ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • আমার ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’

    প্রয়াগ শুক্লা (January 1, 2025)
     

    কালীচরণ অ্যান্ড কোম্পানি— এই নামে আমার বাবার বইয়ের দোকান ছিল নিউ মার্কেটের বি ব্লকে। সে-সময়ের খুবই জনপ্রিয় বইয়ের দোকান। অনেক বিখ্যাত লোকজন আসতেন বাবার কাছে বই কিনতে। সবার নাম এই বয়সে পৌঁছে আর মনে নেই, তবে ভুলতে পারিনি কয়েকজনকে।

    আমার ১০-১১ বছর বয়স যখন, বাড়ির কারও-না-কারও সঙ্গে প্রায়শই চলে যেতাম দোকানে। কখনও বাবার জন্য খাবার নিয়েও যেতে হত। যখন যেতাম, দোকানের বাইরের টুলটায় বসে থাকতাম। কমিকস বইয়ের পাতা ওলটাতাম। আর মাঝে মাঝেই দেখতাম, একজন লম্বা লোক আসেন, বই দেখেন, কেনেন, চলে যান। সবাই তাকিয়ে থাকত ওঁর দিকে। আমিও থাকতাম, কেননা অত লম্বা লোক তখনও আমি দেখিনি। উনিই যে সত্যজিৎ রায়, সেটা বুঝেছি ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পাওয়ার পর। ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ওঁর একটা ছবি বেরিয়েছিল সে-সময়ে।

    এছাড়াও বইয়ের দোকানের উলটোদিকে আমাদের একটা তামাকের দোকান ছিল, যেখানে মাঝে মাঝে পাহাড়ী সান্যাল আসতেন। ওঁর সঙ্গে কথাও বলেছি। আসতেন ত্রিপুরার রাজাও। তরুণ দলাই লামাকে আমি প্রথম বাবার দোকানেই বই কিনতে দেখি।

    বাবার এই বইয়ের দোকান যে কোন সালে তৈরি, সেই তথ্য আমার কাছে নেই। কিন্তু এটুকু জানি, স্বাধীনতার অনেক আগে, অর্থাৎ ব্রিটিশ-রাজত্বেই এই দোকানের পথ চলা শুরু। আমার দাদু উত্তরপ্রদেশ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন বিশ শতকের গোড়ায়। ১৯৪০ সালে আমি যখন জন্মাই, তখন এই দোকান রমরমিয়ে চলছে।

    বাবার একটা পুরনো ডায়েরি আছে; সেখানে দেখেছি, অনেক বই-পত্রপত্রিকার নাম লেখা, যেগুলো বাইরে থেকে আনাতে হত। মূলত ব্রিটিশরা ছিলেন সেসব বইয়ের ক্রেতা। বই পাঠানোর প্রসঙ্গে একবার ত্রিপুরার রাজার কথাও লেখা আছে ডায়েরিতে। তামাকের দোকানটা বিক্রি হয়ে যায় ১৯৫৮ সালে, কিন্তু বইয়ের দোকানটা যে কবে বিক্রি হয়েছিল, সেটা আমার মনে নেই। 

    বাবার এই বইয়ের দোকান যে কোন সালে তৈরি, সেই তথ্য আমার কাছে নেই। কিন্তু এটুকু জানি, স্বাধীনতার অনেক আগে, অর্থাৎ, ব্রিটিশ-রাজত্বেই এই দোকানের পথ চলা শুরু। আমার দাদু উত্তরপ্রদেশ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন বিশ শতকের গোড়ায়। ১৯৪০ সালে আমি যখন জন্মাই, তখন এই দোকান রমরমিয়ে চলছে।

    ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সময়ে বাবা আমাদের উত্তরপ্রদেশের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পাঁচ বছর কাটিয়ে যখন আবার কলকাতায় আসি, তখন নিউ মার্কেট আমাদের কাছে ছিল একটা ওয়ান্ডারল্যান্ড। গ্রামের জীবনযাত্রা এতই সাধারণ ছিল, সেখানে বসে আমরা এই ধরনের মার্কেটের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। ফলে যখনই নিউ মার্কেটে আসতাম, ভাইবোনেরা সবাই দল বেঁধে এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াতাম।

    আরও পড়ুন : কেবল সত্যজিৎ নন, তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায়েরও প্রিয় জায়গা ছিল নিউ মার্কেট

    আমাদের জন্য মার্কেটের নানান খাবার রাখা থাকত, খেতাম। নাহুমের কেক পছন্দ করতাম খুব। সমস্ত দোকানই সে-সময়ে কাঠের পাল্লা দিয়ে বন্ধ করা হত, এটা স্পষ্ট মনে আছে। কেননা, অল্প বয়সে আমাদের ওই দৃশ্যটা দেখতে ভাল লাগত— কাঠের পাল্লা জুড়ে-জুড়ে দোকান বন্ধ হচ্ছে। পাল্লাগুলো একদম বাইরে রাখা থাকত, এখন যেখানে ব্যাগ বিক্রি হয়। সেগুলো নিয়ে আসতে হত ভেতরে। ছেলেবেলায় দু-একবার আমরাও বাবার দোকান ওভাবে বন্ধ করেছি। মজা লাগত খুব।

    সেই নিউ মার্কেটকে কি এখন আর চেনা যায়?

    সবাই বাবাকে ডাকতেন বাচ্চুবাবু বলে। বাবা রোজ সকাল ১১টার মধ্যে দোকান খুলে রাত আটটায় বন্ধ করতেন। আরও একটা জিনিস খেয়াল করতাম ছেলেবেলায়, বিভিন্ন দোকানদারের মধ্যে এক অপূর্ব আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। যখন বেশি খরিদ্দার থাকত না, তাঁরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতেন। আমরা গেলে, আমাদেরও পিছনে লাগত সবাই। মনে হত, গোটা নিউ মার্কেট চত্বরটাকেই কেউ যেন আনন্দের চাদরে মুড়ে রেখেছে। এখন যেমন ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক ঈর্ষা দেখা যায়, সেকালের নিউ মার্কেট ছিল এর একদম উলটো। দোকানদারদের কারও মধ্যে কোনও মালিন্য ছিল না। একে-অপরকে সম্মান করে চলতেন। যত বয়স বেড়েছে, বুঝেছি, এই পরিবেশটা চারপাশ থেকে আস্তে-আস্তে কখন যেন হারিয়ে গেছে।

    ১৫/১৬ বছর আগে আমি শেষবার নিউ মার্কেটে যাই। গিয়ে চিনতে পারিনি। যে-ছবি আমার মনের মধ্যে গাঁথা ছিল, তা এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেল কী করে? মনে আছে, ছেলেবেলার ওই রঙিন দুনিয়ায় বসে-বসে কল্পনা করতাম ব্রিটিশদের হগ মার্কেটকে। আর আপশোস করতাম, ওই সময়ের জৌলুস দেখতে পাইনি বলে। তখন কি ভেবেছিলাম, এই সময়েও আমায় আরও একবার কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে?

    ফাঁকা-ফাঁকা, রুচিশীল, পরিষ্কার আর রঙিন একটা বাজার, বাস্তবে যতই পালটে গিয়ে পুরনো হয়ে যাক, আমার কাছে চিরকালই ‘নতুন’ থাকবে…

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook