‘যদি হাজার বছর পরে একবার রাতের আকাশে জেগে ওঠে তারারা, তাহলে কী হবে?’ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা লেখকের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ‘অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন’ পত্রিকার দুঁদে সম্পাদক জন ক্যাম্পবেল। উত্তরটাও নিজেই দিলেন, ‘আমার মতে, মানুষ সেই দৃশ্য দেখে পাগল হয়ে যাবে’। তরুণ লেখকের কপালে এরপরেই জুটে গেল ‘হোমওয়ার্ক’, ‘যাও, এই প্লট-এর ওপর একটা গল্প লিখে ফেলো।’
আইজ্যাক অ্যাসিমভ-এর তখন মাত্র ২১ বছর বয়স। বছরতিনেক হল লেখালিখির দুনিয়ায় পা রেখেছেন, হাতে গোনা কয়েকটা কল্পবিজ্ঞান গল্প ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। এমতাবস্থায় ক্যাম্পবেল-এর কাছ থেকে লেখার আমন্ত্রণ পাওয়া, দুর্লভ সুযোগ নিঃসন্দেহে। কাজটাও ততটাই কঠিন— লেখা পছন্দ না হলে পত্রপাঠ বাতিল করার আগে দু’বার ভাববেন না কড়া সম্পাদক।
বাড়ি ফিরেই লিখতে বসে গেলেন অ্যাসিমভ, কিছুটা এগতেই মনের ক্যানভাসে স্পষ্ট রূপ পেল একটা ছবি। বহুদূরের এক গ্রহ, ‘লাগাশ’, যার আকাশে জ্বলজ্বল করে ছ’টা সূর্য। রাত কাকে বলে জানেই না সেখানকার বাসিন্দারা। তবে প্রতি দু’হাজার বছরে একবার সবক’টা সূর্যে একসঙ্গে গ্রহণ লাগে, ‘লাগাশ’ ডুবে যায় নিঃসীম অন্ধকারে। তখন ভয়ংকর এক গণউন্মাদনা গ্রাস করে সেই গ্রহকে। ধ্বংস হয়ে যায় সভ্যতা, মুছে যায় ইতিহাস। অ্যাসিমভ গল্পটার নাম রাখলেন ‘নাইটফল’, পাঠিয়ে দিলেন ক্যাম্পবেল-কে। মুগ্ধ সম্পাদক গল্পটা শুধু যে মনোনীত করলেন তা-ই নয়, ‘বোনাস’-সহ চেক পাঠিয়ে দিলেন লেখকের বাড়ির ঠিকানায়। ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’-এর সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ সংখ্যায় প্রকাশ পেল ‘নাইটফল’। পাঠকরা রোমাঞ্চিত হলেন, সমালোচকরা অকুণ্ঠ প্রশংসায় ভরিয়ে তুললেন অ্যাসিমভ-কে। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের আকাশে এক তারকার উদয় হল।
আরও পড়ুন : এআই কি আসলে ভূতের রাজা…
১৯২০ সালের ২ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর অন্তর্গত পেত্রোভিচি-র এক নিম্নবিত্ত ইহুদি পরিবারে জন্ম হয় আইজ্যাক অ্যাসিমভ-এর। ১৯২৩ সালে অ্যাসিমভ দম্পতি তাঁদের সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন আমেরিকার ব্রুকলিন শহরে, ছোট্ট একটা লজেন্সের দোকান খুলে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। আমেরিকাতেই পড়াশোনা আরম্ভ হয় অ্যাসিমভ-এর, মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষকদের স্নেহের পাত্রও হয়ে ওঠেন তিনি। দোকানের জন্য মাইনে করা কর্মচারী রাখার সামর্থ তাঁর পরিবারের ছিল না, তাই স্কুল থেকে ফেরার পর অ্যাসিমভ-কে অনেকটা সময় দোকানে ব্যয় করতে হত। লজেন্স ছাড়াও সেখানে বিক্রির জন্য রাখা থাকত বিভিন্ন স্বাদের পত্রপত্রিকা; বাবার কড়া নজরদারি এড়িয়ে দোকানে বসেই সেগুলো গোগ্রাসে পড়তেন অ্যাসিমভ। এভাবেই সায়েন্স ফিকশন পাল্প ম্যাগাজিন-এর সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর। বিস্ময়কর সব বিজ্ঞান-সুবাসিত কল্পকাহিনি মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলতে থাকে তাঁকে; লেখক হওয়ার উদগ্র বাসনা ডালপালা মেলতে শুরু করে কচি মনের অভ্যন্তরে।
ছেলের ইচ্ছের কথা জানতে পেরে কম দামি, পুরনো একটা টাইপরাইটার কিনে আনলেন বাবা; ১৬ বছর বয়সে শুরু হল অ্যাসিমভ-এর সাহিত্যচর্চা। সেই সময়ে কল্পবিজ্ঞানের জন্য নিবেদিত প্রাণ পত্রিকা ছিল মোট তিনটে- ‘অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন’, ‘অ্যামেজিং স্টোরিজ’ এবং ‘থ্রিলিং ওয়ান্ডার স্টোরিজ’। অ্যাসিমভ তিন জায়গাতেই গল্প পাঠাতে লাগলেন। তাঁর প্রথম প্রয়াস ‘কসমিক কর্কস্ক্রু’ ছাপার জন্য মনোনীত না হলেও ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’-এর সম্পাদক জন ক্যাম্পবেল নবাগত লেখককে উৎসাহ দিতে কার্পণ্য করলেন না। এতেই যেন হাতে চাঁদ পেলেন অ্যাসিমভ, পরিশ্রম আর জেদ বাড়িয়ে দিলেন বহুগুণ। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হলেন; ‘অ্যামেজিং স্টোরিজ’ পত্রিকায় ‘মেরুনড অফ ভেস্টা’ গল্পের হাত ধরে প্রথমবারের জন্য ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পেল আইজ্যাক অ্যাসিমভ-এর নাম। সে-বছরই জুলাই মাসে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’-এ প্রকাশিত হল তাঁর আরেক গল্প ‘ট্রেন্ডস’। আরও বছরখানেক এভাবে চলার পর এল ‘নাইটফল’-এর ধূমকেতুসম সাফল্য; ‘অ্যাসিমভ’-যুগের সূচনা হল সাড়ম্বরে।
গত শতকের চারের দশক— যাকে বিশেষজ্ঞরা ‘গোল্ডেন এজ অফ সায়েন্স ফিকশন’ বলে অভিহিত করে থাকেন— ছিল আইজ্যাক অ্যাসিমভ-এর লেখকজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও। এই দশকেই ‘হার্ড সায়েন্স ফিকশন’ অনুরাগীদের অনবদ্য দুটো সিরিজ উপহার দেন তিনি— ‘রোবট’ এবং ‘ফাউন্ডেশন’। এর আগে রোবট নিয়ে যা গল্প বা উপন্যাস লেখা হত, তার অধিকাংশই ছিল নৈরাশ্যময় (লেস্টার ডেল রে-র ‘হেলেন ও’ লয়’ জাতীয় ব্যতিক্রম বাদে); সেখানে রোবট-দের দেখানো হত বিবেকহীন, যান্ত্রিক দানব রূপে, যারা কিনা মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। এই ‘স্টিরিওটাইপ’ ভাঙার উপায় হিসেবে অ্যাসিমভ সৃষ্টি করলেন ‘থ্রি ল’জ অফ রোবোটিক্স’— রোবট-দের সার্কিটে বুনে দেওয়া এক এমন রক্ষাকবচ, যার প্রভাবে তারা কখনওই মানুষের ক্ষতি করবে না, বরং মানুষের কথা শুনে চলবে। চোখের নিমেষে মানবতার শত্রু থেকে রোবটরা হয়ে উঠল মানুষের আজ্ঞাবাহী অনুচর, বিশ্বস্ত সঙ্গী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত পজিট্রনিক রোবট নিয়ে চমৎকার কিছু গল্প লিখলেন অ্যাসিমভ, যেমন ‘স্ট্রেঞ্জ প্লেফেলো’, রিজন’, ‘লায়ার!’, ‘এস্কেপ’ ইত্যাদি; গড়ে তুললেন ডোনোভান ও পাওয়েল, রোবোসাইকোলজিস্ট সুজ্যান কেলভিন-এর মতো স্মরণীয় চরিত্রদের। ‘নোম প্রেস’ থেকে প্রকাশিত ‘আই, রোবট’ গল্প সংকলনে স্থান পেল সেইসব গল্প, পাঠকের ভালবাসা কুড়লো বিস্তর।
১৯৪১-এর আগস্ট মাসের এক দুপুরবেলা ট্রেনে চড়ে ক্যাম্পবেল-এর অফিসে যাচ্ছিলেন অ্যাসিমভ; তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল প্লটের খোঁজ। একসময় বিদ্যুৎচমকের মতো এল একটা আইডিয়া— এডওয়ার্ড গিবন রচিত ‘হিস্ট্রি অফ দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার’ বইয়ে যেভাবে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে, তারই আদলে এক মহাজাগতিক সভ্যতার পতন এবং পুনরুত্থানের কাহিনি লিখলে কেমন হয়? উত্তেজিত অ্যাসিমভ তাঁর ভাবনার কথা খুলে বললেন ক্যাম্পবেল-কে, এবং সম্পাদকের পক্ষ থেকে তৎক্ষণাৎ ইতিবাচক সাড়া পেলেন। পরের বছর মে মাসে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’-এ প্রকাশিত হল ‘ফাউন্ডেশন’ উপন্যাসিকা। অনাগত ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে ছায়াপথব্যাপী বিশাল সভ্যতার ভাঙাগড়ার আখ্যান আলোড়ন তুলল আপামর কল্পবিজ্ঞানপ্রেমীর হৃদয়ে। কলম থামানোর আর ফুরসৎ পেলেন না অ্যাসিমভ; সম্পাদকের অবিরাম তাগাদা ও পাঠকের চাহিদা মেনে আসতে থাকল একের পর এক নভেলা— ‘দ্য ট্রেডার্স’, ‘ব্রাইডল অ্যান্ড স্যাডল’, ‘ডেড হ্যান্ড’, ‘দ্য মিউল’, ‘নাও ইউ সি ইট’ প্রভৃতি। প্রায় দশ বছর পেরিয়ে সবকটা কাহিনি একত্রিত হল তিনটি বইয়ে— ‘ফাউন্ডেশন’, ‘ফাউন্ডেশন অ্যান্ড এম্পায়ার’ এবং ‘সেকেন্ড ফাউন্ডেশন’। এই ‘ট্রিলজি’ পাশ্চাত্য সায়েন্স ফিকশন-এর অন্যতম উজ্জ্বল নিদর্শন, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
পাঁচের দশকের প্রথম ভাগে আমেরিকার বইবাজারে পেপারব্যাক-এর উত্থান অ্যাসিমভ-এর সামনে নবদিগন্ত খুলে দিল। প্রকাশকদের আবদার মেটাতে তিনি রচনা করলেন বেশ কিছু একক উপন্যাস— ‘পেবল ইন দ্য স্কাই’, ‘দ্য স্টারস, লাইক ডাস্ট’, ‘দ্য কারেন্টস অফ স্পেস’, যা আরেকটা নতুন সিরিজ, ‘গ্যালাক্টিক এম্পায়ার’-এর অন্তর্ভুক্ত হল। অ্যাসিমভ তখন খ্যাতির মধ্যগগনে বিরাজ করছেন, চাইলেই পারতেন নিজের স্বাচ্ছন্দ্য-বৃত্তের ভেতরে রয়ে যেতে, গতে বাঁধা জিনিসপত্র লিখে বারবার ‘বেস্টসেলার’ তালিকায় নাম তুলতে। কিন্তু তিনি সে-পথে হাঁটলেন না, সচেতনভাবে চেষ্টা করলেন চেনা ছকের বাইরে বেরতে। সেই সময় একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, কল্পবিজ্ঞানকে আশ্রয় করে রহস্যকাহিনি লেখা একেবারেই অসম্ভব। এই বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করতে অ্যাসিমভ ডিটেকটিভ এলাইজা বেইলি এবং তার সহকারী রোবট ড্যানিল অলিভা-কে মুখ্য চরিত্রে রেখে লিখে ফেললেন দু’টি অনবদ্য ‘মার্ডার মিস্ট্রি’ ‘দ্য কেভস অফ স্টিল’ এবং ‘দ্য নেকেড সান’। বইগুলোর সাহিত্যগুণ, সাসপেন্স বজায় রাখার ক্ষমতা, ‘হুডানিট’ হিসেবে সার্থকতা সবকিছু একপাশে সরিয়ে রেখে, শুধুমাত্র ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ গ্রহণের সাহস দেখানোর জন্য অ্যাসিমভ-কে শতবার কুর্নিশ জানানো যেতে পারে।
১৯৫৮-য় কল্পবিজ্ঞান থেকে একরকম অবসরই নিলেন আইজ্যাক অ্যাসিমভ, পা রাখলেন ‘নন ফিকশন’-এর জগতে। ততদিনে তিনি বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি শেষ করে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছেন। পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি শাখায় গভীর পাণ্ডিত্য তাঁর ছিলই; এর সঙ্গে এবার যুক্ত হল বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বকে সহজ-সরল অথচ আকর্ষণীয় ভাষায় জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার তাঁর অনায়াস দক্ষতা। ‘দ্য কেমিক্যালস অফ লাইফ’, ‘দ্য ইন্টেলিজেন্ট ম্যান’স গাইড টু সায়েন্স’, ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফিজিক্স’, ‘দ্য হিউম্যান ব্রেইন’ জাতীয় ‘পপুলার ফিকশন’ বই অ্যাসিমভ-কে অল্প সময়ের মধ্যেই বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে জনপ্রিয় করে তুলল। ধীরে ধীরে নিজের গণ্ডি আরও বিস্তৃত করলেন তিনি, বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ লিখলেন ইতিহাস, শেক্সপিয়র-এর নাটক, এমনকী, বাইবেল-এর ওপরেও। ক্রমশ দেশ-বিদেশের শিক্ষিত, রুচিশীল মহলে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে গেল, যারা কোনওদিন কোনও সায়েন্স ফিকশন বই বা পত্রিকার পাতা উলটে দেখেননি, তাঁরাও একডাকে চিনতে শুরু করলেন অ্যাসিমভ-কে।
সাতের দশকে আবারও নিজের চেনা ময়দানে ফিরে এলেন অ্যাসিমভ, ফোটাতে লাগলেন একের পর এক ফুল। বহু বছর আগে জন ক্যাম্পবেল তাঁর সমসাময়িক লেখকদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এমন এক ভিনগ্রহী প্রজাতিকে নিয়ে গল্প লিখে দেখাতে, যাদের চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা মানুষের সমান, কিন্তু মনের গতিপ্রকৃতি মানুষের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। সেই চ্যালেঞ্জ-এর জবাব দিতেই যেন অ্যাসিমভ লিখলেন ‘দ্য গডস দেমসেল্ভস’, এবং সায়েন্স ফিকশন সর্বশ্রেষ্ঠ পুরষ্কার ‘হুগো অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হলেন। যারা ভেবেছিলেন রোবট-বিষয়ক সবধরনের গল্প ইতিমধ্যেই লেখা হয়ে গিয়েছে, এই ঘরানায় নতুন কিছুই আর দেওয়ার নেই কারওর, তাঁদের সবাইকে চমকে দিল অ্যাসিমভ-এর ‘দ্য বাইসেন্টিনিয়াল ম্যান’— এক রোবটের মানুষ হয়ে উঠতে চাওয়ার মর্মস্পর্শী কাহিনি। ‘হুগো’ ও ‘নেবুলা’ দুটো পুরষ্কারই জিতে নিল মানবিক আবেদনের রসে সিঞ্চিত এই উপন্যাসিকা। এরপর ‘এলাইজা বেইলি’ সিরিজ, ‘গ্যালাকটিক এম্পায়ার’ সিরিজ এবং ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজ-কে এক সুতোয় গাঁথার পরিকল্পনা করলেন তিনি। পূর্ববর্তী কাহিনিগুলোর সিকোয়েল লেখা শুরু করলেন নিষ্ঠাভরে, আগে কখনও দেখা যায়নি, এমন অভাবনীয় ব্যাপ্তির কল্পজগত নির্মাণের আনন্দে মেতে উঠলেন। কিন্তু স্বপ্নপূরণের জন্য পর্যাপ্ত সময় তিনি পেলেন না; দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৯২ সালের ৬ এপ্রিল অমৃতলোকের পথে যাত্রা করলেন আইজ্যাক অ্যাসিমভ।
বড় লেখকের পাশাপাশি অ্যাসিমভ ছিলেন একজন বড় মনের মানুষ— অগ্রজ-অনুজ সকলের জন্য তাঁর সাহায্যের হাত সর্বদা বাড়ানোই থাকত। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সাহিত্যগুরু ক্যাম্পবেল-এর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন তিনি করেছেন, সতীর্থ রবার্ট হাইনলাইন-এর সঙ্গে সুস্থ প্রতিযোগিতার সম্পর্ক থাকলেও কল্পবিজ্ঞানে তাঁর অবদানকে মর্যাদার চোখে দেখেছেন। সায়েন্স ফিকশন-এর আরেক স্তম্ভ, ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদ-লেখক আর্থার সি ক্লার্ক-এর সঙ্গে ছিল তাঁর বিশেষ সখ্যতা। দু’জনের লেখার ‘স্টাইল’-এ এতটাই মিল ছিল যে, অনেকেই অ্যাসিমভ-এর গল্পকে ক্লার্ক-এর বলে ভুল করতেন (উল্টোটাও যে হত না, তা নয়)। তাতে কিন্তু বিরক্ত হতেন না অ্যাসিমভ, হাসিমুখেই শুধরে দিতেন পাঠকের ভ্রান্তি। অ্যাসিমভ ও ক্লার্ক-এর বন্ধুত্ব নিয়ে মজার এক জনশ্রুতি রয়েছে। বলা হয়, একবার ট্যাক্সিতে বসে নিউ ইয়র্ক-এর পার্ক অ্যাভিনিউ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্লার্ক-কে অদ্ভুত এক চুক্তির প্রস্তাব দেন অ্যাসিমভ। তার বয়ান ছিল— জনসমক্ষে তাঁরা পরস্পরকে কল্পবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ লেখক বলে সম্বোধন করবেন, এবং নিজেদের দ্বিতীয় সেরার তকমা দিয়েই ক্ষান্ত থাকবেন। ব্যাপারটা এতটাই মনে ধরে ক্লার্ক-এর, যে তাঁর ‘রিপোর্ট অন প্ল্যানেট থ্রি’ বইয়ের ভূমিকায় লিখে ফেলেন— ‘ক্লার্ক-আসিমভ চুক্তির শর্তানুযায়ী, কল্পবিজ্ঞানের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ লেখকের পক্ষ থেকে এই বই উৎসর্গ করা হল কল্পবিজ্ঞানের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ লেখককে।’ রসবোধেও কতটা অনন্য ছিলেন অ্যাসিমভ—এ ঘটনা তারই পরিচায়ক।
২০২৪-এর অন্তিম লগ্নে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। গত শতকে যা ছিল নিছকই কল্পনা, এই শতকের আড়াই দশকেই তার অধিকাংশ বাস্তবে পর্যবসিত হয়েছে, বা দ্রুত বেগে বাস্তবায়নের এগোচ্ছে। এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে গোটা পৃথিবী উত্তাল, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র নিয়ে নানা গবেষণা চলছে চারদিকে, চালকবিহীন মহাকাশযান অহরহ পাড়ি দিচ্ছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, এসবের মাঝেও আইজ্যাক অ্যাসিমভ আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক— কেবল সায়েন্স ফিকশন-এর এক কিংবদন্তি হিসেবে নন, কয়েকটা প্রজন্মের অন্তরে ‘সেন্স অফ ওয়ান্ডার’ জাগিয়ে তোলার অন্যতম কান্ডারি হিসেবেও। তাঁর সাহিত্যকর্ম আজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয়, তাঁর আবিষ্কৃত ‘সাইকোহিস্ট্রি’ শব্দ ইংরেজি অভিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে রোবট-প্রযুক্তি বিষয়ক শাখার নাম রাখা হয়েছে ‘রোবোটিক্স’। আগামী ২ জানুয়ারি, ২০২৫, পালিত হতে চলেছে আইজ্যাক অ্যাসিমভ-এর ১০৫তম জন্মবার্ষিকী। আশা রাখা যায়, তাঁর বিপুল সাহিত্যসম্ভার আমাদের নিবিড় প্রেরণা জোগাবে, হৃদয়-কুঠুরিতে দেদীপ্যমান হয়ে থাকবে তাঁর অমলিন উপস্থিতি।