আদি কাণ্ড
ছোটবেলায় বাংলা নববর্ষের সময় একরাশ হীনমন্যতায় ভুগতাম। সব বন্ধু যখন তাদের বাবা-মা’র হাত ধরে বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে একপেট শরবত আর ফ্যান্টা খেয়ে কমলা ঠোঁটে এক-বগল ক্যালেন্ডার নিয়ে বিজয়-দর্পে আমাদের গলির সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরত, আর আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে মুচকি হাসত, গলির মোড়ে ঝোলা বাল্বের চেয়েও ম্রিয়মাণ হয়ে যেতাম। বাবার ‘দৌড়’ ছিল ক্রিক রো’র নিউ বেঙ্গল টেলর্স অবধি— প্রত্যেক বছর বাবা মানিকতলা থেকে উজিয়ে সেখানে যেতেন। দুই একবার লোভে পড়ে বাবা’র সঙ্গে গিয়েছি, কিন্তু সেখানে একগ্লাস শরবত আর একটা ক্যালেন্ডার ছাড়া আর কিছুই জুটত না। আমি বাড়ি ফেরার জন্য উসখুস করলেও বাবার সেদিকে খেয়াল থাকত না, বেশ কয়েক ঘণ্টা জমিয়ে আড্ডা দিয়ে তবে বাবা বাড়ির দিকে পা বাড়াতেন। মিথ্যে বলব না, বাবা সেখান থেকে ফেরার পথে বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকতেন আর বৈকালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে একটা বড় প্যাকেট মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরতেন। বাবার নির্বুদ্ধিতা দেখে হতবাক হয়ে যেতাম, যেখানে বন্ধুদের বাবারা বিনা পয়সায় মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফেরেন, আমার বাবা পয়সা দিয়ে কেনেন!
একদিন সাহস করে বাবাকে এই কথা বলতে বাবা বলেছিলেন, ‘অনেকদিন পয়লা বৈশাখে বিনা পয়সার মিষ্টি খেয়ে অরুচি ধরে গিয়েছে— অনেক কষ্টে সেখান থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি। তুমিও এইদিনের বিনা পয়সার ভোজের জন্যে কোনওদিন লোভ করবে না— এইটাই প্রার্থনা করি।’ খানিক থেমে বাবা বলেছিলেন, ‘ন্যাড়া মাথায় অফিসে ঢুকেছিলাম, সংসারের জন্য কাবুলিওয়ালা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার করতে হয়েছে। ধার মেটানোর আমন্ত্রণ বছরের পর বছর পেয়ে সেখান থেকে অনেক কষ্টে নিষ্কৃতি পেয়েছি। আমার কোনও প্রবৃত্তি নেই সেই জমানায় আবার ফেরত যেতে। তুমিও চেষ্টা ক’রো সেখান থেকে দূরে থাকতে।’
পরে বুঝেছিলাম, বাবা সেখানে যেতেন প্রত্যেক বছর ওই একদিন তাঁর প্রথম যৌবনের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। বাবার আঠারো বছর থেকে ত্রিশ বছর বয়স কেটেছিল ক্রিক রো-তে, এই দোকান থেকে জামা করাতেন সেই জমানায়।
মধ্য কাণ্ড
চাকরিজীবনে প্রবেশ করার আগে ট্রেনিং-এর সময় একদিন রিসেপ্শনে নাইট ডিউটি করছি। সবে ভোর হবে। ঘুমে চোখ জ্বলছে, এক গেস্ট চেক-আউট করতে রিসেপশনে এলেন। বিল হাতে ধরাতে তিনি একটা প্লাস্টিকের কার্ড এগিয়ে দিলেন। আমি কিছু না বুঝে সেটা হাত পেতে নিয়ে পয়সার জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছি, তিনিও আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। খানিক বাদে বিরক্ত হয়ে তাড়া দিলেন— কী হল? আমি বললাম, ‘পয়সা দিন!’ বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড নাও না?’ কী সন্দেহ হতে ভেতর থেকে ঘুমন্ত রিসেপশনিস্টকে খবর দিতে সে তড়িঘড়ি উঠে এসে বেশ বারকতক মাফ চেয়ে এক বিচিত্র যন্ত্র বের করল। একটা ছোট বইয়ে চোখ বুলিয়ে সেই যন্ত্রের ওপরে কার্ড রেখে ঘটাং ঘট করে একগোছা কাগজে সেটার ছাপ নিয়ে তার ওপরে বিলের দেয় টাকা লিখে গেস্টের দিকে এগিয়ে দিল। সেই ব্যক্তি সেখানে সই করে আমাকে একবার আপাদমস্তক মেপে গটগট করে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সেই ব্রহ্ম-মুহূর্তে আমার সঙ্গে সেই বিচিত্র প্লাস্টিক টুকরোর প্রথম আলাপ হল—ক্রেডিট কার্ড আর ওই গোছা কাগজের নাম, চার্জস্লিপ। জানলাম, এই কার্ড সবাইকে দেওয়া হয় না, রেস্ত বুঝে দেওয়া হয়। যাদের এই কার্ড দেওয়া হয়, কার্ডগুলোর নম্বর একটা বইয়ে ছেপে বেরয়— আর সেই বই সমস্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ক্রেডিট কার্ড হোল্ডারদের কোনওরকম হয়রানি না হয়। আর কার্ডের পিছনে সইয়ের সঙ্গে চার্জস্লিপে করা সই না মিললে চিত্তির, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিল মেটানো যায় না সেরকম হলে।
চাকরির জায়গায় কয়েক বছর বাদে ট্যুরে গিয়ে বিল মেটাতে আমাকে যখন ক্রেডিট কার্ড নিতে বলা হয়েছিল, বেজায় খুশি হয়েছিলাম, মনে হয়েছিল জাতে উঠলাম। সেই জমানায় ক্রেডিট কার্ডের মালিকদের একটা অ্যাড-অন কার্ডের সুবিধে দেওয়া হত। বিয়ের পর বউভাতের রাতে বউকে আংটি না দিয়ে ক্রেডিট কার্ড উপহার দিলাম। পরিচিত মহলে হইচই পড়ে গেল, ‘কী ঘ্যামা উপহার মাইরি!’ শুধু বিলু বলেছিল, ‘কত বড় হারামি তুই!’ কারণ সে জানত আমার নব-পরিণীতা বউয়ের এক আজব অসুবিধের কথা, ওর দুটো সই কখনও মিলত না।
আমার মানিব্যাগেও একটা কালসাপ ঢুকেছিল, যেটা বুঝিনি। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি হয়েছে, রোজগার বেড়েছে, খরচ বেড়েছে, আর বেড়েছে স্ট্যাটাস। পকেটে টাকা নেই তো কী হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড তো রয়েছে! চালাও পানসি দিলদরিয়া! কোনওকিছু কিনে পুরো পয়সা না দিলেও চলে। মিনিমাম একটা পরিমাণ ব্যাঙ্কে নিয়মিত জমা দিলে ‘গাড়ি সিগন্যাল মানে না’ গাইতে গাইতে ধারের গাড়ি চলতে থাকবে।
সর্প-কাণ্ড
আমার জন্মের আগে থেকে আমাদের বাড়িতে থাকা মণিমালা দাসীকে জন্মইস্তক আমি ‘মানা’ বলেছি। ও আমাকে কোলেপিঠে বড় করেছে। সেই মানার পেটে সাপ হল। মানাকে অনেক বোঝানো হল যে, পেটে কৃমি হতে পারে, সাপ হতে পারে না। কিন্তু মানা কিছুতেই মানবে না। এরপর মানা একদিন ঘোষণা করল, ওর পেটে সাপদুটো মাঝে মাঝেই মারামারি করে। ওইটুকুন সাপ মারামারি করতে পারে না জানাতে, মানা জানিয়েছিল যে, সাপদুটো ঢুকেছিল প্রথম শৈশবে, কিন্তু এখন বড় হয়ে গিয়েছে আর দুটোই কালসাপ।
মানাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিলাম আর নিয়তি মুচকি হেসেছিল। কারণ আমার মানিব্যাগেও একটা কালসাপ ঢুকেছিল, যেটা বুঝিনি। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি হয়েছে, রোজগার বেড়েছে, খরচ বেড়েছে, আর বেড়েছে স্ট্যাটাস। পকেটে টাকা নেই তো কী হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড তো রয়েছে! চালাও পানসি দিলদরিয়া! কোনওকিছু কিনে পুরো পয়সা না দিলেও চলে। মিনিমাম একটা পরিমাণ ব্যাঙ্কে নিয়মিত জমা দিলে ‘গাড়ি সিগন্যাল মানে না’ গাইতে গাইতে ধারের গাড়ি চলতে থাকবে।
সাপের ছোবল প্রথম খেলাম, যখন ক্রেডিট কার্ডে বারো হাজারের জিনিস কিনে পঁয়ষট্টি হাজারের বিল চোকাতে হয়েছিল। সেই জমানায় ক্রেডিট কার্ডে ৩০% সুদের পরিমাণ যে কাবুলিওয়ালাদের চেয়েও বেশি, প্রথম বুঝলাম।
কিন্তু কুকুরের লেজ সোজা হয় না, অভ্যেস হয়ে গিয়েছে ধার-বাকির, তাই দুই বছর বাদে আবার ধাক্কা, এবার দেয় পরিমাণ নব্বুই হাজার! শুনেছি, মানুষ জলে ডোবার সময় শৈশবের স্মৃতি মনে ঘাই মেরে ওঠে। আমার মনে ঘাই মেরেছিল ছোটবেলায় শোনা বাবার কথা, ‘তুমিও চেষ্টা ক’রো ধার করা থেকে দূরে থাকতে।’
মা’র দিদিমার বন্ধকী কারবার ছিল। মধ্যবিত্ত বাড়িতে ‘যত্র আয়,তত্র ব্যয়’ হিসেবে চিরদিনই চলে। বাড়িতে আত্মীয়-কুটুম্ব এলে বা লোক-লৌকিকতা করতে হঠাৎ পয়সার দরকার পড়লে পাড়া-প্রতিবেশী-গিন্নিরা সোনার দুল, বাউটি জমা দিয়ে পয়সা নিত, আর পরে সুযোগ বুঝে ছাড়িয়ে নিয়ে যেত। এই ব্যবসার জন্য ভদ্রমহিলাকে কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি আত্মীয়কুলের কাছ থেকে, কিন্তু কেরানি স্বামীর রোজগেরে ছেলে মানুষ করা আর সম্বৎসর দুর্গাপুজো, কালীপুজো করা সম্ভব নয় বলে অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও গ্রামে ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছিলেন মহিলা।
শুনেছি, শহরের সোনার দোকানের মালিকেরা আড়াল থেকে এই ব্যবসা চিরকালই চালিয়ে গিয়েছেন, গহনা বিক্রি দোকানের সদর দরজা দিয়ে, আর বন্ধক নেওয়া এক ঘোমটার আড়াল তৈরি করে, খদ্দেরের সম্মান রাখতে। এই ঘোমটার আড়াল একদিন খসে পড়ল, যখন দক্ষিণ ভারত থেকে আসা কিছু কোম্পানি বিশাল অফিস খুলে ঘোষণা করল— ‘আমরা সোনা বন্ধক নিয়ে ধার দিই।’ তোমার সোনা তুমি পড়বে, না বন্ধক দেবে, না ভেজে খাবে— কার বাপের কী!
বাঙালিকে আর পায় কে! ক্রেডিট কার্ডে জিনিস কেনো, দেয় পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে গহনা বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়ে ক্রেডিট কার্ড বিল মিটিয়ে আবার ক্রেডিট কার্ডে জিনিস কেনো। ভাঁড় মে যায়ে ‘যত্র আয়,তত্র ব্যয়’!
কী কাণ্ড!
ব্যাঙ্কে চাকরি করতে গিয়ে বুঝলাম, অ্যাসেট আর লায়াবিলিটির আসল সংজ্ঞা। সাধারণ মানুষের জমা খাতা ব্যাঙ্কের কাছে লায়াবিলিটি, গ্রাহকদের অনেক বাবা-বাছা করে তুষ্ট করতে পারলে তবে ব্যাঙ্কের ব্যালেন্স বাড়ে। আর ক্রেডিট কার্ড, সমস্ত রকমের লোন হল অ্যাসেট, সেই দপ্তরগুলোর অফিসারদের কী দাপট!
ব্যাঙ্কের বছর শেষ হয় ৩১ মার্চ, সেদিন সারা বছরের ডেবিট-ক্রেডিট মিলিয়ে আর অ্যাসেট-লায়াবিলিটি ঝালিয়ে ব্রাঞ্চের লাভজনকতার পরিমাপ হয়। সম্পাদন সম্পদ বা performing asset যার যত বেশি, সেই ব্রাঞ্চ তত ভাল, আর ম্যানেজার পুরস্কৃত হয়। এর দুই সপ্তাহ বাদেই আসে পুণ্যাহ বা বাঙালি গৃহস্থর হালখাতা— পুরনো ধার শোধ দিয়ে নতুন ধারের খাতা খোলার দিন।
কী আশ্চর্য কাকতালীয় ব্যাপার, তাই না!