নীল রং-রুট
‘আই অ্যাম অন ভ্যাকেশন এভরি সিঙ্গেল ডে, কজ আই লাভ মাই অকুপেশন’…
সূর্যের সাত রং। আমার সপ্তাহের ৭ দিনেরও সাত রং। তবে লাল-নীল-সবুজের রেষারেষি নেই সেখানে মোটেও। সবাই মেতে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। ডেস্টিনেশন যখন ট্রাভেলপ্রিয় বাঙালির খুশি মন, ‘tongue’ মাত করা তখন ডেফিনেটলি লেভেল ক্রসিং প্যারামিটার। আমি সেখানে ট্রাফিক পুলিশ।
টক-ঝাল-মিষ্টি-নোনতা-তেঁতো-উমামির হাউস ব্লেন্ডটায় এক্সপার্টিস করতে পারলেই গ্রিন সিগনাল— হ্যাপি জার্নি! এখনও শিক্ষানবিশ। তাই আরও একটু বেশি জানার নেশায় রোজ বে-নী-আ-স-হ-ক-লা রঙের মশলারা কখনও ছড়িয়েছিটিয়ে আবার কখনও মিলেমিশে একাকার!
আরও পড়ুন : সোমবার কখনও বহুমূল্য গিটার, কখনও সাহারা মরুভূমি! লিখছেন অনিকেত মিত্র…
মনখারাপের রং শুনেছি নীল। ছোটবেলায় এতশত বুঝতাম না ভাই। মফস্সলে ছোটবেলা। একছুটে সবুজ মাঠ আর নীল আকাশ। সেখানে সোমবার মানে স্কুল শুরু। বন্ধু চল। মনখারাপের অবকাশই নেই! খানিক বড় হতে কানে এল ‘ফিলিং ব্লু’। আমি তো ক্লু-লেস! এদিকে নীল রং আজও আমার ভীষণ প্রিয়। সে বোধহয় খানিক কপালগুণে। চাকরি জীবনে তো নয়ই, কারবারেও সে বাড় বাড়েনি কোনওদিন। দিনক্ষণ বদলে ‘রং’বদল করে মনখারাপ ডেকে আনেনি আমার জীবনে। সাতসমুদ্দুর-তেরো নদী বা দিগন্তবিস্তৃত আকাশের মতোই শান্ত-শীতল গভীর সে নীল। আর সেখনেই রামধনু রং মিলে আছে।
আমার কর্মজীবন শুরু সহযোগী পরিচলক হিসেবে। তারপর পাঁচ বছর সাংবাদিকতা। তাই সপ্তহান্তে ছুটির অভিজ্ঞতা হয়নি চাকুরিজীবনে। সোম-বুধ-রবি আর বাংলা ছবি— কোনও কানেকশন নেই। কাজেই তখন নতুন সপ্তাহের শুরুতে কিংবা বলা ভাল, রোববার সন্ধে থেকেই চোঁয়া ঢেকুরের মতো ‘মনডে ব্লুজ’ এসে চিনচিনে বুক ব্যাথাটা অনুভব করাতে পারেনি।
কলকাতায় আসার পর থেকে দীর্ঘ ন’বছর আমার ঠিকানা ছিল লেকগার্ডেন্স। পেয়িং গেস্ট। কলেজ থেকে চাকরি, গেস্ট থেকে ক্রমে বাড়ির আবহ। আমি ছাড়াও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরও ৮-৯ জন রুম মেটস। সকলের ছুটির দিন রোববার। অথচ আমার প্রতিদিনের কাজ যে! বাকিরা যখন উইকেন্ডের প্ল্যান করত, আমার তখন পাতা ছাড়ার শেষ বেলা। চূড়ান্ত গতিতে চলছে লাস্ট প্রুফ চেকিং। কখনও-সখনও মনখারাপ হত বইকি! এক্ষেত্রে তাহলে সানডে ব্লুজ! আমার ডে-অফ থাকত বৃহস্পতিবার। মাঝসপ্তাহে চাকুরিরত বন্ধুবান্ধব নট অ্যাভেলেবল। তাই মনখারাপ। ২০১৭-তে চাকরিতে ইতি টানলাম। ২০১৮-তে, ‘ট্রাভেলিস্তান’-এর জন্মলগ্ন থেকে তো অফিসিয়ালি না আছে উইকলি অফ না উইকএন্ড। এমনকী, পুজোপার্বণে, সকলের ছুটির দিনে দ্বিগুন উদ্যমে ওয়ার্ক মোড অন।
এদিকে সোম থেকে শুক্কুর, গোটা সপ্তাহে, অফিস গিয়ে হোক বা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’– সপ্তাহান্তে ক্লান্ত চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে আবার সোম— এহেন জীবনচক্রে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেসব মানুষজন, তাঁরা কিন্তু রোজ দিনের শেষে না পারলেও সপ্তাহের শেষে অবশ্যই ঢুঁ মারেন ট্রাভেলিস্তান। এককাপ চা বা কফিতে ব্রাউন সুগার আর বেশ কিছুটা ফ্রাস্ট্রেশন একসঙ্গে গুলে একঝুড়ি আড্ডায় পেট ভরিয়ে অনেকটা চার্জড আপ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় আবার পরের উইকএন্ডে জমায়েতের আশা নিয়ে। আবার কখনও বা হিসেব কষে হপ্তাশেষের সঙ্গে সপ্তাহের অন্য এক-আধটা দিন ধার করে হোক বা কখনও সিডিউলড লম্বা ছুটি পেলে— তাঁরাই পাড়ি দেন দেশের অন্যত্র বা বিদেশে। ট্রেকিং-বাইকিং-সার্ফিং কিংবা শুধুমাত্র প্রকৃতির কোলে বসে থাকা আর কিচ্ছুটি না করার কত প্ল্যান হয় ট্রাভেলিস্তানের টেবিলে বসে! আকাশের হোক বা জলের— নীল তখনও ফিল গুড। কিচ্ছু মনখারাপ নয়। আর সেই সবকিছুর সাক্ষী থাকে ট্রাভেলিস্তান। আমারও মানসভ্রমণ হয় গল্পে-গল্পে।
অথচ তা তো হওয়ার কথা ছিল না! আমারও হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল অজানায়। কিন্তু সে গুড়ে বালি। অথচ কর্মক্ষেত্র ট্রাভেলিস্তান! বোঝো কাণ্ড! কেমন আয়রনি!
আসলে আমার মনে হয়, মনখারাপ আপেক্ষিক একটা শব্দ। সে দিনক্ষণ, সময়-সুবিধা বুঝে আসে না। একটু যেই মনকে ঢিলে দিয়েছ তো ‘ব্যস, অন্দর সে মন আচ্ছা নাহি লাগ রাহা’…
কাজ যখানে মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করে, সেখানে শর্টকাট নেয় মনখারাপ। সে বড় জীবনবিমুখ, বায়নাবিলাসী, পরজীবী। ফি-দিন ডিজিটাল ফিডে একের পর এক দুঃসংবাদ জানতে পারি আমরা। আচ্ছা, শেষটায় নিশ্চয়ই দিন-ক্ষণ-বারের হিসেবটা গুলিয়ে যায়! মনডে-র একার ঘাড়েই ডিমন চাপে না শুধু। কোনও রং-ও থাকে না নিশ্চয়ই।
কর্মই জীবন যে জাতির, তার কর্মজীবনের যাত্রাপথের পিচকালো হাইওয়েতে ঝকঝকে সোনারোদ তো থাকবে না সবসময়! ঘন নীল বা ধূসর কালো মেঘও আসবেই, ঠিক তেমনই দিনক্ষণ দেখে ওয়ার্কলোড মনখারাপের রং ধরে না নিজস্ব কাজের জায়গায়। এবড়োখেবড়ো রং ভিড় করে যখন তখন, উইদাউট এনি নোটিশ। গুগল ম্যাপ ভুল ডিরেকশন দেখায়। কিন্তু তারপরেও, ওরাও থাক বরং।
কাজ যখানে মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করে, সেখানে শর্টকাট নেয় মনখারাপ। সে বড় জীবনবিমুখ, বায়নাবিলাসী, পরজীবী। ফি-দিন ডিজিটাল ফিডে একের পর এক দুঃসংবাদ জানতে পারি আমরা। আচ্ছা, শেষটায় নিশ্চয়ই দিন-ক্ষণ-বারের হিসেবটা গুলিয়ে যায়! মনডে-র একার ঘাড়েই ডিমন চাপে না শুধু। কোনও রং-ও থাকে না নিশ্চয়ই। রং মানে তো আলোর সোর্স। আলো মানে নতুন পথ। কিন্তু অফিসের ওয়ার্ক প্রেসারে জীবনের মোহ ভুলে যাওয়ার দমবন্ধ অসহনীয় সময়টা বোধহয় শুধুই গুমোট। লাল-নীল— কোনও রঙের ওপরেই দায়ভার চাপানো যায় না। বর্ণনাহীন অনেকগুলো গুমরে, ডুকরে ওঠা দিন জমাট বাঁধলে এই পরিণতি হয়! কিন্তু এও তো কাম্যও নয়! সারভাইভালে আমরাই এগিয়ে। আমারই একদিন আগুন জ্বালিয়েছি, চাকা থেকে স্পেস— আজ কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে! প্রাণ আলোর অভিমুখী। প্রাণ রঙের সমাহার। প্রাণ সৃষ্টি। মানুষ সৃষ্টির আশ্চর্য দান। কাজেই খুব সহজে প্রাণশক্তি হারানো বোধহয় জীবনের প্রতি অন্যায়। কিন্তু কী-ই বা করণীয়? শুরুর দিন থেকে মানবজতি গোষ্ঠীবদ্ধ। পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল। একাকিত্ব নয়, সংঘবদ্ধতাই তার জীবন। তাই দিনের শেষে হোক বা সপ্তাহ শেষে, ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার সঠিক সহজ সঙ্গই একমাত্র ডিপ্রেশনের দাওয়াই!
ট্রাভেলিস্তানের যাত্রা শুরু এক দোলপূর্ণিমায়। বন্ধুত্বের ভরসায় সেই পথচলা শুরু। কম্পিটিশন, কোভিড, ক্যাপিটালিজম— সব দুর্ধর্ষ দুশমনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আজ ট্রাভেলিস্তানের বয়স সাত। আজও প্রতিটা দিন নতুন চ্যালেঞ্জ! রং-বেরং, সোম-শুক্কুর সেখানে ম্যাটার করে না। ভাল-মন্দ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব— সব নিজের কাঁধে। দু’টো দিন ছুটির পর যখন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সকলে অফিস যায়, তখন আমারও খানিক মনকেমন হয় বইকি, আগের দুটো দিন সবাই মিলে হইহই করার পর হঠাৎ কেমন ফাঁকা! মনে পড়ে, ট্রাভেলিস্তানের একদম গোড়ার দিকে যখন প্রথম বর্ষা এল, কোনও কোনওদিন খুব কম জমায়েত হত। ফাঁকা ক্যাফে আর ‘মনসুন ব্লুজ’। গেস্ট না এলে ক্যাফের সার্ভিস থেকে কিচেন— সবার মুখ থমথমে। এমন অবস্থায় প্রতিদিন সন্ধেবেলায় আমাদের বেজার মুখে হাসি আর মনে ভরসা জোগাতে হাজির হতেন চারজন ‘রেগুলার গেস্ট’। এখন ওঁরা গেস্ট নয়, আমাদের বন্ধু। আমাদের চিরাচরিত একটা ভাবনা আছে, একটা বয়সের পর নতুন বন্ধু হয় না কিংবা কাজের জায়গায় বন্ধু হয়না। এই তথ্য মোটেও ঠিক নয়, তাতে সীলমোহর বসিয়েছে ট্রাভেলিস্তান। ট্রাভেলিস্তান আমাদের একের পরে এক বন্ধুত্ব দিয়েছে। কী পরিমাণ ভালবাসা পেয়েছি তাঁদের থেকে! পেয়েছি ভরসা। তাই হলফ করে বলতে পারি ‘আদারস গেট পেট্রনস, উই গেট ফ্রেন্ডস’।
কর্ম তো শুধু রোজগার নয়, বৃহত্তর দায়িত্ব তার। তাই সে রোজ নতুন কিছু গড়ার স্বপ্ন দেখায়, নতুন সঙ্গ জোগায়। কেউ হাত ধরে থাকে, কেউ চলে যায়। কর্মই প্রতিনিয়ত শেখায় রং রুট, মানে মোটেও হারিয়ে যাওয়া নয়, বরং অ্যাডভেঞ্চার। শেখায় মাটি কামড়ে নিজের নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই। অজানা কঠিন পথ অতিক্রমের যে আনন্দ, তা খানিকটা নেশার মতো। কর্ম আর সাফল্যের হার সমানুপাতিক হোক বা অ-সমানুপাতিক, তা থেকে আস্বাদিত জীবনবোধটাই থেকে যায় শেষদিন পর্যন্ত। ওটাই মনের রশদ। তাই ভালবাসার কাজ করে যাওয়াটা যতটা প্রয়োজন, ততটাই প্রয়োজন কাজের একঘেয়েমি কাটানোর সঠিক সঙ্গ। দুই মেলাতে পারলেই কেল্লাফতে! পশ্চিমি আদলে মনখারাপের দায় গিয়ে পড়ে না খামকা সোমবার বা নীল রঙের ঘাড়ে। কী-ই বা দোষ ওদের! মানুষের তৈরি নিয়মজালেই তো ফেঁসে গিয়েছে বেচারারা। মনখারাপ কি ওদের হয় না?