ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মনডে ব্লুজ : পর্ব ১০

    পবিত্র সরকার (March 17, 2025)
     

    কলঙ্কিত সোমবার

    মানুষের সভ্যতায় ক্যালেন্ডার আর পঞ্জিকা যদি তৈরি না হত, আর তার পথ ধরে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর যদি ঘুরে ঘুরে না আসত, হপ্তাভর্তি কাজের দিন আর ছুটির দিনের যদি ভাগ না হত, তাহলে সোমবার সম্পর্কে আমাদের এত ক্রোধ, ঘৃণা, বিরূপতা, অভিমান, অভিযোগ কিছুই জমা হত না, সোমবারও দিব্যি ফুর্তির মেজাজে নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কফি-হাউসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে পারত।  কিন্তু মানুষ নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরেছে।  সে আদি-অন্তহীন সময়কে কেটে কেটে ক্যালেন্ডার বানিয়েছে, তার সঙ্গে হাজারো প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানের ধরাবাঁধা কাজকর্ম চালু করেছে ক্যালেন্ডার মেনে, আর তাই—

    সোমবার নামে এক বিভীষিকা মানবসভ্যতার ঘাড়ে সিন্দবাদের দৈত্যের মতো এসে চেপে বসেছে।  এখন তাকে ঘাড় থেকে নামানো মুশকিল।  এমন বলা যাবে না যে, সে উটকো আপদ এসে জুটেছে।  আমরাই তাকে ডেকে এনেছি জরুরি বলে, তাকে বাদ দিয়ে আমরা চলার কথা ভাবিই না, কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তার সম্বন্ধে দুটো ভাল কথা বলার লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল।  আজকাল ওপিনিয়ন পোল বলে একটা ব্যাপার হয়েছে, সেটা আপনি যেভাবেই নিন, যদি জিজ্ঞেস করেন, তাবৎ স্কুলছাত্রছাত্রী আর শ্রমিক-কর্মচারীকে যে, সপ্তাহের কোন দিনটা তার মুখ দেখাতে না এলে তুমি সবচেয়ে খুশি হও।  নিশ্চয়ই একশো শতাংশের উত্তর হবে ‘সোমবার’।

    পাঠকগণ, এটা অবশ্যই আমরা যারা পশ্চিমি ক্যালেন্ডার মেনে চলি তার হিসেব।  যাঁরা ইসলামি ক্যালেন্ডার মেনে চলেন, তাঁদের কাছে অবশ্য সোমবার সপ্তাহের সবচেয়ে ঘৃণিত দিন নয়।  যেমন, বাংলাদেশে সে-দিনটা সম্ভবত শনিবার।  সেখানে বৃহস্পতিবার আর শুক্কুরবার ছুটি।  এটা সোমবারের কাছে একটা সুখবর, আর সে নিশ্চয় তা জানে। তবে আমাদের এই লেখা মূলত পশ্চিমি কেতা নিয়েই— যেখানে সোমবার দিয়ে সপ্তাহের কাজের দিন বা উইকডে শুরু হয়।  

    সিরিয়ালে তাও রোজ চিত্রনাট্যটা বদলায়, কর্পোরেট জীবনে তো তাও ঘটে না! পড়ুন শোলাঙ্কি রায়ের কলমে ‘মনডে ব্লুজ’ -এর নবম পর্ব…

    সোমবার নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবে, আমি কেন এমন অভিশপ্ত হয়ে জন্মালাম! মানুষই তো এর জন্যে দায়ী।  কিন্তু সে-বেচারা তো আর কবির ভাষায় মানুষকে তীব্র অভিযোগ জানাতে পারে না যে, ‘আমারে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে দে!’  আর তার কোথাও ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।  সে একদম পাকাপাকি হয়ে থিতু হয়েছে মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায়। শনি-রবিবার ছুটি, তার পর সোমবার থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করো। আমাদের মতো বুড়োরা অবশ্য আগে শনিবার হাফ ছুটি দেখে এসেছে।  এখন দুটো দিন পুরো ছুটির পরে, সোমবারের বীভৎসতা আরও বেড়ে গেছে বলে মনে হয়।  

    তবে পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন, দুটো বা দেড়টা দিন ছুটিই বা কত দিন হল।  সেই যে ১৮৮৬ সালের মে মাসে শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন হল, তার আগে তো পশ্চিমি দুনিয়ায় কাজের ঘণ্টা, দিন বলে কিছুই ছিল না— সতেরো-আঠারো থেকে বাইশ ঘণ্টা পর্যন্ত মানুষকে খাটাত মালিকেরা, ছুটির দিন বলেও কিছু ছিল না।  ওই আন্দোলন (মালিকেরা বলে ‘রায়ট’ বা দাঙ্গা) থেকে আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা ঘুম আর আট ঘণ্টা বিনোদনের ব্যবস্থা হল শ্রমজীবী মানুষের— অন্তত একটা দেশে তার শুরুটা হল।  রোববারটা ছুটির দিন হল নিশ্চয়ই খ্রিস্টান সভ্যতার ধর্মীয় নির্দেশে— ওইদিন গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করতে হবে।  নইলে চোদ্দ হাজার বছর নরকবাস হবে।  

    হে মার্কেটের শ্রমজীবী আন্দোলনই বেঁধে দিয়েছিল ঘণ্টা, দিন, সময়…

    তা হলে দেখুন, সোমবার বলতেই পারে, আরে স্যর, রোববার ছুটির দিন হয়েই তো আমার সর্বনাশ হয়েছে, আমার যত কলঙ্কের জন্য তো রোববারই দায়ী।  রোববার যদি ছুটির দিন না হত, আর তার পরেই যদি কাজের দিন সোমবার না আসত, তা হলে সোমবারের ওপর কি লোকের অত, রাগ, ক্ষোভ, ঘেন্না ইত্যাদি হত?  সোমবার বলতেই পারে, ভাই আমাকে রোববারের পর থেকে সরিয়ে দিন, রোববারের পরে মঙ্গলবার, বুধবারকে নিয়ে আসুন, বরং আমাকে শুক্কুরবার করে দিন, যাতে ছুটির দিনের পরে আমার জায়গা না হয়ে ছুটির দিনের আগে হয়।  সে কি আপনারা করতে পারবেন?  না, মুখেই আপনাদের যত ফুটুনি, আর খামোখা আমার ওপর দোষারোপ!  আমি কি যেচে এই পচা সোমবার হতে চেয়েছি!

    তা সোমবারের কথাটা নেহাত ফেলনা নয়।  রবি হল সূর্য, সে গ্রহের অধিপতি আমাদের এই গ্রহলোকে।  তার পরে অন্য গ্রহগুলোরই লাইন বেঁধে আসা দরকার ছিল আমাদের বারগুলোর নামে— বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি ইত্যাদি।  হঠাৎ চাঁদ এই উপগ্রহটাকে (সেই তো সোম) একটা বারের নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল কেন— এ তো কোনও ব্যাকরণেই যায় না।  চাঁদের এই হেব্বি সমাদরের কারণ কী ?

    আমার মনে পড়ল, সেই পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে আমেরিকায় যখন ছিলাম, তখন শুক্রবার নিয়ে ওদের কী আদিখ্যেতা দেখেছি।  সোমবারের তার ওপর হিংসে হতেই পারে।  শুক্কুরের পাঁচটা বেজেছে কি বাজেনি, লোকে অফিস কাটতে শুরু করেছে।  রাত্রে পার্টি হবে।  অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথেয় দু-বগলে বোতল, আর ব্যাগে স্ন্যাক্স।  সন্ধে হতে না হতেই স্টিরিও বাজছে, নাচ হচ্ছে, গান হচ্ছে— আহ কী ফুর্তি, দু-দিন আর অফিস যেতে হবে না।  কেউ ওয়াগনে করে দূরে কোনও লেকে বা রিসর্টে যাওয়ার কথা ভাবছে, দুটো দিন সেখানে ছুটি কাটিয়ে আসবে।  আবার যখন একটা সোমবারও ছুটি পড়ে যেত— শনি, রবি, সোম এই তিনদিন মিলিয়ে একটা ‘লং উইকএন্ড’ পড়ে যায় সেদিন তো সোমবারকেই দু-হাত ভরে আশীর্বাদ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা।  এই উপলক্ষে, তাদের ফুর্তি এতই বেড়ে যায় যে, মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে তারা মহা উল্লাসে প্রচুর অ্যাক্সিডেন্ট করে আর দমাদ্দম মারা যায়।  আগেই পুলিশ ভবিষ্যৎবাণী করে যে, এই লম্বা হপ্তাশেষে ৫৩৭৪ জন বা ওরই কাছাকাছি লোক গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবে।  জানি না, এই মনোরম প্রথা এখনও ওদেশে চালু আছে কি না।

    মার্কিন টিভি সিরিজ ‘দ্য অফিস’-এ উঠে এসেছিল সে-দেশের কর্মসংস্কৃতির ছবি…

    তবে, ওদেশের কথা যখন উঠলই, আর-একটা বিভীষিকাময় সোমবারের কথা বলেই রাখি।  ওদেশে বেশিরভাগ চাকরিই চুক্তিভিত্তিক আপনারা জানেন, অনেক ক্ষেত্রে হপ্তার শেষে শুক্কুরবার মাইনের প্যাকেট বা চেক পাওয়া যায়।  এই সুবর্ণ ব্যবস্থায় ওদের চাকরি খতম হওয়ার একটা সংলাপ ছিল— যেটা মালিক বা অফিসের বড়কর্তা এসে হতভাগা কর্মীটিকে বলতেন, ‘ইউ নিড নট খাম অন মান্ডি’, অর্থাৎ ‘সোমবারে তোমার আর আসার দরকার নেই’।  এর ওপরে আর কথা ছিল না।  ফলে, ওদেশে সোমবার কতভাবে যে অভিশপ্ত ছিল, তা কহতব্য নয়।

    আবার যখন একটা সোমবারও ছুটি পড়ে যেত— শনি, রবি, সোম এই তিনদিন মিলিয়ে একটা ‘লং উইকএন্ড’ পড়ে যায় সেদিন তো সোমবারকেই দু-হাত ভরে আশীর্বাদ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা।  এই উপলক্ষে, তাদের ফুর্তি এতই বেড়ে যায় যে, মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে তারা মহা উল্লাসে প্রচুর অ্যাক্সিডেন্ট করে আর দমাদ্দম মারা যায়। 

    শুধু অফিস-কারখানা-আদালতের শ্রমিকদের কথাই বলি কেন?  ইশকুলের ছাত্রদের কাছে কি সোমবার কম ভয়াবহ?  কিন্তু তাদের দুঃখের কথা তো রবীন্দ্রনাথই ভারী সুন্দর করে লিখে গেছেন ‘শিশু ভোলানাথ’-এর কবিতায়, রবিবারের আসতে দেরি করার দুঃখের কথা বলে।  সেখানে শিশুটির মনে হয়েছে, সপ্তাহের বাকি দিনগুলো বড়লোক, তাদের নিজস্ব মোটরগাড়ি আছে, গরিব বেচারা রবিবারের সেই সম্পত্তি নেই।  তা শুধু বড়দের কাছে নয়, স্কুলযাত্রী শিশুদের কাছেও সোমবার একটি দৈত্যদানবের মতো আতঙ্ক।  আমার ছোট নাতি ঘঞ্চু বেচারা দশটার আগে কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে চায় না।  কিন্তু সোমবার তাকে উঠতেই হয় ন-টায়, ভয়ংকর আপত্তি করে, ঘুম-ঘুম চোখে চান করে, সকালের খাবার খায়, স্কুলের গাড়িতে ওঠে।  অবশ্য স্কুলের বাসে উঠলেই তার অন্য মূর্তি।  তখন বন্ধুদের দেখে হইচই করে, নানা খবর দিয়ে, ব্যাগট্যাগ থাবড়ে গান গেয়ে সে উল্লাসে ড্রাইভারের মনে আতঙ্ক জাগায়।  কিন্তু তার আগে সোমবারের সকালটা তার মোটেই পছন্দসই লাগে না।  রোববার রাত্রে সে মায়ের তাড়াও খায় সকাল-সকাল ঘুমোতে যাওয়ার জন্য।  সেজন্যও তার সোমবারের ওপর রাগ।

    তা নাগরিকদের অনেকেরই রাগ সোমবারের ওপর।  ব্যতিক্রম আমাদের মতো অবসরপ্রাপ্ত বুড়োরা— যাদের কাছে ‘কীবা দিন কীবা রাত্রি’ যেমন, তেমনই কীবা সোমবার, কীবা রোববার।  আমাদের কাছে সপ্তাহের সাতটা দিনই এক, যদি না কোনও ঘটনা ঘটে সে দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য, ভাল হোক, মন্দ হোক।  তবে ওসব ঘটনা তো দিনবার দেখে ঘটে না।  

    আমি গ্রামের ছেলে, আমার মনে পড়ে সোমবার স্মরণীয় হয়ে থাকে শুধু গরুবাছুরের নামে।  যে গরুটি সোমবার জন্মাল, অবশ্যই বাছুর হিসেবে, তার নাম হল সোমবারি, মঙ্গলে হলে মঙ্গলা বা মুংলি, বুধে হলে বুধি।  দেহাতিদের মধ্যে মানুষের নামেও তাই হত।  জানি না, মানুষের নামে ‘সোমা’ বা ‘সোমনাথ’, ‘সোমশংকর’ সেভাবে এসেছে কি না।  যাই হোক, এতে যদি সোমবার খুশি হয়, তাতে আপত্তি করার কিছু নেই।  এমনিতেই মানুষের কাছে সে যথেষ্ট হেনস্থা হয়, তার জনপ্রিয়তা একেবারে তলানিতে দাঁড়িয়ে আছে।  মানুষের সভ্যতার একটা বড় অংশ  তো ‘সোমবার মুর্দাবাদ’ বলতে পারলে বেঁচে যায় !

    সুখের বিষয় এই যে, ইসলামি সংস্কৃতিতে এই রাগটা শনিবারের ওপর গিয়ে পড়ে।  রবিবারও সেখানে সুখের দিন নয়।  সোমবারকে তাই আমি সান্ত্বনা দিতে একটা ইংরেজি কথা দিয়ে শেষ করি— ইউ উইন সাম, ইউ লুজ সাম।  কখনও তুমি জেতো, কখনও অন্যরা জেতে।  ওই যে একটা বাজে রসিকতার বাজি আছে— পয়সা আকাশে ছুড়তে গিয়ে বলে, ‘দ্য হেড আই উইন, দ্য টেল ইউ লুজ’— সেটা তোমার ক্ষেত্রে সব জায়গায় হবে না, তুমি সব সময় হারবে না— এই আশ্বাস নিয়ে থাকো।  

    এটুকু শুকনো পিঠ-চাপড়ানিতে সোমবারের সব দুঃখ ঘুচবে কি না, কে জানে!

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook