‘ক্যালকাটা’-র লোক

An Obituary of Pritish Nandy, the veteran poet, journalist, producer and ad-hoc, by Anjan Dutta

আমার প্রথমেই যেটা মনে হয় প্রীতীশ নন্দীর (Pritish Nandy) ক্ষেত্রে, তিনি অসম্ভব ভাল কবি ছিলেন। আমরা যখন বড় হচ্ছি, তখন ওই কবিতাগুলো লিখেছিলেন। ইংরেজি ভাষার ভারতীয় কবিদের অন্যতম ছিলেন। দীর্ঘদিন ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’-র সম্পাদক ছিলেন, ওখানে ওঁর কাজের দিকে আমরা সবসময় নজর রাখতাম। ইংরেজি ভাষায় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও খুব জরুরি লোক ছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের সমালোচনা যে-সময় সচরাচর কেউ করত না, সেই সময় ‘ঘরে বাইরে’-র কড়া সমালোচনা লিখতে কিন্তু দ্বিধা করেননি প্রীতীশ নন্দী।

তারপর তো প্রযোজনার জগতে এলেন। প্রযোজক হিসেবে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং যে কাজটা করেছিলেন প্রীতীশ নন্দী, অনেক নতুন ও অন্যধারার পরিচালককে লাইমলাইটে নিয়ে আসা। যেমন সুজয় ঘোষকে দিয়ে করালেন ‘ঝংকার বিটস’। সেই ছবি না হলে সায়ন মুন্সির মতো একজন অভিনেতাকেও হয়তো আমরা চিনতাম না। তবে যেটা ওঁর প্রযোজনার মধ্যেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সুধীর মিশ্রকে প্রায় ফিরিয়ে আনলেন যে-ছবিটার সূত্রে— ‘হাজারো খোয়াইশহি অ্যায়সি’— যা কিনা আধুনিক ভারতীয় ছবির ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে।

‘হাজারো খোয়াইশহি অ্যায়সি’-র পোস্টার

ব্যক্তিগত স্তরে অনেকটা সময় কাটিয়েছি আমরা। ‘বো ব্যারাকস ফরএভার’ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর, ছবিটা দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে উনি কিনে নিলেন, এবং প্রোমোট করলেন ছবিটাকে। খুব পছন্দ করেছিলেন ছবিটা। এমনকী, ‘ম্যাডলি বাঙালি’-কেও জাতীয় স্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই ছবির প্রযোজক তখন আগ্রহ দেখাননি অতটা, তাই সেটা সম্ভব হয়নি।

প্রীতিশ নন্দী ছিলেন কড়া সমালোচকও

আমার সঙ্গে বিভিন্ন ছবির পরিকল্পনা হয়েছিল প্রীতীশ নন্দীর। যেমন, ‘মেরা নাম জুলিয়েট’ বলে একটা ছবি আমরা করতে চেয়েছিলাম। ছবির চিত্রনাট্যও তৈরি হচ্ছিল। আমার স্কুল, দার্জিলিংয়ের সেন্ট পলস, সেখানকার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে ছিল সেই গল্পটা। ছবির চিত্রনাট্য আর মিউজিক নিয়ে কথা বলতে নিয়মিত মুম্বই যাতায়াত করেছিলাম তখন, উনিই পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। চিত্রনাট্যটা খুব পছন্দও হয়েছিল। ইংরেজি ভাষার ছবি হত সেটা হলে। মুম্বই তোলপাড় করে অভিনেতা খুঁজেছিলাম আমরা। আমরা দিনরাত ভেবেছি, সুস্মিতা সেন বা মণীষা কৈরালা, নাসিরুদ্দিন শাহ-র ছেলে ইমাদ শাহ ভাল হবে না রণবীর কাপুর— কে কোন চরিত্র করতে পারবে। শেষমেশ কাস্টিং ঠিকঠাক হল না বলে ছবিটাও হল না। আজ কোনও প্রযোজক এগিয়ে এলেও ছবিটা করতে দ্বিধাই হবে। কারণ অতগুলো পয়সা খরচ হয়েছিল প্রীতীশদার, তারপরেও ছবিটা হল না।

‘ঝংকার বিটস’-এর পোস্টার

‘বো ব্যারাক…’ নিয়ে ভীষণ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে পাঠিয়েছিলেন। ওঁর উদ্যোগ ছিল বলেই কিন্তু ছবিটা জাতীয় স্তরে এই পরিচিতি পেয়েছিল। যেভাবে প্রচার করেছিলেন ‘বো ব্যারাক…’-এর, সেটা ছিল অভিনব। ছবি দেখিয়ে বিভিন্ন স্টারকে দিয়ে বলানো নিয়ে ওঁর আগ্রহ ছিল না। বরং আমি, অমিত দত্ত, লুই হিল্ট, নন্দন বাগচী— আমাদের সবাইকে নিয়েই একটা ব্যান্ড তৈরি করালেন, এবং আমরা ঘুরে বেড়ালাম সারা ভারত। খাবার, গানবাজনা দিয়ে একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মিলিউ তৈরি করালেন। পুনে, বেঙ্গালুরু, মুম্বইয়ের জ্যাজ বাই দ্য বে হয়ে শেষ হল সেই সফর, কলকাতার সামপ্লেস এলস-এ এসে। এতটাই ভাল বুঝতেন উনি, এই অ্যাংলো জীবনের পালসটা, যে ট্রেলার, ব্রোশিওর ইত্যাদি নিয়ে আমি ভাবিওনি। প্রীতীশবাবু, ওঁর মেয়ে রঙ্গীতা যে ঠিক ওগুলো সামলে নেবে, সেটা জানতাম। এবং যে ধরনের শো-কেসিং করলেন ছবিটা নিয়ে, সেটা অনবদ্য! প্রযোজক হিসেবে ওঁর মুনশিয়ানাটা বোঝাতে এই গল্পটা বলা খুবই দরকারি।

‘বো ব্যারাকস ফরএভার’-এর প্রচারকৌশল ছিল অভিনব

আমার সঙ্গে মিশতেন, আমার গানবাজনা, সিনেমা, জীবনের সূত্র ধরেই, আর পাঁচজন প্রযোজক আর পরিচালকের সম্পর্কের মতো সেটা ছিল না। খুব মজার, মজলিশি লোক ছিল। কলকাতায় এলেই যোগাযোগ হত। মুম্বইতে গেলে কোলাবা বা পুরনো বম্বেতে আমরা খেতে যেতাম, মনে পড়ে। উনি আমাকে বলতেন, কোলাবা-ই তোমার জায়গা। ওটাই আসল বম্বে।

‘বো ব্যারাক…’ নিয়ে ভীষণ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে পাঠিয়েছিলেন। ওঁর উদ্যোগ ছিল বলেই কিন্তু ছবিটা জাতীয় স্তরে এই পরিচিতি পেয়েছিল। যেভাবে প্রচার করেছিলেন ‘বো ব্যারাক…’-এর, সেটা ছিল অভিনব। ছবি দেখিয়ে বিভিন্ন স্টারকে দিয়ে বলানো নিয়ে ওঁর আগ্রহ ছিল না। বরং আমি, অমিত দত্ত, লুই হিল্ট, নন্দন বাগচী— আমাদের সবাইকে নিয়েই একটা ব্যান্ড তৈরি করালেন, এবং আমরা ঘুরে বেড়ালাম সারা ভারত।

একটা কথা বলতেই হবে, প্রীতীশ নন্দী ভালবাসতেন ‘ক্যালকাটা’-কে, কলকাতাকে কতটা ভালবাসতেন, বলা মুশকিল। ক্যালকাটা-ই সেই কসমোপলিটান শহর, যেখানে প্রীতীশ নন্দীর মতো একজন ক্রিটিকাল সাংবাদিক থাকতে পারেন, এই শহরে বসেই তিনি ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখতে পারেন, আবার এই শহর থেকেই মুম্বই চলে গিয়ে একেবারে অন্যধারার হিন্দি ছবি প্রযোজনা করতে পারেন। এই যাপনটা আসে ওই ‘ক্যালকাটা’ থেকেই, মুম্বই থেকে নয় কিন্তু। যেখানে বিহারি আছে, মাড়োয়ারি আছে, মারপিট আছে, ঝামেলা আছে, সেই ক্যালকাটার একটা মাধুর্য আছে। সেখানে বাঙালিয়ানাকে ছাড়িয়ে বাঙালি আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। প্রীতীশ নন্দী ক্যালকাটার লোক ছিলেন, ক্যালকাটার লোক আস্তে-আস্তে কমে যাচ্ছে। আমরা তাদের ততটাও বুঝে উঠতে পারলাম না বোধহয়।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)