আমার ক্যাসিনো গুরু
নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা উপলক্ষ্যে ২০১০ সালে আমার প্রথম আমেরিকায় যাওয়া। আর যাঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম, চোদ্দোদিন তাঁর সঙ্গলাভ আমার কাছে অন্যরকম স্মৃতি তৈরি করে। সমরেশ মজুমদার। বিশ্বজিৎ সাহার আতিথেয়তায় তাঁর বাড়িতে সমরেশ জেঠু, প্রবীর মজুমদার, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় আর আমার কাকু সুভাষ চন্দ্র দে ও আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। নিউ ইয়র্ক বইমেলা ছিল তিনদিনের। বইমেলার পরে এখানে-ওখানে ঘুরতে-ঘুরতে পৌঁছে যেতাম নানান জায়গায়। আড্ডায়-গল্পে সময় চলে যেত। সমরেশ জেঠুর একের পর এক মজার গল্প, তার সঙ্গে নানান স্মৃতি শুনতে-শুনতে তিন প্রহর। সমরেশ জেঠু-সহ বাকি কাকুদের রঙিন পানীয়র সঙ্গে চাট তৈরির দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। অল্পদিনের রাঁধুনি হয়ে ছিলাম।
সেই বছর NABC হয়েছিল আটলান্টা সিটিতে। বাংলা বই নিয়ে সবাই মিলে পৌঁছে গিয়েছিলাম আটলান্টায়। নিউ ইয়র্ক থেকে বারো ঘণ্টার বাস ভ্রমণ। বাসের টিকিটের সঙ্গে দশ ডলারের ক্যাসিনো খেলার পাস ফ্রি-তে দিয়েছিল। ২০১০ সালের আগে কখনো ক্যাসিনোয় খেলতে যাইনি। ক্যাসিনোর নাম শুনেছি, জুয়া খেলা হয় বলে জানতাম। সেই প্রথম আটলান্টা সিটিতে সমরেশ জেঠু আমায় ক্যাসিনো নিয়ে গেলেন।
নীল সমুদ্রপাড়ে বিরাট-বিরাট বাড়ি। বড়-বড় গ্লোসাইন, তাতে লেখা ক্যাসিনো। একের পর এক রংবেরঙের ক্যাসিনোবাড়ি। সমরেশ জেঠুর সঙ্গে ৩৪ বছরের অপু ক্যাসিনো খেলতে যাচ্ছে। আজকে সেই সময়টা ভাবতে চোখের সামনে সেই মুহূর্তের ছবিটা যেন দেখতে পেলাম। নানান টেবিল, নানান খেলা। কত মানুষ ঘিরে রয়েছেন সেইসব খেলাগুলোকে। একটা ঘুরন্ত নম্বর, তার মধ্যে একটা ছোট্ট বল লাফাতে থাকে। পাশে কত ছক। সেই ছকে রঙিন গোল-গোল চাকতি। এগুলোই নাকি টাকা।
আমায় সমরেশ জেঠু আরও ভেতরে নিয়ে গেলেন। অনেকগুলো সার-সার মেশিন বসানো। সেই মেশিনের পর্দায় রঙিন-রঙিন ছবি ফুটে উঠছে। রঙিন-রঙিন মানুষ সেই মেশিনের সামনে বসে একটা সুইচ টিপে চলেছে। সমরেশ জেঠু আমায় একটা মেশিনের সামনে বসিয়ে কেমন করে খেলতে হবে আর টাকার অঙ্ক বাড়ছে না কি কমছে এবং তা কীভাবে দেখতে হবে সব বোঝালেন। আমার গবেট মাথা কিছু বুঝল, বেশিটাই বুঝল না।
আমায় বসিয়ে সমরেশ জেঠু একটু দূরে আর একটা মেশিনের সামনে গিয়ে বসলেন। রঙিন জলের গ্লাস নিয়ে এক মনে খেলতে শুরু করলেন। আমিও খেলছি, কিন্তু কী খেলছি আর সেই খেলায় কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। এটুকুই বুঝতে পারছি, টাকার অঙ্ক দশ থেকে বাড়ছে। একটা সময়ে সেই পাওয়া দশ ডলার বাড়তে-বাড়তে ৪২ ডলারে চলে গিয়েছিল। খেলার সময়ে মাঝে মাঝেই ‘জ্যাকপট’ লেখা ভেসে আসছিল স্ক্রিনে।
সত্যি বলতে কী, আমার এই খেলায় একটুও মন ছিল না। খেলার থেকেও এই পরিবেশ, এবং এই সকল মানুষদের দেখার আগ্রহ ছিল বেশি। ৪২ ডলার থেকে একটু-একটু করে কমতে-কমতে যখন ২৮ ডলারে এসে গেছে, তারপরে আর খেলিনি। মেশিন থেকে একটা এন্ড স্লিপ বের করে টাকা তোলার মেশিনে গিয়ে ওই কাগজ ঢুকিয়ে ২৮ ডলার পেয়ে গেলাম। সমরেশ জেঠু একটু-একটু চুমুকে তখনও খেলতে ব্যস্ত। সমরেশ জেঠুর দুটো সিট পরে এক শীর্ণ মেমকে দেখছি খেলতে। সাদা চুল, স্যুট-প্যান্ট পরে এক মনে খেলছেন। খেলতে-খেলতে হারছেন। আর যেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন, ক্যাসিনো মেশিনে চকচকে একটা একশো ডলারের নোট প্রবেশদ্বারে ধরছেন। মেশিনটাও অবলীলায় গিলে ফেলতেই, সেই সুন্দরী ছিপছিপে মেম আবার খেলতে শুরু করেন।
আশেপাশে কে কী করছে, কোনোদিকেই ভ্রূক্ষেপ নেই। এক মনে পানীয়তে চুমুক আর ক্যাসিনো মেশিনের পর্দায় চোখ।
‘জেঠু আমি একটু ঘুরে আসি। আপনি খেলুন।’
‘হ্যাঁ। যা ঘুরে আয়।’
ক্যাসিনো থেকে বেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে চলে যাই সমুদ্রপাড়ে। সমুদ্রে স্নান করে মায়ের কাছে ফিরে আসছে ছোট্ট জলপরি। দূরে বালির ওপর রাখা নৌকোর সামনে প্রেম করছে যুবক-যুবতী। ইতিউতি ঘুরতে-ঘুরতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। ফিরে আসি সেই ক্যাসিনোর ঘরে। সমরেশ জেঠু তখনও খেলে চলেছেন। ক্যাসিনোর এই ঘরে যত মানুষ খেলছেন, তাঁদের বয়েস পঞ্চাশের ওপরে; তার নীচে একমাত্র জুয়াড়ি ছিলাম আমি। যার হাতেখড়ি হল সমরেশ মজুমদারের কাছে। ক্যাসিনো গুরুকে নিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসি। গুরুর মুখে চওড়া হাসি।