‘সোনালী রঙ করা লোহার খাঁচায় দোতলায় উঠে এসে মনে হলো স্বপ্নরাজ্যে এসেছি। মেঝের অনেকখানি জায়গা জুড়ে পাহাড় নদী ব্রিজ টানেল সিগন্যাল স্টেশন সমেত খেলার রেলগাড়ি এঁকেবেঁকে চক্কর মেরে চলেছে রেললাইন দিয়ে। এ ছাড়া ঘরের চারদিকে রয়েছে নানা রঙের বেলুন, রঙীন কাগজের শিকল, ঝালর, ফুল ফল আর চীনে লন্ঠন। তার উপরে রঙবেরঙের বল আর তারায় ভরা ক্রিসমাস ট্রি, আর যেটা সবচেয়ে বেশি চোখ টানছে — গালফোলা হাসি নিয়ে দাড়িমুখো লাল জামা লাল টুপি পরা তিন মানুষ সমান বড় ফাদার ক্রিসমাস।
খেলনা যা আছে তা সবই বিলিতি। তার মধ্যে থেকে আমাদের সাধ্যে কুলোয় এমন এক বাক্স ক্র্যাকার নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সেরকম ক্র্যাকার আজকাল আর নেই। তার যেমনই আওয়াজ, তেমনি সুন্দর তার ভিতরের খুদে খুদে জিনিসগুলো।
বড় আর বাহারের দোকান বলতে তখন যা ছিল তার বেশিরভাগই চৌরঙ্গীতে।’
সত্যজিৎ রায়ের ছেলেবেলার এই স্মৃতিচারণে বড় আর বাহারের দোকান বলতে মোটেই নিউ মার্কেটের কথা বলা হচ্ছে না। তিনি জানিয়েছিলেন, হোয়াইটআওয়ে লেইডল দোকানের কথা। সেটাও ছিল আজকালকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মতো। চৌরঙ্গিতে এখন যেখানে মেট্রো সিনেমা, তখন সেখানে ছিল ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার অফিস। তার পাশে সুরেন ব্যানার্জি রোডের মোড়ে ঘড়িওয়ালা বড় বাড়িটা ছিল হোয়াইটআওয়ে-র বাড়ি। এখনও বাড়িটা আছে, কিন্তু দোকান উঠে গেছে অনেককাল আগে। তারপরই সত্যজিতের প্রিয় দোকান বা বাজার বলতে হয়ে উঠেছিল— নিউ মার্কেট।
যখন ডি জে কিমারে কাজ করতেন, তখন থেকে সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছিল নিউ মার্কেট। অফিস থেকে ধর্মতলার কফি হাউসে যাওয়ার পথে একবার ঢুঁ মারতেন নিউ মার্কেটে কালীচরণ আর অন্যান্য বিদেশি বই ও ম্যাগাজিনের দোকানে। সেইসব দোকানে বাছাই বিদেশি বইয়ের পাশাপাশি সমুদ্র পেরিয়ে আসা বিচিত্র সব ম্যাগাজিনের পশরার আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়া যেত না। যখনই কলকাতার বইয়ের দোকানের কথা কেউ লিখেছেন, কেন জানি না, এই দোকানগুলির উল্লেখ কেউই করতেন না। সত্যজিতের কাছে এই দোকানগুলি এতটাই প্রিয় ছিল, নিজের লেখা বেশ কয়েকটি গল্পে তার উল্লেখ করতে ভোলেননি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, ১৯৬৩-তে ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’ গল্পটি শুরুই হচ্ছে এই কালীচরণের দোকানের উল্লেখ করে। তিনি লিখছেন, ‘নিউমার্কেটের কালীচরণের দোকান থেকে প্রতি সোমবার আপিস-ফেরতা বই কিনে বাড়ি ফেরেন বিপিন চৌধুরী। যত রাজ্যের ডিটেকটিভ বই, রহস্যের বই, ভূতের গল্প। একসঙ্গে অন্তত খান পাঁচেক বই না কিনলে তাঁর এক সপ্তাহের খোরাক হয় না।’
আরও পড়ুন : তরুণ দলাই লামাকে আমি প্রথম বাবার দোকানেই বই কিনতে দেখি…
নিউ মার্কেটের কথা সবিস্তারে তিনি লিখেছিলেন জটায়ুর বলা বিবরণে। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে জটায়ুর কথা দিয়ে— ‘রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর মতে হগ সাহেবের বাজারের মতো বাজার নাকি ভূ-ভারতে নেই।’
যারা জানে না, তাদের জন্য বলা দরকার যে, হগ সাহেবের বাজার হল, আমরা যাকে নিউ মার্কেট বলি, তারই আদি নাম। ‘দিল্লি, বোম্বাই, যোধপুর, জয়পুর, সিমলা, কাশী— সবই তো দেখলুম, আর আপনাদের সঙ্গেই দেখলুম, কিন্তু আন্ডার দি সেম রুফ এমন একটা বাজার কোথাও দেখেছেন কি?’
এ-ব্যাপারে অবিশ্যি আমি আর ফেলুদা দু’জনেই লালমোহনবাবুর সঙ্গে একমত। মাঝে একটা কথা হয়েছিল যে, এই মার্কেট ভেঙে ফেলে সেখানে একটা মাল্টি-স্টোরি সুপার মার্কেট তৈরি হবে। ফেলুদা তো শুনেই ফায়ার। বলল, ‘এ কাজটা হলে কলকাতার অর্ধেক কলকাতাত্ব চলে যাবে সেটা কি এরা বুঝতে পারছে না? নগরবাসীদের কর্তব্য প্রয়োজনে অনশন করে এই ধ্বংসের পথ বন্ধ করা।’
‘আমরা তিনজন গ্লোবে ম্যাটিনিতে এপ অ্যান্ড সুপার এপ দেখে বাইরে এসে নিউ মার্কেটে যাব বলে স্থির করেছি। লালমোহনবাবুর টর্চের ব্যাটারি আর ডট পেনের রিফিল কেনা দরকার, আর ফেলুদাও বলল কলিমুদ্দির দোকান থেকে ডালমুট নিয়ে নেবে; বাড়ির ডালমুট মিইয়ে গেছে, অথচ চায়ের সঙ্গে ওটা চাই-ই চাই। তা ছাড়া লালমোহনবাবুর একবার মার্কেটটা ঘুরে দেখা দরকার, কারণ কালই নাকি এই মার্কেটকে সেন্টার করে একটা ভাল ভূতুড়ে গল্পের প্লট ওঁর মাথায় এসেছে।’
প্লটটা হচ্ছে— ‘একজন লোক রাত্তিরে মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবার পরে দেখে কী, সে ভিতরে আটকা পড়ে গেছে। লোকটা রিটায়ার্ড জজ— অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। বোঝো তপেশ— এই বিশাল হগ সাহেবের বাজার, সব দোকান বন্ধ, সব বাতি নিভে গেছে, শুধু লিন্ডসে স্ট্রিটের দিকের কোল্যাপ্সিবল গেটের ভিতর দিয়ে আসা রাস্তার ক্ষীণ আলোয় যেটুকু দেখা যায়। গলিগুলোর এ মাথা থেকে ও মাথা খাঁ খাঁ করছে, আর তারই মধ্যে কেবল একটিমাত্র দোকান খোলা, একটা কিউরিওর দোকান, তাতে টিমটিমে আলো, আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা কঙ্কাল, হাতে ছোৱা৷ খুনির কঙ্কাল, যে খুনিকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিলেন ওই জজ সাহেব। যে দিকেই পালাতে যান, মোড় ঘুরেই দেখেন সামনে সেই কঙ্কাল, হাতে ছোৱা, ড্রিপিং উইথ ব্লাড।’
এর পরেই সত্যজিৎ মার্কেটের বর্ণনায় জানাচ্ছেন, ‘সামনেই মোহনস্-এর কাপড়ের দোকানের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে, বাঁয়ে ঘুরে গুলাবের ঘড়ির দোকান পেরিয়ে ডাইনে একটু গেলেই একটা তেমাথার মোড়ে ইলেকট্রিক্যাল গুডসের দোকান। ব্যাটারি সেইখানেই পাওয়া যাবে, আর তার উলটোদিকেই পাওয়া যাবে রিফিল। দে ইলেকট্রিক্যালসের মালিক ফেলুদার ভক্ত, দেখেই একগাল হেসে নমস্কার করলেন।’
এই বিবরণ থেকে বোঝা যায় সত্যজিৎ কতটা পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিউ মার্কেটের ভূগোলটা জানতেন।
নিউ মার্কেটের শুরুটা কিন্তু খুব সহজভাবে হয়নি। একটা সময় মধ্য কলকাতায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত, ন্যায্য দামের বাজার বলতে তেমন একটা ছিল না। সাহেবতলায় তখন যে দুটো বাজার ছিল, তার একটা হল লালবাজার পুলিশ অফিসের উত্তরে টিরেট্টা বাজার, যাকে বিকৃত উচ্চারণে আমরা বলি টেরিটি বাজার। যে বাজার এখনও চালু। দ্বিতীয় বাজারটি হল ধর্মতলা মার্কেট। এটি ছিল চৌরঙ্গি আর ধর্মতলার কোণে এখনকার মসজিদ-লাগোয়া অঞ্চলে।এর মালিক ছিলেন সেকালের ধনী বাঙালি হীরালাল শীল। এই বাজারটি ছিল চারিদিকে বাড়িঘর-ঘেরা একটা ঘিঞ্জি বাজার। একে নোংরা, ঘিঞ্জি, তার ওপর গলাকাটা দামে খদ্দেররা বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। এইসব অব্যবস্থার কারণেই তখনকার বেশ কিছু ইংরেজ মিউনিসিপ্যালিটির কাছে চিঠি লিখে নালিশ করেন। এর ফলেই তৈরি হয়েছিল নিউ মার্কেট। যদিও এর মাঝে অনেক তর্ক-বিতর্ক, মামলা-মোকদ্দমা ঘটে গিয়েছিল। তবে নতুন বাজার তৈরিতে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন কলকাতা পুরসভার সভাপতি ও পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ। এই বাজারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ন্যায্য দামে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে সবরকমের মাছ-মাংস, তরিতরকারি আর নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র জোগান দেওয়া। অচিরেই বাজারটি তখনকার সাহেব-মেমদের প্রিয় হয়ে ওঠে। পরে উচ্চবিত্ত বাঙালিদেরও। যত দিন যেতে লাগল, বাজারটি আয়তনে আর স্টলের সংখ্যায় বেড়ে শুধু দরকারি জিনিসপত্র নয়, পৃথিবীর সবরকম জিনিসের সুপারমার্কেটে পরিণত হয়।
কথায় বলে নিউ মার্কেটে ‘আলপিন টু এলিফ্যান্ট’ সব পাওয়া যায়। তবে বলতে দ্বিধা নেই, ক্রমশ নিউ মার্কেট শুধু দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্ট নয়, স্থানীয়দের কাছেও অবশ্য-দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে। নিউ মার্কেটে সবকিছু পাওয়া যায় বলতে মনে পড়ে যায়, সত্যজিতের ‘মহাপুরুষ’ ফিল্মের সেই দৃশ্যটির কথা। ভণ্ড গুরু, বিরিঞ্চিবাবা ঘাঁটি গেড়েছে সহজ-সরল ধনী অ্যাডভোকেট গুরুপদ মিত্তিরের বাড়িতে। বিরিঞ্চিবাবার সুবিধে-অসুবিধের খোঁজ করতে এসে গুরুপদ জানতে চেয়েছেন, তাঁর কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না? উত্তরে ‘মহাপুরুষ’-টি বলেন, ‘তুমি তো তোমার সাধ্যমতো সবই করছ। আর আহারাদির কথা যদি বলো, আমি কি তোমার কাছ থেকে জলহস্তীর রোস্ট খেতে চাইব? কারণ আমি জানি, ওটা তোমার সাধ্যের অতীত!’ তিনি জানান, ‘জলহস্তীর রোস্ট বড় মুখরোচক।’ তিনি নাকি ‘স্টোন এজ’-এ অনেক খেয়েছিলেন!
গুরুপদর নায়েব, গণেশ সব শুনে বলে ওঠেন, ‘স্থলহস্তী হলে একটু সুবিধা হত।’ তবে জলহস্তীও পাওয়া যাবে, কারণ, নিউ মার্কেটে তো ইদানীং সব জিনিসই পাওয়া যাচ্ছে।
হাতি বা জলহস্তী না পাওয়া গেলেও এই বাজারে একদা কুকুর, খরগোশ বা অন্যান্য জীবজন্তু ছাড়াও লেপার্ড আর কুমিরের ছানাও কিনতে পাওয়া যেত বলে শোনা গেছে। আর পাওয়া যায় শৌখিন পাখি। পাখি বলতে মনে পড়ে গেল, সত্যজিতের আরেকটি ছবিতে নিউ মার্কেটের পাখির বাজারের দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। সিদ্ধার্থ আর তার বন্ধু আদিনাথ নিউ মার্কেটে একটি বিশেষ ধরনের পাখি খুঁজতে যায়। মুরগি থেকে শুরু করে অসংখ্য বিচিত্ররকমের পাখি দেখা গিয়েছিল সেই দৃশ্যে। ছবির নাম ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’।
কেবল সত্যজিৎ নন, তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায়েরও প্রিয় জায়গা ছিল নিউ মার্কেট। সেখানকার কসমেটিক্সের দোকানে বিদেশি পারফিউমের সন্ধানে যেতেন। একবার নিউমার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটি দোকান থেকে খুঁজে পেয়েছিলেন ‘আগন্তুক’ ছবির প্রয়োজনে একটি বিশেষ ধরনের টেবল ঘড়ি।
এখন আর এই বাজারটি দেখে বোঝার উপায় নেই, এশিয়ার প্রথম বিভাগীয় বিপণিটি ছিল কলকাতার গর্ববিশেষ। এমন বিচিত্র বাজারের জৌলুস হয়তো কমেছে দিনে দিনে, কিন্তু ইতিহাসে এখনও জ্বলজ্বল করে এর গরিমার চিহ্ন।