সম্ভাবনামুকুলের দিন
সেই সুখী, যে-ব্যক্তি অঋণী ও অপ্রবাসী— যুধিষ্ঠির বলেছিলেন যক্ষকে। সুখের সম্ভাব্য রেসিপিতে আরেকটি কথা জুড়ে নিতে ইচ্ছে করে— ঘরে ও বাইরে নিজের পছন্দসই কাজ নিয়ে সময় কাটানোর সুযোগ আছে যার, সুখী সেই ব্যক্তিই। অর্থাৎ, কেউ যদি চাকুরিজীবী হন, সকালবেলায় নিজের কর্মস্থলে ঢুকতে গিয়ে তাঁর মন ভাল হয়ে যাবে, চনমনে লাগবে, আবার সন্ধেয় বাড়ির পথে রওনা দিয়েও আরেক রকম আনন্দে ভরে থাকবে মন— এ হল প্রকৃত সুখ।
ভাবি, সুখ তো অবিমিশ্র হয় না! কারও হয়তো কাজের জায়গায় বিপুল স্ট্রেস। কারও হয়তো কাজের জায়গা মসৃণ, কিন্তু দুস্তর পথ পেরিয়ে যাতায়াত, ক্লান্তি। কেউ হয়তো এমন কোনও পেশায় থাকতে বাধ্য হয়েছেন, যার সঙ্গে তাঁর মনের যোগ নেই। সেইজন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকেন সপ্তাহান্তের জন্য। ওই একটা বা দুটো দিনই তো নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারার সুযোগ। সেখান থেকেই সোমবার নিয়ে ভীতি। মনডে ব্লুজ।
তবে মনডে ব্লুজ ব্যাপারটা থাকাটুকুও এক ধরনের বিলাসিতা হয়তো। কারণ, যে-গৃহসহায়িকা দিদি শনি-রবি-সোম রোজই কাজে আসেন, যে-রিকশাচালক বা সবজিবিক্রেতা দাদা প্রতিটি ভোরে একই রকমভাবে কাজে যান, সোমবাসরীয় মনখারাপের ফুরসত মেলে না তাঁদের। আমাদের মনডে ব্লুজ বুঝিয়ে দেয়, আমরা আদতে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর মানুষ, যাদের সপ্তাহে একটি বা দুটি দিনের ছুটি জোটে।
সোমবার। Sombre। আমার জন্য কেমন? সত্যি কথা বলতে, মনডে ব্লুজ ব্যাপারটা কোনওদিনই বুঝতে পারিনি তেমন। তার সবচেয়ে বড় কারণ, অ্যাকাডেমিয়াতে থাকলে তো ওরকম গতে বাঁধা দশটা-পাঁচটা রুটিন থাকে না আসলে! যে-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স পড়াই, তার ক্লাসের অবশ্যই নির্দিষ্ট শিডিউল থাকে। কিন্তু সেই ক্লাসের প্রস্তুতির পিছনের যে-পড়াশুনো, সে তো মূলত ওই ক্লাস আওয়ারের বাইরেই। তাই সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে যেমন বই-খাতা-কলম বাগিয়ে বসতেই হয়, বসতে হয় শনি-রবিতেও।
আর পড়ানোর পাশাপাশি চলতে থাকে গবেষণার যে-কাজ, তার তো আরওই কোনও বাঁধা সময় থাকে না। আমার যে-সহকর্মীরা এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সে কাজ করেন, তাঁদেরকে বহু সময়েই ল্যাবে কাটাতে হয় সারারাত, বা শনি-রবিও। কারণ একটা পরীক্ষা যখন চলতে থাকে, তার নিজস্ব কিছু সময়সীমা চলতে থাকে— কতক্ষণ পর পর রিডিং নিতে হবে, কতবার যন্ত্র চেক করতে হবে, ইত্যাদি; যা ঠিক সপ্তাহের-বারের হিসেব মেনে চলে না। আমার নিজের গবেষণার কাজ এক্সপেরিমেন্টাল নয়— থিওরেটিকাল, অর্থাৎ খাতা-কলমে কিংবা কম্পিউটারে অঙ্ক করা। তাই রাতবিরেতে ল্যাবে দৌড়তে হয় না বটে, কিন্তু বাড়িতে কাজ নিয়ে বসতে হয়ই।
ছেলের স্কুলের জলের বোতলে জল ভরতে-ভরতে ভাবি, তারও তো আরম্ভ হল নতুন সপ্তাহ! স্কুলে গিয়ে শিখবে নতুন কত কী, তুলবে নতুন গানের সুর। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে আমিও জড়িয়ে যাব তার সঙ্গে, শৈশবের পাঠগুলো তার পাশে বসে নাহয় নেব আরেকবার। সোমবার আসলে এই সব সম্ভাবনামুকুলের দিন। নিজেকে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতির পালক সকালের হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার দিন।
মনে আছে, অনেকদিন আগে আমার এক বন্ধু তার তাত্ত্বিক গবেষণার কাজ একটা বক্তৃতায় প্রেজেন্ট করেছিল ক্রাইম থ্রিলারের আদলে। মানে, অঙ্ক কষে দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক কোনও ঘটনার এই রকম অদ্ভুত ফলাফল বেরোচ্ছে, কিন্তু কেন বেরোচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না… ফলে আশেপাশের ঘটনাগুলোকে গাণিতিক লেন্সের তলায় ফেলে একে-একে পরীক্ষা করে করে দেখা যাক, কালপ্রিট কোথায় লুকিয়ে আছে— এইভাবে সাজিয়েছিল সে তার প্রেজেন্টেশনটা। সত্যি করেই বিজ্ঞানে যেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন গবেষকরা, সেই সন্ধানের প্রকৃতি অনেকটা ওই গোয়েন্দাকাহিনির মতোই। এইবার, অমন একটা মিস্ট্রি নিয়ে আপনি লড়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন, এমন সময়ে আচমকা একটা নতুন সম্ভাবনার আলো আপনার মাথায় ঝিলিক দিল শুক্রবার বিকেলে— আপনি কি তখন রহস্যভেদের উত্তেজনায় শনি-রবি নাওয়া-খাওয়া ভুলে সেটা নিয়ে লড়ে যাবেন না?
এবার, শনি-রবি যেহেতু কাজের ভাবনা থেকে ছুটি নেই, তাই সোমবার নতুন করে সে-ভারে ভারাক্রান্ত হওয়ার ভয়ও নেই। সোম থেকে রবি পার হয়ে আবার পরের সোম, গোটাটাই, একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস, একই ধারাবাহিকতার অন্তর্গত। তা ছাড়া, ওই যে শুরুতে বলছিলাম, কাজের জায়গাটি প্রিয় হয়ে গেলে সে-সুখ অন্য রকম। তখন সোমবার এলেও দুশ্চিন্তা বা বিষাদ আসে না ঠিক। বরং, দু’দিন বিরতির পর বিশ্ববিদ্যালয়চত্বরে যখন পা রাখি, প্রাচীন বিল্ডিং তার উঁচু-উঁচু খিলানের মতো স্থাপত্য নিয়ে স্বাগত জানায়, রেলিং-এর নকশা দীর্ঘ ছায়া ফেলে রৌদ্রস্নাত করিডোরে, মনটা এমনিই ঝলমল করে ওঠে।
আর পেশাগত কাজের বাইরে যে-কাজ? সামান্য, খুবই সামান্য লেখালেখি করি, যেখানে লেখার চেয়ে না-লেখার পাল্লা চিরদিনই ভারী। রবিবার, বা অন্য কোনও ছুটির দিন মনের সুখে লিখব, এমনটা হয় না আমার ঠিক। কারণ, লেখারা মেজাজি, বিশেষত কবিতা। আমার সময় থাকলে সেও যে সেদিনই সম্মত হবে, এমন তো নয়! বরং অন্যান্য কাজের চাপ যখন সবচেয়ে বেশি, দেখেছি লেখার ভাবনারা তখনই মগজে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালায়। ফলে এখানেও রবি-সোম আলাদা কিছু নয় আমার জন্য।
তবে, নিজস্ব পেশার বা শখের পরিধির বাইরেও তো বিবিধ কাজ থাকে মানুষের। সংসার থাকে, সন্তান থাকে। কাকভোরে উঠে নিজে রেডি হয়ে, সন্তানকে স্কুলের জন্য রেডি করে, দ্রুতহাতে দুজনের টিফিন গুছিয়ে মা-ছানা একসঙ্গে পা-মিলিয়ে দৌড়-দৌড়-দৌড় থাকে। রবিবার এলে হয়তো ওই দৌড়ের নির্ঘণ্ট খানিক শিথিল হয়। বিছানায় গড়িয়ে আসা এক চিলতে রোদ্দুরের সঙ্গে একটু বেশিক্ষণ খুনসুটি করা যায় সেদিন। সোমবারের আগে নতুন করে অ্যালার্ম সেট করে নিতে হয় আবার।
তবে, ওই যে বললাম— নতুন সপ্তাহ মানে নতুন সম্ভাবনা। এই সপ্তাহে নতুন করে কিছু শিখব, বা ক্লাসে নিজের ভালোলাগার একটা বিষয় পড়াব, না-মেলা অঙ্কটা নিয়ে কোমর বেঁধে লড়ব, সোমবারের শুরুতে সেই আনন্দ মেশানো উত্তেজনা থাকে। ছেলের স্কুলের জলের বোতলে জল ভরতে-ভরতে ভাবি, তারও তো আরম্ভ হল নতুন সপ্তাহ! স্কুলে গিয়ে শিখবে নতুন কত কী, তুলবে নতুন গানের সুর। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে আমিও জড়িয়ে যাব তার সঙ্গে, শৈশবের পাঠগুলো তার পাশে বসে নাহয় নেব আরেকবার। সোমবার আসলে এই সব সম্ভাবনামুকুলের দিন। নিজেকে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতির পালক সকালের হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার দিন।