শীতের দুপুরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বেজায় ভিড়, তাই আগত ভিনরাজ্যের বহু মানুষের ওপর রাগ করাটা ঠিক হবে না বোধ হয়। কারণ, বেঙ্গল বিয়েনালের এক অমূল্য সম্পদ দেখার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে দরবার হলে। অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, সুনয়নী দেবী। তৃতীয় শিল্পী প্রথম দু’জনের বোন। যে শিল্পীরা আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলাকে দিশা দেখিয়েছিলেন, উনি তাঁদের অন্যতম। অথচ ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, রাজা রামমোহন রায়ের নাতির স্ত্রী, ওঁর সম্পর্কে সাধারণভাবে এর বেশি কথা জানা যায় না। বাংলার নবজাগরণের সাক্ষী, স্বশিক্ষিত শিল্পী উনি। আটপৌরে বাঙালি জীবন, পুরাণ, এইসব নিয়ে তিরিশ বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু। সহজিয়া সুরের, আলতো স্পর্শের কাজ ওঁর। Mukula-Ma-Ke-Didima, Lady-With-Flower দেখার সুযোগ পাওয়া গেল এখানে।
নতুন করে অবনীন্দ্রনাথের চিত্র বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। প্রদর্শনীর মধ্যে আছেন ‘ভারতমাতা।’ আছে আরব্য রজনী সিরিজের মনিমুক্তো। সিন্দবাদ, হারুন অল রশিদ, আলাদিন। এক মা তার শিশুসন্তানকে গল্পে শোনা চরিত্রদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রদর্শনীর বড় সার্থকতা। রয়েছে ‘The Hunchback of Fishbone’, একই স্টাইল। কিন্তু গল্পটা অন্য। ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোং’-এর লোকজন আলোকিত ঘরে ফুর্তি করছেন, সারছেন খানাপিনা। পাশের বাড়ির প্রায়ান্ধকার ঘরে অন্য ঘটনা ঘটছে। অতি সূক্ষ্ম, পেলব তুলি ওঁর। স্বপ্নের মতো। ওঁর লেখাও তাই। যদিও ছবির কাহিনি প্রায়ই বেয়াড়া ইঙ্গিত দিয়ে চলে। দেখে আজকের গ্রাফিক নভেল শিল্পীরা নতজানু হতে দ্বিধা করবেন না। আশ্চর্য লোক এই অবন ঠাকুর। এই একবার চৈনিক, কখনও মুঘল মিনিয়েচার, কখনও খেয়ালখুশির লাইন ড্রইং, কী না করেছেন ছবি নিয়ে! হেভিওয়েট কাকা বিশ্বজয় করলেন। উনি ডুবে রইলেন অল্প কিছু লেখা আর তুমুল রেখার রোমান্স নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের চাপ থাকা সত্ত্বেও নিজের ক্যানভাসে ছড়ি ঘুরিয়ে গেলেন আর-এক ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ। ওই আমলে লোক চিনল কার্টুনিস্ট হিসেবে। যেটা সম্ভবত জানত না, তা হল, পাবলো পিকাসোর ঢের আগেই রেখে গেছেন কিউবিস্ট ফর্মের অজস্র কাজ। প্রাচ্যের জলরং পদ্ধতিতে আঁকা মায়াবী ছবি তো বটেই, গগন ঠাকুরের ওজনটা আরও বেশি টের পাওয়া যায় দুরন্ত সাদা-কালোতে। যে কোনও কারণেই হোক, ছবির টাইটেল এঁরা দিতেন ইংরেজিতে। ‘Song of the Dawn’, ‘Only in the Night’, ‘Dwarka Puri’, ‘Seven Champa Brothers’, ‘The Palace of Snow’, ‘Flower Girl’, ‘Evening Star’, ‘The Scene of Dawn’, ‘Spirit of the Night’, ‘Ladies Parlour’, একঝাঁক জবরদস্ত, বিখ্যাত ছবি এই প্রদর্শনীতে।
এর পরেও আক্ষেপ থেকে যায়। সবই ছোট ছোট কাজ। প্রচুর ডিটেইল। নিরাপত্তা-বেষ্টনীর বাইরে, যে দূরত্ব থেকে দেখতে হচ্ছে, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। সম্ভাব্য দর্শকদের জন্য উপদেশ, ক্লোজ ফোকাস বাইনোকুলার সঙ্গে রাখুন। ভিড়ের উপদ্রব কমাতে নিরাপত্তারক্ষীদের তাড়া খেয়ে, ধমক শুনে কষ্ট পাবেন না। ছবি তোলা নিষিদ্ধ। পাশের ঘরে এই উৎসবের আরেকটি অংশ রয়েছে তা সহজে বোঝা যায় না। কিন্তু আছে।
ক্যান্ডিড ফোটোগ্রাফির জনক হেনরি কার্তিয়ের ব্রেঁস-র কাজের একটি সংকলন রয়েছে মূল ঘরের পাশের গলি ঘরে। শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে তোলা ‘In the Presence of the Eternal’, সাদা-কালো। ব্যাকলিট। ১৯৫০ সালের ছবি। শ্রীঅরবিন্দ এবং মাদার। আশ্রমের পরিবেশ, কর্মকাণ্ড, ভক্ত সমাবেশ, আধ্যাত্মিকতা। এই দুষ্প্রাপ্য ছবি তোলার অনুমতি পেতে ব্রেঁস-কে নাকি প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। পশ্চিমি দুনিয়া ঠিক কীসের আগ্রহে, অনুসন্ধানে ভারতবর্ষে আসে তার পরিচয় এখানে। অন্তর্দৃষ্টিমূলক, সময় থমকে রাখা প্রত্যাশিত ব্রেঁস। এই সিরিজের পরেই ‘Threads of the Ramayana, A Kantha chronicle’ দেখা কিঞ্চিৎ অস্বস্তির। মেজাজটা একেবারেই অন্য যে। বাংলাভাষী মানুষের কাছে কাঁথার মহিমা কীর্তন করার দরকার নেই। কিন্তু প্রদর্শনীতে দেখতে পাওয়া পিসগুলি অপূর্ব। আর্টফর্ম হিসেবে কাঁথা দেখার সুযোগ কোথায়? বেঁচে থাকা, না থাকা, বাঁচতে চাওয়া, বা না পারা, নিজেদের জীবনের জিগস পাজল্ জুড়েই রামায়ণ। আমাদের যাবতীয় অনুভূতি, মন-শরীরের তাপ-উত্তাপের সুতোয় বোনা ছবির জন্য কাঁথা এক আদর্শ ক্যানভাস হয়ে উঠেছে; সেটাই স্বাভাবিক।
ভিক্টোরিয়ার দক্ষিণ দরজার বাইরে এই চত্বরের সবচেয়ে আকর্ষক আর্টটি রয়েছে। পরেশ মাইতির ভাস্কর্য, ‘Urbanscape’, ব্রোঞ্জের তৈরি, শায়িত, এক সুবিশাল কাঁঠাল। স্বাভাবিক, আসল ফলটির চেয়ে বহুগুণ বর্ধিত। অতএব, তার বর্শা অধ্যুষিত বর্মটি দেখলেই ভয় করে। যেন এক অতি ভারী, স্থবির, জরোদ্গব নগর দেহ, সর্বাঙ্গ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে ধারালো হাইরাইজ, না কি মনের, দেখার ভুল?
কাছেই গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শনশালা। সেখানে আমাদের সবার চেনা বাঙালি আর্টের প্রিয় জ্যাঠামশাই যামিনী রায়। কিছুদিন আগেই হইচই পড়ে গিয়েছিল তাঁর আসল বা নকল শিল্পের প্রদর্শনী নিয়ে। তবে এগুলি নিশ্চিতভাবে অরিজিনাল। রাজ্য চারুকলা বিভাগের নিজস্ব সংগ্রহ। কেউ বলেন গ্লোরিফায়েড পটুয়া। তবে এমন সুললিত বিভঙ্গ, চোখের টান, রঙে মাটির গন্ধ, সর্বোপরি পরবর্তীকালের বহু শিল্পীর কাজের ওপর প্রভাব, অস্বীকার করার উপায় নেই। ইউনেস্কো পুরস্কৃত কলকাতার দুর্গার নব চেহারায়, চোখে ক্রমাগত যামিনী। ‘সোনার কেল্লা’-য় ফেলুদার বসার ঘরেও, সেই যামিনী রায়।
পাশের বাড়ি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস। পিছনের এক রহস্যময় সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছত্রপতি দত্তর ‘শ্যাডো লাইন্স।’ অন্ধকার ঘর। ইনস্টলেশনের গভীরে লুকিয়ে আছে দেশভাগের, বিভাজনের বিষাক্ত স্মৃতি। যা আজও কাটাকুটি করে চলেছে আমাদের মনকে। এক ভয়ংকর বোঝা, মাথা তুলতে দেয় না স্মৃতিভারকে উপেক্ষা করে। চলমান স্পটলাইটের তলায় একটা রেললাইন। কোথা থেকে এসেছে, কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। তবে নিশ্চিতভাবে বুঝিয়ে দেয়, যেদিকেই যেতে চাও, যাত্রা থেমে যাবে এক ভয়ংকর বাফারে। যদি যেতেই হয়, যেতে হবে নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারে, ব্লাইন্ডফোল্ডেড, মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা সারি সারি বুকের পাঁজরের মধ্য দিয়ে।
একতলায় মালবিকা ব্যানার্জির ঝলমলে কিউরেশন, ‘সেলফি’, শিল্পী যখন তৃতীয় পুরুষ। সমকালীন দুনিয়া নিজেকে ক্রমাগত আবিষ্কার করে চলেছে সেলফোনে তোলা আত্মপ্রকৃতির মাধ্যমে। অঙ্কন শিল্পীরা এগিয়ে থাকেন সময়ের চেয়ে। বরাবরই। আপন স্বাধীনতায়, খেয়ালে, যেভাবে খুশি এঁকে ফেলেন নিজেকে বা আপন পরিচয়ের ব্যক্তিগত সংজ্ঞাকে। জমকালো আর্টিস্ট সম্মেলন। অতুল দধিয়া, গোবর্ধন আশ, জয়শ্রী বর্মণ, জ্যোতি ভাট, মনু পারেখ, এম এফ হুসেন, রবিন মন্ডল, আরও অনেকে। পরিতোষ সেনের নামটা আলাদা রাখলাম। কেন, দেখলেই বুঝবেন।
পরের ঘরে আবার অন্ধকার। সুদর্শন শেঠীর ‘ওয়ান লাইফ মেনি।’ ইনস্টলেশন। ছোট্ট জায়গায় অনেক খানি জীবন। টুকরো ছবি, অচেনা অবজেক্টস, বাস্তব ও পরাবাস্তবের মধ্যে যোগাযোগ। বিচিত্র পরিবর্তনের আভাস। কাঠের সিনেমা প্রোজেক্টর, ফাইবার গ্লাসের ঝুলন্ত ক্যারকাস, মাটিতে নেমে আসা সিলিং ফ্যান, পুতুল ঘোড়ার কঙ্কাল। ভিডিও রয়েছে। ভাগবত পুরাণ, নারদ, বিষ্ণুর যোগাযোগের উল্লেখ, আজকের ভাবনায়। আজব এক রহস্যময়তা যা সহজে দর্শককে ছুটি দিতে নারাজ।
তিব্বত লোকচক্ষুর আড়ালে এক আজও অচেনা এক পৃথিবী। পলা সেনগুপ্ত ও সুজয় দাসের ‘ইনটু একজাইল- দ্য টিবেটান প্রেডিকামেন্ট’ তেমনই এক লুকিয়ে থাকা উপস্থাপনা। গ্যালারির শেষ প্রান্তে, ঘর গলি পেরিয়ে। প্রথমেই এক ‘এলেম নতুন দেশে’-র জগৎ। অতি যত্নে তৈরি করা নিমীলিত আলোতে হৃদয় স্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে পর পর ঘূর্ণায়মান ধর্মচক্রে। দীর্ঘ এক স্ক্রোল, যাত্রাপথের উপকথা। কাচের বাক্সের ভেতর হৃদয় খাঁ খাঁ করা পুতুল মানব মানবীরা। দেখতে হবে কাচের ওপর ছাপাই কাহিনীর মধ্যে দিয়ে। আজব এক ত্রিমাত্রিকতা। তিব্বতি পরিযানের চেনা দুঃখ, চেনা সুখের প্রায় নিস্তব্ধ এক কল্পদৃশ্য আবৃত্তির পাঠন। কলকাতার আর্ট গ্যালারি কক্ষটি হয়ে উঠেছে এক কাল্পনিক মনাস্ট্রি। কল্পনার বিস্তার যাতে দুর্বোধ্য না হয়ে ওঠে, কঠিন বাস্তবে ফিরিয়ে আনার অভিপ্রায়ে চলছে সাদা চোখে দেখা এই মানুষের অজস্র রঙিন ছবির প্রেজেন্টেশন। ভিডিও প্রোজেকশনে। নিঃসন্দেহে এবারের বেঙ্গল বিয়েনালের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি।
পার্ক স্ট্রিটের ট্রিঙ্কা’জ-ও রয়েছে তালিকায়। লুই ব্যাঙ্কস খ্যাতিমান জ্যাজ শিল্পী, ইলেক্ট্রনিক মিউজিক কম্পোজিশনের জগতে বড় নাম। উনি ছবিতেও আছেন। এক অতি ক্ষুদ্র চিত্রসমষ্টিতে ওনার ট্রেডমার্ক সংগীতের আবহ।
ডোভার লেনের এক নিঝুম বাড়ি ‘The Z’s Precinct’, ছোট্ট তিনখানি ঘরে তিনটি আলাদা ভিডিও প্রেজেন্টেশন। ‘বিটুইন মেমোরি অ্যান্ড মোশন।’ হেলিন বোজতেপ, জ্যাকব গটেল, কোরহান বাসারনের কাজ। আবার অতীত ও বর্তমানের সেতু নির্মাণ। সঙ্গে ইতিহাস, বিশ্বাস ও আপন ভাবনার জীবন দর্শন। শিল্পীদের বক্তব্য অনুযায়ী প্রবহমান জীবন স্রোতের সঙ্গে যুক্ত যাত্রাগুলি একমুখী নয়। বৃত্তাকার। ফিরে আসার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। সমকালে এবং অতীতে।
‘মিউজিয়াম অফ তানপুরা’, দয়ানিতা সিংয়ের ফোটোগ্রাফের ডালি। ভারতীয় মার্গসংগীতের আইকনদের স্টেজের বাইরের আলগা জীবন। অসামান্য, দুর্লভ সব মুহূর্ত। অল্প বয়েসের রশিদ খান, অজয় চক্রবর্তী, অনেকেই রয়েছেন প্যানেলে। চোহান ট্র্যাভেলসের বাসে তিন সপ্তাহ ধরে ভারত ভ্রমণের অবাক মুহূর্ত। বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্ব, তাস খেলছেন, বাসের মেঝেতে সিট খুলে ফেলে জোড়ামরি করে আড্ডা মারছেন, বেঁধে বেঁধে থাকছেন, প্রায় অবিশাস্য কল্পচিত্র। অনিবার্যভাবে চোখ টেনে নিচ্ছেন সদ্যপ্রয়াত জাকির হোসেন, একটি আলাদা প্যানেলে।