ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মনডে ব্লুজ : পর্ব ৩

    জয়ন্ত ঘোষাল (January 27, 2025)
     

    সাংবাদিকের সব দিনই সোমবার

    ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনগুলোর রং সেই শৈশব থেকে দেখছি— কালো এবং লাল। অনেক কালো রঙের মধ্যে সপ্তাহান্তে একটি লাল রঙের তারিখ ছিল বড় আনন্দের। লাল রং মানে রবিবার। লাল রং মানে ছুটির দিন। আবার শুধু রবিবার তো নয়! আরও বেশ কিছু লাল রঙের তারিখ থাকে। তা সে বড়দিন হোক, বিজয়া দশমী অথবা মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন। এই লাল আর কালোর মেরুকরণের মাঝখানে অন্য রঙের দিন যে আছে, তা ছেলেবেলায় জানতাম না।

    আসলে কালো আর লাল ছাড়াও এক-একটি দিনের হয়তো এক-একরকম রং থাকে। আর নানা রকমের রং যাই হোক, কর্মজীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল নীল‌ রঙ।

    সোমবারের রং নীল, একথা টের পেলাম কর্মজীবনে। রোববার সন্ধে হতে না-হতেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। আর সেই মনখারাপ হয়ে যাওয়ার ভাইরাসটা আজও রক্তস্রোতের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। শিরা-ধমনির চলকে ওঠার রক্তস্রোতে যে বোধ কাজ করে, তার মধ্যে ‘মনডে ব্লুজ’-এর ভূমিকা এখনও অনস্বীকার্য। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সাংবাদিক জীবনের ঠিক কতগুলো সোমবার অতিক্রান্ত হয়েছে, তার হিসেব তো কখনও রাখিনি! বরং সাংবাদিকতার পাঠশালার প্রথম দিন‌ থেকে শিখে এসেছি যে, রিপোর্টার হয়েছ, ছুটি-তত্ত্বে বিশ্বাস ক’রো না। ‘ছুটি কাহাকে বলে’— সাংবাদিকরা সেকথা জানে না। অতএব, এতদ্বারা জানানো হইতেছে, আপনি রিপোর্টার। আপনার কোনও রবিবার নেই। কোনও ছুটি নেই। তাহলে তো প্রতিটা দিনই সোমবার।

    আরও পড়ুন : ব্লুজ সংগীতের বিষাদ আর সোমবারের আলস্য কি মিলে যায়?
    পড়ুন উপল সেনগুপ্তর কলমে মনডে ব্লুজ : পর্ব ২

    তবুও, আমাদের জীবনেও রবিবার এসেছে। রবি ঠাকুরের কবিতায় এক বালক তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, যে কেন রবিবার এত ধীরে ধীরে আসে? অন্যদিনগুলো যেভাবে তাড়াতাড়ি আসে, রোববার কেন সেভাবে আসে না? মনে পড়ে, রাজনৈতিক নেতারা অনেকেই শনি অথবা রবিবারের ছুটির দিনটিকে সাংবাদিক বৈঠক ডাকার অন্যতম দিন বলে মনে করতেন। রোববার দুপুরে রাজধানী দিল্লিতে রাজনৈতিক নেতাদের বাসভবনের সবুজ লনে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হত। সেখানে খাওয়াদাওয়ার আয়োজনের কোনও ত্রুটি থাকত না। সেকথা অনস্বীকার্য। তবুও বিরক্তির একসার হত। রোববার রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ির ভোজসভায় যোগ দিতে মন চাইত না! মনে হত, মন্ডা-মিঠাই নিষ্প্রয়োজন। বাড়িতে নিজের বিছানায় থেবড়ে বসে টিভি দেখা, আড্ডা মারা, সকালবেলায় লুচি-সাদা আলুর তরকারি, দুপুরবেলা আলু দেওয়া মাংসের ঝোল-ভাত, কিঞ্চিৎ দিবানিদ্রা, সন্ধ্যায় পারিবারিক অভিযান— এইসবই ছিল কত দামি!

    এখনও মনে পড়ে, রোববার ছোটবেলায় বাবার একটা আঙুল ধরে হাঁটতে হাঁটতে যেতাম শিবপুর বাজারে। বাবা বাজার-দোকান করতেন। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল, একটা ছোট্ট স্টেশনারি দোকান। আজও মনে আছে, দোকানটার নাম ছিল ‘উদয় স্টোর’। সেখানে একজন প্রৌঢ় বসে বিক্রি করতেন নানা রকমের প্যাস্টেল রং, ক্যামেলিন কালি, পেনসিল। আমাদের ছোটবেলায় তখন লাক্সারের কলম এসে গেছে, আরটেক্স পেন এসেছে। নানা রঙের সুলেখা কালি। লাল, কালো, নীল ছাড়াও বাজারে এল একটা বাদামী কালি। কোম্পানির নাম ছিল ‘চেলপার্ক’। বাবা সেসব নিত্যনতুন পণ্য কিনে দিতেন। পাশেই ছিল একটা ছোট্ট বইয়ের দোকান। দোকানটির নাম ছিল ‘সরস্বতী বুক হাউস’। সেখানে সাজানো থাকত গল্পের বই। বাবার হাত ধরে সেই ড্রয়িং খাতা আর রঙ-তুলি নিয়ে এসে রোববার দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ড্রয়িং খাতায় ডানা মেলত কল্পনার স্বর্গরাজ্য।

    যখন আমাকে কোনও মিনিস্টারের প্রেস কনফারেন্সে যেতে হত, যখন বলা হত রোববারটা প্রেস কনফারেন্সের জন্য ভাল। সেদিন খবর কম থাকে। মিনিস্টারের প্রেস কনফারেন্সের পাবলিসিটিটা ভাল হবে। টিভি চ্যানেলগুলি এসে যাওয়ার পর দুপুরবেলাটাই রাজনৈতিক নেতারা পচ্ছন্দ করেতেন। কারণ, সারাদিন ধরে টিভি চ্যানেলে র হুইলে ঢুকে যাবে সেই প্রেস কনফারেন্স। রাত পর্যন্ত দেখানো হবে। অনেক সময় তো অনেক মন্ত্রী শনি-রবিবার যেতেন নানারকম ট্যুরে, কাশ্মীর থেকে সিয়াচেন, অথবা তাঁর নির্বাচন কেন্দ্র। গুজরাট কিংবা মহারাষ্ট্র কিংবা অসম। সাংবাদিকদের সঙ্গে যেতে হত! শনি-রোববার তাঁরা বাছতেন, কেননা অনেক সময় সোমবার সংসদ থাকত। অফিসকাছারি শুরু হয়ে যেত। শনি-রবিবারটা সাধারণত তাঁরা দিতেন দিল্লির বাইরের ট্যুর অথবা নিজের নির্বাচনী এলাকার জন্য। আর এইসবের পর, সোমবার সকালে ঘুম ভাঙত। রবিবার গভীর রাতে হয়তো ফিরেছি। ঘুম ভেঙে সম্বিত ফিরে পেতেই মনে পড়ে গেল, আজ সোমবার। আর সঙ্গে সঙ্গে মনটা একদম তেতো হয়ে গেল। যাকে বলে তিতিবিরক্ত! তখন মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকত। কিশোর সন্তানের দিকে তাকাতে লজ্জাবোধ হত।

    শনি-রবির এই হতাশা জানলে আমার নীল রঙের সোমবারের কাহিনি বুঝতে খুব সুবিধা হবে আপনাদের!

    ভাবতাম, আমি যেরকম বাবার সঙ্গে হাত ধরে ‘উদয় স্টোরে’ যেতাম, আমার ছেলেও কিন্তু আশা করে আমার সঙ্গে করলবাগ অথবা কনট প্লেস গিয়ে বইয়ের দোকানে গিয়ে টিনটিন কিনবে, অথবা তার খেলার সামগ্রী। আমি কর্মব্যস্ত ছিলাম। তাই মায়ের সঙ্গে সে রোববার কাটিয়েছে। অথচ সোমবার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে এসে উপস্থিত। সে খুব পাংচুয়াল। সোমবারের সময়ানুবর্তিতা অতুলনীয়। অতএব, সোমবারদিন একধরনের মানসিক জ্বর আসতো। পরে জানলাম, এটাকেই বলে নাকি ‘মনডে ব্লুজ’।

    অনেক ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে হত। কেননা, রোববার আনন্দ উৎসব করতে গিয়ে মধ্যরাতে স্বাধীনতা এতটাই প্রলম্বিত হত যে, সোমবারের স্বাধীনতা হীনতার কাহিনি তখন স্মরণে থাকত না। ফলে অ্যালার্ম বাজিয়ে রোবটের মতো পিচুটিভরা বন্ধ চোখে কোনরকমে নিজেকে সজীব করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে দৌড়াতাম। সোমবার সংসদের অধিবেশন। অধিবেশন বসবে এগারোটায়। কিন্তু পৌঁছে যেতে হয় সকাল দশটায়। কারণ, ফিল্ডিং‌-এ পোজিশন নিতে হয়। প্রেস গ্যালারিতেও ভিড় হয়। তারপরে নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। ভেতরে প্রবেশের আগেও আছে অনেক পূর্বশর্তের লম্বা মিছিল। প্রতিটি উইকেন্ডে ভাবতাম, এই রাতবিরেতের রোববারকে আলবিদা বলার এইবারই শেষ। এর পরেরবার থেকে রোববার দুপুরের মধ্যে গুটিয়ে নেব সুতোটা। তাহলে একটা হোমওয়ার্ক করে নেব সোমবার কাজে যাওয়ার। রোববারটা দুপুরের পর থেকে কাজের মোডে আসার জন্য মেডিটেশন শুরু হয়ে যাবে। অতএব, সোমবার আর কোনও কষ্ট থাকবে না। আরও চাঙ্গা হয়ে যাব আপিসে। কিন্তু যতবার আলো জ্বালাতে যাই, নিভে যায়‌ বারেবারে। কী করব? তবে বয়স বাড়ার পর চেষ্টা শুরু হল, শুক্রবার সন্ধে আর শনিবার সন্ধেতে যাবতীয় শখ-আহ্লাদ পূরণ করে নেওয়া। আর রোববার থেকে শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট হয়ে ওঠো।

    অনেক সময় তো অনেক মন্ত্রী শনি-রবিবার যেতেন নানারকম ট্যুরে, কাশ্মীর থেকে সিয়াচেন, অথবা তাঁর নির্বাচন কেন্দ্র। গুজরাট কিংবা মহারাষ্ট্র কিংবা অসম। সাংবাদিকদের সঙ্গে যেতে হত! শনি-রোববার তাঁরা বাছতেন, কেননা অনেক সময় সোমবার সংসদ থাকত। অফিসকাছারি শুরু হয়ে যেত।

    আজকাল ভাবি যে, সোমবারের এই দুঃখ নীল কেন? আসলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই ‘মনডে ব্লুজ’-এর প্রবাদটি শুরু হয়েছিল ইউরোপে। তা বেশ! কিন্তু ব্লু কেন? ব্লু ব্লাড মানে নীল রক্ত, সে তো আভিজাত্যের প্রদর্শন। সোমবারের এই লেথার্জি-তে নীল রঙ আসে কোথা থেকে? অবশ্য, আমাদের দেশে সাপে কাটলে মানুষ নীল হয়ে যায়। তখন যথেষ্ট দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হয়। কিন্তু আর যাই হোক, সাপে কাটা থেকে আর তো নীল সোমবারের উৎপত্তি নয়। নীলকণ্ঠ বিষপান করে নীলকণ্ঠ হয়েছিল। সোমবারের গরল কি নীল রঙের?

    এ-ব্যাপারে গবেষণা করার চেষ্টা করতে গিয়ে জানতে পারলাম যে, বিদেশের পাশ্চাত্য দুনিয়ায় নীল রঙের সঙ্গে একটা বেদনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যে-কারণে ইংরেজিতে বলা হয়, ‘নীল দুঃখ’। অনেক কবিরাও দুঃখে নীল হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।

    কাজেই ফিলিং ব্লু। এটা পাশ্চাত্যের খুবই সহজ, স্বাভাবিক ধারণা। এই রঙের ব্যঞ্জনা বা বেদনা, তার তো একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে ফারাক হতে পারে। একটা সংস্কৃতির সঙ্গে আরেকটা সংস্কৃতির তফাত হতে পারে। ভারতীয় হিন্দু ধর্মে নীল আবার শান্ত, সমাহিত এক পবিত্র রং। বিষ্ণুর সঙ্গে নীল পদ্ম, নীল ফুল, নীল রঙের যথেষ্ট ব্যঞ্জনা আছে।

    তবে সোমবার, তা সে তুমি নীলই হও, আর কালোই হও, আর ধলোই হও— সোমবারের ল্যাদ তো বিশ্বজনীন! এ-ব্যাপারে মানুষের ঐকমত্য আন্তর্জাতিক।

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook