ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং : পর্ব ৬১


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (October 18, 2024)
     

    আঁশটে যূপকাষ্ঠে

    জাপানে একজন কয়েদির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকল ৪৫ বছর, তাঁকে জেল খাটতে হল মোট ৪৮ বছর, এখন তাঁকে ‘দুঃখিত, আপনি নির্দোষ’ বলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ফিরে দু’মাস তিনি বাড়ি থেকে বেরোননি, বলা ভাল বেরোতে পারেননি। ক্রমাগত পায়চারি করেছেন। কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না, কেউ জানে না। নির্দোষ মানুষকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে জেলে ভরে দেওয়া হচ্ছে, এ-জিনিস নতুন নয়। একটা সিনেমায় দেখেছিলাম, একজন বাচ্চা ছেলেকে ১২ বছর জেলে রাখা হয়েছে, কোনওদিন বিচারের এজলাসে তোলাই হয়নি, তার অপরাধ: সে একদিন রেলস্টেশনে হিসি করছিল। তৃতীয় বিশ্বে এমন উদাহরণ নিশ্চয়ই ভূরি-ভূরি আছে, আমাদের এখনও-স্মৃতি-থেকে-হারিয়ে-না-যাওয়া ধনঞ্জয়কেই ১৪ বছর এই মৃত্যুদণ্ডের খাঁড়া মাথায় নিয়ে থাকতে হয়েছে, তারপর তার ফাঁসি হয়েছে, যদিও অনেকের মতে, ধনঞ্জয় দোষ করেছিল কি না, তা পুরোপুরি প্রমাণিত নয়। দোষ না করে কারাগারে থাকা জঘন্য ব্যাপার, কিন্তু দোষ না করে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া, আর অতলান্ত ভয় মাথায় নিয়ে প্রতিদিন ঘুমোতে যাওয়া জঘন্যতর। জাপানের এই কয়েদি অধিকাংশ দিন কাটিয়েছেন সলিটারি সেল-এ, অর্থাৎ একক কক্ষে, যেখানে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না, কারও মুখ দেখতে পাবেন না। আর তাছাড়া ৪৫ বছর ধরে প্রতি মুহূর্তে ভেবেছেন, এই এই এক্ষুনি বোধহয় ঘাতক এসে বলল, চলো, তোমার দণ্ড আজ কার্যকর হবে। এই ভয়াবহ অত্যাচার, মর্মান্তিক নিগ্রহ অতুলনীয়। এঁর আখ্যান আজ খবর হয়েছে, কারণ তিনি এক রকমের রেকর্ড করেছেন, আজ অবধি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনও মানুষকে এতদিন বেঁচে থাকতে হয়নি। সম্ভবত বিশ্বময় আরও গুচ্ছ বিচারের বাণী আছাড়িপিছাড়ি কাঁদছে। আইনের একটি অবশ্যপালনীয় নীতি হল: একশোটা অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, তবু একজন নিরপরাধও যেন শাস্তি না পান। এই নীতি যখনই লঙ্ঘিত হয়, কোনও একজন কী গাঢ় বেদনা বহন করে চলেন, পরাধীনতার প্রখর কষ্ট ছাড়াও কত দুর্বিষহ অপমান সহ্য করেন (কারণ তিনি তো দোষ না করেও সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে ঘৃণ্য অপরাধী), তা আমরা আন্দাজ অবধি করতে পারব না। এই ভদ্রলোক বাড়িতে একটা চিঠি লিখেছিলেন, ‘যখন আমি প্রতি রাত্রে ঘুমোতে যাই আমার নিঃশব্দ একক কুঠুরিতে, কখনও-কখনও আর পারি না, ঈশ্বরকে অভিশাপ দিই। আমি তো কোনও দোষ করিনি, আমার প্রতি এত নিষ্ঠুর আচরণ তো একটা ঠান্ডা মাথার কদাচার।’ এখন বলা হচ্ছে, তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হযেছিল যে-প্রমাণগুলোর ভিত্তিতে, তা ভুল ছিল, যে-রক্তের দাগকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছিল তাতে তাঁর ডিএনএ পাওয়া যায়নি, তিনি স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন পুলিশের অত্যাচারে। আজকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হল বটে, কিন্তু এবার বাকি জীবনটা নিয়ে তিনি কী করবেন? তাঁর বয়স এখন ৮৮, আর কোন প্রাচুর্য তাঁকে তৃপ্তি দিতে পারবে? স্বাধীনতারই বা কী মূল্য আছে তাঁর কাছে? একটা বিখ্যাত ছবিতে দেখানো হয়েছিল, প্রায় সারা যৌবন ও প্রৌঢ় বয়স জেলে কাটানোর পর একজন লোককে ছেড়ে দেওয়া হযেছে, সে-বৃদ্ধ বাইরের জগতের এই জীবনটা কীভাবে যাপন করতে হয় তা আদৌ বুঝে উঠতে পারছে না, শেষমেশ সে গলায় দড়ি দিয়ে এই প্রকাণ্ড গোলকধাঁধা থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু বাস্তবের এই জাপানি চরিত্রের জীবন-যৌবন-ধন-মান সবই যে নিরন্তর গড়িয়ে গেল এক বিশাল নিষ্ফলা গর্তে, বয়ে গেল শুধু অপ্রাপ্তির কয়েকটা দগদগে ক্ষতস্তানের পুঁজস্রোতে, এবং তা ঘটল কিছু অক্ষম আইনকর্তার দোষে, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? ইনি যে প্রতিদিন দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠবেন, কাল ভোরে তাঁর শেষমুহূর্ত, সে-হাঁসফাঁসের কোন মলম আবিষ্কৃত? এবার কি সেই অত্যাচারী পুলিশদের, বা বদযুক্তি আওড়ানো উকিলদের টেনে এনে জেলে ভরা হবে? তাতেও কি এই লোকটির তীব্র হতাশা আর অঝোর কান্নার কোনও অবসান সম্ভব?

    একটা বিখ্যাত ছবিতে দেখানো হয়েছিল, প্রায় সারা যৌবন ও প্রৌঢ় বয়স জেলে কাটানোর পর একজন লোককে ছেড়ে দেওয়া হযেছে, সে-বৃদ্ধ বাইরের জগতের এই জীবনটা কীভাবে যাপন করতে হয় তা আদৌ বুঝে উঠতে পারছে না, শেষমেশ সে গলায় দড়ি দিয়ে এই প্রকাণ্ড গোলকধাঁধা থেকে মুক্তি পায়।

    সন্দেহ নেই ‘বিলম্বিত বিচার অবিচারের সমান’, কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, চটজলদি হাতে-গরম বিচারের ফল চাইলে, বিচারপ্রক্রিয়ায় হইহই তাড়াহুড়ো করলে, অনেক সময়ে উলটো কাণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা। অপরাধ ঘটলে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই দাবি করে, যথাসম্ভব দ্রুত দোষীকে ধরা হোক, তার শাস্তিবিধান হোক। আবেগের একটা তাড়া আছে, ক্রোধ তীব্র থাকতে থাকতে প্রতিকারের স্টেশন দেখতে পাওয়ার দুরন্ত তৃপ্তি আছে। কিন্তু অভিযুক্তেরও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলে, ন্যায়ের প্রতি প্রধান নজর নিক্ষেপ করলে আমরা মানব, এই বিরাট ও জটিল কাজ যাতে নিখুঁত ও নিশ্চিত হয়, সেজন্য যতটা সময় লাগার, দিতেই হবে। তাতে দিনমাসবছর গড়িয়ে গেলে অবশ্যই মুশকিল, কিন্তু গল্পের শেষে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের হুড়োহুড়িতে শিগগির-পরিণাম চাইলে তা প্রায়ই সত্যঘাতী। আমরা বারে বারে বলি, পুলিশ চাইলে এক সপ্তাহে অপক্রিয়ার সমাধান করে দিতে পারে। বাস্তবে তা অনেক সময়েই হয় না, তখন দুর্নীতির কারণে অথবা মানুষের কাছে তড়িঘড়ি একজন ভিলেনকে উপস্থিত করার দায়ে যদি কাউকে খামখা দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে সুরাহা চাইতে গিয়ে চূড়ান্ত অবিচারই ডেকে আনলাম। এ তো সমাধান নয়, সমস্যা। এই প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে যদি দেশের সমাজ-হৃদয় তৈরি হয়, তাহলে বিচার শেষ হওয়ার আগেই আসামিকে এনকাউন্টারে হত্যা করলে জনগণের মধ্যে উল্লাসের বান ডেকে যায়, ঢোল-শহরত বাজতে থাকে, ঘাতক পুলিশকে পুরস্কৃত করা হয়। চেপে ধরলে জনতা বলে, ধুর, ন্যায়বিচার হতে তো দশক গড়িয়ে যাবে, তার চেয়ে এই ভাল। আর সরকার বলে, ভিড়ের স্মৃতিতে ঘটনা টাটকা থাকতে-থাকতে একটা হুড়ুম ফয়সালা ঢুকিয়ে দাও, হিন্দি সিনেমার শেষ দৃশ্যের ব্যাকরণে হাততালি তুলে নিয়ে বেরিয়ে যাও। ওতেই ভোট ফলবে। কিন্তু তাতে যে বিচারকে অপমান করা হল, সমীচীনতা থেকেই দূরে সরে যাওয়া হল, তা অশিক্ষিত দেশের মগজে ঢোকে না। তাই বুলডোজার-বিচারকে মাথায় তুলে এমন উদ্দাম নেত্য। একজন অভিযুক্ত দোষী প্রমাণিত না-হতেই তাঁর বাড়ি বা দোকানঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, এটা কোন ধরনের মীমাংসা? সুবিচারের সঙ্গে দর্শক-খ্যাপানো নাটকীয়তার কী সম্পর্ক? এ কি অজয় দেবগণের সিনেমা হচ্ছে, যেখানে কয়েদিদের চোখে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হবে? না কি অনিল কাপুরের সিনেমা, যেখানে অভিযোগ শোনামাত্র টাইপরাইটারে রায় লিখিত হবে? সবচেয়ে বড় কথা, কেউ দোষী প্রমাণিত হলেও আমি তার বাড়ি গুঁড়ো করে দিতে পারি না, তাকে জেলে ভরতে পারি শুধু। কিন্তু কিছু দেশ আজও এই ইতরতা ফলিয়ে কল্যাণখ্যাতি কিনতে চায়, উচিত-কেতন ওড়াতে চায়। ‘এক্ষুনি দাও, এক্ষুনি দাও’ আবদার ওয়েব-সিরিজ বা ইনস্টারিলের কাছে চলতে পারে, ন্যায়যন্ত্রের কাছে নয়। এসব ধরনে চলতেন তৈমুর লং বা আলাউদ্দিন খিলজি। এভাবে চলেছে ক্যাঙারু কোর্ট বা খাপ পঞ্চায়েত। শাস্তির কর্কশতাই যেখানে বিচারকের গর্বিত সিলমোহর। একে হাতির পায়ের তলায় ফেলে মাথা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, ওর পায়ু দিয়ে শূল ঢোকাচ্ছে, তার হাত-পা ছুটন্ত ঘোড়া দিয়ে ছিঁড়ছে। সেই আদলেই কিছু দেশের কিছু অঞ্চলের লোক একরাত্রে চার-পাঁচজনের নালিশ শুনে লোকটাকে গাছে বেঁধে বিছুটি দিয়ে চাবকাচ্ছে, কিংবা ক্লাবঘরে টেনে নিয়ে সাঁড়াশি দিয়ে তার যৌনাঙ্গ-কর্তনচেষ্টা চালাচ্ছে। রাষ্ট্র যখন কাদায় উজাড় হয়ে নিম্ন-উদাহরণ আষ্টেপৃষ্ঠে আত্মীকরণ করে, আর জনগণ যখন বিচারবিরোধী শাস্তিদাতাকে অসামান্য দণ্ডকর্তা বলে উপাসনা শুরু করে, তখন নির্দোষের গারদে ঢুকে যাওয়ার, এমনকী মৃত্যুদণ্ডে তড়পাবার সম্ভাবনা প্রবল। জয় ধর্ষকামের জয়, সম্মিলিত টর্চারাকাঙ্ক্ষার জয়, আঁশটে যূপকাষ্ঠে চড়িয়ে দে লাশটে— বিশ্বের অধিকাংশ ম্যাপেরই মুষ্টিবদ্ধ চাহিদা, এবং তা বহুক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সাদর সাড়ম্বর প্রশ্রয়পুষ্ট। সহস্র নির্দোষের মুখ-ঘষটানি ও অশ্রুরক্তামিতেও সে-কলুষ লজ্জিত হয় না।

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook