ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • হাহাকারের ধৈবত

    রুদ্রাঞ্জন মুখোপাধ্যায় (March 21, 2025)
     

    মজলিশি কথালাপে একটি শব্দের বিশেষ প্রচলন আছে। সুরের ‘তাসির’। ইংরেজিতে তার অর্থ হল, effect. কিন্তু শুধু এই অনুবাদে তাকে ছোঁয়া মুশকিল। কত শিল্পী-জীবন কেটে যায় এই ‘তাসির’-এ পোঁছতে— তার হিসেব নেই। জীবনের শেষ পর্বে এসে উস্তাদ আমির খাঁ নিজের শ্রেষ্ঠ গান্ধারটি লাগিয়েছিলেন, রেওয়াজের সময়, তারপর খানিক ধ্যানমগ্ন বিরতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘ইয়ে গান্ধার জিসকা লগ যাতা হ্যায় ও জ্যাদা দিন রেহতা নেহি।’ এর ক’দিন পরেই পথ দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়।

    শাস্ত্রীয় সংগীত তো শুধু বিনোদনের বিষয় নয়। তাকে ঘিরে থাকে আত্মদীপের আলো। সেই আলোর কাছে স্থানু হয়ে বসে থাকা শিল্পী হয়তো চটুল, বৈঠকি হাসিতে সানাই হাতে তুলে নেন। মনে ভাবেন, ‘বহুযুগের ওপার’-এর কথা। যখন তিনিও ছিলেন শিষ্য । ওস্তাদের কাছে শুনেছিলেন, ‘আগর সুর মে তাসির পয়দা করনা হ্যায়, তো সুভে সে লেকে শাম তক একভি ঝুট নাহি বোলনা।’ এর মধ্যেই তিনি সুর লাগান বাগ্রেশ্রীতে, খরোজের পঞ্চম থেকে সা-তে পৌঁছন। তাঁর নেপথ্যে ছাল-বাকলা উঠে যাওয়া চুনকাম দেওয়ালে মুশায়েরার কলরোল।

    আরও পড়ুন : ভাত যোগানোর জন্য গানের টিউশনিও করতে হয়েছে অখিলবন্ধু ঘোষকে! লিখছেন সুকুমার সমাজপতি…

    বিভূতিভূষণের সঙ্গে বিসমিল্লাহ খাঁ-র পরিচয় ঘটেনি। লবটুলিয়াকে তিনি দিনে দিনে শেষ হয়ে যেতে দেখেননি। তিনি জানতেন না, দুর্গা স্রেফ ক’দিনের জ্বরেই চলে গেছে, অপুকে ফেলে। তাঁর বসতবাড়িতে নেই হিজলের জানালা, যাতে আলো আর বুলবুলি একত্রে খেলা করে। সেখানে সুপুরির সারি বেয়ে সন্ধে নামে, তাকে দেখেননি তিনি। অথচ তাদের নিয়েই তাঁর বিধ্বংসী সানাইয়ের সুর। সুন্দর যেন তার অপরকে নিয়ে সমাসীন হয় সুরের সাম্রাজ্যে, মিলে যায় বেনারসের জলহাওয়ার সঙ্গে। কল্যাণে পুরিয়ার রং লাগলে রেখাব কোমল হয়। তখন তার শান্তির সংসারে এসে মেশে কোমল রেখাবের অস্তিত্ব সংকট।

    ১৯৬৪ সালের একটি অনুষ্ঠানে

    সুরের সঙ্গে ভূগোলের এক অদ্ভুত সম্পর্ক। বৃন্দাবনী সারংয়ের বিখ্যাত বন্দিশ, ‘বন বন ঢুডন যাউ, কিতহু ছুপ গয়ি কৃষ্ণ মুরারি’ : নিধিবনে রাধাকৃষ্ণের মিলনপূর্ব খেলাখেলির যাবতীয় গল্প যেন একেবারে ছবির মতো স্পষ্ট করে। বাংলার বাতাবরণে এ-সুরের চিত্র কল্পনা করা খানিক কষ্টকর। এ-সুরের সিংহভাগ উত্তর ভারতের। তার প্রতিটি চালচলন যেন আপাদমস্তক দেহাতি। কিন্তু দেহাতের সঙ্গে বাংলা মিলে যায় কীর্তনের বুলিতে। এই যুগলমিলন দেখিয়েছিলেন প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, তাঁর ওয়েব সিরিজ, ‘বিরহী’-তে। তেহট্টের মাটিই যেন সেখানে বৃন্দাবনী সারংয়ের উর্বরভূমি। ওস্তাদি বন্দিশের পরিবর্তে সে রাগের চলন তৈরি করে খাস বাংলার কীর্তন, ‘যমুনা পুলিন কেশি ঘাট বংশী বট হে।’

    এভাবেই সুর তার জমি আঁকড়ে ধরে। মিশে যায় মাটির সঙ্গে। ঠিক যেমন বেনারসের ঘাটকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রাখে শুদ্ধ সারংয়ের মধ্যম। কাজেই, মাটি বিপর্যস্ত হলে সুরও বিপর্যস্ত হয়, বলাই বাহুল্য। ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে বীরকৃষ্ণ দাঁ এক জায়গায় বেণীমাধব চাটুজ্জেকে বলছেন, ‘টাকার সামনে অমন অনেক বন্দুকের নল মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, কাপ্তেনবাবু। দু’হাতে আটটা জড়োয়ার আংটি, এর যে কোনও একটা দিয়ে আপনাদের ওই সাহিত্য-ফাহিত্য সব কিনে নিতে পারি।’ এই সংলাপ লেখা হচ্ছে এমন এক সময়, যখন পশ্চিমবঙ্গের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা থাকত, ‘বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।’ অর্থাৎ, অতীতকে গ্রহণের ক্ষেত্রে এসে পড়ছে নাটককারের বর্তমান যাপনের অভিজ্ঞতা।

    বিসমিল্লাহ খাঁ-র সুরমাধুর্যকেও হয়তো ঠিক সত্য, শিব, সুন্দর দিয়ে বোঝা উচিত
    হবে না

    এমনটাই তো হয়। আমরা যা কিছু দেখি, যা কিছু গ্রহণ করি, তার সঙ্গে আমাদের পারিপার্শ্বিকের যোগাযোগ তৈরি হয়। প্রতিগ্রহণ তো সমাজ-বহির্ভূত কোনও বিষয় নয়। বরং সে ঘোরতরভাবে সামাজিক। সে-হিসেবে, বিসমিল্লাহ খাঁর সুরমাধুর্যকেও হয়তো ঠিক সত্য, শিব, সুন্দর দিয়ে বোঝা উচিত হবে না। বিশেষ করে, যে ভূখণ্ড তাঁর সুরসৌন্দর্যকে নির্মাণ করেছে, সে ভূখণ্ডই যখন বর্তমানে হিন্দু-ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রবিন্দু। সৌন্দর্য কখনওই শর্তমুক্ত নয়। অপরকে সঙ্গে নিয়েই তার অস্তিত্ব।

    উস্তাদ ইমদাদ খাঁ-র সেই বিখ্যাত গল্প হয়তো অনেকেই জানেন। কন্যাসন্তানের মৃত্যুর কালে বেহাগের রেওয়াজে তিনি এতটাই ডুবে ছিলেন যে, আসন ছেড়ে উঠতে পারেননি। ওই অবস্থাতেই তিনি কন্যার মৃত্যুর খবর পান, তার দফনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। সেদিন থেকে খাঁ সাহেবের আপাত আনন্দের বেহাগ প্রবল যন্ত্রণার স্মৃতি বয়ে বেরিয়েছিল। সে যেমন সুন্দর, আনন্দের, তেমন যন্ত্রণারও। অনুভূতির এমন দ্বিজাতি তত্ত্বেরই প্রতিমূর্তি বিসমিল্লাহ খাঁ-র সানাই।

    বিসমিল্লাহ খাঁ-র সুরমাধুর্যকেও হয়তো ঠিক সত্য, শিব, সুন্দর দিয়ে বোঝা উচিত হবে না। বিশেষ করে, যে ভূখণ্ড তাঁর সুরসৌন্দর্যকে নির্মাণ করেছে, সে ভূখণ্ডই যখন বর্তমানে হিন্দু-ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রবিন্দু। সৌন্দর্য কখনওই শর্তমুক্ত নয়। অপরকে সঙ্গে নিয়েই তার অস্তিত্ব।

    ধৈবতের ব্যবহার দু-রকম। একদিকে সে কেদারে এলিয়ে পড়া চাঁদের আলো, অন্যদিকে সে মারওয়ায় নিঃস্ব করে দেওয়া হাহাকার। এমন হাহাকারের ধৈবত নিয়েই বিসমিল্লাহ-র বিশ্ব। বিসমিল্লাহ খাঁ-কে বাবরি পরবর্তী রামমন্দির দেখে যেতে হয়নি। হোলি বলতে তিনি শুধুই বুঝতেন হোরি, কাজরির সমাহার। কিন্তু কাজরি ছাড়াও হোলি খেলা যায়, রক্তের হোলি। যেমনটা ইজরায়েল খেলছে গাজার মানুষদের নিয়ে।

    এসব কিছুই জানতেন না খাঁ সাহেব। সানাইয়ের সুরে তিনি শুধুই নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে যাওয়ার কালে অপুর নিজেকে করা সেই সরল প্রশ্নটি তুলেছিলেন, ‘যেখানে যাইতেছে সেখানকার বনে গুলঞ্চ-লতা পাওয়া যায় তো?’

    বিক্ষুব্ধ সময়ে এমন সারল্য হাজার মুষ্টিবদ্ধ হাতের চেয়েও বেশি রাজনৈতিক।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook