একটা এগ-মটন রোল
শহরের একটি নাম-করা দোকানে, রবিবার দুপুরে নীলা একটা কুর্তির ঝুল মাপছিল নিজের গায়ে ফেলে। আচমকা পাশ থেকে পরিচিত সেই কণ্ঠস্বর, ‘আরে! নীলাদেবী যে!’
নীলা একটু চমকে উঠলেও মুখ তোলে না, ‘কী ব্যাপার নীলাব্জ, নতুন গার্লফ্রেন্ড হল নাকি?’
নীলাব্জ : গার্লফ্রেন্ড? কেন?
নীলা : মেয়েদের জামাকাপড়ে তোমার কবে এত শখ জাগল শুনি?
নীলাব্জ : আরে না, না। আমি এই ক্যাফেটাতে এসেছিলাম। এই দোকানের যে-ক্যাফেটা…
নীলা : বাবা! বোনাস-ফোনাস পেলে নাকি? পাঁচশো টাকার প্যাটিস খেতে এলে এখানে?
নীলাব্জ : আসলে ক্লায়েন্টের উপর নির্ভর করে। দামি ক্লায়েন্টকে দামি কফি খাওয়াতে হয়।
নীলা : তা ঠিক।
নীলা কুর্তিটা হাত থেকে রেখে দেয়।
নীলাব্জ : ওমা! রেখে দিলে যে? ওটা তো ভালই মানিয়েছিল তোমাকে।
নীলা : দামটা ঠিক মানাচ্ছিল না।
নীলাব্জ : তোমার খুব তাড়া না থাকলে একটু বসি, না কি?
নীলা : বসে কী করবে? সেই তো কিছু একটা নিয়ে তুমুল ঝগড়া বাধাবে। অন্য কাউকে ধরো না, ঝগড়া করার জন্য।
নীলাব্জ হাসে। কিছু বলে না। দশটা মিনিট দোকানের বিভিন্ন জামাকাপড়ে হাত বোলানোর পর দুজনে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করে।
নীলাব্জ : তাহলে একটা ভাল এগ-মটন রোল খাওয়াই তোমাকে।
নীলা : না, এসব ফালতু খাবার খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি।
নীলাব্জ : ফালতু খাবার? রোল ফালতু খাবার?
নীলা : অবশ্যই। তেলে চপচপ, ময়দা, রেড মিট, চিলি সস… কোনটা ভাল?
নীলাব্জ : আহ্, ওরকম ভাবে কেউ দেখে নাকি? স্বাদটা কেমন বলো?
নীলা : সুস্বাদু বিষ। ওইসব খেয়ে মেডিক্যাল বিল বাড়াতে চাই না।
নীলাব্জ : যাসসালা! তাহলে চলো মিষ্টির দোকানে ঢুকি। যে-কোনও পাঁচ রকমের মিষ্টি আমি তোমাকে খাওয়াব।
নীলা : ওরে বাবা রে বাবা! শ্মশানেই নিয়ে চলো তাহলে। রোলের চাইতেও খারাপ ওই মিষ্টি। গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ আমার সব অর্গ্যান ড্যামেজ করে দেবে।
নীলাব্জ : তোমার কি তার কেটে গেল না কি? ডায়েট-ফায়েট করছ? বেশ রোগা-রোগাই তো আছ!
নীলা : আমি এই জঘন্য খাবারগুলোর থেকে দূরে থাকতে চাই। আমি সুস্থ থাকতে চাই। সুস্থ থাকতে চাওয়া কি অন্যায়, না পাগলের লক্ষণ?
নীলাব্জ : একদমই তা নয় কিন্তু এরকম খাবই না, একটা চরমপন্থী মনোভাব…
নীলা : লোভ সংবরণ করতে গেলে একটু কঠোর মনোভাব থাকা ভাল। নাহলে নিজের সিদ্ধান্তে অচল থাকা যায় না। দুনিয়া চায় তুমি বিপথে যাও। বিপথে যাবার হাজার প্রলোভন তোমার সামনে ছিটিয়ে রাখা আছে। রং মেখে প্রতিটি অস্বাস্থ্যকর খাদ্যদ্রব্য তোমাকে ডাকছে। এই দ্যাখো কোল্ড ড্রিঙ্ক। এই দ্যাখো বার্গার। এই দ্যাখো পিজ্জা। এই দ্যাখো চিপস। কোনওদিন দেখেছ আপেলের বিজ্ঞাপন? শসার বিজ্ঞাপন?
নীলাব্জ : ধ্যাত, ওসবের বিজ্ঞাপন করলে আরও দাম বেড়ে যেত। সাধারণ মানুষ কিনতে পারত না।
নীলা : সাধারণ মানুষের কথা কে ভাবে? তুমি তো নিজেই নেশার স্বপক্ষে তর্ক করতে গিয়ে বলেছিলে সরকার চায় সাধারণ মানুষ নেশা করে মরুক। সেই একই ভাবে কর্পোরেট চায়, মানুষ লোভ করুক, বাজে খাবার খাক, খেয়ে মরুক বা অসুস্থ হোক। অসুস্থ হলে ফার্মা কোম্পানিগুলোর রমরমা, নার্সিংহোমগুলোর রমরমা। ফার্মা কোম্পানিগুলোর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা ক্রনিক কোনও রোগ বাধিয়ে দিতে পারলে। আজীবনের গ্রাহক। দীর্ঘস্থায়ী রোজগার। আমাকে একদম সাধারণ মানুষ দেখাতে আসবে না। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। আমি মরলে, কালকেই আরও একশোটা নীলা জন্মাবে।
নীলাব্জ : তুমি তো দেখছি ভয়ানক মুডে আজকে। মানুষ হয়ে জন্মেছি, একটু লোভ করব না? মনুষ্যত্বের খুব বেসিক ব্যাপার, এই লোভ। লোভ আছে বলে কত মানুষ খেয়ে, পরে বাঁচছে সেটা দেখছ না? মিষ্টির দোকানে যারা কাজ করছে, প্যাকেট ফুডের কারখানায় কত শ্রমিক কাজ করছে, তাদেরও তো সংসার আছে। ব্যাংকিং সেক্টর পুরোটাই তো মানুষের লোভের ওপর দাঁড়িয়ে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ লোন নেবে না? তুমি নাওনি?
নীলা : নিয়েছি, তবে নিজের পকেট বুঝে। গবেটের মতো নয়। সাধারণ মানুষের বোকামির ফায়দা তোলে চালাক ব্যবসায়ীরা। এই যে দেশজুড়ে এত চিট ফান্ড আর হাজার রকমের স্ক্যাম হয়, তা শুধুমাত্র মানুষের বোকামি আর লোভের জন্য। এদের কেউ বাঁচাতে পারবে না। এদের টাকার লোভ এতটাই যে, আরবিট কোনও পাঁচুগোপাল যদি এসে বলে আমি এক বছরে তোমার টাকা ডবল করে দেব, অমনি লোভীগুলো সাত-পাঁচ না ভেবেই ছুটবে সেখানে। তারপর টাকা মার গেলে মরাকান্না জুড়বে। আমার একদম দয়া হয় না এই মানুষগুলোর জন্য। এদের যাওয়াই উচিত। জানে না, কারোর টাকা এক বছরে ডবল করা সম্ভব নয়?
নীলাব্জ : আহ্! এরা গরিব মানুষ। এদের টাকা নেই, টাকা বাড়ানোর আর কোনও উপায়ও নেই। মাইনেতে চলে না। তাই চান্স নিয়ে দ্যাখে…
নীলা : গরিবের গল্প দেবে না একদম। এই লোভ মানুষের একদম ভেতরের জিনিস। বড়লোক ক্যাসিনোতে যাচ্ছে, টাকা হারছে। নিজের অযোগ্য ছেলেকে ডাক্তার করাবে বলে একে-ওকে ডোনেশন দিচ্ছে। সেই টাকা দালাল মেরে দিচ্ছে। তখন কাঁদতে বসছে। মধ্যবিত্ত শেয়ার বাজারে ফিউচার অপশন খেলছে কিন্তু ৯০% মানুষ লস করছে। এদের কী বলবে? আসল সমস্যাতে এসো, লোভ। রাতারাতি বড়লোক হবার। এদিকে সবাই জানে, রাতারাতি কিছু হয় না। ইন্টারনেটে গেলেই বিজ্ঞাপন দেখবে, ওজন কী করে কমাবেন। সবাই ক্লিক করছে, পড়ছে, জানছে, জেনেই চিপসের প্যাকেট কিনছে, মোগলাই পরোটা খাচ্ছে আর ঢকঢক করে মাল গিলছে। তারপর একদিন জিমে গিয়ে ভাবছে রাতারাতি রোগা হয়ে যাবে।
নীলাব্জ : তুমি তো রোগাই আছ, তাহলে এত চাপ নিচ্ছ কেন?
নীলা : রোগা আছি কারণ আমি প্রতিদিন এই লোভের ফাঁদ এড়িয়ে চলছি। প্রতিদিন চকচকে বিজ্ঞাপনগুলোকে মাড়িয়ে যেতে পারছি বলে। তুমি আমাকে একদিন রোল খাইয়ে সেই পরিশ্রমের পথ থেকে বিচ্যুত করতে চাইছ। বলতেই পারতে, চলো একটা টক দই খাই কিংবা দুটো কমলালেবু।
নীলাব্জ : এই রে, এবার তোমাকে আমার অল্প-অল্প ভয় করছে। সংযম ভাল, কিন্তু তুমি মানে…
নীলা : তুমি মানে কী?
নীলাব্জ : সন্ন্যাসী, নান এইসব হয়ে যাবে না তো? প্রেমে অ্যালার্জি, নেশা করবে না, এখন রোলের দোকানকে অভিশাপ দিচ্ছ, কী হয়েছে তোমার নীলা?
নীলা : মানুষের একটাই লক্ষ্য। গত বছরের চেয়ে আমি যেন উন্নততর হতে পারি। ইনক্রিমেন্ট। মিনিমাম ১০%। প্রথমেই স্বাস্থ্যের দিক, তারপর অর্থনৈতিক দিকটা, তারপর আরও অন্যান্য সব…
নীলাব্জ : বুঝেছি। নিৎশের উবারমেনশ হতে চাইছ তুমি। কিন্তু একদিন রোল খেলে তোমার এই সাধনার কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত কে জানে!
নীলা : ট্রিভিয়াল করে দিয়ো না ব্যাপারটা। রাতারাতি কিছু হয় না। এই একদিন-একদিনের সংযমই আমাদের লক্ষ্যে নিয়ে যাবে। তোমার লক্ষ্য কী, সেটা তুমি ভেবে বের করো। আমাকে এই অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে এসো না আর।
নীলাব্জ : সামান্য একটা রোল থেকে তুমি তোমার লক্ষ্য কীসব…
নীলা : আমার লক্ষ্য আমার কোলেস্টেরল, আমার লিপিড প্রোফাইল, আমার ইউরিক অ্যাসিড লেভেল, আমার ব্লাড প্রেশার, আমার ওজন, আমার ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন…
নীলাব্জ : বলছি শোনো না, আমি আজকে আসি। একটা নতুন টিউশনি নিয়েছি। পরে কথা হচ্ছে।
নীলা কিছু বলে না। একটা হালকা হাসি দেয়। নীলাব্জ কীরকম রুদ্ধশ্বাসে ব্যস্ত রাস্তাটা ক্রস করতে উদ্যত হয়, সেইদিকে তাকিয়ে থাকে।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী