আঙ্করে আতঙ্ক, থানা-পুলিশ, চোরাগলি
পৃথিবীর এত দেশে ঘুরেছি, কাজে-অকাজে, কখনও পাসপোর্ট কেড়ে নেয়নি কেউ। কেনই-বা নেবে? স্মাগলার বা সন্ত্রাসবাদী কোনওটাই তো নই! তাই প্রথমে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। আঙ্করের মন্দিরের বাইরে অলিন্দে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার সামনে বর্ণনা দিচ্ছিলাম, ব্যাগটা রাখা ছিল কয়েক হাত দূরে মেঝেতে। হঠাৎ চোখের কোণ দিয়ে নজরে পড়ল, দুটো লোক আমার ব্যাগটা তুলে নিয়ে হাঁটা লাগাল। সঙ্গে-সঙ্গে মাঝপথে বলা বন্ধ করে ছুটলাম ওদের পিছনে। রীতিমতো চেঁচামেচি করে থামালাম লোকদুটোকে। টুকরো-টুকরো ইংরেজি শব্দে বোঝাল, ওরা নাকি পুলিশ। আঙ্কর-চত্বরেই আছে ফাঁড়ি, সেখান থেকে বেরিয়ে টহল দেয় ওরা। ইউনিফর্ম পরেনি, ফলে পুরোপুরি বিশ্বাস করা মুশকিল। জিগ্যেস করলাম, ‘কী হয়েছে যে আমার ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছ?’ জানাল, আনআইডেন্টিফায়েড অবজেক্ট ফেলে রাখা নিয়ম নেই এই চত্বরে। আমি কি ছাড়ার পাত্র? ব্যাগের মধ্যে রয়েছে সর্বস্ব। পাসপোর্ট, প্রেস কার্ড, ডলার, কম্বোডিয়ান রিয়েল, থাই ভাট, আরও কত দরকারি কাগজপত্র। এরা কোথায় যাচ্ছে কে জানে! আমি আর ক্যামেরাম্যান ওদের সঙ্গ ছাড়ব না। বললাম, ‘আমি তো পাশেই ছিলাম। একটু জোরে কার ব্যাগ জিগ্যেস করলেই জবাব পেতে। পাসপোর্ট মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যেত, ওটা আমার ব্যাগ।’ এর কোনও জবাব নেই। কেন নেই সেটা মালুম হল ফাঁড়িতে পৌঁছনোর পর। এদিকে একটা লোক এত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে ব্যাগটা যে, টানাহ্যাঁচড়া করে লাভ নেই। তাছাড়া ভাবলাম, বিদেশ-বিভুঁইয়ে ঝামেলা পাকালে হয়তো পুলিশে ধরবে। তখন কে বাঁচাবে? তার থেকে থানায় গিয়ে এদের বড়বাবুর সঙ্গে কথা বললে তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। তখন ব্যাগটা ফেরত পেতে আর অসুবিধা হবে না। তাই কথা বলতে-বলতে ওদের পায়ে পা মিলিয়ে চলতে লাগলাম।
এমন আশ্চর্য থানা বোধহয় একমাত্র শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পে দেখা যায়। আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশের মানুষ, পুলিশের দুর্নীতি কিছু চোখ-ছানাবড়া-করা বিষয় নয় আমাদের কাছে। তবু এমন থানা কভু দেখিনি আগে। দূর থেকেই নজরে পড়ল একটা ছোট্ট পুরনো এক তলা বাড়ি। সামনে ঘাসজমি। কাছে গিয়ে দেখি, দুটো বেঁটে-বেঁটে কাঁঠালিচাঁপা গাছের মাঝখানে টাঙানো হ্যামকে দোল খাচ্ছেন এক হোঁৎকা ভুঁড়িদার, চোখ বোজা। অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে পরিচয় করাল দুই কর্মচারীর একজন, ‘ইনি আমাদের অফিসার ইন চার্জ।’ কোনওমতে চোখ একটু খুললেন, লাল টকটকে। জড়ানো গলায় কিছু আওয়াজ করে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন। পাত্তা না পেয়ে অপমানিত হওয়া তো দূরের কথা, বরং বেশ ভরসা পেলাম। কেন জানেন? জাঁদরেল ওসি হলে সমস্যা হত, নানারকম জেরা করত, পারমিশন দেখতে চাইত। হয়তো আটক করে দূতাবাসে খবর পাঠাত। কিন্তু ভরদুপুরে আইনরক্ষকের এ হেন রূপ দেখে বুঝে গেছি, ব্যাগ সিজ করার পিছনে তোলাবাজি ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই এর টিমের। ঠিক তাই। আমাদের ফাঁড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে বলল, ‘কত ডলার আছে?’ মনে-মনে ভাবলাম, পথে এসো। অবাক গলায় বললাম, ‘ডলার? সে তো ব্যাংককে এক বন্ধুর কাছে রেখে এসেছি। জানি, এখানে লাগবে না।’ সন্দেহের গলায় বলল, ‘মিথ্যে বলছ।’ এরপর যা করল সেটা ভাবনার বাইরে। আমার ব্যাগটা টেবিলে রাখা ছিল, চেনটা খুলল। আমাকে খুলতে বললেও একরকম ছিল। কোনও মহিলার হ্যান্ডব্যাগ এভাবে খুলতে পারে কেউ দেখিনি আগে। এদিকে আমার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া, ভেতরের চেনে একটা খামে রাখা আছে ডলার। অত ধৈর্য অবশ্য নেই দেখলাম পুলিশের। যে-ছোট চেনটায় টাকাপয়সা থাকে, সেটা খুলে সব রাখল টেবিলের ওপর। কী বেরোল? অনেক রিয়েল আর ১২৮৯ থাই ভাট। রিয়েলগুলো অবহেলায় ঠেলে দিল একপাশে। নিজের দেশের মুদ্রায় এতটুকু আগ্রহ নেই। স্বাভাবিক, বিশ্বের বাজারে এত কম তার মূল্য। ভাট নিয়েও খুব একটা উৎসাহী নয় কারণ সেটাও খুব একটা দামি কারেন্সি নয়। তবু নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল, এটা ভেবেই মনে হয় বেজার মুখে ভাটগুলো পকেটে পুরল। এরপর ব্যাগ থেকে আমার আর ক্যামেরাম্যানের পাসপোর্ট দুটো বার করে বলল ধরে দাঁড়াতে, ফটো তোলা হবে। কেন? যদি আমরা পরে অভিযোগ জানাই যে পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছে পুলিশ, তাই নাকি প্রমাণ রাখতে হবে। মাথামুন্ডু বুঝলাম না। নালিশটা কী আর সেটা নথিবদ্ধ হল কোথায় যে এরকম প্রসঙ্গ উঠতে পারে? যাই হোক, কথা না বাড়িয়ে যা বলছে তাই করা ভাল, কারণ আলো পড়ে আসার আগে আঙ্কর থমে শ্যুট করতে হবে। বেরিয়ে আসার পথে দেখলাম, ওসি নিদ্রা গিয়েছেন, নাক ডাকছে রীতিমতো। হাঁটতে-হাঁটতে ভাবছিলাম মরাল অফ দ্য স্টোরি কী? ‘চলো নিয়মমতে’— আগেভাগে হোম ওয়ার্ক করে ইউনেস্কোর অনুমতি আনালে এত হেনস্থা হতে হত না। ওই একটা চিঠি দেখালে পুলিশ বাবাজিরা বাপ-বাপ বলে তখুনি ব্যাগ ফেরত দিয়ে দিত।
কলার প্রতি আমার দুর্বলতা নিকটজনেরা সবাই জানে। এই নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করলে আমি শচীন তেন্ডুলকর, স্টেফি গ্রাফদের উদাহরণ দিই। খেলার মাঝখানে ওরা কলা খেতেন এনার্জি পাওয়ার জন্য, আমি দেখেছি টিভিতে। আঙ্কর থমের গেটে ঠেলায় কলা বিক্রি হচ্ছে দেখে উল্লসিত হয়ে এক কাঁদি হাতে নিয়ে ছবি তুলেছিলাম মনে আছে। এরপর ক্যামেরার সামনে কথা বলতে গিয়ে বিপত্তি। এমন জোরালো ঝিঁঝির ডাক কোথাও শুনিনি। জঙ্গলঘেরা মন্দিরচত্বর আর সেখান থেকে এই ভর বিকেলে তীব্র স্বরে ঝিঁঝি ডাকছে। পাশের লোকের কথা শুনতে পাবেন না এমন আওয়াজ। আসলে আঙ্কর আর্কিওলজিকাল পার্কে রয়েছে মোট তিনটি মন্দির— আঙ্কর ভাট, আঙ্কর থম ও বেয়ন। আঙ্কর থমের মাঝখানে বেয়ন মন্দিরটি ঘিরে বট গাছের ভিড়, কারণ গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন বট গাছের নীচে বসে ধ্যান করে। আর সেখানেই এই লক্ষ-কোটি ঝিঁঝির বাস। বেয়নের আর একটা বৈশিষ্ট্য হল, দিনের বিভিন্ন সময়ে সূর্যের আলোর রং বদলানোর সঙ্গে। বদলে যায় এর রং। সেই সঙ্গে মন্দিরের ছায়া আর বিশাল-বিশাল গাছের ছায়া মিলে তৈরি করে এক অলৌকিক জগৎ। এটা চোখ ভরে দেখার জিনিস, মন ভরে অনুভবের জিনিস, ক্যামেরার লেন্সে বলুন কি কথায়-লেখায় বর্ণনা, সবসময়েই কম মনে হবে।
জেনে ভাল লাগল, নির্মাণ শ্রমিকদের গরিমা মিশে আছে বেয়ন নামের সঙ্গে। রাজারাজড়ার তৈরি স্থাপত্য সাধারণত তাঁদের নামেই বিখ্যাত হয়। এখানে ব্যতিক্রম। এই মন্দির-সংস্কারের সময়ে শ্রমিকেরা বট গাছের ইংরেজি ব্যানিয়ান টি উচ্চারণ করতে না পেরে বলতেন, বেয়ন। সেখান থেকেই নাম হয়ে গেল বেয়ন মন্দির। আঙ্করের অধীশ্বর যে-বুদ্ধ, তাঁর নাম অবলোকিতেশ্বর— বোধিসত্বের দশম অবতার। তাঁর মুখ সর্বত্র এমন উচ্চতায় বসানো আছে, যেন গোটা রাজত্বের ওপর নজর রাখছেন। আমরা গুনিনি, তবে শুনলাম, পঞ্চাশটা মিনারে মোট দুশোটি অবলোকিতেশ্বরের মুখ পূর্বদিকে চেয়ে আছে। প্রতিটি মুখ একইরকম, গভীর প্রশান্তি ছেয়ে আছে, নিমীলিত আঁখি, হালকা হাসির আভাস। সত্যি, অস্তসূর্যের নিভন্ত আলোয় ওই ভাস্কর্য আপনার ভেতরটা অল্প সময়ের জন্য হলেও বদলে দেবে। এই পৃথিবীর তুচ্ছ হিংসা-দুঃখ-দীনতা পেরিয়ে যাওয়ার সেতু যেন আপনার সামনে। ‘যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ।/ আসিতে তোমার দ্বারে মনে হল/ মরুতীর হতে সুধাশ্যামলিম পারে’।
দেখলাম, আঙ্কর ভাটে যা নেই তা আছে আঙ্কর থমে— অসংখ্য গলিঘুঁজি। ভুলভুলাইয়া কোথায় লাগে! মন্দিরচত্বরে এত সরু গলিপথ যে, ঘুরতে-ঘুরতে হারিয়ে যাবেন। তার ওপর বট গাছের শিকড়বাকড় ঢুকে এসেছে মন্দিরের দেওয়াল পর্যন্ত। হঠাৎ দেখলে পোড়ো মনে হয়। পাথুরে পথে আচমকা নিজেকে একলা আবিষ্কার করাটা মোটেই সুখকর নয়। গা ছমছম করে। সন্ধে হয়ে এল। আমরা বেরিয়ে দেখলাম, মন্দিরের পাশেই ছোট-ছোট মেয়েরা বসেছে হাতে তৈরি স্যুভেনির নিয়ে। ভাবলাম কিনি, ওদেরও উপকার হবে। এই গরমে সারাদিন বসে থাকে, ক’জনই বা কেনে? ছোট একটা পোড়ামাটির অবলোকিতেশ্বরের মুখ হাতে নিয়েছি, মাঝখান থেকে দু’টুকরো হয়ে গেল। খেমর ভাষায় টুটাফাটা ইংরেজি মিশিয়ে চেঁচিয়ে উঠল বছর বারোর দোকানি, ‘তুমি আমার জিনিস ভেঙে ফেলেছ, দশ ডলার দাও।’ এ কী! আমি উলটে বলতে যাচ্ছিলাম, ‘ভাঙা জিনিস দিচ্ছ কেন?’ তার বদলে ও চেঁচামেচি শুরু করে দিল। বোঝানোর চেষ্টা বৃথা দেখে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তোমার এই ভাঙা জিনিসই আমি নেব, ডলারও দেব, কিন্তু এক ডলার।’ ডলারের নাম শুনে চোখ চকচক করে উঠল দেখলাম, কিন্তু আমি জিনিসটাও নেব শুনে হতাশ হল। আসলে ওর দোষ নেই, ট্রেনিংটা অন্য। ভাঙা জিনিস ‘ভেঙে ফেলেছ’ বলে টাকা আদায় করা, তারপর আবার সেটি ডালায় সাজিয়ে রেখে পরের খদ্দেরের সঙ্গে একই ট্রিকস। ভেবেছিল, ভাঙা, ফেলে দেওয়ার যোগ্য জিনিস কোন বিদেশি নেবে? কিন্তু এবারের ব্যাপারটা সিলেবাসের বাইরে চলে যাওয়াতে বেচারি ঘাবড়ে গেল। আমিও এক ডলার দিয়ে দু’টুকরো অবলোকিতেশ্বর সযত্নে কাগজে মুড়ে ব্যাগে ভরলাম। বিশ্বাস করুন, সেই মুখ ফেভিকুইক দিয়ে জোড়া দিয়ে কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে আজও শোভা পাচ্ছে আমার ড্রইংরুমের দেওয়ালে। এই না হলে বাঙালি!
ভিনদেশি হয়ে বোকাও বনতে হয় কখনও-সখনও। তবে তা যদি হয় নিছক মজা, তাহলে রাগ করার কিছু নেই। সকালে উঠেই শুনলাম, নদীতে বোট রেস হচ্ছে। গিয়ে দেখি, হইহই ব্যাপার, রইরই কান্ড। কতরকম নৌকো হয়, তার সাজসজ্জাই বা কত কিসিমের হতে পারে, সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিযোগীদের ফ্যাশন প্যারেড এক কথায় রঙের রায়ট চারপাশে। সবটাই কিন্তু এথনিক। আধুনিকতার এতটুকু ছোঁয়া নেই কোথাও। মনে হবে, অকস্মাৎ কয়েকশো বছর পিছনে চলে গেছে মন্দির নগরী সিয়েম রিপ। শাঁ শাঁ করে নৌকো বাইচ আর সেই সঙ্গে শয়ে-শয়ে গলার উল্লাসের চিৎকার, একদম কার্নিভালের মেজাজ। কিছুটা দূরে দেখলাম, স্টেজ বেঁধে ফাংশন হচ্ছে। পুরো আমাদের গ্রামগঞ্জের ‘রামায়ণ’ যাত্রা, তবে খেমর ভাষায়। থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার সাধারণ জীবনে রাম-সীতা-লক্ষ্মণ মিশে থাকেন, অন্তত সেই ২০০৮ সালে থাকতেন। এখন নিশ্চয়ই বিনোদনের আরও একশো এক উপকরণ হাজির। ভাষা না বুঝলেও চিরচেনা গল্প বুঝতে তো অসুবিধা হয় না। তবে রাবণের সঙ্গে সীতার খুনসুটি সম্ভবত লোক-কাহিনির সরস সংযোজন। হাসতে-হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেল। কিন্তু এরপর যখন সত্যিই হাসির খোরাক এল মঞ্চে, অর্থাৎ যাকে বলে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি, তখন হাসার উপায় নেই। ভাষাই তো বুঝি না, কখন হাসতে হবে জানব কীভাবে? এদিকে চারপাশে হো-হো হাসির রোল উঠছে যখন, তখন আর আমরা দুজন চুপচাপ বসে আছি। কী বিড়ম্বনা!
ছবি সৌজন্যে : লেখক