ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • নানা হাসি রাশি রাশি

    স্বস্তিক চৌধুরী (May 4, 2025)
     

    হাসি। কখনও মুচকি, কখনও অট্ট। হাসির অভিঘাত এক-একজনের দৃষ্টিকোণে এক-একরকম। তার প্রভাবও বিস্তর। ইতিহাস টিউশন শেষে মেয়েটির ঘাড় ঘুরিয়ে বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া হাসি, দীপুকে রাতে ঘুমোতে দেয় না। আবার রেজাল্ট হাতে পেয়ে পাস নম্বরটুকু উঠে যাওয়ায়, একগাল স্বস্তির হাসি নিয়ে বাড়ি ফেরে বিল্টু। অন্যদিকে সকাল থেকে উচ্ছে, আলু-চচ্চড়ি হবে শুনে, পাতে সুগন্ধি পোলাও আর লেগপিস দেখার পর হতচকিত মুখে পিকলুর হাসি প্রাণভোলানো।

    তবে হাসিরও প্রকারভেদ আছে। রেজিগনেশন লেটার সেন্ট হওয়ার পর বিজয়ীর হাসি কিংবা চাকরি পেয়ে প্রথম মাইনে ঢোকার নোটিফিকেশনের হাসি, উভয়ই খানিক ব্যক্তিগত আত্মশ্লাঘার। প্রথমবার কাজের প্রয়োজনে কলকাতা ছেড়ে ডানা মেলে ওড়া বা এক দশক ব্যাঙ্গালোরে কাটিয়ে অনেক কষ্টে নেওয়া ট্রান্সফার, দুটোতেই উইন্ডো সিট্ মিললেও ঠোঁটে হাসিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন তৃপ্তির সংজ্ঞাবাহক। ওই যে শুরুতে বললাম, দৃষ্টিকোণের তফাৎ। পাড়ার পাঁড় মোহনবাগানী পাঁচুজেঠু খবরের কাগজটা খুলে গঙ্গাপাড়ের তাঁবুতে রবসনের আগমনের হেডলাইনটা পড়ে চায়ের চুমুকে যে মিষ্টি হাসিটা ষাটোর্ধ্ব বাবুয়াকাকাকে ছুড়ে দেয়, তাতে শুধু অহং নয়, খানিক শ্লেষও মিশে থাকে। অন্যদিকে হাসেন বাবুয়াকাকাও, বলেও ফেলেন, ‘নে, এখন তোদেরই তো সময়!’ তবে এতে মিশে থাকে অভিমান, বেদনা। দু-জনেই হাসিমুখে চা খেয়ে পয়সা মেটায়।

    এক-একটা হাসি এক-একরকম। কারও কাছে হাসি অস্বস্তিকরও হতে পারে। যেমন, বিউটিকাকিমা আগেরদিন খোঁজ নিতে এসেছিল, যে, পাপিয়াদির বর শিক্ষকতার চাকরিতে বহাল কি না। চাকরি যাওয়ার খবর নিশ্চিত শুনে, কাকিমার মুখের ওই চাপা হাসিতে খানিক বিষ মিশেছিল। হাসির কারণ ও সংজ্ঞা বদলে যায় ঘরে ঘরে থুড়ি মুখে মুখে। অজ্ঞাতপরিচয়, ঠিকানাবিহীন কাতুকুতু বুড়োর কাছে যে হাসি প্ৰিয়, বাংলা-বাড়ির হ্যাংলা সন্তান হুঁকোমুখোর কাছে তাই আবার অস্বস্তিকর। তবু হাসিকে নিয়েই লেখা হয় কত কাব্য, কত গান, কত কবিতা। সেই কবে রবিঠাকুর রাতের জ্যোৎস্নায় বাঁধভাঙা হাসি দেখেছিলেন, তারপর বাঙালির প্রেমের একমাত্র প্রাণপুরুষ সেই ভুবনভোলানো কালজয়ী হাসি মেখে কাবেরী বসুকে বললেন, ‘এই হাসি মানায় না তো!’

    আরও পড়ুন : অভিমানে ঘর ছেড়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র! লিখছেন আশিস পাঠক…

    যতই না মানাক, তবু বাঙালি আপন করে নিল হাসিকে। সঙ্গে কবীর সুমনের গানকেও। তিনি শেখালেন, হাসিতে শান দিতে। কিন্তু হঠাৎ পিছন থেকে চমকে দিয়ে ডেকে উঠলেন অঞ্জন, বাঙালি অবাক চোখে দেখল নাকের সিকনি আর সরল চকচকে হাসির এক বিরল কম্বো।

    কিন্তু এহেন বিশুদ্ধ হাস্যরস যে আদৌ হিতকর নয়, এমন নিদান কি কেউ জারি করেছে কখনও? বোধহয় না। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে, ১৪০ কোটির ভূখণ্ড বদলেছে বিস্তর। আড়াআড়িভাবে ভাগ হয়েছে সমাজ। সর্বত্র সংখ্যাগুরুর দাপট। রে রে করে দুই প্রান্ত দিয়ে বজ্রনিনাদ উন্মত্ত জনতার। নিজস্ব ধ্বজা হাতে পিটিয়ে মারার আগে সামান্য থেমে যায় তারা। অবাক চোখে দেখে, উভয়েরই অভিন্ন দ্বিষৎ। সংখ্যালঘুর গায়ে আদতে সাম্প্রদায়িক রঙ নেই, তারা নিতান্তই ধর্মনিরপেক্ষ। বাজার যাদের ‘সেকু’ বলে বিদ্রুপ করে। ক্ষুদ্র বিশ্বে তারাই আদতে হ্রস্বকুল।

    তবু এহেন নিদারুণ পরিহাসেও ক্ষান্ত নয় দুই পক্ষ। চলে নিধনযজ্ঞ। ফোন পেরিয়ে হৃদয় ও যথাক্রমে মগজের দখল নেয় বিদ্বেষ। তবু একদল সংখ্যালঘু মুক্তমনা শত আঘাতেও অবিচল। সদাহাস্য, বিদ্বেষহীন মুখাবয়ব। সাহসের মতো, খানিক হাসিও সংক্রামক কি না। তেমনই বোধহয় ভয়ও। হাস্যরস বা কমেডি থেকে ভয়। রাষ্ট্রের ভয়! নিদারুণ ভয় থেকে কুনাল কামরার ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ নেমে আসে। চলে হ্যাবিট্যাট ক্যাফেতে ভাঙচুর। আদতে মত্ত সেনা বন্ধক রেখেছে মগজ। তাই প্রি-শুট ভিডিও পোস্ট হলেও তারা ভয় পান, কুনাল কামরা আছেন। লুকিয়ে আছেন ক্যাফেতে। বা কোনও অলিগলি, পাকস্থলীতে। ভীত আজ্ঞাবহ দাস সন্ধান করে কুনাল ও তার হাসির। যে হাসির স্ফুর্তি ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম পেরিয়ে নগর, নগর পেরিয়ে মহানগর, পেরিয়ে সুদূর উপমহাদেশ জুড়ে।

    কুণাল কামরা

    হাসি এবং সত্য উভয়ই শাসকের চোখে ভয়ংকর। কুনালকে শায়েস্তা করতেই হবে। না পারলে যারা হাসছে, তাদের। দক্ষিণে ছুটি কাটাতে যাওয়া এক ব্যাংককর্মীকে মুম্বই পুলিশ শমন পাঠায়। অপরাধ? কুনালের শো-তে উপস্থিত ছিলেন তিনি। শো-তে ‘হাসিতে ফাঁসিও না’-র বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ থাকলেও ফেঁসে গিয়ে ফাঁসিকাঠে ঝুলেছেন বেচারা। নির্ঝঞ্ঝাট মধ্যবিত্ত চাকুরের কাছে পুলিশের আঠারো ঘায়ের ছোঁয়া তো ফাঁসিকাঠেরই সমার্থক কিনা। যদিও উপমুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে দাবি করেছেন, মজা করা যেতেই পারে, কিন্তু সব মজার একটা ‘সীমা’ থাকা দরকার। তবে এই সীমা অতিক্রমের সংজ্ঞাটা তিনি দেননি বলেই মুম্বই পুলিশ ভাঙচুরের বিরুদ্ধে এফআইআর না করে কুনালের বিরুদ্ধে করেছেন। ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায় যে, এই সীমা অতিক্রম আদতেই নতুন নয়। মুনওয়ার ফারুকিকে শুধু হুমকি বা থ্রেট কল দিয়েই থেমে থাকেনি রাষ্ট্রীয় লেঠেল। হাসানোর অপরাধে রাত কাটাতে হয়েছিল জেলে। যেদিন মুনওয়ারের শো থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, তাঁর সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন আরেক কৌতুকশিল্পী নলিন যাদব। হতে পারে, তিনি ব্যাপ্তি ও পরিচিতিতে মুনওয়ারের সমতুল্য নন। তাই হাসি দমনে শাসক আরও কড়া। রাজনৈতিক ব্যঙ্গ না করেও তাঁকে জেলে থাকতে হয় ৫৭ দিন। তাঁর গ্রামের বাড়িতে ৫০ জনের লেঠেলবাহিনী পাঠায় স্থানীয় নেতা। বাড়ি বিক্রি করতে জোর দেওয়া হয়। ছয় থেকে সাতবার আক্রমণ হয় তার ওপর। কিন্তু পুলিশ এফআইআর নেয় না। পরবর্তীতে পাল্টা গুন্ডাগিরির অভিযোগে তাঁর নামেই এফআইআর হয়। পরবর্তীতে আসে কোনও ভেন্যুতে পারফর্ম না করতে দেওয়ার হুমকি। বর্তমানে শো আয়োজক ও বুকিং সংস্থাগুলির রক্তচক্ষু থেকেও ছাড় পাচ্ছেন না নলিন যাদব, কুনাল কামরার মতো ব্যক্তিত্বরা।

    মুনওয়ার ফারুকি

    এই প্রসঙ্গে আসে আর-এক কমেডিয়ান প্রাণিত মোরের কথাও। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে তাঁর শো-তে তিনি বলিউড অভিনেতা বীর পাহাড়িয়াকে নিয়ে কৌতুক করেন। শো শেষে কিছু যুবক এসে তাঁর ওপর চড়াও হয় এবং মারধর করে। পরবর্তীতে ‘বীর বাবা’-কে নিয়ে যে-কোনওরকম কৌতুক থেকে বিরত থাকতে বলা হয় প্রাণিতকে। এছাড়াও যদি কমেডিয়ান নারী হন, তো আক্রমণ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় আদিম ও নৃশংস। সম্প্রতি কৌতুকশিল্পী অগ্রিমা জোশুয়াকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়। অপরাধ? তিনি ফেক নিউজ ছড়ানো ও মানুষের সহজেই তা বিশ্বাস করে নেওয়া নিয়ে কৌতুক করেন। তাঁর এই কৌতুকে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত ছত্রপতি শিবাজীর ভাস্কর্যটির প্রসঙ্গও উঠে আসে। সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভুল তথ্য ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে ছত্রপতি শিবাজীর ওই ভাস্কর্যটির মধ্যে সোলার সিস্টেম বসানো হয়েছে, যা গোটা মহারাষ্ট্রকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। অগ্রিমা জোশুয়া বিষয়টিকে হাস্যরসের মাধ্যমে পরিবেশন করলে উন্মত্ত জনতার মনে হয়, তিনি আদতে ছত্রপতি শিবাজীর অপমান করছেন। ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি তাঁকে সমাজমাধ্যমেও হুমকি দেওয়া হতে থাকে। অবশেষে, তিনি ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। আরও এক কৌতুকশিল্পী মোহিত মোরানি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে কৌতুক করলে তাঁর ওপরও আক্রমণ ধেয়ে আসে। ক্রমাগত আসতে থাকে প্রাণে মেরে দেওয়ার ফোন কল। যদিও তারপর থেকে তিনি পারতপক্ষে রাজনৈতিক কৌতুক এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে নিজের চ্যানেলে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আদতে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ক্রমাগত বাড়ছে। তাঁর এক পরিচিত কৌতুকশিল্পীকে শো চলাকালীন স্টেজে উঠে কটুক্তি করা হয়। এছাড়াও সময় রায়নার শো বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে দেশজোড়া বিতর্ক তো আমরা সাম্প্রতিক অতীতেই প্রত্যক্ষ করেছি।

    হাসি এবং সত্য উভয়ই শাসকের চোখে ভয়ংকর। কুনালকে শায়েস্তা করতেই হবে। না পারলে যারা হাসছে, তাদের। দক্ষিণে ছুটি কাটাতে যাওয়া এক ব্যাংককর্মীকে মুম্বই পুলিশ শমন পাঠায়। অপরাধ? কুনালের শো-তে উপস্থিত ছিলেন তিনি। শো-তে ‘হাসিতে ফাঁসিও না’-র বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ থাকলেও ফেঁসে গিয়ে ফাঁসিকাঠে ঝুলেছেন বেচারা। নির্ঝঞ্ঝাট মধ্যবিত্ত চাকুরের কাছে পুলিশের আঠারো ঘায়ের ছোঁয়া তো ফাঁসিকাঠেরই সমার্থক কিনা।

    অগত্যা সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে, হাসির ফেরিওয়ালাদের শাসক কিঞ্চিৎ শত্রুর নজরেই দেখে। উপহাসটুকুর সম্পূর্ণ অধিকার শুধুমাত্র শাসক ও তাঁর পোষা ভাঁড়েদের। কিন্তু দর্শক যে অসহিষ্ণু— এ অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। নাহলে কি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি নিয়ে প্রাইমটাইমে এমন ভাঁড়ামো চললেও, আমরা নিতান্তই চুপ থাকি! বা খুব বেশি হলে দু-একটি এফআইআর এবং খানদশেক মিম-শেয়ার। ধৈর্যর দীর্ঘ পরীক্ষা চলে রাস্তা জুড়ে শিক্ষক কিংবা ডাক্তারের বেশে। সদাহাস্যমুখে আমরা রাষ্ট্রীয় বিদ্রুপে শরিক হই। বিশ্বাস রাখি, আমার সঙ্গে তো উপহাসটুকু হয়নি।

    অগত্যা আপন হাসিটুকু নিরাপদ ও অমলিন। ‘ওয়ার্ল্ড লাফটার ডে’-তে বিশ্বজোড়া অহেতুক লাফালাফি না করে নিজের হাসিটুকু সযত্নে আগলে রাখি ও উইক-এন্ডে দিঘার নতুন মন্দির ঘুরে আসি। কবি তো কবেই বলে গেছেন, ‘হাসছি মোরা হাসছি দেখো!’

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook