সিংজি’র ধাবা
বাবা খুব পছন্দ করত ধাবা থেকে খাবার কিনে এনে খেতে। এখানে অবশ্য ‘ধাবা’ ব্যাপারটার একটু বর্ণনা আমাকে দিতেই হবে, কেননা আজ, এই ২০২৪ সালে ‘ধাবা’ বলতে এক লহমায় আমরা যা বুঝি, তখন এমনটা ছিল না। বা থাকলেও, আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্তদের ধারণার আওতায় পড়ত না সে-জিনিস। এখন ধাবা বলতেই দু’ধরনের ব্যাপার মনে আসে। এক, কলকাতা ছাড়ালেই হাইওয়ের দু’ধারে বিস্তর এলাকাজুড়ে জমিয়ে খাওয়া-দাওয়ার যে মহা আয়োজন, সেই। আর দুই হল, শহরের ভিতরেই, সে কলকাতা হোক বা অন্য কোনও শহর, রাত আড়াইটে অবধি বিক্রিবাটা চলতে থাকা জমজমাট রোশনিদার দোকানপত্তর। সেখান থেকে কাবাবের গন্ধ এসে সামনের রাস্তা আটকে পড়ে থাকবে, সেই সুতোয় বাঁধা পড়বে সার-সার গাড়ি, তাদের জানলায় টোকা দিয়ে কিশোর ছেলেরা সার্ভ করে যাবে মনমতো প্লেট। এখন ‘ধাবা’ শুনলে স্বভাবতই এসব দৃশ্য ফুটে ওঠে চোখের সামনে। তখন, মানে আমার যখন বছর সাতেক কি আটেক বয়স, ছবিটা ছিল অন্যরকম। বলি তাহলে।
গড়িয়া মোড় যেখানে, তার জ্যামচক্করের তেমাথা ছাড়িয়ে দু’পাশে ঝলমলে ছোট-বড় দোকানের স্রোত নিয়ে বয়ে চলেছে স্টেশন রোডের দিকে, যে-রাস্তায় কিছুদূর এগোলেই ডাঁয়ে পড়ত মহুয়া সিনেমা হল, সে-রাস্তাতেই ডান হাতে পড়ত ‘সিংজি’র ধাবা’। এরকম নাম কোথাও লেখা ছিল না দোকানে, সত্যি বলতে কী, লেখার জায়গাও ছিল না। কিন্তু বেশ কয়েক কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে সিংজি’র ধাবা বলতে লোকে ওই একটি দোকানকেই চিনত। দোকানও কি ঠিক বলা যায় তাকে? অন্তত আজকের দোকানপাটের নিরিখে? এমনকী সে-সময়েও তার আশেপাশে দোকানঘর বা রেস্তোরাঁদের যেমন জেল্লা, তার ঠিক উলটো ছিল এই সিংজি’র ধাবা। রাস্তার উপরেই যে তার অবস্থান, এমনটাও বলা চলে না। বরং ফুটপাথ থেকে দু’পা নীচুতে নেমে তবে দাঁড়াতে হত সেই দোকানের দরজার সামনে। দোকান বলতে একখানা বারো বাই বারো ঘরমাত্র, যার মাথার উপরে এবড়োখেবড়ো টালির চাল। দেওয়ালে কবে হালকা সবজেটে রং করানো হয়েছিল কে জানে! সে আজ ক্ষয়ে গিয়ে তেলচিটে হয়ে কোনও রকমে নিজের অতীত বাঁচিয়ে রেখেছে। ঘরের একপাশে ইট গেঁথে একখানা পোশাকি সীমারেখা করা, যার ওপাশে ইয়াবড় খানতিনেক মাটির উনুন, যাকে তন্দুর বলাই উচিত, যাদের কারও গর্ভে কখনও সেঁকা হচ্ছে মোটা-মোটা রুটির শরীর তো কারওর মাথায় কড়াই চাপিয়ে তেলে তড়কার ছ্যাঁকা দেওয়া হচ্ছে। তো এই হল যাকে বলে রসুইঘর। আর সেই দেওয়ালের এপাশে খানকতক তেড়ামেড়া টেবিল আর বেঞ্চি সার বেঁধে রাখা, যাদের কখনওই আমি খালি পড়ে থাকতে দেখিনি। বাবার হাত ধরে যখনই সিংজি’র ধাবার দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি, লোকজন কবজি ডুবিয়ে মুখ নামিয়ে খাচ্ছে।
এবারে সিংজি’র কথায় আসি। ওঁর পুরো নাম যে কী, তা কাউকে জানতে দেখিনি। সকলে সিংজি বলেই উল্লেখ করত, ওঁকে অবশ্য সাড়াও দিতে দেখিনি কখনও। কেননা, ওরকম গম্ভীর মানুষ ওই বয়সে আমি কমই দেখেছি। তেলকালিমাখা পাঠান স্যুট পরে থাকতেন; মাথায় যে পাগড়ি, তা বলাই অতিরিক্ত, হাতে বালা, যাকে ওঁদের ভাষায় ‘কড়া’ বলা হয়। দোকানের গোড়ায় একটা ছোট কাউন্টারমতো ছিল, সেখানে বসেই অর্ডার নিতেন, ভেতরে জনাতিনেক কমবয়সি ছেলেরা কাজ করত, গ্রাম্ভারি স্বরে তাদের রান্নার হুকুম দিতেন, আর একটা টিনের বাক্সে টাকাপয়সা রাখতেন, সেখান থেকেই ফেরত দিতেন। বেশির ভাগ সময়ে বসেই থাকতেন ওখানে, খদ্দের এলে মুখ তুলে তাকানোর বিশেষ বালাই ছিল না। যাঁরা রোজকার খাওয়ার খদ্দের, তাঁরা তো এসেই যে যার টেবিল নিয়ে বসে পড়তেন। আর যাঁরা এই আমার বাবার মতো যাকে বলে ‘ফ্লাইং কাস্টমার’, তাঁদের অর্ডার উনিই নিতেন। তারপর রান্নাঘরের দিকে মুখ বাড়িয়ে, ‘দো রোটি এক অন্ডা তড়কা লগা’ বা ‘এক মটন শিক অওর কিমা প্যাক কর’ বলে পরের খদ্দের সামলাতেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রান্নাঘর থেকে গরমাগরম খাবারের প্যাকেট এসে যেত কাউন্টারে। এইখানে প্যাকেজিংটাও বলতে হবে। আজকের মতো প্লাস্টিকের কন্টেনার তখনও দূর অস্ত। তড়কা বা কিমা দেওয়া হত মাটির ভাঁড়ে, ফিনফিনে কাগজ দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে, ঠিক যে-ভাঁড়ে এবং যেভাবে রসগোল্লা বা পান্তুয়া দেওয়া হত। আর রুটি দেওয়া হত খবরের কাগজের চৌকো টুকরোতে গোল করে পাকিয়ে। এসবের একটা অন্য আমেজ যে ছিল, তা অনস্বীকার্য।
বাবা হয়তো আমার হাত ধরে স্কুলের বইখাতা বা অন্য কিছু কিনে দিতে গড়িয়া মোড় অবধি গেছে, ফেরার পথে এ-রাস্তায় ঘুরলেই বুঝতাম, এবার গন্তব্য সিংজি’র ধাবা। বাবা এসব খেতে খুব পছন্দ করত। বাড়ির রান্না, সে তো খেতেই হয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে এসব ঝাল-ঝাল মশলাদার জম্পেশ নৈশভোজ নাহলে বাবার চলত না। আমারও মজা, রাতে খাবার পাতে ভাগ পাব একটু। বাবার পছন্দের আইটেম ছিল দুটো, ডিম তড়কা আর মটন শিক কবাব। সঙ্গে দু’খানা রুটি আর তিন কোয়া পেঁয়াজ। ব্যাস। এ-খাওয়া আমি ছোট থেকে দেখছি। মা মোটে এসব খেতে ভালবাসত না, বাবাকেও বারণ করত। কিন্তু ভোজনরসিক রোগাসোগা বাবা আমার সেসবে কর্ণপাত করত না। বরং উত্তরাধিকারসূত্রে আমিও যাতে এই পথের সাথীকে চিনে নিতে পারি, সেসব মন্ত্র দিয়ে যেত।
আজ বাবা নেই, বহু বছর হল। ঝকঝকে গড়িয়া মোড় পেরিয়ে সেই সিংজি’র ধাবাও আর নেই। সিংজিও নিশ্চয়ই নেই। আমার বাবার চেয়ে বয়স কিছুটা বেশিই ছিল তাঁর। কিন্তু একেবারে কি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এইসব ছোট আলোর, তেলচিটে দেওয়ালের, ভাঙাচোরা টেবিল-চেয়ারসমৃদ্ধ ‘ধাবা’-রা? নাহ, পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়নি তাদের। এই তো, এখন যে-পাড়ায় থাকি আমি, সেখানেই আছে দিব্যি। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে ঘুরেই সরুমতো রাস্তা একটা, যার মাথার ওপর দিয়ে জীবনানন্দ সেতু বয়ে যাচ্ছে সারাক্ষণ। তার ঠিক নীচে, সেই আমার ছোটবেলার দেখা সিংজি’র ধাবার মতোই ঘুপচি, তেলচিটে, টিমটিমে, ধোঁয়া-ওঠা, টাটকা রুটি-তড়কার খুশবু-ছড়ানো একখানা ধাবা। বিহার থেকে আসা দুই ভাই মিলে চালান, তাঁদের বয়স হয়েছে ভালই। তাঁরাও, ওই সিংজি’রই মতো, কিঞ্চিৎ গম্ভীর। আর তাঁদেরও সঙ্গে আছে কয়েকজন কমবয়সি চটপটে ছেলে, যারা এই রুটি বেলছে তো এই সবজি কাটছে তো এই তড়কা লাগাচ্ছে।
আমার ভারি ভাল লাগে তাদের ধাবার রান্না। বিশেষত মুরগির ঝোল। বাড়িতে কি হয় না সেসব? ভালই হয়। কিন্তু ওদের রান্নায় একটা আলাদা মজা আছে, স্বাদ আছে, গন্ধ আছে। দূর্বা ইদানীং একটু বারণই করে আমায়, বলে, ‘রোজ-রোজ এত বাইরের খাবার খাস না, শরীরটা যাবে।’ কিন্তু ওই যে, উত্তরাধিকার। ওই যে, পথের সাথীকে চিনে নেওয়া। সন্ধেয় অলস পাড়া-বেড়ানোর পর মাঝেমধ্যে আমি গিয়ে দাঁড়াই সেই ধাবার সামনে। ‘চিকেন হবে না কি আজ?’ সম্মতিসূচক ইশারা পেলে বলি, ‘তাহলে এক প্যাকেট দেখি।’ আমারও একটু পড়ন্ত বয়সের চেহারা বলেই বোধহয় মালিক দু’ভাই একটু সমীহ করেন আমাকে। তাই আমি চাইলে নিজেরাই কেউ একজন রসুইঘরে দাঁড়িয়ে, তন্দুরের ওপর কড়া গরম করে আলু আর ঝোল-সহ ঝাল-ঝাল মুরগি একটু নেড়েচেড়ে তরতাজা করে দেন। আর নামানোর সময় মেথিপাতার গুঁড়ো ছড়িয়ে আরেক পাক চালান। তাতে যে-সুগন্ধটা বেরোয়, তা অলীক।
এসব কিনে আমি একা-একাই বাড়ি ফিরি। রাতে আমি আর দূর্বা যখন খেতে বসি, ওর পাতে হয়তো খুব স্বাস্থ্যসচেতন স্যালাড। আমি পাশে দুটো রুটির সঙ্গে গরমাগরম চিকেন নিয়ে বসে যখন জিগ্যেস করি, ‘তুই তাহলে খাবি না তো?’, তখন ‘দে দেখি এক পিস’ ব’লে দিব্যি তুলে নেয়। আমি বুঝি, ওই স্বাদ, ওই খুশবু আসলে যতখানি রান্নার, তার চেয়েও অনেক বেশি করে অতীতের। খুব অল্প দামের এক প্লেট মুরগির ঝোল আর রুটির স্বাদ পৃথিবীর সব কিছুকে হার মানাতে পারে আজও। কেবল অতীতকে পারে না। বাবার পাত থেকে এক সময়ে কত খেয়েছি। আজ আর চাইলেও বাবাকে একটু তুলে দিতে পারি না আমার পাত থেকে। অসামান্য এই ছোট ধাবার রান্নায় ওটুকুই যা খামতি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র