা জাতীয় দলের কোচও প্রথম একাদশ খেলিয়ে দিলেন রোনাল্ডোকে বেঞ্চে বসিয়ে। ক্যামেরা নাগাড়ে তাঁকে দেখাচ্ছে, জেনে তাঁর মুখ রাখতে হল ভাবলেশহীন, হাততালি দিতে হল দলের টুকটাক সুবিধে-সংগ্রহে, তারপর রোনাল্ডোর বদলি গোল দিলেন, আর রোনাল্ডোকে সেই গোলের উল্লাসে প্রাণপণ নাচতে হল সর্বকাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। নিশ্চয়ই দলের সাফল্যে তিনি খুশি, নির্ঘাত নয়া খেলোয়াড়ের শৈলী তাঁর নজর এড়ায়নি, কিন্তু তাঁকে বাদ দিয়ে বিজয়োল্লাসে তিনি অভ্যস্তও নন, আর এত বড় আইকনের বুকে অন্যের জয়কীর্তন প্রথমেই একটা শলাকা বিঁধিয়ে দেয়, তারপর তথ্যটাকে কার্ডবোডে হেলান দিয়ে এনে দাঁড় করায়, ব্যাকগ্রাউন্ডে ক্ষোভের শনশন। রামায়ণে আছে, ঋদ্ধিমান পুরুষ অন্যের শংসা সহ্য করতে পারেন না। রামায়ণ না পড়েও বোঝা যায়, ঋদ্ধি সিদ্ধি চক্রবৃদ্ধি, যা দিয়ে গড়ো হোক লোক, কেউই নিজে সাইডলাইনে নখ খেতে-খেতে অন্যের সাফল্য দেখা সইতে পারে না।
একদিন সব খেলোয়াড়কেই রিটায়ার করতে হবে, একদিন ব্র্যাডম্যানকেও ব্যাট নামিয়ে রাখতে হবে, সবাই জানে, কিন্তু জানা আর মানা তো এক নয়। ২১-২২ বছরের ছেলে যখন ৪০ বা ৫০ বছরের লোককে ঘাটের মড়া ভাবে, তখন কি সে সত্যি ভাবতে পারে, তারও একদিন অমন বয়স হবে? যুধিষ্ঠির যে বলেছিলেন, সবাই মরছে কিন্তু লোকে ভাবছে তারা মরবে না, এ-ই বিস্ময়, এরই ন্যাজ ধরে বলা যায়, সবাই বুড়ো হচ্ছে কিন্তু কেউ কখনও ভাবে না তার যৌবন আদৌ ফুরোবে, এ-ই ট্র্যাজেডি। সমস্ত মনটায় কামাল কি তাজগি, চনচন রস উইট উদ্যম সাধ, কিন্তু মেয়েরা মাথায় টাক দাড়িতে পাক দেখে ‘কাকু’ বলে প্রণাম ঠুকে পালাল, এই সত্য আত্মাকে চকিত-রদ্দায় বোমকে রাখে। তেমনই, তেন্ডুলকর অবসর নেওয়ার পরদিন সকালে উঠে যখন চকিতে এই তরোয়াল খান, আর কোনওদিন খেলব না, কক্ষনও কদাপি নয়, তাঁর কি ধরণী কেঁপে ওঠে না? তাঁর কি মনে হয় না, কী আশ্চর্য, সমান নিশপিশ করছে হাত ও সত্তা, বল দেখলেই চিনে নেব বাঁ-দিকে সুইং ভাঙবে না এক পা বাড়ালে ফুলটস, ইচ্ছে করলেই দুই ফিল্ডারের মধ্যে দাগ টেনে তার মধ্যবিন্দু দিয়ে একশোয় একশোবার বাউন্ডারি পার, বোলারের আগে বুঝব পরের ডেলিভারি স্লোয়ার করবে না ইয়র্কার, আর আমি কিনা নির্বাসিত? অন্য ক্রিকেটার অধিষ্ঠিত? কোন দোষে? কী প্রথায়? যাঁরা বিশ্বের সেরা কীর্তিমান, তাঁরা গোটা জীবনটা নিবেদন করে দেন তাঁদের কাজে। কবিতা না লিখতে পারলে কবির দিন ব্যর্থ, ল্যাবরেটরির বাইরে বৈজ্ঞানিক নিতান্ত বস্তু-ক্যাবলা। যখন খেলার প্রহর শেষ হয়, খেলোয়াড় ভাবতেই পারেন না এমন অবিচারের ভূমিতেও তাঁকে ছিটকে পড়তে হবে। নেট প্র্যাকটিসে আর যাব না? দশ পাক দৌড়ে তারপর গোলে গোলার মতো শট মারব না? তবে কী করব মুঠোভর্তি মুহূর্তগুলো নিয়ে? নায়ক যখন শোনেন তাঁকে এবার বাবার রোল করতে হবে, তিনি বাথরুমের ছলে উঠে গিয়ে বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে চোখ চেপ্পে দুঃস্বপ্ন তাড়াতে চেষ্টা করেন না, যেন তারা ক্ষণিক ভ্রমপোকা?
