শাফিকা (পাঁচ)
ধ্যান দিয়ে ঠোঙা বানাতে-বানাতেই, নতুন এক বাঁক এল শাফিকার জীবনে । ‘বাবা’র আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সে পৌঁছে গেল এক অন্য কলকাতায়, আঁকা ছবির প্রদর্শনী দেখতে; সঙ্গে তার মিয়াঁ ইসমাইল। কোলাজশিল্পী সুখবীর সিং নেহালকেই সে ‘বাবা’ বলে ডাকে। ইনি যে শুধু তার গুরু, তাই-ই নয়, একইসঙ্গে আল্লার দোয়ায় পাওয়া, সর্বশ্রেষ্ঠ এক উপহারস্বরূপ! আর সুখবীর সিং নেহালের কাছে শাফিকা যেন তাঁরই ক্যানভাস থেকে ঠিকরে পড়া, এক উজ্জ্বল দ্যুতি। সেদিনের সেই একরত্তি মেয়েটার মধ্যে কোলাজশিল্পী হয়ে ওঠার যে অমিত সম্ভাবনা তিনি দেখেছিলেন, তা যেন আজও লালন করে চলেছেন তিনি; তাঁর এক নিভৃত স্বপ্নের মতোই। এখনও তাঁর আশা যে, একদিন এক সফল শিল্পী হয়ে উঠবেই এই শাফিকা। যতবার তাকে টেনে রাখতে চেয়েছেন এই হয়ে-ওঠা জীবনের আঁতুড়ঘরে, ততবারই তো ছিটকে পড়েছে শাফিকা; পরিস্থিতিই নিয়ন্ত্রণ করেছে তার জীবনের গতি। ইশকুল ছাড়িয়ে দিয়ে সবজিওয়ালা ইসমাইলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, শাফিকার মা, সুর্মাবিবি। ইসমাইলের বড়বিবি এবং বাচ্চাদের সঙ্গেই ঘর করছে শাফিকা। গরুর দেখভাল, দেওয়ালজুড়ে ঘুঁটে দেওয়া এবং নিজের পেটের বাচ্চাদের সামলেই শাফিকার সংসার। ইসমাইল তাকে ভালোবাসলেও, এতগুলো হাঁ-মুখের অন্ন জোটাতে সে অক্ষম। নিরুপায় ইসমাইল টাকা চেয়ে তাঁর কাছে এসে দাঁড়ালে, এক তাড়া খবরের কাগজ তার হাতে দিয়ে সুখবীর বলেছেন, ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি করে তা থেকেই যেন পয়সা উপার্জন করে শাফিকা। সে-ব্যবস্থায় রাজি হওয়াতে একদিকে লাভই হয়েছে সুখবীরের। সবজিবেচা শেষ করে, সুখবীরের কাছে প্রায় প্রতিদিনই আসে ইসমাইল; ঠোঙা বানাবার কাগজ নিতে; তাই শাফিকার খবরও তিনি পেয়ে যান, তার কাছ থেকেই। ইসমাইল নিয়মিত তাঁর কাছে এলেও, শাফিকার পক্ষে সম্ভব হয় না, সূর্যপুর থেকে আবার এতদূর উজিয়ে তালতলায় আসা; তাছাড়াও বেশি সময় ধরে ঠোঙা না বানালে, দিনের দিন ওই কুড়ি-পঁচিশ টাকা হাতে আসাও কঠিন হয়ে পড়ে। ইসমাইলের ছোটবিবি শাফিকা এখন পরিণত এক নারী। ধীরস্থির, শান্ত। কারণ, শাফিকাকে নিয়ে তাঁর কাছে কক্ষনও কোনও অভিযোগ জানাইনি ইসমাইল; দারিদ্রে ডুবে থাকলেও, তার মুখেচোখেও তিনি দেখতে পেয়েছেন অদ্ভুত এক প্রশান্তির প্রলেপ। সেই ভরসাতেই একটা আমন্ত্রণপত্র ইসমাইলের হাতে দিয়ে বললেন, ‘দুজনেই এসো কিন্তু। অনেকের আঁকা নিয়ে ছবির প্রদর্শনী; আমার আঁকাও থাকবে।’
পার্ক সার্কাস স্টেশনে নেমে বড় রাস্তার দিকে না গিয়ে, পাশের একটা সরু গলির দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল ইসমাইল। শাফিকাও পা চালিয়ে এগিয়ে এসে, অনুরোধ করল, গলির দিক না ধরে, সুখবীরের বলে দেওয়া সেই বাসরাস্তা ধরেই সেখানে যাওয়ার জন্য। বেশি ভাড়া দিয়ে মিনিবাসেই উঠতে হল, কারণ ওই রুটে শুধু মিনিবাসই চলে। বিড়লা তারামণ্ডল স্টপেজে নেমে, দু’একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই তারা দেখিয়ে দিল, নাক-বরাবর সামনের ফুটপাথটাই। মস্ত বাগান দেওয়া সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালটা যে কার বাড়ি, সেটা অবশ্য আন্দাজ করতে পারল না তারা। পাঁচিলঘেঁষা নির্জন ওই ফুটপাথটা পার হতে-না-হতেই আরও একটা বাগান বাড়ি দেখতে পেল তারা। তবে এখানকার গেটটা বেশ হাট করে খোলা; ভেতরে পা রাখতেই, পাড়বাঁধানো একটা ফোয়ারা। নানা মানুষের জটলা গেটের বাইরেও। সেটা কি কোনও সিনেমা দেখার হল— দারোয়ানকে এমন এক প্রশ্ন সভয়ে করতেই সে বলল, ডানদিকে আর্ট গ্যালারি আর বাঁ-দিকে থিয়েটার হল। ‘বাবা’র বলে দেওয়া অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস নামটা, একবার নিজের মনেই বিড়বিড় করে নিয়ে, আমন্ত্রণপত্রটা পকেট থেকে বার করে দারোয়ানকে দেখাল; জানতে চাইল যে, সেখানে ঢুকতে টিকিটের দাম কত! ইসমাইলের দেওয়া কার্ডটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দারোয়ান বলল যে, সোজা গিয়ে বাঁ-দিকে— ওটাই নর্থ গ্যালারি; সেই সঙ্গে এও বলল যে, থিয়েটার দেখতে টিকিট লাগে; কিন্তু একজিবিশন দেখা ফ্রি-তে; আঙুল তুলে আবার নির্দেশ করল, গ্যালারিতে ঢোকবার মুখেই রাখা একটা পোস্টারের দিকেও। সেদিকে তাকাতেই আরও কিছু পোস্টারের সঙ্গে তারা দেখতে পেল, এমন একটা ছাপানো কাগজ, যেটাতে আরও কয়েকজনের সঙ্গে রয়েছে, সুখবীরের মুখেরও একটা ফোটো। শাফিকা অবাক হয়ে ভাবল যে, এত মানুষ ছবি আঁকে! আর সেসব দেখতে টিকিট কাটতে লাগে না! ইসমাইল স্বগতোক্তি করল, ‘বড়লোকদের যে কতরকম শখ!’
রেলিং-দেওয়া আরও একটা খোলা গেট পেরিয়ে, নর্থ গ্যালারির মুখটায় এসে দাঁড়াতেই, সুখবীরই দেখতে পেলেন তাদের। বাইরের সেই ফোয়ারার দিকের দেওয়ালটা জাফরিকাটা; দাঁড় করানো বন্ধ ছাতার বাঁকানো ডাঁটিটা মুঠোয় ধরে, সেখানে রাখা লম্বা একটা চেয়ারে বসে ছিলেন সুখবীর; চেয়ার ঠিক নয়; অনেকটা যেন পার্কে রাখা লোহার চেয়ারগুলোর মতো; কিন্তু এর কারুকাজ দেখে বোঝা যায় যে, খুবই শৌখিন নকশায় এবং দেদার পয়সা ঢেলে বানানো; আর সেই বেঞ্চিটার সামনে রাখা শ্বেতপাথরের বড় একটা গোলটেবিলও। তাদের দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে, সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন সুখবীর। দুটো সিঁড়ি উঠে যেতেই, তাঁকেই অনুসরণ করল শাফিকা ও ইসমাইল। সিঁড়ির দু’পাশের ছড়ানো কোনাদুটোতেও সাজানো রয়েছে, পাথরের দুটো মূর্তি; সেগুলোর উচ্চতা তো চার-পাঁচ ফুটের কম নয়ই; পায়ের নীচে সিমেন্ট-বাঁধানো মেঝে এবং মাথার ওপর প্রায় দেড়তলা সমান ঢালাই করা ছাদ— এ-দুটোই এমন মজবুত করে বানানো যে ঝড়-জল বা বাজ কোনও কিছুরই উৎপাত ঘটবে না সহজে। এমন জায়গা তো তারা দেখেইনি কখনও। সুখবীরজির সঙ্গে পায়ে-পায়ে হেঁটে তারা ঘুরে বেড়াতে লাগল এমন এক কক্ষে, যেখানে অনেক লোক একসঙ্গে ছবি দেখলেও, কেউ কোনও শব্দ করছে না। ইসামাইল আন্দাজ করল যে, একটা টেবিলের চারপাশে কয়েকটা চেয়ার সাজিয়ে বসে, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছে যারা, তারাই এঁকেছে এসব ছবি; বাকিরা সব তার আর শাফিকার মতোই, ‘আমন্ত্রিত’; এত লোক এসেছে শুধু ছবি দেখতে! গলায় ক্যামেরা ঝোলানো কয়েকটা লোক এসে আবার ইন্টারভিউ করতে চাইছে সুখবীরের। অন্যদের দিকে আঙুল নির্দেশ করে, তিনি আবার হাঁটতে শুরু করছেন শাফিকাকে নিয়ে। এক-একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়েই শাফিকা তো একেবারে আঠার মতোই সেঁটে যাচ্ছে। কোনও তাড়া কি সুখবীরেরও আছে? শাফিকা যেভাবে প্রত্যেকটা ছবিই খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে, তাতে তো বেশ অধৈর্যই হয়ে পড়ছে ইসমাইল। ইতিমধ্যেই তিন-চারবার পাক খাওয়াও তো হয়ে গেল তার; আর কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে! এমনকী সে দেখে ফেলেছে, ওপাশের অন্য চারটে গ্যালারিও। ছবি টাঙানোর ঘরগুলোকেই যে গ্যালারি বলে, সেটাও সে জেনে নিয়েছে ঘুরতে-ঘুরতেই।
ছবি দেখা শেষ হলে, সেই হলটা থেকে বেরিয়ে, বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে সুখবীরের সঙ্গে তারাও এগিয়ে গেল, ক্যান্টিনের দিকে। তাদের হাতে চা আর ফিস রোল ধরিয়ে দিয়ে, নিজে শুধু এক ভাঁড় চা নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কেমন লাগল তোমাদের!’ ইসমাইল চুপ করে আছে দেখে শাফিকা তার প্রতিক্রিয়া জানাতেই, একেবারে চুপ করে গেলেন সুখবীর। আশ্চর্য হয়ে গেলেন শাফিকার মন্তব্যে! কী করে এমন চোখ তৈরি হল শাফিকার! তাঁর আঁকাগুলো বাদ দিয়ে আর যে-চারটে ছবির কথা সে বলল, সেগুলোই তো এ-প্রদর্শনীর সেরা কাজ! শিল্পী হিসেবে তাঁরা তো ইতিমধ্যেই বেশ নামও করেছেন! ছবির বিষয়বস্তু, রঙের ব্যবহার, কম্পোজিশন এবং সব মিলিয়ে তার ইমপ্যাক্ট— একেবারে পাকা সমঝদারের মতোই বলে গেল শাফিকা। সুখবীরের অনুরোধে আরও একবার গিয়ে, আবার তারা এসে দাঁড়াল সেই হলটাতেই। শাফিকা আর ইসমাইলকে কাছে ডেকে, নিজে থেকেই ওই চারজন শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুখবীর বললেন, ‘এঁরা হলেন গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, গণেশ হালুই আর ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত।’ লজ্জায় জড়ো হয়ে যাওয়া শাফিকা তার নিজের মুখটা নীচু করে থাকলেও, বেশ সপ্রতিভ হেসেই কিন্তু আলাপ করল ইসমাইল; তাদের পরিচয় দিয়ে সুখবীর যখন বললেন যে, এরা দুজন তাঁর মেয়ে এবং জামাই— সে-পরিচয়টুকুও বেশ গর্বের সঙ্গে গ্রহণও করল তার মিয়াঁ। তাঁদের পা ছুঁয়ে সকলকেই প্রণাম করল শাফিকা। ফেরবার সময়, গেট অবধি এসে তাদের একটু দাঁড়াতে বললেন সুখবীর। নিজের মুঠো আলগা করে তাঁর সেই ছাতাখানি ধরতে বললেন শাফিকাকে; নিজের বুকের ওপর দিয়ে আনা, কাঁধ থেকে কোনাকুনি করে ঝোলানো, কাপড়ের ঝোলাটার ভেতর হাত গলিয়ে মানিব্যাগ হাতড়ে, তা থেকে বের করলেন, একশো টাকার একটা নোট; ইসমাইলের পাঞ্জাবির বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে তাকে বললেন, ট্যাক্সি ধরে স্টেশনে পৌঁছতে; কারণ ফেরার বাসে ভিড় হবে খুব।
ট্যাক্সিতে উঠেই, শাফিকা বলল, ‘আমি আবার আঁকব; আমাকে আঁকতেই হবে; দেখলে না, বাবা কেমন অপেক্ষা করে আছেন!’ শুনেই সে হেসে উঠে বলল, ‘আঁকবে মানে? এসব তো শিক্ষিত আর বড়লোকদের ব্যাপার!’
‘সে আমি জানি না; আমি আঁকব; শুরু করব নতুন ভাবে।’
‘আর সংসার! রসুই, গরু, বাচ্চাদের দেখভাল— সেসব তো আমি পারব না।’
‘সব সামলে নেব আমি; দরকার হলে, নাহয় রাত জেগেই আঁকব।’
‘লম্পর আলোয়? কেরোসিন পুড়িয়ে? পয়সা পাব কোথায়?’
‘তুমি শুধু হ্যাঁ বলে দাও; বাদবাকি দায় আমার।’
‘আর ঠোঙা! ছবি এঁকে তো দুটো টাকাও ঘরে আসবে না! এতে তবু দিনের দিন কিছু না হলেও কুড়ি-তিরিশ টাকা তো হেসে খেলেই আসে!’
‘মন ভাল থাকলে, ডেইলি পঞ্চাশটাকারও বানিয়ে দেওয়া যায়; আঁকার বোর্ড আর কিছু কাগজ কিনে দাও; আমি শুরু করি।’
আকুতির বদলে, শাফিকার দু’চোখে এমন এক প্রত্যয় ছিল যে, ওই ট্যাক্সিতে বসেই তাকে কথা দিয়ে দিল ইসমাইল। হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল শাফিকা; ইসমাইল বুঝল যে, শাফিকার এই কান্না আসলে, এতদিনের বন্দিদশা থেকে তার মুক্তি পাওয়ার উচ্ছ্বাস। ইসমাইল শুধু বুঝে উঠতে পারল না যে, কাজটা কি ঠিক করল! সে কি জানে যে, কোন ছবি ফুটে উঠবে শাফিকার বোর্ডে!
২
স্টেশনে ঢোকবার মুখেই, সারি-সারি যে-গুমটিঘরগুলো— কী না পাওয়া যায় সেখানে! ডাঁই করে রাখা পুরনো কার্টুনগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল শাফিকা; মসৃণ দেখে বেছেও নিল দুখানা; তার পাশেই পুরনো খাতা-বইয়ের দোকান থেকে এক কেজি মতো ম্যাগাজিন-বই নিয়ে, এবার সে তাকাল তার মিয়াঁর দিকে। শাফিকা দেখেছে যে, ট্যাক্সিভাড়ায় সবটা লাগেনি। পকেট থেকে কুড়ি টাকা বার করে, সেগুলোর দাম মেটাল ইসমাইল। দোকানির থেকে আর একখানা খবরের কাগজ এবং এক টুকরো সুতলিদড়ি চেয়ে নিয়ে, নিজেই গুছিয়ে বাঁধল শাফিকা; বৃষ্টির নামগন্ধ নেই, তবু সেই বেঁধেছেঁদে নেওয়া তাড়াখানি এবার নিজের আঁচল দিয়ে ঢেকে, ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘চলো; দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!’ সেই ধীরস্থির-শান্ত শাফিকার ওই অধীরতা দেখে, ইসমাইল আন্দাজ করল যে, তাড়া-লাগার এই ধরন তার কাছে যেন একেবারেই অচেনা। ভিন্ন কোনও সংসার যেন শাফিকার অপেক্ষায়। খালি ট্রেনে জানলার ধারে বসতে পেল শাফিকা। তার পাশে বসা ইসমাইল কিছুক্ষণ পরেই খেয়াল করল যে, খোলা জানলার শিকে মাথা রেখে, পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে শাফিকা। চলন্ত ট্রেন থেকে আজ যেন আর কিছুই দেখার নেই তার। শাফিকার মাথাটা আলতো ধরে নিজের কাঁধে ফেলে নিতেও, ঘুম ভাঙল না শাফিকার। ইসমাইল বুঝল যে, তার ওই গাঢ় ঘুমের মধ্যেই, আজ যেন ধীরে-ধীরে জেগে উঠছে— কোলাজশিল্পী শাফিকা।
সমান টুকরোর কার্ডবোর্ডগুলোতে কুচি-কুচি কাগজের টুকরো সাঁটিয়ে কী যে অপূর্ব সব ছবি তৈরি করেছে শাফিকা! সেদিন প্রদর্শনীতে গিয়ে, সেখানকার বেশিরভাগ ছবিই সে বুঝতে পারেনি; কিন্তু ছোটবিবির এই আঁকাগুলো দেখে, একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল ইসমাইল। এক ঝুড়ি সবজি, লাল শাড়ি পরে ঘুঁটে দিচ্ছে শাফিকা, গোয়ালের ছায়ায় তাদের গরুদুটো আর একটা ছুটন্ত ট্রেন; তাদের চারপাশটাই জুড়েতাড়ে, কেমন এক-একখানা ছবি হয়ে গেছে! ইসমাইল অবাক হয়ে দেখল, শাফিকার রঙের ব্যবহার; সাদা চোখে দেখলে মনে হয়, তাদের এই হতশ্রী গরিব কুঁড়েতে কীই-বা এমন আছে! দোর, দালান, চালা, বেড়া, গোয়াল— সবই তো ভাঙাচোরা! বাড়ির মানুষগুলোর চেহারাও হাড়-বের-করা জিরজিরে; পরনের পোশাকেও না আছে ছিরি, না আছে ছাঁদ! কিন্তু ছবিতে যেন একেবারে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে, ঝলমল করছে আলোয়। ইসমাইল ভাবতে লাগল যে, সে-ও তো এসবই রোজ দেখে! এই গরু, ঘুঁটের দেওয়াল, লাল শাড়ি পরা তার বিবি, দূরের পুকুর-ডোবা, এমনকী ওই ট্রেনটাও; সেই দেখাগুলোই তো অবিকল এঁকেছে শাফিকা! তফাতটা তাহলে ঠিক কোথায়? ছবিতে কি একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়, রোজের দেখা এই সত্যিগুলোই! এজন্যই কি পেটভরে খাওয়া না-জুটলেও অতটা কষ্ট হয় না শাফিকার, যতখানি কষ্ট সে পায় ছবি আঁকতে না পেলে! ইসমাইলের খুব দুঃখ হল এ-কথা ভেবে যে, এই এতগুলো বছর ধরে কী পরিমাণ অভুক্ত থেকেছে শাফিকা! ছেলেপুলে, মিয়াঁ এবং মাথার ওপরে একখান চাল পেলেও, আসলে বোধহয় নিজেকে সর্বস্বান্তই মনে হয়েছে শাফিকার; কারণ এর কিছুই তো সে চায়নি! শাফিকার হয়ে বর চেয়েছে তার মা; ছেলে চেয়েছে তার মিয়াঁ; আর তার হয়ে দোয়া মেনেছেন ইমাম। কিছু যে চাইতে হয়, সেটাই তো কোনওদিন শেখেনি শাফিকা; সে যেটা শিখেছে তা হল, দু’চোখ মেলে দেখা; আর শিখেছে, রং-বেরঙের কাগজকুচি একটা বোর্ডের মধ্যে আঠা দিয়ে সাঁটিয়ে, নিজের মতো করে সেটাকেই ফুটিয়ে তোলা। সে জানে যে, একেই বলে ছবি; যার অন্য নাম কোলাজ। সে তাই বুঝতে পারেনি যে, কী জন্যই বা তার হয়ে এত কিছু চাইতে গেল— মা সুর্মাবিবি, মিয়াঁ ইসমাইল বা মসজিদের ইমাম! সে শুধু বুঝেছে যে ‘বাবা’ সুখবীরের চাওয়াটাই তার জন্য এক প্রকৃত চাওয়া।; কারণ সেই চাওয়ার মধ্যে মিশে আছে, শাফিকার চাওয়াটাও। শাফিকার দিকে চেয়ে মুগ্ধ ইসমাইল শুধু বলল, ‘ছোটবিবি, সত্যি করে বল তো, তুই আবার কোনও হুরি-পরি নোস তো! বিবির ছদ্মবেশে এই সংসারে এসে, ঘর করতে লেগেছিস আমার সঙ্গে!’
কার্ডবোর্ডে আঁকা সেই ছবিগুলো নিতে, ইসমাইলের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল শাফিকা। ছেলেমানুষের মতো সেগুলোর ওপর হাত চাপা দিয়ে হাসতে লাগল ইসমাইল। নিজে থেকেই বলল যে, ছবিগুলো নিয়ে কালই সে নাকি তার বন্ধুদের দেখাবে। শাফিকা একটু অবাকই হল; তার মনে হল যে, আঁকাগুলো ‘বাবা’কে না দেখিয়ে, তার আগেই বন্ধুদের কাছে কেন দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে মিয়াঁ! তারা যদি আপত্তি জানায়, তাহলে কি তাকে আর আঁকতে দেবে না ইসমাইল! মোল্লাঘরে ধরকাট তো অনেক! তায় আবার গরিব; সম্বল বলতে শুধু তো ওই ভিটেটুকুই! ছবিগুলো নিয়ে ইসমাইল পাড়ায় বেরিয়ে যেতেই, থম মেরে বসে থাকল সে; ছেলেদের বিছানার চারপাশে মশারিটা গুঁজে দিয়ে নিজের বিছানাখানাও পেতে নিল নীচে; দাওয়ায় গিয়ে পা-মুখ ধুয়ে, ঘরে এসে ছেড়ে নিল ভাত-খাওয়া কাপড়টা; জানলার ভাঙা পাল্লাটার দড়ি খুলে, ভেতরদিকে টেনে বন্ধ করে, আবার দড়ি বেঁধে দিল শিকটার সঙ্গে। কী মনে হতে, এক টুকরো ছেঁড়া কাপড় বার করে, লম্প থেকে কেরোসিন তেল ঢেলে, সেটা একটু ভিজিয়েও নিল জুত করে। দরজার বাইরে এসে দরজাটা টেনে দিল, ছেলেদের ঘুম যাতে না ভেঙে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে এক ধাপ সিঁড়ি নেমে, ফুলে ভরা মেহেদি গাছটার নীচে এসে দাঁড়াল শাফিকা; কার্তিকের মরা আলোয় চাঁদের গায়ে যেন, আজ এক অপরূপ ছায়া! আর ক’দিন পরেই কালীপুজো। নিজে একজন ‘মোল্লানি’ হলেও কালীকে ভাল লাগে তার। এক গা গয়না-পরা, ওই উলঙ্গীর যেন অনেক শক্তি; তার যেন মনে হয়, এই কালীও তার মতোই এক কালো মেয়ে; ভয়ডর নেই বলেই বোধহয়, সবাইকেই রক্ষে করতে পারে; শাফিকা ভাবে যে, হিন্দুদের দেবী হলেও, এ যেন তার খুব কাছের কোনও মেয়ে। অনেক বিপদের দিনে সে যেন আপনা হতেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শাফিকার। শাফিকা তাকে দেখতে পায় তার ঘরেদোরে, উঠোনে, পুকুরপাড়ে; এমনকী ট্রেনলাইনে বা ঝোপজঙ্গলের ভেতরেও; কোনও কালীমন্দিরের ভেতরে, সে তো কখনও যায়নি; তাই সে জানে না, যে-মন্দিরে থাকা কালী যে ঠিক কীরকম হয়; কালীমূর্তি সে দেখেছে, শুধু রাস্তায়; লরি করে নিয়ে যাওয়ার সময়ে। শাফিকা তাই নিজের ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি দেখতে পায় কালীকে।
কেরোসিন-মাখানো ন্যাকড়ার টুকরোটার কাছে জ্বলন্ত দেশলাই ধরতেই, ফস করে জ্বলে উঠল সেটা; মুহূর্তের মধ্যেই তৈরি হতে থাকল এক আলোর বলয়। সেই আলোবাহারের দিকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল শাফিকা। তাদের ধর্মে দেবদেবী নেই, কালী নেই; নেই শ্মশান-চিতা বা আগুনশুদ্ধি হওয়ার রীতি। তার মিয়াঁ একবার বলেছিল যে, সব আগুনই যে বাতাস পেয়ে জ্বলে, তা কিন্তু নয়; বুকের মধ্যে যে তোলপাড় সেই ধড়ফড়ানিতেও নাকি জ্বলে ওঠে; শাফিকার মনে হল, এই আগুনটাও সেরকমই কিছু; এখনও যে আলো হয়ে আছে বাইরেটা, সে কি তার মনের মধ্যে জেগে ওঠা ওই ভয়ানক তোলপাড়ে; মনে হল যে, এ হল সেই আগুন, যেখান থেকে তৈরি হয়েছিল ‘জিন’; তাদের ধর্মবিশ্বাসে, এই জাগতিক জীবনে যাবতীয় যত কিছু, সব তৈরি হয়েছে মাটি থেকে; ব্যতিক্রম শুধু ওই ‘জিন’, কারণ তা এসেছে আগুন থেকে; এজন্যই ‘জিন’ ঘিরে যত রহস্য; ‘জিন’ জাদুময়। বড়বিবির মতো তার বিশ্বাস নেই ‘জাদুটোনা’ বা ‘নজর’ লেগে যাওয়ায়। কিন্তু আজ সে আল্লার কাছে এই দোয়াই চাইল, ‘জিন’ যেন মিশে থাকে তার ছবি আঁকায়। যেন বন্ধ না হয়ে যায়, তার ওই ছবি আঁকার সুযোগটুকু। শাফিকার জ্বালানো আগুনে ছড়িয়ে পড়ল মায়া; অন্ধকারেও দেখা যেতে লাগল, কেমন দৌড়ে পার হয়ে গেল কয়েকটা শেয়াল; গোল হয়ে ঘুরতে লাগল বাস্তু বেজিদুটো; ডানা ঝটপট করে উড়ে গেল দু’একটা রাতচরা পাখি। আলো দেখে নড়ে উঠল পিপুলের ডালে ঝুলে থাকা থোকা-থোকা বাদুড়ের দল; একটুও না চমকে সাদা প্যাঁচাটাই শুধু ডানা মুড়ে বসে রইল শাফিকার ঘরের চালটাতে। শাফিকা তাকে দেখতে না পেলেও, সে কিন্তু সবটাই দেখে গেল, ‘হুট’ শব্দটিও না করে। শাফিকার জ্বালানো আগুনটা ধীরে-ধীরে নিভে এলেও, অদ্ভুত এক ঝিরঝিরে আলোয় কিন্তু জেগে রইল, ঘর থেকে একটু দূরে থাকা ওই ভাঙা পাঁচিল, ঝোপজঙ্গল, আর সেই পিপুল গাছটা; ছায়া কেটে চাঁদটা বেরিয়ে আসতেই, সাদা ডানাজোড়া মেলে সেদিকেই উড়ে গেল প্যাঁচাটাও। ঘরে এসে লম্ফের আলোতেই শাফিকা আঁকতে বসল সদ্য দেখা ‘জিন’, আর সেই আগুনের মায়া; যা কালো নয়, ঘন সবুজ রঙে, শ্যাওলার মতো সজীব আর পিছল।
৩
বন্ধুদের পরামর্শেই শাফিকার আঁকাগুলো নিয়ে সুখবীরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, ইসমাইল; ঠোঙার জন্য গুছিয়ে রাখা কাগজের তাড়াটা টুলের ওপর রেখে, এবার সে বার করে আনল, থলিতে রাখা ছবিগুলো; কাগজের মোড়ক খুলে ‘বাবার’ হাতে দিয়ে বলল, ‘আপনার জন্য ছোটবিবি পাঠিয়েছে।’
‘কবে এঁকেছে? কতদিন আগে?
‘কলকাতার প্রদর্শনী দেখে ফিরেই; দিন দুয়েক সময় লেগেছে এই চারখানা বানাতে।’
‘ওকে বোলো যে, ছবিগুলো আমি নিলাম।’
‘কিছু কি বলতে হবে ছোটকে?’
‘এটুকুই বোলো যে, কাজ যেন সে বন্ধ না করে; এভাবেই চালিয়ে যায়।’
সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে যাবার পর, জানলা থেকে ইসমাইলকে ডেকে সুখবীর শুধু বললেন, ‘কাজগুলো করতে হবে, শুধু আর একটু বড়মাপের বোর্ডে।’
———————————————————————————————-
আমি শাফিকা। সেই আঁকাগুলো বাবার কাছে পৌঁছনোর এক সপ্তাহের মধ্যেই, বাবা জানালেন যে, আমার আঁকা খানকুড়ি ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হবে কলকাতার গ্যালারিতে; তিনি তাঁর আর্ট গ্রুপের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেই, একটা গ্যালারিও নাকি বুকিং করে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। সেই সঙ্গে মিয়াঁর হাতে পাঠিয়েও দিয়েছেন ভাল বোর্ড, দামি রং আর আঠা।
মিয়াঁ আর আপত্তি করল না। গোয়ালের অন্য দিকটা পরিষ্কার করে নিতেই, পুরনো একটা ত্রিপল কিনে এনে টাঙিয়েও দিল মিয়াঁ। চোরের মতো রাত জেগে-জেগে আঁকা সেই ছবিগুলো সাজানোও হল গ্যালারির দেওয়ালে। আমাকেও সেখানে যেতে হবে শুনে, বাবার কাছে গিয়ে বললাম, লেখাপড়া জানি না, কথা বলতে গেলেই দেহ যেন পাথর হয়ে যায়—আমি গিয়ে কী করব!
বাবা বললেন, ‘এবার তো লেখাপড়া জানা, বলিয়ে-কইয়ে লোকেরাই তোমার কাছে আসবে।’
ঘরে এল একলপ্তে , থোক— সত্তর হাজার টাকা— আমার ছবির দাম!
স্টুডিয়ো হিসেবে, প্রথমে একটা পাকা দালান এবং এর কিছু সময় পরে, ইলেকট্রিক-আলোজ্বলা দু’কামরার একখানা পাকা বাড়িও উঠল ওই বাস্তুজমিতেই। ইসমাইলের ছোটবিবির বাড়ি; বাজারে গিয়ে একটা পেতলের পাতে, নিজে বসে থেকে মিয়াঁ লিখিয়ে আনল— ‘Studio – Shafika Sheikh, Collage Artist’।
দোয়া মেনে, আমি মনে-মনে লিখলাম—বাবা।
পরদিন, ফ্রেমলাগানো নতুন একটা বোর্ড ঘনসবুজ রঙে লেপে, তার ওপর সাঁটিয়ে দিলাম আমারই বানানো একটা কাগজের ঠোঙা; সেই ঠোঙাটার মাঝখানে, কাগজ জুড়ে-জুড়ে বানানো গোবর রঙের ঘুঁটেটা সাঁটিয়ে, তারই ওপর সাদা দিয়ে লিখে দিলাম দুটো শব্দ—-‘ঘর’।
ইসমাইলের লাগানো পেতলের সেই পাতটার পাশেই, আরও একটা পেরেক পুঁতে, বোর্ডটার পিছনে সুতলি দড়ি লাগিয়ে, এবার ছবির মতো ঝুলিয়ে দিলাম সেই বোর্ডখানাই।
আমি জানি যে ‘ঘর’ হল, আল্লার দান এবং এ-সেই পবিত্র জায়গা যা দেয় শান্তি, নিভৃতি, প্রেম আর ভালবাসা। ওই ঘন সবুজ-রং, কাগজের ঠোঙা, গোবরের ঘুঁটে আর আঠা লাগানো কাগজের কুচিগুলোই যা আমাকে দিয়েছে— আমার ‘ঘর’ —STUDIO…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র