‘নানা, তুমি কি সত্যিই উত্তম্যানাইজার?’
একদিন খুশবন্ত সিংকে মুখোমুখি প্রশ্ন করল তাঁর কিশোরী নাতনি। সেখানে উপস্থিত খুশবন্ত সিংয়ের স্ত্রী, ওই কিশোরীর নানি এবং তার মা, অর্থাৎ, খুশবন্তের মেয়ে।
একথাটা আছে খুশবন্তের আত্মজীবনী, ‘সেক্স, স্কচ অ্যান্ড স্কলারশিপ’-এ। আর কোনও ভারতীয়র কথা আমি ভাবতে পারি না, যিনি তাঁর আত্মজীবনীর এই নাম রাখতে পারেন। এবং আর কোনও ভারতীয়কেও ভাবতে পারি না, যিনি তাঁর ‘মেন অ্যান্ড উইমেন ইন মাই লাইফ’ গ্রন্থে কলম হাঁকড়ে লিখতে পারেন, নারীর নিতম্বে চিমটি কাটতে বেশ লাগে আমার। অর্থাৎ, খুশবন্ত শুধু উওম্যানাইজারই নন, তিনি ‘বটম পিনচার’।
আরও পড়ুন : দিলীপকুমার রায়কে কতটা চেনে বাঙালি? লিখছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়…
খুশবন্তের নাতনির মোক্ষম প্রশ্নে ফিরে যাই: দাদু, তুমি কি মেয়েবাজ? কী দুর্ধর্ষ শুরু, সেলিব্রেটেড দাদামশাইয়ের আত্মজীবনী ও স্বীকারোক্তির! খুশবন্ত এক অবাক করা, আকস্মিক, সৎ ও সাহসী ভারতীয় লেখক, যিনি তাঁর রামধনু জীবনের প্রধান রং হিসেবে মেলে দিয়েছেন স্কচ, সঙ্গমসুখ, এবং লেখাপড়াকে। এ তো প্রায় ভারতের পৌরাণিক জীবন। ঋষি-জীবনও বলা যায়! প্রাচীন ভারতের ঋষিরা তাদের পবিত্র অভয়-অরণ্যের অমল সাধনভূমিতে তো মগ্ন থাকতেন, সংসারের প্রাত্যহিক ঝামেলার বাইরে, সঙ্গম, সুরা, অধ্যয়নের নিবিড় নিভৃতে! বিপুল ধনী ব্যবসায়ী শোভা সিংয়ের পুত্র খুশবন্ত প্রথমে হলেন বিলেতফেরত ব্যারিস্টার। তারপর ঝলমলে ডিপ্লোম্যাট। তারপর ক্লান্তিহীন রঙের জীবনে, ভারতের পৌরাণিক দীক্ষায়, প্রবিষ্ট হলেন তিনি, ত্রিমুখী সাধনায়: সঙ্গম, সুরা ও সরস্বতী। এর চেয়ে কাম্য কম্বিনেশন আর কী-ই বা হতে পারে?
যাই হোক, এহেন খুশবন্ত স্বীকার করেছেন তাঁর বর্ণিল আত্মজীবনী, ‘সেক্স, স্কচ অ্যান্ড স্কলারশিপ’ গ্রন্থে, যে, তাঁর নাতনি যখন তার দিদিমা ও মা-র সামনে একদিন প্রশ্ন করল, ‘নানা, তুমি কি মেয়েবাজ?’, তিনিও উত্তর দিতে আমতা-আমতা করেছেন। তারপর তাঁর বর্ণময় সংলাপি ‘মাঞ্জা’ উড়িয়ে বলেছেন, তুমি দেখতে পাও না, আমার চারপাশে কত রঙের ফুল ফুটিয়ে তরুণীরা ভিড় করে আসে। তখন বুঝতে হবে তো তোমাকে, আমি ঠিক কী! উত্তরে খুশবন্তের নাতনি বলে, ‘নানা, ওটা আলাদা ব্যাপার। আর উত্তম্যানাইজিং আলাদা।’ খুশবন্ত ঢোক গেলেন। সত্যি তো! কোথায় অব্যর্থ পাছায় চিমটি, আর কোথায় তাঁর চারপাশে তরুণীদের বাঁধভাঙা চাঁদের হাসি।
খুশবন্ত কিছুটা বিস্মিত। তাঁর নাতনি এত বড় হয়ে গেছে! বুঝতে পারে মেয়েবাজি, আর মেয়েদের সঙ্গে রম্য ফষ্টিনষ্টি করে তাদের ড্রয়িংরুম-আনন্দদানের তফাত! বাহ্, বলে ওঠে খুশবন্তের আধুনিক, নারীচর্চিত মন। তিনি তাকান তাঁর স্ত্রীর মুখের দিকে। প্রৌঢ় স্ত্রী-র মুখ সেই একইরকম মেঘলা। কোনওদিন সেই মেঘলা মুখের থমথমে মেজাজে দেখা দিল না খুশবন্তের জীবনে নারী-প্রবাহের প্রতি প্রসন্নতা। এবার খুশবন্ত তাকান তাঁর কন্যার মুখপানে। যে কন্যার কন্যার মুখ থেকে ছুটে এল এই লক্ষ্যভেদী প্রশ্নবাণ: নানা, আর ইউ আ উওম্যানাইজার?
খুশবন্ত কিন্তু দেখলেন, তাঁর কন্যার মুখে মরুভূমির আকাশে চাঁদের মতো হাসি।
আহা! বলে ওঠে খুশবন্তের নিঃসঙ্গ মন। তিনি স্কচের গ্লাসে চুমক দেন। সিঙ্গল মল্ট স্কচ। ট্যালিস্কার। ট্যালিস্কার এইট্টিন। আঠারো বছরের পুরনো ট্যালিস্কার। পৃথিবীতে এর থেকে মার্জিত মদ আর নেই। নিশ্চিত খুশবন্ত।
একটি প্রাচীন ইংরেজি কবিতা হঠাৎ সান্ধ্য-পাখির মতো ডানা মেলে খুশবন্তের মনের আকাশে:
I strove with none, for none was worth my strife:
Nature I loved, and, next to Nature, Art:
I warm’d both hands before the fire of Life;
It sinks; and I am ready to depart.
ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডর-এর লেখা, কী সহজ সত্য কথা! খুশবন্তের বর্ণময় জীবনের একেবারে অন্তর-উচ্চারণ: কারও সঙ্গে কলহ করিনি আমি। কারণ, কাউকে মনে করিনি যুদ্ধের যোগ্য। ভালবেসেছিলাম প্রকৃতিকে। এবং প্রকৃতির পরেই শিল্পকে। আমি জীবনের আগুনে দু-হাত সেঁকে নিয়েছিলাম। আগুন ক্রমশ নিভছে। আমিও বিদায়ের জন্য প্রস্তুত।
যেদিন তাঁর দিল্লির বাড়িতে খুশবন্তের সঙ্গে স্কচ পানের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, সেদিন তাঁর মুখে শুনেছিলাম ল্যান্ডরের এই চার পঙক্তির কবিতা। কী মধুর কারুণ্যে, অথচ আভিজাত্যের অহংকারে চারটি লাইন আবৃত্তি করেছিলেন খুশবন্ত। তখন তিনি ‘নিউ দিল্লি’ পত্রিকার সম্পাদক। আর সেই পত্রিকায় সবে ছাপা হয়েছিল, জেমস বন্ডের সেক্স লাইক নিয়ে আমার লেখা। ভুলতে পারিনি সেই রঙিন সন্ধে, খুশবন্তের সোনালি সংলাপ, আর তাঁর পাশে বসে থাকা সেই ডাগর আঁখির কাঞ্চনকন্যাকে। সেই মেয়েই কি কত নামে বারবার চলকে উঠেছে খুশবন্তের দুর্বার উপন্যাস ‘দ্য কোম্পানি অফ উইমেন’-এর পাতায় পাতায়? অমন ভারতীয় উপন্যাস খুব বেশি পড়েছি কি জীবনে, যার বিষয় নারী-শোষণ?
খুশবন্তের আত্মজীবনীর সততা কাঁপিয়ে দেয়। এবং আদায় করে নেয় ভালবাসা। তাঁর ‘সেক্স, স্কচ অ্যান্ড স্কলারশিপ’ নামের আত্মজীবনীতে তিনি অকপটে জানাচ্ছেন, তাঁর অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট যাচ্ছেতাই! সুতরাং, তাঁর পক্ষে স্কলারশিপ পেয়ে অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে পড়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু তবু তিনি ইংল্যান্ড-আমেরিকায় লেখাপড়া করেছেন। ব্যারিস্টার হয়েছেন। আপাতভাবে, সেটা সম্ভব হয়েছে, তাঁর বাবা শোভা সিং দুর্ধর্ষ ধনী বলে।
কিন্তু এই লাবণ্যময় নম্রতার সবটুকু সত্যি নয়। আমাদের খোলা ছাড়াতে হবেই। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে খুশবন্তের আসল লেখাপড়া বা স্কলারশিপের অন্তরশাঁস। খুশবন্ত সিংয়ের লেখা পড়লেই বোঝা যায়, তাঁর অধ্যয়নের প্রসার, তাঁর অভিনিবেশের নিবিড়তা এবং তাঁর সাহিত্য এবং দর্শন এবং ইতিহাস-চর্চার অপরিমেয় ভাণ্ডার।
এই প্রসঙ্গে লর্ড বায়রনের একটি উক্তি আমার মনে পড়ছে, ‘শেলি ইজ আ ফুল, হি রিডস টু বিকাম আ স্কলার। আই রিড টু ড্যাজেল উইমেন।’ শেলি বোকা। সে ক্রমাগত পড়ছে পণ্ডিত হওয়ার জন্য। আমি পড়ি, নারীকে ঝলসে দিতে। এই কথাটা হয়তো খুশবন্ত সম্পর্কেও বলা যায়। এত বিষয়ে এমন তৎপর লেখাপড়া ছিল খুশবন্তের, যা আলোকিত করে আছে তাঁর সমস্ত লেখা, এবং বিদ্যুতের মতো চমকে উঠত খুশবন্তের সঙ্গে যে-কোনও আড্ডায়। তাঁর নারী-আকর্ষণের, বলা যায় তাঁর সেক্স-অ্যাপিলের বড় কারণই ছিল, খুশবন্তের বৈদুষ্য। সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো তাঁর স্মার্ট ভাবনা, তাঁর সহজ ইংরেজির অননুকরণীয় ঝলক। কিন্তু নারীকে সবথেকে সহজে উপড়ে ফেলত, তাঁর রঞ্জিত রসবোধ এবং তাঁর শ্লীলে-অশ্লীলে মিশ্রিত ককটেল-জোকস। খুশবন্ত-র সংগৃহীত হাস্যরসের বই কিনতে পাওয়া যায়। পড়ে দেখবেন, যদি এখনও না পড়ে থাকেন। আদিরসের এমন ‘সংস্কৃত’ ব্যবহার! আহা! কত বন্ধুনিকে যে ভালবেসে উপহার দিয়েছি এইসব অশ্লীল সরস্বতী! এবং কাঙ্ক্ষিত টোল ফেলেছি ভাবনায় তাদের ইচ্ছুক ভাবনায়।
এবার আসি খুশবন্তের ‘মেয়েবাজি’-তে। কী বর্ণময় সেই মেয়েবাজি! এবং আত্মজীবনীতে কী সৎ সাহসের প্রকাশ সেই শরীরী যাপনের বিস্তার ও বর্ণনায়! উত্তম্যানাইজিং কোন পর্যায়ে যেতে পারে, এবং কী সাহস লাগে তাকে আত্মজীবনীতে স্থান দিতে! সেক্সের এই সেলিব্রেশন, যৌনতার এই উৎসব, সঙ্গমের এই চূড়ান্ত মোচন, শিশ্নের এই প্রবল প্রতাপ, নারীর শীৎকারের এই তৃপ্ত বার্তা– এসব ভারতীয় আত্মজীবনীতে বরফের তলায় ঘুমিয়ে আছে। ভি. এস. নাইপলের আত্মজীবনী ‘হাফ আ লাইফ’-এ বেশ্যাবাড়িতে নাইপলের অভিজ্ঞতার কথা আছে। কিন্তু কী ক্লান্ত, ধূসর, বিষণ্ণ, মরবিড সেক্স! কোথাও নেই খুশবন্তের এই তাড়িত, পাপবোধহীন, দুরন্ত আবেগ ও স্পর্ধারোহণ, এবং প্রান্তিক তরল বিস্ফোরণ ও তারল্য। সেই সাহসী বর্ণনা আছে তাঁর লেখায়, যাঁরা পড়তে ইচ্ছুক, পড়তে পারেন। ভারতীয় আত্মজীবনী কতটা সৎ হতে পারে, তা দেখতে পাবেন।
খুশবন্ত যেমন অকপট তাঁর যৌনজীবন নিয়ে, তেমনই খোলামেলা তাঁর দাম্পত্য জীবন নিয়ে। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আনন্দ-হতাশা সব তাঁর লেখায় কুণ্ঠহীনভাবে তুলে ধরেছেন। আড়াল রাখেননি কোথাও।
খুশবন্তের জীবনে রং। এবং তাঁর লেখাতেও রং। একটা সহজ জ্যান্তভাব উথলে উঠছে তাঁর প্রাত্যহিক জীবনে, তাঁর সহজ লেখায়। আর সব রং পেরিয়ে সন্ধে হলেই তিনি ফিরে ফিরে আসেন তাঁর স্কচে। তাঁর পান করার সময় ৪৫ মিনিট। এবং ৪৫ মিনিটে তিনটে লার্জ স্কচ। এই হল তাঁর ‘কোটা’। জল মেশান না। ‘নিট’ স্কচ। এবং মাতাল হন না কখনও। শুধু তাঁর সংলাপ হয়ে ওঠে রেনবো। তাঁর বৈদগ্ধ্য হয়ে ওঠে বহ্নিমান। তাঁর অশ্লীলতা, তো রূপকথা। লিখছেন খুশবন্ত: ‘Come evening and I look forward to my Scotch. After all that exercise and frugal meals, I feel it warming its way down my entrails. And I usually have quite a mehfil to drink with me. My quota: three large Scotches.’ ঈর্ষা করার মতো অভিলাষ। দীক্ষা নেওয়ার মতো সংযম!
এই লেখার একেবারে শেষে জানাচ্ছি, খুশবন্তের জীবনে সবচেয়ে দুঃখের ঘটনাটি। তা হল, তাঁর দাম্পত্য-জীবনের নিঃস্বতা। তিনি নিজে জানাচ্ছেন, তাঁর ‘Absolute Khusbant’ বইতে— তাঁর স্ত্রী অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে ছিলেন একটানা বিশ বছর। খুশবন্ত লিখছেন, This was something that affected me deeply, snapping something inside me. Emotionally, I felt totally bankrupt.
খুশবন্তের আবেগহীন প্রকাশে ক’জন ভারতীয় বলতে পারবে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের আর্তিময় পাতালকথা?