আর কেউ যদি দিব্যি ফর্মে থাকাকালীনই দেখেন তাঁর হাত থেকে রাজদণ্ড ভিড়ের মধ্যে কে বা কারা তালেগোলে কেড়ে নিচ্ছে, হড়হড়িয়ে পিছলে যাচ্ছে পায়ের তলা থেকে চির-পোষা গোল্লা-গ্লোব, তখন প্রেস কনফারেন্সে বা চ্যানেলের বাইটে স্থৈর্য দেখাতে হয় বটে, কিন্তু নিজেকে থামাতে দাঁত ঠোঁটে কেটে বসে, আর্তনাদ চাপতে গলা-নলি ব্যথা। গোটা জীবনটা যাঁর কাছে ব্যাখ্যাত ছিল শুধু ফুটবলের সাফল্য দিয়ে, গোল করে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঝাঁকানো দিয়ে, সম্মোহিত স্তম্ভিত সসাগরা দুনিয়ার কুর্নিশ আস্বাদন দিয়ে, তাঁকে যদি হঠাৎ শুনতে হয়, ‘ইয়ে, দিন হল অবসান’, তিনি থতমত খেয়ে এদিক-ওদিক তাকান আর ভাবেন, ই কী রে, এটাই সেই মাঠ ঘাস গ্যালারি তো, এই আমার শেষ বিশ্বকাপের নিয়তি-নির্দিষ্ট রূপকথা-ন্যারেটিভ তো! তাহলে সহসা সব গুলিয়ে যাচ্ছে কেন, বিশ্বাসঘাতকতার পোড়া গন্ধ আসছে কোত্থেকে, ঘড়ি আর প্ল্যানার লালে চুবিয়ে উল্টে ঝুলিয়ে দিল কে! এ জিনিস সহ্য করতে না পেরেই জিদান ঢুঁসিয়ে দেন, রোনাল্ডো হনহনিয়ে টানেলে ঢুকে যান। বলা হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচে তাঁকে ৬৫ মিনিটের মাথায় তুলে নেওয়ায় তিনি অসন্তুষ্টি দেখিয়েছিলেন, তাই কোচ রেগে গেছেন। হতে পারে। বলা হচ্ছে, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের কোচ সাহস দেখানোর পর থেকেই অনেকে বুঝেছিলেন, এই লোকটাকে নামালে বরং আধুনিক খেলার ছন্দ নষ্ট হচ্ছে। হতে পারে। কিন্তু এগুলো আসল সংকট নয়। রোনাল্ডো এরকম অনেক ধারণাকে লাথিয়ে পোঁটলা পাকিয়ে ছেড়েছেন। কিন্তু যখন অর্জুন গাণ্ডীব তুলতে গিয়ে সভয়ে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেন তাঁর জ্যা রোপণ করতে কষ্ট হচ্ছে এবং একটাও দিব্যাস্ত্র স্মরণ করতে পারছেন না, সে সংকটের তীব্রতা ও বিপন্নতার তুলনা নেই। আমি ব্যর্থ হচ্ছি! আমার লীলারও অন্ত ঘটে! সুন্দরকে যখন রূপ ছেড়ে যায়, জিনিয়াসকে যখন প্রতিভা ছেড়ে যায়— তা দেহকে আত্মা ছেড়ে যাওয়ার অধিক করুণ। যে ফুটবল ছিল তাঁর ক্রীতদাস, যে অতিমানুষিক নিপুণতা তাঁর চারপাশে অনুগত কুকুরের মতো ঘুরঘুর করত, যে অসম্ভব আশ্চর্যকে তিনি সাবলীল টানে এনে ফেলতেন প্রতিবার নিজের পায়ের চেটোয় শরণবিন্দুতে, তারা এখন ডাকলেই উপস্থিত হয় না, তাঁর ইচ্ছানুযায়ী বেঁকেচুরে নেচেকুঁদে ভেলকি দেখায় না, এই ঘটনা গিলতে রোনাল্ডোর হৃদয় রক্তাক্ত, অনিশ্চয়তা আর ভয়ে দম বন্ধ। যে-কোনও প্রতিভাবানের প্রকৃত লড়াই তাঁর নিজের সঙ্গে। রোনাল্ডো জানেন, আগের ফর্ম থাকলে তাঁকে বসানোর সাধ্য কোনও নশ্বর মানুষের হত না। হচ্ছে যে, যে কোচ রোনাল্ডোর কথানুযায়ী চলতেন তিনি আজ রোনাল্ডোকে বসিয়ে দিতে পারছেন, তার মানেই দিব্য-বলয় তাঁকে ছেড়ে যাচ্ছে এবার। দেহপট সনে নট, আর ডজ-শট সনে ফুটবলার সকলই হারায়, কিন্তু শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিন এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ লোকের জীবনে বিশ্বকাপের মধ্যেই হানা দেবে, এই গ্রিক ট্র্যাজেডি গোছের ধড়াস সর্বনাশ ভাবা যায়নি।
অবশ্য চাকা ঘুরতেই পারে। ঘুরলে চমৎকার। ঘোরে, অনেকের ক্ষেত্রে, তখন প্রত্যাবর্তনের অবিশ্বাস্য আখ্যান রচিত হয়, হয়তো স্লো-মোশনে তেমন ইন্দ্রজাল অপেক্ষমাণ। কিন্তু তখনও এই মহাকালের মেগা-তামাশার ইঙ্গিত আমাদের মন থেকে স্লিপ করে না যায়। কারণ আজ বাদে কাল, কাল বাদে পরশু, প্রত্যাহৃত হবেই আয়ুধ, তখন কোচকেই গিয়ে না বলতে হয়, আমাকে বসিয়ে দিন।