ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • তাহিতি বেগম

    কুণাল বিশ্বাস (May 8, 2025)
     

    আমাদের রং অনুবাদে মনোযোগ কম। সিঁদুর লাল, বোরখা কালো, মেঘহীন আকাশ নীল। মগরাহাট এবং মাদাগাস্কারের পৃথক দুই ব্যক্তি এইসব বস্তুকে একই রঙে দেখে। যদিও আমার ধারণা, অবস্থাভেদে ভাবনার বিন্দু আলাদা। রাজনৈতিক মিছিলের লাল পতাকা অথবা ট্র্যাফিকের সতর্ক সিগন্যাল, সাই মিং-লিয়াংয়ের ছবির পোস্টারে যোনির উপর বসানো আধকাটা তরমুজ তার চেয়ে স্তর ও প্রকাশে আলাদা লাল। যে-কালো আদতে আলোর অনুপস্থিতি, নিরক্ষীয় বর্ণ, মাতিসের কাছে সেই রং এক ব্যক্তিত্ব। আকাশকে নীল ভাবতে মিশরীয়দের বহুকাল ব্যয় হয়েছে। আবার, ওসিপ মান্দেলস্তামের কথায় এপ্রিলের আকাশ খোদ মিকেলেঞ্জেলো। 

    মগরাহাটে ফিরি। একই সিঁদুর অনেক নতুন বউয়ের রোমাঞ্চ, প্রৌঢ়ার অভ্যাস। অর্থ: সময়-ফারাকে রং তার গুরুত্ব পালটে ফেলেছে।

    আরও পড়ুন: জীবদ্দশায় কোনও দুঃখের ছবি আঁকেননি অঁরি মাতিস! লিখছেন গৌতম সেনগুপ্ত…

    রেনোয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে পল সেজানও প্রথম পর্যায়ে ইম্প্রেশনিস্ট। কিন্তু, ছবি যে শুধুই আলো-ছায়ার খেলা নয়, তার ভিতর হার্ডকোর জ্যামিতি রয়ে গেছে, এই সত্য সেজান বুঝলেন খুব দ্রুত। ভ্যান গখ এবং পল গগ্যাঁও। শিল্পের মাধ্যমে শুধুই শান্ততা দিতে এঁরা তিনজনেই ক্রমে অনিচ্ছুক ও অপারগ। গাছ, পাথর কিংবা মানুষের শরীরে দৃঢ়তা ফুটিয়ে তোলার কৌশলে তিন শিল্পী যদিও আলাদা। অ্যালাইনমেন্ট পালটে ব্রাশের মোটা স্ট্রোক, ভ্যান গখের দিব্যোন্মাদ রং! অ্যাক্সো ব্লেডে মুন্ডুহীন খাসির লোম ছাড়ালে লালাভ মসৃণ উঁচু-নীচু মাংসের চর্বি বেরিয়ে আসে যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ স্পষ্ট। ক্যানভাসকে সদ্য স্কন্ধকাটা লোমশ খাসির দেহ ভেবে ব্রাশ চালিয়েছেন সেজান। এক খাবলা রং একবারে বেরিয়ে ক্যানভাসে সমান, অন্য রং পাশে, তার কাছে অন্য আরেক। স্পষ্ট তিন মাত্রা। ব্রাশ ব্যবহারে ভ্যান গখ আর সেজান থেকে পল গগ্যাঁ খানিক দূরে। গখের চেয়ে এলায়িত, সরু স্ট্রোক তার। আবার সেজানের কায়দায় স্তরবিন্যাসে নারাজ। গগ্যাঁর বহু ক্যানভাসে অনেকটা জমিজুড়ে একই রং, আপাত-একঘেয়ে, যেন নিশ্চিত কিছুর ইঙ্গিত তবু দর্শক বা পাঠক নির্দিষ্ট হতে পারছে না। চরিত্রের মাথা-ঘাড় ঘোরানো, দৃষ্টি সুদূর ও নিষ্পাপ, কখনও ভীতিপ্রদ। ওঁর বয়ানে, ‘ছবির আসল গুণ যেটুকু আঁকা হয়েছে তার বেশি যতখানি আঁকা হয়নি তা। গান যেরকম সুর ও কথার অন্তর্বর্তী শূন্যকেও গান করে নেয়।’

    Tahitian Woman, 1894

    গগ্যাঁর পছন্দ ফ্ল্যাট সারফেস, ইতালির ফ্রেস্কো প্রিয়। তদুপরি যে-নতুনের খোঁজে তিনি, তার তুলনায় নিজের পুরাতন ইম্প্রেশনিস্ট কায়দাকে ওঁর নার্ভাস পদ্ধতি মনে হল। সমধিক অপছন্দ অ্যাকাডেমির চিরাচরিত ক্যালেন্ডার ছবি।

    এই ধন্দ কাটানোর জলদি উপায় শিল্পীর অজানা। আমৃত্যু এই সফর। তারই এক ধাপে জুন, ১৮৯১ এবং গগ্যাঁর জলযান তাহিতির মাটি ছুঁয়ে নিল। আগের গগ্যাঁ এক, তাহিতিপর্ব এবং পরবর্তী গগ্যাঁ আরেক। আঁকিয়ে না হয়েও এ-কথা বলা সহজ। তাহিতি যাওয়ার পথে স্রেফ কিছু ফোটোগ্রাফ, প্রিন্ট আর স্কেচ অবলম্বন; গগ্যাঁর ভাষায় যারা ‘খুদে বৃত্তের কমরেড’। ফ্রান্সের জনশিক্ষা ও চারুকলা পর্ষদের কাছে সরকারি অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে দ্বীপের পোশাক ও চারুকলা দেখা ও ছবি আঁকার অনুরোধ ছিল ওঁর। তাহিতির টিকিট গগ্যাঁ বেশ ডিসকাউন্টে পেলেন। 

                                                  ‘Dites, qu’avez-vous vu?’— Charles Baudelaire

    ‘আমাদের বলো, ঠিক কী দেখলে তুমি?’… তরজমায় এই পংক্তির মাধ্যমে তাহিতি জার্নালের মহরত।

    গগ্যাঁ কী দেখলেন?

    Piti Tiena, 1892

    তাহিতি ছোঁয়ার আগে মাওরি জাতির শেষ রাজা সদ্য মারা গেছেন। জনজাতির নিজস্ব রেওয়াজে ক্রিয়াকর্ম শেষ। তবু গগ্যাঁর ধারণা হল যে তাহিতি তার লোকাচার ভুলে ক্রমে আরও বিজাতির উপনিবেশ হয়ে উঠছে। চিঠিতে স্ত্রীকে লিখলেন, ‘একে-একে তাহিতি নিজেকে ভুলে যাচ্ছে। আমাদের ক্রিশ্চান মিশনারিদের দ্বিচারিতা তুলনাহীন। এই দ্বীপ আপাদমস্তক কবিতা হারিয়ে ফেলছে।’ তবু যা খুদকুঁড়ো, শিল্পীর সম্বল, তাই দিয়ে গগ্যাঁ কাজ শুরু করলেন। দ্বীপের সব কিছুর উপর নজরদারি। বৃক্ষ, চারাগাছ, গুল্ম, লতাবিতানের ঢল, কর্মরত মানুষের কথা ও ভঙ্গি, আকাশের পর পর ক্ষত। মাওরি নারীদের অপরিসীম মন্থরতা, যা ঠিক আলস্য নয়। গগ্যাঁ সবচেয়ে আলোকিত হলেন তাদের আত্মমগ্ন থাকার গর্বে। জনৈক বন্ধুর সঙ্গে পত্রালাপ: ‘আমি রাতদিন স্কেচ করছি, নোট রাখছি সব। এগুলো মকসো বই কিছু নয়। আজ অবধি একটা গোটা ছবি আঁকতে পারিনি। তবু আমার বিশ্বাস, আমার কাজে না লাগলেও ভবিষ্যৎ কোনও শিল্পী উপকৃত হবে।’

    মাঠজলজমিকে সূর্যাস্ত নতুন পোশাক পরিয়ে দেয়। ঘুমোবার আগেও সূর্য ভূমিশাসন করছে। প্রত্যহ এই ঘটনা গান হয়ে ওঠে। সেই গান ও বর্ণাঢ্য সকাল-বিকাল, লোকজ বুলি ও নারীর চলনে গগ্যাঁ খুঁজে পেলেন সমস্ত জনজাতির সাইকি। পাতার পোশাক পরা মানুষ, বাকল জড়ানো ঈশ্বরী যারা সুস্থির, অথচ পরবশ নয়। তাহিতির বুনোলাল মাটিতে আঁকা যে-কোনও শরীর, এর আগে শহরে আঁকা ওঁর ফিগারের চেয়ে ঢের বেশি আমিষ। নাগরিক ভদ্রতা বাতিল করে শিল্পী তাই শ্রেষ্ঠ নিরীক্ষায় আদিম, বিকল্প এস্থেটিক্স সন্ধানে রত। যৌনতা এখানে জরুরি মশাল, যার প্রভায় থকথকে মাটির উপরে ওঁর অতিপার্থিব সময়, মৈথুন ও সংগ্রাম, বুভুক্ষা ও অন্ডকোষ পাশাপাশি ঝুলে।

    The Guitar Player, 1894

    তাহিতি আসার অব্যবহিত পরে তিতি নামের বাকপটু নাতি-কৃশাঙ্গিনীর সঙ্গে প্রণয়, এবং গগ্যাঁ হতাশ। তার মধ্যে গোটা ইয়োরোপ বসে আছে। এরপর সদ্য ঋতুমতী তেহামনা, পলেনেশীয় রক্ত, সর্বোপরি রহস্যে ভরপুর। রঙের আড়ত থেকে প্রথম সূত্র।

    Nevermore, 1897

    বৈপরীত্য! ফরাসি সরকার গগ্যাঁর যাত্রা মঞ্জুর করেছিল কলোনিয়াল সংস্কৃতির ধারক হিসেবে। ভেবেছিল, ওঁর আঁকা ছবি ও নথি দ্বীপের উপর আধিপত্য কায়েমে সহায়ক হবে। সোজা কথায় গুপ্তচর। কিন্তু শিল্পী কারও ধারণার বাইরে, তাই ব্যাখ্যাতীত! নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে জন্মালেও তার হাওয়া-রোদ সর্বত্র। অতএব তকমা না পেয়েও গগ্যাঁ মনেপ্রাণে রাষ্ট্রবিরোধী। অন্যদিকে রাফায়েল, দাগার লাইন ড্রয়িংয়ে মুগ্ধতা ফুরোয়নি। ল্যুভরে দেখা এশিরীয়, মিশরীয় ভাস্কর্য ওঁর মনে স্থির। অভিজ্ঞতা গগ্যাঁর বর্তমানে জায়গা নিল। চীন, ভারত, ফিলিপিন্সের নারীচিত্রে কীভাবে যেন দেবী মিনার্ভা অথবা আথেনা ওঁর কাছে প্রকট। এই ঐতিহ্য গগ্যাঁ অতি অনায়াসে ভাঙলেন। যদিও কালো চকে সাবেক এথনোগ্রাফে আঁকা একই মুখের সম্মুখ ও পার্শ্বিক প্রোফাইলের ধারণা তাঁর ছিল। সেই জ্ঞান গগ্যাঁ প্রয়োগ করলেন অভূতপূর্ব কায়দায়। নগ্নিকা শুয়ে আছেন, একবার জেগে, অন্যবার ঘুমন্ত। দৃষ্টিকোণ বদল মানে সংজ্ঞা বদল। ঐতিহ্য-প্রণেতা হওয়ার বদলে তিনি ট্রেন্ডসেটার।

    Two Tahitian Women and a Marquesan Earplug, 1891/1893

    এমন নয় যে তিনি নিষ্পাপ বালক। ব্যভিচারী, স্ববিরোধী, কখনও পলাতক। ফ্রান্সে ফেরত যাওয়ার পর তাহিতি প্রত্যাবর্তনে গগ্যাঁ সিফিলিস ও এগজিমা-আক্রান্ত, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। অল্প সময়ে তাহিতি অঢেল বদলে গেছে। গগ্যাঁ হতোদ্যম। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ তাঁর মজ্জায়। কোনওরকম খবরদারি তাঁর বরদাস্ত নয়। সময়মাফিক কাজ না করায় আনন্দ, বিশপের বিকৃত মূর্তিনির্মাণে পুলক, দুর্বৃত্ত বন্ধুর সংসর্গে মাদকাসক্তি, ফলত দুর্ভোগ গগ্যাঁর স্বনির্বাচন।

    মিশনারি স্কুলে ছেলেমেয়ে পড়ানো কোনও নিয়মে লেখা নেই। জনে-জনে গগ্যাঁ এ-কথা প্রচার করে বেড়ালেন। এক অভিভাবক তাঁর মেয়েদের স্কুল ছাড়ানোমাত্র তাদের এক কিশোরীকে গগ্যাঁ তাহিতি-পর্যায়ে নিজের তৃতীয় বউ করে আনলেন। ফলে আপাদমস্তক বন্দিত তিনি নন, কোনওক্ষেত্রে সুযোগসন্ধানী ও ঘৃণিত। তবু মরজাগতিক এই পরিবেশে, যেখানে যুদ্ধ বিনোদন, পুতুলনাচ অবলুপ্ত, হাতঘড়ি মেলানো একমাত্র শৃঙ্খলা, সেখানেও গগ্যাঁর শিল্প আমাদের মুক্তি দেয়। আয়ু সুস্থির ও আনন্দময় করে। এক উৎকৃষ্ট পারফিউমার, সুরস্রষ্টা, তিনি কবি।

    পল গগ্যাঁ

    আমরা বিস্তর গাংচরের হাওয়া খেয়েছি। মুড়ির অপরনাম এখানে হুড়ুম, আকাশের নীচে নদী-আস্ফালন, ওঝা-সাপুড়ের ঝাড়ফুঁক, বানরের হাতদেখা, ম্যাজিক খেলায় অভিভূত জনপদে আমরা অভ্যস্ত। আমাদের ধমনীপ্রবাহে আক্রোশ ও তুরীয় উদ্বাস্তুর বাস। কাজেই গগ্যাঁর শিল্প আমার নিজের। ঘরে বসে, পোর্টিকোয়, বিছানা-অবসরে আমি গগ্যাঁর ছবি দেখছি। সমুদ্রের পাশে, অপরাহ্নে, নগ্ন দুই মেয়ে শলায় ব্যস্ত। ওদের আলাপ যতিহীন। আড়ি পাতার ইচ্ছে হল। সাকারে, রঙে, সহবাস ও নৈরাজ্যে গগ্যাঁর ছবি জ্বলে উঠছে। ফুটে উঠছে তাহিতি, যে স্বয়ং এক দীপান্বিতা অথবা সমর্থ বেগম। ধাতু-পাষাণ-দারু-মৃত্তিকায় গড়া এই মানবী আসলে পৃথিবী, যে গগ্যাঁর প্রিয়। নখরাঘাত চাইছে শিল্পী। আরও রক্তপাত, নতুন বিচ্ছেদ। যেন এই জীবনে যথেষ্ট শোক পায়নি সে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook