ইংরেজিতে একটা কথা আছে— ‘Too good to be true’. এর যথাযথ বঙ্গানুবাদ কী হতে পারে, জানা নেই। কোনওকিছুর উৎকর্ষ এমন স্তরে পৌঁছয় যে, তা আদৌ বাস্তবে ঘটতে পারে কি না, সন্দেহ জাগে। হলুদ রঙের প্রসঙ্গে সেই বাক্যটিই মাথায় আসে প্রথমে। উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত এক রং— নাকছাবিও যেখানে-সেখানে নয়, হারায় ‘হলুদ বনে বনে’-ই। দু’বার ‘বনে’ শব্দটি উচ্চারণ করে অজ্ঞাত সেই ছড়াকার বনের বিস্তৃতি বোঝান, সেই সঙ্গে পাঠকের মনে এঁকে দেন তার হরিদ্রাভা। সবুজ অরণ্য-কল্পনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তা।
কিন্তু অবিশ্বাস্য ঠেকে কেন? আর পাঁচটা রঙের মতো একটা রং বই তো নয়! তবে কি ধর্মে উজ্জ্বল হওয়াই কারণ? নীল, লাল, সবুজ বা কালো-র ভেতরে যে অন্ধকার দিক লুকিয়ে, হলুদে তা নেই বলে? মলিন মর্ম মুছায়ে চলে শুধু? ধূসর এই দেশে হলুদের ঔজ্জ্বল্য ‘বিশেষ’ বলেই কি শাহরুখ খান-অভিনীত কালজয়ী গানের দৃশ্যপটে দেখা যায় সরষের খেত? এত সব প্রশ্নের আলোড়নে ঘেঁটে যাই। মনে পড়ে বাঙালির নিজস্ব ‘গায়ে হলুদ’ রীতি। ‘হলদি’ নখ-দাঁত বের করেও যাকে পুরোপুরি গিলতে পারেনি। হলুদই কেন? হলুদ-ব্যবহারে ত্বক খোলতাই হয়— এই ধারণাই কি মিশে গেল বিবাহ-পূর্ববর্তী লোকাচারে? চৈত্র সংক্রান্তিতে পালনীয় ‘রূপ-হলুদ ব্রত’-তেও সেই ইঙ্গিত। কাশীরাম দাস অনূদিত ‘মহাভারত’-এ দেখা যায়— ‘হরিদ্রা তৈলেতে কৈল অঙ্গের মার্জ্জন’, অর্থাৎ, তেল-হলুদ দিয়ে শরীর পরিষ্কার করা।
তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যা-ই হোক-না কেন, হলুদ রঙের কাব্যিকতা লুকিয়ে তার সমার্থক একটি শব্দে— ‘পীত’। প্রাক-ঔপনিবেশিক সাহিত্যে, বিশেষত বৈষ্ণব পদাবলিতে এর উপস্থিতি লক্ষণীয়। সেই কবে জয়দেব লিখে গিয়েছিলেন— ‘ধীরসমীরে যমুনাতীরে পীতবসনবনমালী’। পীত, অর্থাৎ হলুদরঙা বসন (কটিবস্ত্র বা ধুতি) পরে, যমুনার পাড়ে কৃষ্ণের বিচরণ। এত রং থাকতে, হলুদ বর্ণের পোশাকই কেন পরতেন তিনি? নামে ‘কালা’ হলেও গাত্রবর্ণ নীল তাঁর; অঙ্গে হলুদ বস্ত্র যে রং-বৈপরীত্য সৃষ্টি করে, তা নজর টানে দ্রুত। একইভাবে, গৌরবর্ণা রাধার শাড়ির রং নীল— বৈপরীত্য ফুটিয়ে তুলতেই। কৃষ্ণের ক্ষেত্রে ঔজ্জ্বল্য ফুটল তাঁর বসনে, রাধার ক্ষেত্রে গাত্রবর্ণে।
কিন্তু যদি এই হিসেব গুলিয়ে দেওয়া যায়? প্রেমে আকুল রাধিকা যদি বহিরঙ্গে কৃষ্ণ হয়ে উঠতে চান আর কৃষ্ণকে করে তুলতে চান রাধা, সেই লীলাকে আমরা জানা-বোঝার ছকে ফেলব কী করে? তবে বৃন্দাবনদাসের পদে, রাধার বয়ানে সেই ইঙ্গিতও মেলে। ‘তুমি লহ মোর নীল শাড়ী।/ তব পীত ধড়া দেহ পরি।।’— এ কি নিছকই বস্ত্র-আদানপ্রদানের প্রস্তাব? রাধা কি ‘বিপরীতরতাতুরা’-ও হয়ে উঠছেন না এ-মুহূর্তে? কৃষ্ণের হলুদ ধড়া (কটিবস্ত্র)-পরিহিত রাধাকে কল্পনা করি মনে-মনে। আর কৃষ্ণের অঙ্গে শাড়ি, কপালে সিঁদুর, গলায় মুক্তার মালা। পাঠক, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘গোয়েন দা’ চলচ্চিত্রে ‘জলে কী রূপ হেরিয়া’ গানটির দৃশ্যায়ন মনে পড়ে কি?
কৃষ্ণের এই পীত অঙ্গবস্ত্র নজর এড়ায়নি সেকালের মুসলিম কবিদেরও। একজন কবি বা পদকর্তার ধর্মোল্লেখ অশালীন, কিন্তু তাত্ত্বিক আলোচনার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয়ও বটে। প্রাক-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক যুগে বহু মুসলমান কবি রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে পদ বেঁধেছিলেন। বাংলার চিরন্তন মিলন-ঐতিহ্যের উদাহরণ হিসেবে উল্লিখিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে সেইসব পদ। তেমনই এক পদে, হবিব ফকির লেখেন— ‘কটিতে পীতাম্বর, দেখিতে মনোহর, মুকুন্দ মোহন যদুরায়।’ ‘কটিতে পীতাম্বর’, অর্থাৎ কোমরে হলুদবস্ত্র পরিহিত। অন্যদিকে, বৃন্দাবনদাস ‘চৈতন্যভাগবত’ কাব্যে নিমাই-বন্দনায় লিখছেন— ‘বিশ্বম্ভর চরণে আমার নমস্কার।/ নব ঘন পীতাম্বর বসন যাহার।’ নিমাই-এর পোশাকের এই রং-উল্লেখ কি নিছকই ‘অবতার’ হিসেবে কৃষ্ণের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে? মনে হয় না।
‘পীত’ থেকে ফিরে আসি হলুদে। সরস্বতী পুজোর দিন হলুদ শাড়ি বা পাঞ্জাবি পরার যে ট্র্যাডিশন সমানে চলিছে, তার কারণ খুঁজতে বসলে মনে পড়ে, হলুদের ঔজ্জ্বল্য একদিক দিয়ে বসন্ত-আগমনেরও প্রতীক। যে-কারণে শুধু বসন্ত পঞ্চমীই নয়, দোলযাত্রা তথা হোলিতেও প্রাধান্য পায় হলুদ পোশাক। লাল বা গোলাপি আবিরের পাশাপাশি বাতাসে ওড়ে হলুদ রং। শুধু পলাশ বা কৃষ্ণচূড়াই নয়, প্রশাখা আলো করে থাকে রাধাচূড়াও। মানুষ ও প্রকৃতির এই বোঝাপড়া, একটি রংকে ঘিরে, নেহাত উড়িয়ে দেওয়ার নয়।
‘কটিতে পীতাম্বর, দেখিতে মনোহর, মুকুন্দ মোহন যদুরায়।’ ‘কটিতে পীতাম্বর’, অর্থাৎ কোমরে হলুদবস্ত্র পরিহিত। অন্যদিকে, বৃন্দাবনদাস ‘চৈতন্যভাগবত’ কাব্যে নিমাই-বন্দনায় লিখছেন— ‘বিশ্বম্ভর চরণে আমার নমস্কার।/ নব ঘন পীতাম্বর বসন যাহার।’ নিমাই-এর পোশাকের এই রং-উল্লেখ কি নিছকই ‘অবতার’ হিসেবে কৃষ্ণের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে? মনে হয় না।
অথবা, হয়তো উড়িয়ে দেওয়ারও। উড়তে উড়তে পৌঁছে যায় কৃষিক্ষেত্রে, আলো হয়ে থাকে ফসলের গায়ে। ‘সোনার ফসল’-এর বর্ণ ঠিক কী? পাকা ধান যখন ছড়িয়ে থাকে মাঠে, খড় যখন শুকোতে দেওয়া হয় পথের ধারে, তার যে রং, তাকে কি ঠিক হলুদ বলা যায়? রোদ— সেও কি হলুদ? মাঝে মাঝে মনে হয়, হলুদ এক পরিবারের রং; কাছে-পিঠের আত্মীয়-পরিজন সন্তান-সন্ততিকে নিয়ে সংসার তার। ভ্যান গঘের ছবির মতো। কখনও মলিন, কখনও তীব্র উজ্জ্বল, কিন্তু ‘হলুদ’-পরিচয়ের বাইরে নয়।
আবার, এই পরিচয়ই যখন ঠাঁই পায় মধ্যবিত্তের ঘরের ভেতর, দেওয়াল সেজে ওঠে চুনকামের রং হয়ে। জায়গায়-জায়গায় চটা ওঠা, ভেতরের নগ্নতা বেরিয়ে আসা, তারপরেও কী আপ্রাণ টিকে থাকার চেষ্টা! বাজতে থাকে জামরুল গাছে হলুদ পাখি বসে থাকার গান। বইয়ের তাক থেকে উঁকি দেয় ‘হলদে পাখির পালক’। রান্নাঘরে নুন-হলুদের সালতামামি। খানিকটা লেগে যাওয়া শাড়ির আঁচলেও। এ-শাড়ি রাধারানির নয়, বরং অন্নপূর্ণার। মৃন্ময়ী হলে, গাত্রবর্ণেও হরিদ্রাভা। তখন তিনি দুর্গা অথবা অন্য-কেউ। পরিচয় ঘেঁটে দিলে দেখা যায়, গৌর-নিতাই-এর অধিকাংশ দারুবিগ্রহের রংও সেই হলুদ। কেন?
উত্তর একটাই— ঔজ্জ্বল্য। সূর্যের কিরণ যে-প্রাণবন্ততা ছড়িয়ে দেয়, তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা। ক্রমাগত ধূসর হয়ে-চলা পৃথিবীতে আর কোন রংই-বা এমন উদযাপন শেখাবে! মুসলমান সমাজের বিয়ের গানেও সে-কারণেই প্রতিফলিত হয় এমন কথা— ‘আমার ভাইয়ের গায়ে মাজায় রে হলুদ মাখাইয়া তোরা দে।’ ধর্মের গণ্ডি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না লোকাচারে।
বিনয় লিখেছিলেন, ‘ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না ক’রে শ্যামল হতে দেওয়া।’ হলুদ বিবর্ণতারও রং, জানি। ঝরে-পড়ার প্রাকমুহূর্ত। কিন্তু তার বিপরীত দিকটি এতই জোরালো যে, মন সরে না।
ওই যে গোড়াতেই বলেছিলাম, ‘টু গুড টু বি ট্রু’; তা যদি সত্যি-সত্যিই সত্য হয়, এড়ানোর পথ কই!
ঋণ:
আশুতোষ মজুমদার, মেয়েদের ব্রতকথা, দেব সাহিত্য কুটীর, ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ
কাশীরাম দাস অনূদিত, মহাভারত আদিপর্ব্ব, আহিরীটোলা, ১২৫৩ বঙ্গাব্দ
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস ও অন্যান্য বৈষ্ণব মহাজন গীতিকা, দেব সাহিত্য কুটীর, ১৯৪০
জয়দেব গোস্বামী, শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম, বসুমতী কর্পোরেশন লিমিটেড, পুনর্মুদ্রণ ২০১৪
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সংকলিত ও সম্পাদিত, বাঙ্গালার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবির পদমঞ্জুষা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৭
শক্তিনাথ ঝা, মুসলমান সমাজের বিয়ের গীত, পুস্তক বিপণি, ১৯৯৬
হরিপদ ভৌমিক, বিয়ের শব্দকোষ, গাঙচিল, ২০১২