বাবার জন্য ইসবগুল কিনতে গেছিল বটাই। ফেরার সময় গোকুলদার দোকানের সামনে যে-লোকটাকে বেঞ্চে বসে-বসে ঠ্যাং দোলাতে দেখল, তাকে দেখে চেনা মনে হল। অনেকটা অনুপকাকুর মতো! ব্যাস, মগজে তুড়ুক নাচন লেগে গেল! মনে-মনে লোকটার ফোলা-ফোলা গালদুটো ভেতরপানে একটু ঠুকে দিয়ে, চিবুকটা খানিক চেপে দিতেই অনুপকাকুর মুখের আদল চলে এল। বটাইয়ের মনে হয় যে, একই মুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকে হাজারটা মুখ! তাই ফাঁক পেলেই ও মুখ বদলাবদলি করে।
বটাই এবার দাঁড়িয়েই পড়ল। আরও একটু খুঁটিয়ে নজর করতেই মনে হল কপালের চওড়া ভাবটা খানিক কমিয়ে, একটু প্যাঁচ মেরে ডানদিকের কপালে আধুলি সাইজের একটা আঁব গুঁজে দিলেই ওই লোকটাই অবিকল পোটোপাড়ার নগেনবাবু হয়ে যাবে!
শুধু রূপমতীর কচি পানপাতা মুখে অন্য কোনও মুখ খুঁজবে না বটাই। ও এখনও দেখেনি, রতনস্যারের অ্যাসিস্ট্যান্ট বজুদার মুখে শুনেছে। জলের দেশের মেয়ে রূপমতী নদীর বুকে যখন সাঁতার কাটে, তখন নাকি সাক্ষাৎ মৎস্যকন্যে!
বটাই একজন ম্যাজিশিয়ান। লাল গোলাপ থেকে গোলা পায়রা, কাগজের ফুলকে সোনাব্যাঙ বানানো ওর কাছে জলভাত! চোখ বুজে বাহান্ন তাসের মধ্যে থেকে ইস্কাবনের বিবি ও এক চান্সেই তুলে আনে!
এসব শিখেছে রতনস্যারের কাছেই। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় রতন ঘোষাল এসেছিল স্কুলে ম্যাজিক দেখাতে। গরমের ছুটি পড়বে সেদিন। বটাই হারুদের পেয়ারা গাছে দোল খাচ্ছিল আর স্কুলমাঠের দিকে নজর রাখছিল। স্টেজে গোছগাছ শুরু হতেই সামনে গিয়ে বসে পড়ল। জাদুকর কোনও একজন ছেলেকে ডাকতেই বটাই এক লাফে স্টেজের ওপরে।
‘কী করতে হবে স্যার?’
‘বেশি কিছু নয়, এই ফুলদানিটায় কী আছে দেখে জোরে-জোরে বলে দাও সবাইকে।’
‘কাঠিতে জড়ানো কাগজের লাল-নীল ফুল!’ বটাইয়ের চিৎকারে পান্থপাদপ গাছ থেকে টুনটুনিটা উড়ে গেল।
জাদুকর তারপর শূন্যে হাত ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে জাদুমন্তর বুলিয়ে দিল, ‘গিলি গিলি গো, গিলি গিলি গো’।
‘এবার দ্যাখো তো কী আছে?’
চোখ রাখতেই দুটো লাল পুঁতি নজরে এল বটাইয়ের। আরিব্বাস, পায়রাটা ওকে চোখ মারছে! কী দেখেছে বলার আগে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছেলেদের মুখগুলো বেশ তারিয়ে-তারিয়ে দেখে নিল। এক-একজনের ভাবভঙ্গি এক-একরকম! বলতে গেলে মানুষের মুখ নিয়ে ওর নাড়াচাড়া করার সেই শুরু!
মন্তরটা অঙ্কখাতার পিছনে যত্ন করে লিখে রেখেছে বটাই। ক’দিন বাদেই হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা। উনিশ-কুড়ির বেশি তো আর পায় না অঙ্কে! ওটা আউড়ে নম্বরটা যদি একটু পালটে নেওয়া যায়! অবশ্য এসব করেই বা কী হবে? লেখাপড়াটা যে ওর হবে না, তা বেশ বুঝে গেছে। তবুও বাপের গোঁ, পাশ একটা দিতেই হবে। তা পাশটাও দিয়েই ফেলল বটাই। সে এক ম্যাজিকই বটে! নাহলে ওদের ফার্স্ট বয় অমন জব্বর সাজেশনটা ওকে ডেকে-ডেকে দেবেই বা কেন! ওর ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা মেরে দিয়েছে আর মাঝেমধ্যে বাড়ি বয়ে স্কুলের হরিকাকার তেঁতুলের আচার দিয়ে এসেছে, তাই? বাবার ইচ্ছাপূরণ হয়েছে, এবার ওর পালা। ও ম্যাজিশিয়ান হবে।
রতন ঘোষালের খোঁজ পাবার আগেই নৈহাটি স্টেশনের বুকস্টল থেকে বটাই পেয়ে গেল ‘ম্যাজিকের অআকখ’। মুদির দোকানে বসে বিক্রিবাটার ফাঁকে-ফাঁকে তাসের খেলাগুলো বেশ শিখে ফেলল। নতুন দাঁত গজালে বাচ্চারা যেমন সবসময় কিছু-না-কিছু কামড়াতে চায়, বটাইও তেমন সারাদিন টুকটাক হাতসাফাই দেখিয়ে বেড়ায় সকলকে আর ম্যাজিক খুঁজতে থাকে! কত কিছু যে ঘটে চলে চারদিকে! এই তো সেদিন স্নান করার সময় জল তোলা ঘটিটা কুয়োয় পড়ে গেল। আঁকড়াওয়ালা কাঁটাটা যেন কোঁকড়াচুলো এক রাক্ষুসে মাথা! ঝনঝন করে নেমে গিয়ে বর্ষার ভরভরন্ত গভীর জল থেকে নাচতে-নাচতে যখন ঘটিটা তুলে আনল, বটাই ভারি অবাক। বইয়ে পড়া ম্যাজিকের থেকে কম কী!
মাস দুয়েক পরই বটাই একদিন ধরে ফেলল রতন ঘোষালকে। বৈঠকখানা বাজারে একটা পেতলের সিংহাসন নিয়ে দরাদরি করছে। বটাই সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পট করে চিনে ফেলল।
‘তুমি হরিমতী বয়েজে পড়তে না?’
‘হ্যাঁ স্যার, এখন পড়ি না, ম্যাজিক শিখতে চাই।’
সেই থেকেই বটাইয়ের যাযাবর জীবন। মা কান্নাকাটি করেছিল। ‘ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস। লজ্জা করবি না। নিজের হক ঠিকঠাক বুঝে নিবি।’ শেষ কথাটা মা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিল। তা ঠিক! তাই তো দলে ঢোকার পর প্রথম যেদিন রতন ঘোষাল রানাঘাটে দল নিয়ে গেল, বজুদা আর ঘন্টু ওকে যে চাপে রাখতে চাইছে ও বেশ বুঝতে পারছিল। প্যাঁচপয়জার বুঝে ফেলতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। আর স্টেজের ওপারের মানুষগুলো? আলুভাতে, ডালভাতের সাধারণ জীবন তো ম্যাজিকই চায়! করাতচেরা দুই খণ্ড শরীর জুড়ে যাওয়ার মতো যদি জুড়ে যেত ভাঙা মন, ভেঙে যাওয়া ঘর! কথার চকমকি, পোশাকের ঝকমকিই তো সব! মাঝসমুদ্রে বাক্সবন্দি ম্যাজিশিয়ানের শিকল কেটে বেরিয়ে আসা, সেও তো দুঃখী মানুষেরা সুখস্বপ্নের মতো বুকের ভেতর জিইয়ে রাখে। শো চলার সময়ে বটাইয়ের এই কথাগুলো মনে হয়।
হয়েও তো গেল কতগুলো দিন রতনস্যারের কাছে! বছর পাঁচেক তো বটেই! কত যে গাঁ-গঞ্জ-শহর ঘুরে বেড়াল, তার ঠিকঠিকানা নেই! ম্যাজিক যত না দেখাল, দেখল বোধহয় তার চেয়েও বেশি! নীলকণ্ঠ সার্কাসের শীলা হাসতে-হাসতে বলেছিল, ‘সত্যিই তুমি ম্যাজিক দেখাতে পারো?’ নাহ, বটাই পারে না। পারলে পাশের শহরে শো করে ভজহরিপুরের মেলায় ফিরে এসে শূন্য মাঠে ধুলোর ঘূর্ণি দেখতে হত না!
শীত আসতে বেশি দেরি নেই। রান্নাঘরের খোড়ো চালটা মেরামত না করলেই নয়! রফিকুলকে ডাকা দরকার।
হঠাৎ সদরের কড়াটা নড়ে উঠল। রতনস্যার দাঁড়িয়ে আছে। বটাই নেমে এসে চেয়ার এগিয়ে দিল। ‘তোমার বাবা কোথায় বটাই? কথা আছে।’ বাবাকে খবর পাঠাল বটাই। বটাইয়ের মনে পড়ল, দিন কয়েক আগে নবাবহাটের একশো আট শিবমন্দিরে বসে রতনস্যার ওর বয়স জানতে চেয়েছিল। ও চট করে বলতে পারেনি। চানাচুর, নিমকি, চা খেয়ে আসল কথাটা পাড়ল : ‘আমার মেয়েটা লেখাপড়া বেশিদূর করেনি কিন্তু মেয়ে আমার লক্ষ্মীমন্ত। বটাইও আমাদের খাটিয়ে ছেলে। বেশ মানাবে দুটিতে।’ বটাইয়ের রক্তে নাচন লাগে।
রতনস্যার তারপর একটু থেমে বলল, ‘সামনের বৃহস্পতিবার ভাল দিন। ওইদিন আপনারা আসুন, সব দেখে-টেখে যান।’
তা সব কিছু দেখে ভারি ভাল লাগল বটাইয়ের। শুভদিনে গোধূলি লগ্নে বটাই রতনস্যারকে বাবা ডেকে আশীর্বাদ চেয়ে নিল।
গতকাল রাতে অষ্টমঙ্গলা থেকে ফিরেছে বটাইরা। ওদের বাড়ির পেছনেই শালুকপুকুর। পুকুরঘাটের বাঁধানো চাতালে রূপমতী আর বটাই বসে আছে। অঘ্রানের হিম কুয়াশায় চরাচর আচ্ছন্ন। রূপমতী তখনই কথাটা তুলল।
‘তুমি কি এখনও ঘুরে-ঘুরেই বেড়াবে? আমি কিন্তু বাপু এভাবে ঘুরে-ঘুরে সংসার করতে পারব না, এই বলে দিলাম, বুঝলে! কী হল, বলো!’
কীই-বা বলতে পারে বটাই, অমোঘ সেই অক্ষরগুলোয় জাদুদণ্ড বুলিয়ে দেওয়া ছাড়া? ‘হিম পড়ছে রূপু, ঘরে চলো।’
পুকুরপাড়ের বটগাছটায় জোনাকিরা জ্বলছে, নিভছে। রূপমতীর মুখের দিকে তাকিয়ে ও কিছু বুঝতে পারল না। কী জানি কী ভাবছে! তেমন হলে মাসখানেক পর বেরিয়ে পড়বে দক্ষিণের দিকে। কথাবার্তা মোটামুটি হয়েই আছে।
চুপচাপ বসে থাকতে-থাকতে বটাইয়ের চোখে ঝিম ধরে যাচ্ছে। চটকাটা ভেঙে গেল। রূপমতী কিছু বলছে না কি?
‘দুটো ঘর হলেই হবে। সামনে লেবু-লঙ্কা লাগাব আর পেছনে পুঁই, চালকুমড়ো। ঘাটে থাকবে ডিঙিনৌকা। পূর্ণিমার রাতে ঘুরে বেড়াব জলের বুকে। কী গো ম্যাজিশিয়ান, পারবে না?’
রূপমতীর মধুমাখা চাউনিতে বটাই এক্কেবারে কুপোকাত! ওর জাদু ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এল।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র