নম্বর
নীলা একটা পার্কের বেঞ্চিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক বসেছিল। হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পেল, ‘কী ব্যাপার নীলা দেবী? কীসের টেনশান? অফিস?’
নীলা: না। এই সিনেমার পোস্টারের কথা ভাবছিলাম।
মোবাইল ফোনটা নীলাব্জ-র চোখের সামনে ধরে।
নীলাব্জ ওই বেঞ্চিতেই বসেই পড়ে— ‘ওরে বাবা! এ তো ভয়ংকর সিনেমা।’
নীলা: ভয়ংকর কি না আমি জানি না। আমার যেটা অবাক লাগছে যে সিনেমার পোস্টারে নায়কের ফুলে ওঠা মাংসপেশি, অর্ধনগ্ন নায়িকা অনেক দেখেছি কিন্তু এটাতে সেইসব ঢেকে দিয়ে বড়-বড় করে এই বক্স-অফিস সংখ্যাটাই চোখে বেশি পড়ছে।
নীলাব্জ: এক্স্যাক্টলি! তাই জন্যই তো লিখছে! ইট ইজ আগলি অ্যান্ড ইভেন মোর ভালগার।
নীলা: কিন্তু চোখ তো ওটাতেই পড়ছে।
নীলাব্জ: তাই তো পড়ার কথা। জামা পরে দাঁড়ালে কে দেখবে? খুলে দাঁড়ালেই তো চোখ পড়বে!
নীলা: তুমি এই ভাবে ভাবো যে একটা সিনেমা বানিয়েছে প্রযোজক, সে চায় জিনিসটা বিক্রি করতে। সে চায় আরও বেশি নজরে পড়ুক, সবাই দেখুক তার ছবি। সে তো ভালই আইডিয়া বের করেছে মাথা খাটিয়ে।
নীলাব্জ: ঘোড়ার ডিমের আইডিয়া। একজন সাধারণ মানুষের কী যায় আসে এই সংখ্যাগুলো দিয়ে? কী করবে সে জেনে এটা ১০ কোটি না ১০০ কোটি? তার কাছে প্রশ্ন একটাই, ভাল লাগল না খারাপ লাগল, তাই না?
নীলা: তুমি বুঝতে পারছ না। আমি যেরকম ভাবছিলাম এই ছবিটা দেখতে যাব কি না। তারপর পোস্টারে যখন দেখলাম এই সংখ্যাটা, মনে হল এত ব্যবসা যখন করেছে তাহলে নিশ্চয় ভালই হবে।
নীলাব্জ: মুরগি করছে পাবলিককে। একে তো জল মেশানো সব নম্বর। সব মিথ্যে। আগে তাও বিশেষণ ব্যবহার করা হত, হিট-সুপারহিট-ব্লকবাস্টার এইসব। এখন একেবারে কাছা খুলে গেছে। অশ্লীল! আর তুমি বলছ, এই অশ্লীলতার দ্বারা তুমি আকৃষ্ট হচ্ছ?
নীলাভ: আকৃষ্ট বলতে পারো, একটা আগ্রহ তো নিশ্চয় জন্মাচ্ছে।
নীলাব্জ: একটা সিনেমার বাণিজ্যিক একটা মিথ্যে নম্বরে তোমার আগ্রহ জন্মাচ্ছে?
নীলা: মিথ্যে নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন তোমার? পোস্টারে নায়িকার ওই রূপ, সেটা সত্যি? নায়কের গায়ে রক্ত লেগে, ওটা সত্যি? পুরো মিথ্যে একটা বিনোদনের দুনিয়া তাকে বেচার জন্য আর একটা মিথ্যে নম্বর বসিয়ে যদি প্রযোজকের উপকার হয় তাহলে হোক না, তোমার কী?
