দাদাগিরির তীর্থে, খুনির খপ্পরে
বাকিংহামের বারান্দায়/রাণীর ছেলের কাঁথা শুকায়’, অমিতাভ চৌধুরীর সেই বিখ্যাত ছড়া মনে পড়ে গেল!
রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে। কালো-সোনালি বিশাল গেটের ওপারে রানি এলিজাবেথ, প্রিন্স চার্লস আর নববধূ ক্যামিলার সংসার। আরও একজন না-থেকেও ভীষণভাবে রয়েছেন, বলা ভাল, এই প্রাসাদকে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর অদৃশ্য ছায়া, যুবরানি ডায়না। ২০০৭ সাল মানে, ডায়নার মৃত্যুর দশ বছর পরও দেখলাম, শয়ে শয়ে মানুষ আসেন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে, হাতে ফুলের বোকে, মোমবাতি, কার্ড নিয়ে, ডায়নার নামে রেখে যান রাজপ্রাসাদের সিংদরোজায়। নিয়ম ভাঙার জেদে যেদিন ট্র্যাকস্যুট পরে বাকিংহামের সামনের রাস্তায় জগিং করেছিলেন ডায়না, সেদিন যেমন, আজও তেমনই ওই নামটা কানে গেলেই বুকের রক্ত চলকে ওঠে আমজনতার।
এত বছর পর, যখন ২০২৪-এর এপ্রিলে আবার দাঁড়ালাম রাজপ্রাসাদের গেটে, বুঝলাম এতটুকু ফিকে হয়নি ডায়না-ম্যানিয়া। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন, ক্যামিলা (‘কুইন’ কথাটা কিন্তু বলল না কেউ) আসছেন। সত্যি, রানি ক্যামিলা লং কোট আর টুপি পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটে পার্ক করে রাখা অডি গাড়িতে উঠলেন। তারপর একটিমাত্র পাইলট কার সামনে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। দীর্ঘশ্বাস সহকারে মন্তব্য ভেসে এল, ‘ডায়না ইজ ডায়না, এমন চেঁচামেচি হত যে প্রিন্সেস এদিকে তাকাতেন, হাতও নাড়তেন।’
আরও পড়ুন : লন্ডনের মানুষ বিষণ্ণ হয়ে থাকে বছরভর মেঘলা আকাশ আর টিপটিপে বৃষ্টিতে…
যদিও কথাটা সত্যি, তবু যিনি বললেন, সেই ভারতীয় তরুণটি কিন্তু ডায়না জমানার অনেক পরে জন্মেছেন। তাঁর পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন।
জানুয়ারির হালকা তুষারপাতে লন্ডনের রাজপথ সবসময়ই ভেজা, পিছল। সাবধানে হাঁটতে হয়, তাড়াহুড়ো করলেই পা পিছলে আলুর দম। আমরা না-হয় ঘুরতেই এসেছি, কিন্তু এই হাড়কাঁপানো শীতে, যখন-তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টির উৎপাত মাথায় নিয়ে কেন অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বাইরে বেরিয়েছেন— বুঝলাম না। রোজই দেখছি এই দৃশ্য নানা জায়গায়। কেউ লাঠি হাতে হাঁটছেন, মাঝে ফুটপাথে বেঞ্চে বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন। কারও হাতে ধরা পোষা কুকুরের চেন। এমনকী, পাকা আপেলের মতো গোলগাল, সাদা রেশমি চুল, লাল টুকটুকে এক মেমকে দেখলাম প্ল্যাম ঠেলে নিয়ে চলেছেন কয়েক মাসের বাচ্চাকে। নাতি বা নাতনি হবে নিশ্চয়ই। ছিঁচকাঁদুনে দুপুরবেলা এমনই এক একলা মানুষের পাশে বসেছিলাম বেঞ্চে। বিদেশে পথেঘাটে, টিউবে, দোকানে চোখাচোখি হলে এমনিতেই সৌজন্যের হাসি দেয় মানুষ, কখনও উইশও করে। তাই খুব একটা ইতস্তত না করে আলাপ জমালাম। কাছেই বাড়ি। কয়েকটা কথার পর কৌতূহল সামলাতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, ‘এই আবহাওয়ায় আপনি বাড়ির বাইরে ঘুরছেন কেন?’ জবাব পেলাম, ‘সবাই তো সকালে কাজে বেরয়। হিটিং সিস্টেম সারাদিন আমার একার জন্য চালানোটা খুব এক্সপেনসিভ হয়ে যায়। আবার বন্ধ বাড়িতে বেশিক্ষণ একটানা থাকা যায় না। তাই খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে বেরিয়ে পড়ি মাঝে মাঝে, একটু বসি কোথাও। বাই সিক্স, দে উইল বি ব্যাক।’ নচিকেতা জানলে নিশ্চয়ই বৃদ্ধাবাসের সিক্যুয়েল লিখে ফেলতেন!
প্রথমেই স্বীকার করে নিয়েছি, স্পোর্টস আর আমার সম্পর্ক আদা আর কাঁচকলার। ছেলেবেলায় গাবলুগুবলু থাকার কারণে সেই যে স্কুলে খেলার পিরিয়ড এলেই আড়ষ্ট হওয়া শুরু, তারপর আর পাল্টাল না, চারপাশে ফুটবল-ক্রিকেট নিয়ে এমন উন্মাদনা সত্ত্বেও। সে আর কী করা যাবে! আপাতত লর্ডস যাত্রার আগে বুক ধুকপুক। প্রতিবার লেন্স খুলতে খুলতেই আমার দিকে তাকাচ্ছে পেশাদার ক্যামেরাম্যান, কী শট নেবে। অন্য জায়গায় সমস্যা নেই, কিন্তু লর্ডস বলে কথা, এমন ভুবনবিখ্যাত স্টেডিয়ামের আমি কতটুকু জানি! আর সঙ্গী তারকা ক্রীড়া সাংবাদিকের মেজাজ বেশিরভাগ সময় বেশ চড়া। উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করলে গালাগালি খেতে হবে।
যাই হোক, দীর্ঘদিন রিপোর্টিং করার দৌলতে কিছুটা তো কনফিডেন্স আছে, যাকে বলে স্ট্রিট স্মার্ট! সেই ভরসাতেই চলেছি। টিকিট কেটে ঘণ্টাদেড়েকের গাইডেড ট্যুর হয়। লং রুম, প্লেয়ার্স ড্রেসিং রুম, মিটিং হল, এমসিসি মিউজিয়াম— সব দেখায়। বিশ্বের প্রাচীনতম স্পোর্টস মিউজিয়াম এই মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব মিউজিয়াম। সত্যি দেখার মতো, ক্রিকেটের ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই খেলার জন্ম থেকে টি-টুয়েন্টি, আইপিএল পর্যন্ত সবটা। কিন্তু আমার পাখির চোখ সেই ব্যালকনি— যেখানে ২০০২ সালের ১৩ জুলাই জার্সি খুলে উড়িয়েছিলেন বাংলার দাদা, সৌরভ গাঙ্গুলি। ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ ফাইনালে দুই উইকেটের সেই ঐতিহাসিক জয় ক্রিকেট-দুনিয়ায় মাইলস্টোন হয়ে রয়ে গেল ওই দাদাগিরির জন্য। এমনিতে কিন্তু এই ‘তীর্থক্ষেত্র’-তে রীতিমতো ড্রেস কোড আছে। ধর্মস্থানের মতো। ছেঁড়াফাটা— যাকে ফ্যাশন পরিভাষায় ‘রিপড’ বলে, সেরকম কিছু বা হাওয়াই চপ্পলজাতীয় জুতো পরে ঢোকা যাবে না। আর স্বল্পবাস তো একেবারে নিষিদ্ধ। অবশ্য লন্ডনের ঠান্ডায় খোলা জায়গায় নিউমোনিয়ার ঝুঁকি নিয়ে কে-ই বা স্বল্পবসনা হবে, সেটাও ভাবার বিষয়!
এবার বুঝেছেন তো, সৌরভের খালি গা নিয়ে কেন অমন গেল গেল রব উঠেছিল? অনেকেই ছি ছি করেছিলেন, লর্ডস-এর পবিত্রতা নষ্ট হল! আমি তো শিহরিত সেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি চোখের সামনে আবার দেখব সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া দৃশ্য।
গায়ে কাঁটা, রোমহর্ষক, শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত— এসব যে নেহাতই কথার কথা, কে জানত! মাদাম তুসোর ওয়াক্স মিউজিয়াম ভুবনবিখ্যাত। সেখানে আব্রাহাম লিঙ্কন থেকে মহাত্মা গান্ধী, চার্লি চ্যাপলিন থেকে ঐশ্বর্য রাই, লেডি ডায়না থেকে জন লেনন, মোমমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এবং সবাই লাইফ-সাইজ। শিল্পীরা নিশ্চয়ই ইউরোপের, লক্ষ করে দেখলাম, পাশ্চাত্য চরিত্রগুলোর অবয়ব ও ব্যক্তিত্ব যেমন প্রায় নিখুঁত ফুটেছে, প্রাচ্যেরগুলো ততটা নয়। গান্ধী আর অমিতাভ— দুটোই হাস্যকর। সেই তুলনায় রাজপরিবার কিম্বা বিটলস দারুণ। দুর্ধর্ষ হল স্পিরিট অফ লন্ডন রাইড। এই শহরের সঙ্গে সমার্থক যেমন লাল দোতলা বাস, তেমন ব্ল্যাক ক্যাব। কালো সেই গাড়ির মডেলে বসার ব্যবস্থা, রাইডের মতোই ট্র্যাক ধরে চলে সারি সারি, সামনে সরে সরে যায় লন্ডনের ইতিহাস। শিল্পবিপ্লব থেকে প্লেগ-মড়ক— সবই লাইট অ্যান্ড সাউন্ডে, অভিনয়ে জীবন্ত। শুকনো রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজচিত্র নয়, নাচ-গানে ভরপুর শো।
এসব দেখে দারুণ মুডে আমরা ঠিক করলাম, মাদাম তুসোর বিখ্যাত চেম্বার অফ হররস-এ ঢুকব। ভূতপ্রেতে বিশ্বাসী নই, রং মেখে, নাকি সুরে ভয় দেখানো বোকা বোকা ব্যাপার। এখানে সেসব একদম নেই। চেম্বার অফ হররস পুনর্নির্মাণ করে কুখ্যাত সব অপরাধের। খুন, অপহরণ, সিরিয়াল কিলিং। শুনেছি, এতই নাকি বাস্তবসম্মত সেই দৃশ্যায়ন এবং অভিনয় যে, মনে হবে আপনার সঙ্গেই ঘটছে। এত শোনার পর দেখার ইচ্ছে হবে না? আরে বাবা, জানি তো নকল, কত আর ভয় দেখাবে?
সে ভাবনা যে কত ভুল, টের পেয়েছিলাম অচিরেই। এখানে আসার আগে ঘুরে এসেছি ২২১বি, বেকার স্ট্রিট, শার্লক হোমসের ঠিকানা। আমার মনে হয়, এখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ফেলুদার বাড়ির ঠিকানা লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়, ২১ নম্বর রজনী সেন রোড। সেখানে অবশ্য ফেলুদা মিউজিয়াম করার কথা কেউ কখনও ভাবেনি। বেকার স্ট্রিটের বাড়িটা আর তার সামনের রাস্তাটাতে কিন্তু ভিক্টোরীয় আমল থমকে আছে। মানে রাখা হয়েছে। উনিশ শতকের লন্ডনের পাথুরে রাস্তা, গ্যাসলাইট, বাকিংহামের মতো কালো টুপি পরা গার্ড, এমনকী, চারতলা বাড়িটাও একটুও বদলায়নি। বাড়ির ভেতরটা ছোট, কিন্তু অ্যান্টিক আসবাব আর প্রপসে নিখুঁত সাজানো। আর্থার কোনান ডয়েলের বেশ কয়েকটা বিখ্যাত কাহিনীর চরিত্ররা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হোমস আর ওয়াটসন যেন এইমাত্র কোথাও থেকে ফিরে বসবেন রহস্য সমাধানে। এমনকী, মগজাস্ত্রে শান দেওয়ার জন্য দরকারি পাইপটাও টেবিলে রাখা। ঢিমে আলোয় গা ছমছমে রহস্যের গন্ধ বাচ্চা-বুড়ো সবাই বেশ উপভোগ করে।
ভাবলাম, চেম্বার অফ হররস-এ কী আর এমন ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হবে? বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণে লেখা আছে, কোন কোন অবস্থায় এই আতঙ্কপুরীতে ঢোকা নিষেধ। যেমন, হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগলে, অন্তঃসত্ত্বা হলে, জোরালো শব্দ বা আলোয় অসুবিধা কিংবা ইন্দ্রিয়জনিত অতি স্পর্শকাতরতা থাকলে। এসবের কোনওটাই আমার নেই। অতএব দ্বিধা কীসের? নাচতে নাচতে ঢুকে পড়লাম অন্ধকার ঘুটঘুটে ঘরে এবং পিছনের দরজা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ মানে লকড। আর এখানে নিয়ম, এক-একটা চেম্বারে এক-একবারে একজনই ঢুকবে।
তারপর যে কী বিভীষিকা শুরু হল— কী বলব! এই সিলিং থেকে কেউ ঝাঁপিয়ে প্রায় ঘাড়ে পড়ছে তো পরের চেম্বারে ঢুকতেই দরজার আড়াল থেকে আততায়ী খোলা ছুরি হাতে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। ‘প্রায়’ বললাম এই কারণে যে, এই পেশাদার ভয়-দেখানিয়ারা এতটাই হিসেব মেনে মুভমেন্ট করে যে, কখনওই আপনাকে স্পর্শ করবে না। আপনার মনে হবে গলা টিপে ধরছে, কিন্তু একচুল হলেও গ্যাপ থাকবে। এত নিখুঁত তাদের মেক আপ, চেম্বারের আবহ এত গবেষণা করে তৈরি করা যে, অতি বড় সাহসীও ভয় পাবে। আসলে ভয় পাওয়ার জন্যই তো পয়সা খরচ করে চেম্বার অফ হররস-এ ঢোকা।
এবার ক্লাইম্যাক্সটা বলি। নির্বিঘ্নে পেরিয়ে এসেছি পুরো ঘরটা, বেরনোর মুখে ব্যান্ডেজ ভূতের মতো কী একটা অন্ধকার ফুঁড়ে পথ আটকে দাঁড়াল। তার আবার সারা গা থেকে রক্ত ঝরছে। আমি তাকে কাঁপা গলায় কোনওমতে বললাম, ‘দেখো ভাই, আমার নার্ভে খুব চাপ পড়ছে। আমি অসুস্থ বোধ করছি। আমাকে এখান থেকে বের করো প্লিজ।’ সে সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বাজাল। এমার্জেন্সি দরজা খুলে গেল। আমি বাইরে বেরিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। রক্ষী আমাকে চেয়ারে বসাল। প্যারামেডিক নিয়ে হাজির হল মাদাম তুসোর অফিসের কর্মী। আমার পালস রেট, ব্লাডপ্রেসার পরীক্ষা হল। জলটল খেয়ে চাঙ্গা হয়ে আমি ফেরার পথ ধরলাম। তবে ওই অদ্ভুত আঁধারেও ‘রক্তাক্ত খুনী’-র মুখে যে বিস্ময় ও আতঙ্ক আমি দেখেছিলাম একঝলক, তা কোনওদিন ভুলব না।
ও নিশ্চয়ই ভাবছিল, মড়া মেরে খুনের দায়ে পড়ব না তো!