ছোটবেলা থেকে কিঙ্করদাকে দেখেছি, একটা টোকা (বড় টুপি) মাথায়, হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরে নিজের খেয়ালে চলাফেরা করছেন, শান্তিনিকেতনের রাস্তায়। সেই অদ্ভুত চেহারার মানুষটি যে অত বড় মাপের শিল্পী তা তখন খেয়ালই করিনি। অদ্ভুত সব গল্প শুনতাম তাঁর সম্পর্কে আর ভাবতাম, এই মানুষটি এত গুণী!
ওঁকে দেখা, ওঁর সম্পর্কে শোনা নানা কিংবদন্তী আজও শান্তিনিকেতনে মানুষের মুখে-মুখে ফেরে; আজ কিঙ্করদার জন্মদিনে তারই কিছু ভাগ করে নিচ্ছি;
একবার শুনলাম, সরকারি আমন্ত্রণে, কিঙ্করদা চলেছেন দিল্লির পথে, দিল্লিতে মূর্তি গড়তে। রাস্তায় হঠাৎ কোনও পাথর দেখতে পেলেন, যা কাজে লাগতে পারে— ট্রেন থেকে নেমে চলে গেছেন সেই পাথরের খোঁজে।
রবীন্দ্রনাথ কি এখানে চা খেতে এসেছিলেন? শান্তিনিকেতনের শতবর্ষ প্রাচীন কালোর দোকানের আড্ডা নিয়ে লিখছেন, ব্রতীন্দ্রমোহন সেন। পড়ুন, মশগুল পর্ব: ১০
আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে, সুধীররঞ্জন দাসের ভাই, যাকে শান্তিনিকেতনের সবাই সমীহ করে চলত— তিনি কিঙ্করদাকে কোনও একটা কাজ করার সময় কিছু একটা বলেছেন, কিঙ্করদা কাজ করতে-করতেই তার দিকে পিছন ফিরে বললেন, ‘এ লম্বু আর্ট নয় হে! তুমি বুঝবে না।’
সবাই বেশ শঙ্কিত, সুধীরদার ভাইকে অমন কথা বলাতে কিঙ্করদার কী না কী হয়! দেখা গেল, কিঙ্করদাকে বিব্রত করার সাহস কারও ছিল না।
এইরকম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি একবার বেশ বিপদে পড়েছিলেন! সত্যেন বোস যখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য, তখন এক ইংরেজির অধ্যাপক এসে জুটেছিলেন বিভাগে, যিনি ক্লাসে আসতেন রংচঙে সব শার্ট ও হাফপ্যান্ট পরে; তাঁর অদ্ভুত সব কথাবার্তা শুনে আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা খুবই বিরক্ত হতাম, কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না।
একবার তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে একটা ইংরেজি নাটক করাবেন স্থির করলেন; সংগীতভবনের মঞ্চে তার মহড়া শুরু হল। একদিন সন্ধ্যায় যখন মহরা চলছে, কিঙ্করদা ঐখানে এসে কোনও একটা বিরূপ উক্তি করে থাকবেন। সেই ইংরেজির অধ্যাপক রেগে গিয়ে, তার হাতের লাঠিটা দিয়ে কিঙ্করদাকে দু’এক ঘা লাগিয়েছিলেন!
আর যায় কোথায়! কলা ভবনের ছেলেরা সন্ধ্যার অন্ধকারে স্টাফ ক্লাবের সামনের রাস্তায় ভদ্রলোককে রিকশা থেকে নামিয়ে বেদম প্রহার দিল! ভদ্রলোক তার অল্প সময়ের মধ্যেই ট্রেন ধরে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করলেন।
আর যায় কোথায়! কলা ভবনের ছেলেরা সন্ধ্যার অন্ধকারে স্টাফ ক্লাবের সামনের রাস্তায় ভদ্রলোককে রিকশা থেকে নামিয়ে বেদম প্রহার দিল! ভদ্রলোক তার অল্প সময়ের মধ্যেই ট্রেন ধরে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করলেন।
এই ঘটনা নিয়ে বহুদিন আশ্রম তোলপাড় করে ডাইনি খোঁজা চলল, যদিও আমি ঘটনার ধারে- কাছে ছিলাম না, তাও কেন জানি না, আমাকেও সন্দেহ করা হয়েছিল।
কিঙ্করদা এমনই, বরাবর ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। আমার সৌভাগ্য কিঙ্করদাকে নানা শিল্পসৃষ্টির সময় স্বচক্ষে দেখেছি।
শ্রীনিকেতন যাওয়ার পথে মালঞ্চ পেরিয়ে ডানদিকে যে-রাস্তাটি বেঁকেছে, সেই রাস্তার ডান দিকের প্রথম বাড়িটায় কিঙ্করদা কিছুদিন বাস করেছিলেন। কোনও এক কারণে ইলেকট্রিক সাপ্লাই, তাঁর বাড়ির ইলেকট্রিক লাইনটা কেটে দিয়েছিল। তাতে তার ভ্রুক্ষেপ ছিল না, রাত্রে বারান্দায় বসে সেই অন্ধকারে গাইতেন, ‘চাঁদের এত আলো!’
বিচিত্রা নাট্যঘরের সামনে রাস্তার ধারটা বেশ ঝোপঝাড় ছিল। সেইখানে আমার বন্ধু বেটুদা,
আসন চাপা দিয়ে একটা খরগোশের বাচ্চা ধরছিল। সেইসময় কিঙ্করদা রাস্তা দিয়ে কলাভবন যাচ্ছিলেন, খরগোশ-ছানাটি দেখে একগাল হেসে বললেন, ‘Push it, Push it’ অর্থাৎ খরগোশটিকে পোষ।
কিঙ্করদার নাটকে বিশেষ উৎসাহ ছিল, কখনও-কখনও নিজেও অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে মঞ্চ সজ্জায় তার খুবই আগ্রহ ছিল। একবার ‘রক্তকরবী’ নাটকটির জন্য অসাধারণ মঞ্চ পরিকল্পনা করেছিলেন, সে-মঞ্চে ‘রক্তকরবী’র রাজা যেখান থেকে কথা বলতেন সেই দৃশ্য দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল।
ঋত্বিক ঘটক একবার তাঁকে নিয়ে একটা ছবি করতে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। দুই পানাসক্ত ব্যক্তির সান্ধ্য আড্ডার মিলনটি অতি চিত্তাকর্ষক হয়েছিল; সেই ছবি নিয়ে নানা মজার গল্প আমরা শুনেছি।
কিঙ্করদাকে নিয়ে আরও মুহূর্ত স্মৃতিতে অমলিন হয়ে রয়েছে, তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে এই সংক্ষিপ্ত লেখা শেষ করলাম।