পান্নালাল ভট্টাচার্যর মতো স্বল্পায়ু শিল্পী সম্পর্কে কথা বলার সমস্যা হল, একই কথা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে বলতে হয় । একে তো ৩৬ বছর বয়সে মারা গেলেন, এদিকে যা তথ্য পাওয়া যায়, তা দিয়ে কিছু লেখা দুরূহ একটা বিষয়। এদিকে সমস্যা হচ্ছে, আমাদের হিরোও চাই, আবার সাধকও চাই— এই দুইয়ের কাউকে আমরা ছেড়ে যাব না। যার ফলে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দীর গল্পের চরিত্ররা আমাদের মনে রেখা ফেলে যায় না। কারণ এরা সবাই রক্তমাংসের মানুষ। বিমল করের সুধাময়ও আমাদের হিরো নয়। পান্নালালও আমাদের হিরো নন, তাই শ্যামাসংগীত-গাইয়ে মাত্রই তাঁকে কালীসাধক হতে হয়, শ্মশানে গিয়ে পড়ে থাকতে হয়। তার বউ-ছেলেপিলে থাকতে নেই।
তবে পান্নালাল ভট্টাচার্য সত্যিই যদি হিরো হয়ে থাকেন, সেটা এই জন্য যে, ওঁকে অতিক্রম করে আজকেও কোনও পুজোর অনুষ্ঠানের গান সম্পূর্ণ হয় না। ওই একই কথা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর ক্ষেত্রেও খাটে। একেই বোধহয় সময় বলে, উত্তমকুমারের অনুষ্ঠানও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বদলি হিসেবে লোকে নেয়নি।
আরও পড়ুন : তুখড় ছদ্মবেশ শিল্পী থেকে দাপুটে অভিনেতা, ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকে চিনল না বাঙালি! লিখছেন সায়নদেব চৌধুরী…
আগেকার দিনে ভক্তিমূলক সিনেমায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় হতেন রামপ্রসাদ, বামাখ্যাপা, ওঁর লিপে থাকত ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর গান। আর বেসিক ডিস্কের রেকর্ডে পান্নালাল ভট্টাচার্যর গান। ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’-তে ধনঞ্জয় গেয়েছিলেন, ‘আপনারে আপনি দেখ যেও না মন কারও ঘরে’। কালীপুজোর দিন দুপুরে এই সিনেমাগুলো দিত। বড় ভাই-এর ক্লাস ছেড়ে ছোট ভাই-এর খপ্পরে পড়ত বাঙালি সন্ধের সময়।
পান্নালাল কত বড় সাধক ছিলেন, মন্দিরে গিয়ে কতবার মা ডাকতেন, আজকেও আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ার এত এত জটিলতার মধ্যে এই চিন্তা স্থায়ী হওয়ার কথা বোধহয় না, তিনি যতবারই মা ডাকুন, তাঁর গলায়, ‘দুঃখ যদি তোর ছিল জানা, সুখ দিতে কে করল মানা!’— এই সুরোক্তি আক্ষেপের সঙ্গে প্রশ্ন না তুলে দিত, তাহলে কি আমরা তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতি করতাম? পান্নালাল-কে আমরা মনে করতাম, না, এই ভদ্রলোক আমাদের দুঃখের কথা বলছেন।। সুখ দিতে কে করল মানা— এই প্রশ্নের পূর্বাপর আছে। বঙ্কিম যখন লেখেন, ‘এ জীবন লইয়া কী করিব, এ জীবন লইয়া কী করিতে হয়’, যখন তারাশংকর লেখেন, ‘জীবন এত ছোট কেনে’, আবার যখন অর্জুন কৃষ্ণকে বলেন, ধৃতরাষ্ট্রদের মেরে আমাদের কী সুখ হবে— এইসব প্রশ্নের সার পান্নালালের গলায় পাই, ‘দুঃখ যদি তোর ছিল জানা, সুখ দিতে কে করল মানা’! এই এতগুলো প্রশ্নের উত্তর নেই, কিন্তু উত্তরে মৌন থাকলেও, প্রশ্নগুলো থাকে! এই প্রশ্নের উত্তরে একটা কথাই আসে, ‘দোষ কারও নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।’ আর শুধুমাত্র ‘মা’ ডাকেই যে সবকিছু হয় না, সঙ্গে চর্চা আর চেষ্টা লাগে একটা অসামান্য গান গাইতে— সেটা পান্নালাল ভট্টাচার্যর গলায়, ওই শ্যামা বামা কে— গানটা শুনলেই বোঝা যায় ।
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, ‘বন্ধুরা বিদ্রূপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে; তোমার চেয়েও তারা বিশ্বাসের উপযোগী হলে আমি কি তোমার কাছে আসতাম ভুলেও কখনো?’
পান্নালাল কত বড় সাধক ছিলেন, মন্দিরে গিয়ে কতবার মা ডাকতেন, আজকেও আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ার এত এত জটিলতার মধ্যে এই চিন্তা স্থায়ী হওয়ার কথা বোধহয় না, তিনি যতবারই মা ডাকুন, তাঁর গলায়, ‘দুঃখ যদি তোর ছিল জানা, সুখ দিতে কে করল মানা!’— এই সুরোক্তি আক্ষেপের সঙ্গে প্রশ্ন না তুলে দিত, তাহলে কি আমরা তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতি করতাম?
মৃত্যুর এত বছর পরে এখনও কোনও পুজোয় পান্নালালের গান বাজে এই কারণেই যে, পান্নালালের মতো বিশ্বাস বাঙালি আর কাউকে করেনি শ্যামাসংগীতের ক্ষেত্রে । এই বিশ্বাস শঙ্খ ঘোষের অন্ধের স্পর্শের মতো।
ছোটবেলা থেকে শুনি পান্নালাল গাইছেন ‘আমি যদি ভুল করি মা তুই যেন গো করিস নে ভুল’। এখন তো অনেকেই সচেতন, আগে লেখাপড়া না করলে মারধর খেলে বলা যেত, বুদ্ধি থাকলে— আমি যদি ভুল করি মা তুই যেন গো করিস নে ভুল। পাষাণের মা গলত কি না জানি না, রক্তমাংসের মায়ের হাত থেকে লাঠি খসে যেতেও পারত।
কিন্তু যে কথাটা পান্নালাল মর্মে গেঁথে দিলেন, আজকে পান্নালাল যে বয়েসে চলে গেলেন সেই বয়েসে এসে বুঝতে পারি, ‘আঁধারে করেছি জমা আলোক রথের ওড়া ধুল’। কে বলতে পারে, অভিমন্যু মারা যাওয়ার পর অর্জুন ফিরে এসে সন্ধেবেলা মনে মনে এই কথাই বলেননি!
বাস্তবিক দুঃখ হয় অন্য কারণে যে, ৩৬ বছর বয়সে একজন মানুষ চলে গেলেন, তার ওপর ওরকম শিল্পী, সালটাও ১৯৬৬ । ১৯৬৬ সাল, দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এক-একজন দিকপাল। দাপিয়ে পান্নালালেরও বেড়ানোর কথা ছিল! কিন্তু ওই, ‘ফাটা ডিমে তা দিয়ে আর কি ফল পাবে, মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া’। তবু এও ভাল, অসহ্য আত্মরতির মধ্যে কখনও পান্নালাল ভট্টাচার্যের মতো শিল্পীর গাওয়া গান শোনা যায়। ওই সত্যজিতের ‘মহাপুরুষ’ সিনেমায় বিরিঞ্চিবাবা-রূপী চারুপ্রকাশ ঘোষকে দিয়ে সত্যজিৎ বলিয়েছিলেন, ধর্ম নিয়ে ফুটবল খেলা হবে— আজকে যখন হচ্ছে, তার মধ্যেও আস্তিক-নাস্তিক সবার জন্যই পান্নালাল এক আশ্রয়।
যে আশ্রয় আমাদের ভরা চৈত্রে ঠান্ডা করে।