নীলাব্জ: তুমি বোঝার একটু চেষ্টা করো নীলা। দেখো, সিনেমা একটা শিল্প। বহু শিল্পী মিলে কাজ করে একটা সিনেমা তৈরি হচ্ছে। সেই শিল্পকে মাপবার কোনও সিস্টেম মানুষ বানাতে পারেনি, পারবেও না। কারণ একটা কিছু অনুভূতি এভাবে মাপা সম্ভব নয়। কোনও রকম শিক্ষা যদি তুমি কোথাও থেকে পাও, সেটাকে মাপা যায় না। একটা সিনেমা তোমাকে কবে, কীভাবে স্পর্শ করে যাবে তুমি মাপবে কী দিয়ে? হতেই পারে সুপার ফ্লপ সিনেমা কিন্তু তোমার কোনও কারণে সেটা ভাল লেগেছিল। দুনিয়া তাকে বাতিল করে দিলেও, তুমি কি সেটাকে মূল্যহীন ভাববে? তোমার কাছে তো সেটা ভাল সিনেমা, তাই না?
নীলা: আরে ধুর বাবা, এত জটিল করছ কেন? আমার একটা ভাল দিয়ে প্রযোজকের কী এসে যায়? এই ভাল আর খারাপ তো আপেক্ষিক ব্যাপার। বলেই বা কে দেবে ভাল না খারাপ? সিনেমার রিভিউগুলো তো আর কেউ বিশ্বাস করে না। সেখানে ঘুষ দিয়ে খারাপকে ভাল বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। আর ব্যক্তিগত রাগ থাকলে ভালকেও তুলোধোনা করে ছাড়ে। তাই পাবলিক কেউ আর রিভিউ পড়ে না। এই সংখ্যাটা অনেক বেশি আকর্ষণীয়, ডিটারমিনিস্টিক। এত সিনেমার মধ্যে এটাকে বেছে নিতে আমাকে সাহায্য করছে।
নীলাব্জ: এই তো সমস্যা। সিনেমাকে চাল-ডাল-সাবানের মতো বানিয়ে দিয়েছে ক্যাপিটালিস্ট সমাজ। একটা প্রোডাক্টমাত্র। বিক্রি করতে হবে। আমার ১০ কোটি বিক্রি! আমার ২০০ কোটি বিক্রি! এরপর দু’দিন বাদে মানুষের গায়েও নেট ওয়ার্থ লেখা থাকবে। এই যে বিকাশ মিত্র, তেইশ লক্ষ চার হাজার আর ওই যে প্রীতি চোপড়া, একান্ন কোটি তিরিশ হাজার। ওহ্! তাহলে বিকাশ মিত্র ফালতু লোক আর প্রীতি চোপড়া দারুণ কেউ একটা!
নীলা: আমরা কিন্তু এভাবেই ভেবে ফেলি অনেক সময়ে। প্রোডাক্ট হলে মূল্য থাকবেই। মানুষ যদি নিজেকে প্রোডাক্ট বানিয়ে ফেলে, তাহলে তারও মূল্য থাকবে। তোমারও আছে। তোমার কর্মদক্ষতা বা ক্ষমতার রেট কিন্তু এখনও আছে। হ্যাঁ, সিনেমা একটা প্রোডাক্টমাত্র এই বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির। সে তো বিক্রি হতে চাইবেই।
আমার দুটো অবজেকশান। এক, ভাল-খারাপ-দারুণ বলে দেওয়ার তুমি কে হে? আমাকে বুঝতে দাও না, সেটা। দুই, বেস্টসেলার মানেই যে সেটা উৎকৃষ্ট কিছু তার কোনও মানে নেই। তুমি যে প্রোডাক্ট-প্রোডাক্ট করে লাফাচ্ছিলে এত, এবার তুমি ভেবে দেখো, একটা বেস্ট সেলিং সাবান আর একটা প্রিমিয়াম কোয়ালিটি সাবান, কার বিক্রি বেশি?
নীলাব্জ: নিকুচি করেছে ইন্ডাস্ট্রির। শিল্পের কী হবে?
নীলা: কেন? করে খাচ্ছে তো শিল্পীরা। ইন্ডাস্ট্রি আছে বলেই তো করে খাচ্ছে। মেক-আপ করার এত টাকা, গান গাওয়ার এত টাকা, ক্যামেরা চালানোর এত টাকা।
নীলাব্জ: সে তো আগেও করে খেয়েছে। আগে তো এভাবে বেচতে হত না। আচ্ছা তুমি বলো, তুমি কি জানো ‘শোলে’ কত ব্যবসা করেছে? ‘সোনার কেল্লা’ কত ব্যবসা করেছে? আমার জেনে হবেই-বা কী? এগুলোর আগে পরে যা খুশি একটা সংখ্যা লাগিয়ে দিলেই মান পালটে যাবে?
নীলা: আরে এগুলো তো পুরনো সময়ের ছবি। তখন মার্কেট আলাদা ছিল। এখনের সঙ্গে তুলনা ওভাবে করা যায় না। এটা একটা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিমাত্র। আগে তো লিখত ১০০ দিন চলেছে! সগৌরবে ১০ সপ্তাহ। এগুলো কী?
নীলাব্জ: লক্ষ করো, টাকার কথা কিন্তু লিখছে না। একটা বেসিক সভ্যতা ছিল।
নীলা: ঠিক কথা। কিন্তু এখন লিখছে।
নীলাব্জ: আর সেটা কাজও করছে। এখানেই আমার দুঃখটা। পাবলিক ভাবছে, তুমি ভাবছ এগুলো দারুণ সিনেমা বুঝি।
নীলা: আরে অদ্ভুত কথা! আমার দুটো অবজেকশান। এক, ভাল-খারাপ-দারুণ বলে দেওয়ার তুমি কে হে? আমাকে বুঝতে দাও না, সেটা। দুই, বেস্টসেলার মানেই যে সেটা উৎকৃষ্ট কিছু তার কোনও মানে নেই। তুমি যে প্রোডাক্ট-প্রোডাক্ট করে লাফাচ্ছিলে এত, এবার তুমি ভেবে দেখো, একটা বেস্ট সেলিং সাবান আর একটা প্রিমিয়াম কোয়ালিটি সাবান, কার বিক্রি বেশি? কোন মদ বেশি বিক্রি হয়, সিঙ্গল মল্ট না বাংলা? দর্শনের বই বেশি বিক্রি হবে না পাতি গোয়েন্দা গল্প?
নীলাব্জ: তুমি ঠিকই বলছ কিন্তু একটা পার্সেপশান তৈরি করছে এরা। এই যে, আমাদের এত বিক্রি অর্থাৎ আমাদের জিনিসটা ভাল। এখানেই আমার মূল আপত্তি।
নীলা: প্রথমে শুরু করলে বলে যে তোমার মূল আপত্তি সংখ্যার খেলাতে। এখন বলছ বাজে জিনিসকে ভাল বলে চালিয়ে দেওয়াতে আপত্তি। কিন্তু তুমিও তো জানো যে ব্যবসায়ী সবসময়ে বলবে, আমাদের জিনিসটাই বেস্ট। বার্গার বেচার লোকটা কি জানে না সে বিষ বেচছে? সে কি বাড়িতে ওটা খাচ্ছে? দেখা যাবে সে ব্যাটা ভিগান। কী? করবে প্রতিবাদ? তাহলে তো মরে যাবে প্রতিবাদ করতে-করতে!
নীলাব্জ: তুমি বলছ পাবলিকের ওপর ছেড়ে দিতে। যে যার মতো করে, যা বোঝার বুঝে যাবে।
নীলা: যার মনে হবে ১০০ কোটি মানে ভাল সিনেমা তার মনে হবে। তুমি কী করবে?
নীলাব্জ: আমি এই প্রচারটাই বন্ধ করতে চাই। এইভাবে কিছু গবেট যদি সত্যি ভাবতে শুরু করে যে এটা ভাল, তাহলে তো…
নীলা: কী? সমাজটা গোল্লায় যাবে? চলেই গেছে হয়তো। যাই হোক, আমাকে ওই পোস্টারের সংখ্যাটা সিনেমাটার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি কাল যাচ্ছি দেখতে, যাবে?
নীলাব্জ: অসম্ভব! ওই থার্ড গ্রেড জিনিস আমি দেখতে পারব না। ইট ইজ নট আ ফিল্ম, ইট ইজ আ থিং। একটা জিনিস!
নীলা: বেশ, আমি ওই জিনিসটা কাল দেখতে যাব।
নীলাব্জ: তোমার সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে ফেলতে হবে মনে হচ্ছে আমার।
নীলা হাসতে শুরু করে, তাই? দেখা যাক।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী