‘বাণীচক্র’ বলে একটি গানের স্কুল আছে। সেখানে সপ্তাহের কোনও একটা দিন ক্লাস করাতেন সুধীন দাশগুপ্ত। আমি ঠিক তার পাশের ঘরে পিয়ানো বাজানো প্র্যাকটিস করতাম। আমি সলিল চৌধুরীর সরাসরি শিষ্য হয়তো ছিলাম, কিন্তু আমার বাবা, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলতেন, তোমার মধ্যে সুধীনদার একটা প্রভাব আছেই। সেটা হয়েছিল, কারণ সুধীন দাশগুপ্তর ভাই পরিমল দাশগুপ্ত আমাকে প্রায় হাতে ধরে গিটার শিখিয়েছিলেন। পরিমল দাশগুপ্তর মূল্যায়নই সেভাবে হয়নি। কিন্তু বাংলা গানের জগতে অমন শিক্ষিত সংগীত-আয়োজক, অ্যারেঞ্জার বাংলা গানের ইতিহাসে দুর্লভ। সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গে ওঁর যুগলবন্দি প্রায় কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। মনে একদিন ওই ক্লাসেই বললেন, ‘বম্বে থেকে একটা গান রেকর্ড করে এসেছি, একটু বাজা তো আমার সঙ্গে!’ মনে আছে, গানটা ছিল, ‘কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়’।
আমার বাবার সঙ্গে খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল সুধীন দাশগুপ্তর। বাবা ‘সুধীনদা, আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন, আর সুধীন দাশগুপ্ত ‘অভিজিৎ, তুমি’ বলে ডাকতেন। দু’জনে মর্নিং শো-তে একসঙ্গে ইংরেজি ছবি দেখতে যেতেন। সুধীন দাশগুপ্ত খুব ভাল অ্যাকর্ডিয়ন বাজাতে পারতেন, সেতারও বাজাতে পারতেন। হয়তো বাবার কোনও গানে অ্যাকর্ডিয়ন বাজানোর কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, সুধীন দাশগুপ্ত বললেন, ‘অভিজিৎ, তোমার গানে আমি অ্যাকর্ডিয়ন বাজিয়ে দেব।’
আরও পড়ুন : মৌলিকত্বর সন্ধানে সেতারের মোটা তার ব্যবহার করেছিলেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়…
সুধীন দাশগুপ্ত একজন অত্যন্ত ভদ্র, অমায়িক মানুষ ছিলেন। অসম্ভব ব্যক্তিত্ব ছিল। আমার কাছে, ব্যক্তিগতভাবে, শিল্পীদের চেয়ে সুরকারদের গুরুত্ব একটু বেশি ছিল চিরকালই। আমি চিনতাম এঁদেরই। বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর বেশিরভাগই সুধীন দাশগুপ্তর কম্পোজিশন। যেমন, খুব জনপ্রিয় সুর সেগুলো, তেমন তার মধ্যে গভীরতাও ছিল। ‘এত সুর আর এত গান’ ‘আকাশে আজ রঙের খেলা’ বা ‘এত বড় আকাশটাকে’ যেমন মনে পড়ছে। মুম্বইয়ের শিল্পীদের পাশাপাশি বাঙালি বহু শিল্পীকে দিয়েও গান গাইয়েছেন। আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এমন কত গান রয়েছে।
খুব ভাল গান লিখতেনও। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন ওঁর গান লিখেছেন, তেমনই নিজেও লিখতেন। ওঁর এক বন্ধু এবং ভ্রাতৃসম, অরুণ বিশ্বাসের জন্য যেমন বেশ কিছু গান লিখেছেন। সুনীলবরণ ওঁর খুবই বন্ধু ছিলেন, সুনীলবরণের জন্য কিছু গান লিখেছেন।
লিরিক থেকে, সুর থেকে, সংগীতায়োজন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ওঁর কাজ ব্যাপ্তি পেত। সলিল চৌধুরী ছাড়া আর দু-জন সংগীতকারই গানের সুরারোপের পাশাপাশি অর্কেস্ট্রেশনটাও পূর্ণাঙ্গভাবে জানতেন। একজন আমার বাবা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যজন সুধীন দাশগুপ্ত। সুধীন দাশগুপ্ত এই সংগীত-আয়োজনের কাজটা পরিমল দাশগুপ্তর সঙ্গে করতেন। ফলে, ওঁদের দু-জনের কাজ অনন্য হয়ে রয়েছে। পরের দিকে যদিও, পরিমল দাশগুপ্ত, সুধীন দাশগুপ্তর থেকে কিছুটা আলাদা কাজ করতে শুরু করেন। তখন অলোকনাথ দে সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গে কাজ করতেন।
এখন সুরকাররা চারটে কর্ড জেনে সংগীত করে দিতে পারেন। তাঁরা হয়তো কারিগরি দিক থেকে দক্ষ, কিন্তু সংগীতকে অতটা অন্তর থেকে জানেন কি? সুধীন দাশগুপ্ত যেমন পাশ্চাত্য সংগীত জানতেন, তেমনই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতও জানতেন, আবার ফোক বা লোকায়ত সংগীতও ছিল ওঁর নখদর্পণে। না-হলে ‘ডাকহরকরা’ ছবির সংগীত করতেই পারতেন না তিনি। পরবর্তীকালে ‘হংসরাজ’-এর ছবিতে লোকসংগীতের অপূর্ব ব্যবহার করেছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। কোথায় কোন যন্ত্র বাজাতে হবে, সেটাও কিন্তু আয়ত্তে ছিল ওঁর।
সুধীন দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে যে খুব আত্মস্থ করেছিলেন, তা বলা যায় না, যেভাবে করেছিলেন সলিল চৌধুরী বা বাবা। কিন্তু জনপ্রিয় আধুনিক গান ওঁর মতো করে আর কেউ বানাননি, এক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র। এককথায় বললে, বাংলা গানের জগতে সবচেয়ে স্মার্ট সুরকারের নাম সুধীন দাশগুপ্ত।