ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৪৪


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (October 7, 2024)
     

    রমিতা

    রমিতার বিয়ের বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই, যখন তার ছোট বোনটির বয়স তিন, আরও একটি সন্তান হল রমিতার মায়ের। রমিতার সবচেয়ে ছোটভাই। দিল্লির সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউটে হস্টেলে থাকার সময়ে, ছুটিছাটায় মা-বাবার কাছে এলে, সেই ভাইকে দেখিয়ে সবাই বলত, এটা তো মিতারই ছেলে। ১৯৪৯ সালে বিয়ে হয়ে ১৯৫০ সালে একটা বাচ্চা তো তাদের হতেই পারত। ৪২ বছর বয়সে তার সেই সর্বশেষ গর্ভযন্ত্রণায়, ভয়ংকর লজ্জা পেয়েছিলেন রমিতার মা সুপ্রভা। ফলে সকলে যখন তাঁর ছোটছেলেকে দেখিয়ে রমিতার ছেলে বলে ইঙ্গিত করতেন, বড় শান্তি পেতেন সুপ্রভা। রমিতার বাবা ভূতেশ অবশ্য নির্বিকার ছিলেন এসব প্রশ্নে। অন্যদিকে, মায়ের সেই কোলপোঁছা একরত্তি ভাইকে নাড়াচাড়া করতে-করতে রমিতাও মনে-মনে ভাবত যে এবার তাদের নিজেদের একটি সন্তান এলে বড় ভাল হয়। রমিতা তো একরকমটা ভেবেই রেখেছিল যে, এমএড পড়া শেষ হলেই সে ফিরে যাবে নিজের সংসারে, তার সোদপুরের বাড়িতে; তার জন্য রণেন বা তরুলতার অধীর অপেক্ষা ছাড়াও সে নিজেও তো ব্যাকুল হয়েছিল তাঁদের সঙ্গে থেকে সংসারসুখ পেতে। রণেন এবং শাশুড়িমায়ের চিঠি থেকে বারে বারেই তো জেনেছে যে, পারিবারিক কত উপনয়ন-বিয়ে-সাধভক্ষণের নিমন্ত্রণ থেকে বাদ হয়ে রইল সে! মিতার ধারণা যে, এসবে যোগ না দিলে একটি পরিবার এবং তার মানুষদের যেন ঠিকমতো চেনা হয়ে ওঠে না; নিজের বাপের বাড়ির পারিবারিক বন্ধনে সে যেমন আনন্দ পায়, ঠিক ততটাই মেতে ওঠে শ্বশুরবাড়ির উৎসব-অনুষ্ঠানে। বছরদুয়েক ধরে ওই বাড়ি ছেড়ে থাকার কারণেই মিতাও এবার অস্থির হয়ে আছে বাড়ি ফেরবার কাতরতায়।

    এর মধ্যে একবার অবশ্য দিল্লিতে এসেছিল রণেন। মিতার সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটাবার উৎসাহ না থাকলে, মিতা নিশ্চিত যে, অন্য কোনও উৎসাহ পেয়েই রণেন অন্তত আসত না; বিশেষত নিজে থেকে এমন তদ্বির-তদারকি করে। মিতার বাবার আমন্ত্রণে সে মোটেই আসেনি। রণেন এসেছিল, দিল্লির AIFACS আর্ট গ্যালারিতে তার নিজের ছবির প্রদর্শনী করতে। রণেনের এই উদ্যোগে এই ভেবেই একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল মিতা যে, ইচ্ছে করলে রণেন তবে সবটাই পারে! মোহিত নামে তার এক সাগরেদ তথা ছাত্রকে সঙ্গে করে, নিজের আঁকা বেশ কিছু ছবি-সহ, সোজা একেবারে দিল্লি চলে এসেছিল রণেন। মিতাদের বাড়ি না উঠে তারা উঠেছিল রণেনেরই চেনা আর একজনের বাড়ি। রণেন নিজে তো বটেই, এমনকী রণেনের অতিথি হিসেবে সেখানে বিস্তর যত্ন পেয়েছে মিতা এবং মোহিতও। ওই ক-টা দিন কী আনন্দেই না কেটেছে মিতার! রণেনের ওই প্রদর্শনী উপলক্ষে, এলাহাবাদ থেকে দিল্লি চলে এসেছিলেন মিতার দিদি এবং বড় জামাইবাবুও। মিতা এবং ওই বড় জামাইবাবু মিলেই তো রণেনের আঁকাগুলোর ইংরেজি টাইটেল করা হল। মিতার দায়িত্ব ছিল অতিথি এবং দর্শকদের সঙ্গে হিন্দি-ইংরেজিতে আলাপচারিতা চালিয়ে যাওয়া। রণেন অবশ্য নির্বিকার মুখে একটু দূরে-দূরেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এমন এক উপভোগ্য সময়ের উদযাপন, মিতার জীবনকে যেন মুড়ে দিয়েছিল একরাশ সুগন্ধি ফুলে। প্রদর্শনী উপলক্ষে মিতাকে একটা নতুন শাড়িও কিনে দিয়েছিল রণেন। উদ্বোধনের দিন সেই শাড়ি গায়ে জড়াতেই রণেন বলেছিল, ‘তুমি এত সুন্দর যে, সব শাড়িই তোমার কাছে ম্লান হয়ে যায়।’ দীর্ঘ চুম্বন-আশ্লেষে তারা ডুবেছিল, বহুক্ষণ। প্রদর্শনীতে ছবির প্রশংসা এবং বিক্রি দুইই হয়েছিল; তার থেকেও বড় কথা যে, চাকরির ব্যাপারে এমন কিছু ভাল যোগাযোগও হয়েছিল, যেখানে রণেন একজন পাশকরা ডিগ্রিধারী চিত্রী কি না সেটাও বিচার্য ছিল না। রমিতা এবং রণেন দুজনেই মনে করেছিল যে, এই প্রদর্শনীই তাদের জীবনে নিয়ে এল এক আশাতীত সৌভাগ্য। প্রদর্শনী শেষে বাকি ছবি নিয়ে মোহিত সোদপুরে ফিরে গেলেও, মিতার বাবা এবং বড়দিদি ও বড় জামাইবাবুর অনুরোধে রণেন রাজি হল, মিতার মা-বাবার সঙ্গেও কিছুদিন কাটিয়ে তারপরে ফিরে যাবার। রণেন যদিও কিছুতেই যেতে না চাইলেও, মিতা একরকম জোর করেই নিয়ে গিয়েছিল তাকে; কারণ মিতা তো জানতই যে, তাদের বিয়ের পর এই ছয়-সাত বছরের মধ্যে রণেনকে জামাই হিসেবে কখনও কাছে না পাওয়ায়, কী নিদারুণ আক্ষেপই না জমে আছে সুপ্রভার মনে! কিন্তু সব যে গোলমাল পাকিয়ে গেল, সেও কিন্তু মিতার এই জোরাজুরিতেই। কারণ একসঙ্গে খেতে বসে, রণেনের দিকে তাকিয়ে, মিতার বাবা ভূতেশ হঠাৎই বলে উঠলেন, ‘তোমার বাবার কানেকশনে একবার লেগে গেলেও, এই ম্যাজিক কিন্তু বার বার হবে না; মনে রেখো যে, এটা সোদপুর নয়; রাজধানী দিল্লি।’ রণেনের সঙ্গে বাকি সকলেই অপমানিত বোধ করল; বিশেষত বড় জামাইবাবু। ‘ম্যাজিক’ শব্দটা রণেন এবং মিতা— দুজনের কানেই লাগল বেশ জোরে ধাক্কার মতো। কারণ ওইদিন সন্ধেবেলা চায়ের আড্ডায়, অন্যদের গানের সঙ্গে বাঁশি বাজানো ছাড়াও মজার-মজার বেশ কিছু ম্যাজিকও দেখিয়েছিল রণেন; শাশুড়িমা-সহ বিশেষত রণেনের ছোট-ছোট শালা-শালিরা তো দারুণ আহ্লাদ করেছিল তা নিয়ে। ভূতেশের কথার উত্তরে, তখনকার মতো রণেন মুখে কিছু না বললেও, ভেতরে-ভেতরে ফুঁসে উঠেছিল অপমানে। পরদিন মিতাই আবার জোর করে রণেনকে নিয়ে চলে গিয়েছিল তার ইনস্টিটিউটে। এক রাত মিতার সেখানকার গেস্টহাউসে কাটিয়ে, হাওড়ার ট্রেন ধরেছিল রণেন। মিতার মনে হয়েছিল যে, তার বাবা খুব নিষ্ঠুর।   


    সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে, থার্ড-র‍্যাঙ্ক করবার খবর দেওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মিতাকে বলা হল, তাদের অধ্যক্ষ ড. অনাথনাথ বোস মহাশয়ের ঘরে গিয়ে একবার দেখা করে আসতে। সেইমতো তাঁর ঘরে গিয়ে ড. বোসকে প্রণাম করার সঙ্গে-সঙ্গেই মিতাকে তাঁর সামনের চেয়ারটিতে বসিয়ে তিনি জানতে চাইলেন যে, বড় কোনও চাকরি করার কথা সে কিছু ভাবছে কি না! মিতার উত্তর শোনবার আগেই তিনি জানালেন, তাঁর একান্ত ইচ্ছের কথা। অর্থাৎ মিতা যেন অবিলম্বেই সোজা গিয়ে যোগ দেয় সিমলার Indian Institute of Advanced Study-তে। কারণ ফার্স্ট এবং সেকেন্ড র‍্যাঙ্ক-হোল্ডারকে বাদ দিয়ে, সার্বিক বিচারে মিতাকেই উপযুক্ত মনে করেছেন তিনি। বিহ্বল মিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের বাইরে এল, তাঁর কাছে থেকে এক সপ্তাহের সময় চেয়ে নিয়ে। মিতা বুঝতে পারল যে, এমন দোলাচলে সে কখনও পড়েনি। কারণ, সিমলায় এ-চাকরি নিলে মিতা নিশ্চিত যে, সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে কখনওই থাকবে না রণেন। ফলে অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে তাদের বিচ্ছেদ, যা মিতা ভাবতেও পারে না। অন্যদিকে তার বাবা জানলে তো আনন্দে মেলা বসিয়ে দেবেন; কারণ মিতার ক্যারিয়ারটাই প্রধান, যেখানে রণেন থাকল-কি-গেল তা একবারেই ধর্তব্য নয় তাঁর কাছে। আর বাকি রইল মিতা নিজে; সে ঠিক কী চায়! মিতার মনে হল যে সেটা সে মোটেই জানে না; কারণ সে যেন ঝুলে আছে তার প্রবল ইচ্ছে এবং কী তার করা উচিত— এমন এক অদৃশ্য দড়ি থেকে।

    আগে হলে, রেজাল্টের খবর দিতে বাড়ি ফিরেই রণেনকে চিঠি লিখতে বসে যেত মিতা; অথচ আজ যেন তার হাত সরছে না; ভীষণ ইচ্ছে করছে আগামীকালই ইনস্টিটিউটে গিয়ে জানিয়ে আসে যে, ওই চাকরিটা নেওয়ায় সে সম্মত। একটু রাতে, সবাই শুয়ে পড়লে, রণেনকে চিঠি লিখে তার রেজাল্টের কথা জানালেও, চাকরি পাওয়ার খবরটা কিছুতেই যেন লিখতে পারল না মিতা। ভালোলাগার অপরাধবোধে তলিয়ে গিয়ে সে লিখল, ফেয়ার-ওয়েলের অনুষ্ঠান হয়ে গেলেই সোদপুরে ফিরবে আসবে সে। হস্টেলে ফিরে, এখানে পাওয়া নতুন বন্ধু পার্সি-মেয়ে নিকোবিন এবং অমৃতসরের জনকের কাছ থেকে মিতা জানল যে, ফেয়ার-ওয়েল হতে দিন পনেরো দেরি আছে; ওরা তাই সিমলা যাচ্ছে, Institute of Advanced Study-তে দেখা করে, চাকরির হালহকিকত বুঝতে। ড. বোসের প্রস্তাবের কথা কিছু না জানিয়ে মিতাও রাজি হয়ে গেল, দিন দুয়েকের জন্য, ওদের সঙ্গে গিয়ে সিমলা ঘুরে আসবার। মিতা জানে যে, বছর সাতাশ-আঠাশের অবিবাহিত জনক বা নিকোবিনের তেমন কোনও পিছুটান নেই, যা মিতার আছে; অন্যদিকে, বাড়ির কাছেই একটা আধা-সরকারি ইশকুলে মিতার মতো কোনও চাকরির ভরসাও নেই তাদের জীবনে। সবেতন ছুটি না পেলেও ইশকুলের ওই চাকরিটা তো মিতার আছেই। কিন্তু এই ইন্সটিটিউট দেখার পর সব ইশকুল-কলেজকেই তো মনে হয় ম্লান মনে হবে মিতার! একইসঙ্গে মুগ্ধতা এবং আত্মবিশ্বাসে যেন ভরপুর হয়ে  উঠল মিতা। একবারে যেন ছবিতে দেখা, কোনও স্কটিশ স্থাপত্য। ইনস্টিটিউটে পড়াকালীন কয়েক মাস আগে এখানে যখন স্টুডেন্টস-ভিজিট হয়েছিল, মিতা যায়নি। কারণ দিন দশেকের ছুটি নিয়ে তখন সে মেতে ছিল, AIFACS হলে রণেনের ছবির প্রদর্শনী নিয়ে।

    ওই প্রাসাদোপম ইনস্টিটিউটের কারুকাজ এবং বিভিন্ন ভাইসরয়দের আমলে তিলে-তিলে গড়ে ওঠা এর বিলাসবৈভব দেখেই যে মিতা ক্রমশই মুগ্ধ হয়ে পড়ছিল তা নয়; নেশাগ্রস্তের মতোই মিতা ডুবে যাচ্ছিল এর পালটানো সময়ের ইতিহাসেও। মিতার মনে পড়ছিল মাত্র বছর দশেক আগের খবরে পড়া, সেই ‘সিমলা’ কনফারেন্স; সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমানদের নিয়ে ‘Viceroy’s Executive Council’ গড়ে তোলার উদ্যোগ; বা বলা ভাল যে, দেশভাগ আটকানোর এক অন্তিম  চেষ্টা। জহরলাল, মউলনা আজাদ, লিয়াকৎ আলি, ভুলাভাই দেশাই, তারা সিং, জিন্না— কে না উপস্থিত ছিলেন সেই মিটিং-এ! আরও আশ্চর্য যে, মহাত্মা গান্ধী সে-সময়ে সিমলায় উপস্থিত থেকেও যোগ দেননি ওই মিটিং-এ। মুসলিম লিগ, কংগ্রেস এবং  ব্রিটিশদের সেই ত্রিপাক্ষিক বৈঠক, ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন, শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন… সব যেন একেবারে চোখের ওপর ভেসে উঠছিল মিতার। আর মনে পড়ছিল, কিশোরীবেলায় ছেড়ে যাওয়া তার সেই আদরের সিমলা, বালুগঞ্জে তাদের কাঠের বাংলো, জাকু পাহাড়ে বাঁদরের দল এবং লেডি ইরুইন ইশকুলের মিস দোয়ারাকে। লাইব্রেরি, বাগান, কোয়ার্টার— যা দেখছে তাতেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল মিতা; মনে-মনে, একরাশ মেঘ মেখে  রণেনের সঙ্গে যেন সে-হেঁটেও বেড়াচ্ছিল চারপাশে ছড়িয়ে থাকা চিনার, মেপল আর ফুল্ল ম্যাগনোলিয়ার ছায়ায়।

    এটা কোনও ইশকুল বা কলেজ নয়; সারা ভারতের চিন্তাভাবনা আদান-প্রদানের জন্যই মস্ত একটা রিসার্চ সেন্টার। আবার একইসঙ্গে তা গ্রীষ্মকালীন রাষ্ট্রপতি নিবাসও বটে। ফলে এরকম এক প্রতিষ্ঠানে তাদের কাজের সুবিধা হবে না ভেবে জনক এবং নিকোবিন দুজনেই একটু হতাশ হল; তাদের থাকার মেয়াদ আরও দুটো দিন বাড়িয়ে। তারা ভাবতে লাগল যে, চার্চ-স্কুলগুলোয় সরাসরি যোগাযোগ করলে কেমন হয়! ওদের সঙ্গেই ফিরবে বলে, মিতাও থেকে গেল আরও দুটো দিন। যদিও সে জানে যে, রণেনের চিঠি এসে পড়ে আছে, হস্টেলের ঠিকানায়; এবং সে এ-ও জানে যে, দিনের দিন মিতার কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে, কী ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়বে রণেন! এই প্রথম যেন মিতা বুঝল যে, স্বাধীনতার স্বাদ কাকে বলে! ইচ্ছে হলেই নিজের জীবনটাকে সে একদম পালটে দিতে পারে! মেঘ পেরিয়ে ভেসে গিয়ে, ওই অচেনা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে এমন এক ডেরাও তো সে বাঁধতেই পারে যেখানে, তার বাবা এবং রণেনের ওই নিয়ত রেষারেষি কোনও ভাবেই স্পর্শ করবে না তাকে! কেবলই তার মনে পড়ছে, উৎসাহে ভরা, ড. বোসের সেই চোখদুটো। নিকোবিন আর জনক তাদের পছন্দের চাকরির খোঁজে বেরিয়ে গেলে, মিতা ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল, কলস ফুলের মতো পেঁয়াজি রঙের ট্রাম্পেট ভাইন, মিহি হলুদ রঙের প্রিমরোজ জেসমিন আর বাদুড়ের মতো গুচ্ছে-গুচ্ছে ঝুলে থাকা টক-টক স্বাদের ফল কিউই।

    তবে ঝামেলাটা বাধল সম্পূর্ণ এক অন্য কারণে; আর তা হল, এক সপ্তাহের মধ্যে মিতা কিছু না জানানোয় তার নিয়োগপত্র এসে পৌঁছে গেল, মিতাদের দিল্লির বাড়িতে; এমনকী ড. বোসের রেকমেন্ডেশন লেটারসমেত; আর পড়বি তো পড় সেটা গিয়ে পড়ল একেবারে বাবার হাতে। সিমলা থেকে ফিরে, সে-রাতে হস্টেলে আর না গিয়ে মায়ের কাছেই এসেছিল মিতা; মিতা স্বয়ং এবং ওই চিঠি— দুটোই একইসঙ্গে আসাতে, বাবার আনন্দ আর দেখে কে! ইতিমধ্যে সিমলা গিয়ে মিতা যে ক-টা দিন কাটিয়ে এল, সেটা মনে হয় আন্দাজই করতে পারেননি মিতার বাবা; ফলে তিনি বোধহয় ধরেই নিয়েছিলেন যে, চিঠির ব্যাপারটাও মিতার অজানা এবং খুশির খবরটা তিনিই জানাবেন মিতাকে। বাবার উচ্ছ্বাস দেখেই মিতার মনে হল যে, এই চাকরিটা নেওয়া মানেই রণেনকে ভীষণভাবেই ছোট করা। বাবার সঙ্গে এ-নিয়ে কথা শুরু হবার আগেই, ভয়ানক এক জেদ এবং বিরোধিতায় চাকরি না-নেওয়ার যুক্তিগুলি মনে-মনে একেবারে সাজিয়ে ফেলল মিতা। খেতে বসে যথারীতি বাবা জানতে চাইলেন, ‘কবে জয়েন করছ? যত তাড়াতাড়ি যোগ দেবে, মাইনেও তত ভারী হবে।’

    ‘জয়েন করব কেন? পড়া শেষ। এবার তো বাড়ি ফিরব; ওখানকার স্কুলও তো অপেক্ষা করে আছে; আর এক মাস বাদে ছুটির মেয়াদও তো শেষ হয়ে যাবে।’

    ‘পাগলেও নিজের বুঝ বোঝে; তুমি দেখি শুধু পাগল নয়, প্রেমেও অন্ধ হয়ে বসে আছ!’

    ‘নিজের সংসার ছেড়ে, প্রবাস-জীবনে থেকে একা-একা চাকরি করতে আমি চাই না।’

    ‘সংসার! ভিখারির আবার সংসার? স্কলারশিপ না পেলে, এখানে কি তোমাকে পড়াতে পারত রণেন?’

    সিমলা থেকে ফিরে, সে-রাতে হস্টেলে আর না গিয়ে মায়ের কাছেই এসেছিল মিতা; মিতা স্বয়ং এবং ওই চিঠি— দুটোই একইসঙ্গে আসাতে, বাবার আনন্দ আর দেখে কে! ইতিমধ্যে সিমলা গিয়ে মিতা যে ক-টা দিন কাটিয়ে এল, সেটা মনে হয় আন্দাজই করতে পারেননি মিতার বাবা; ফলে তিনি বোধহয় ধরেই নিয়েছিলেন যে, চিঠির ব্যাপারটাও মিতার অজানা এবং খুশির খবরটা তিনিই জানাবেন মিতাকে।

    ‘বিয়ের পর তো বিএড পড়লাম, স্কলারশিপ কোথায় ছিল?’

    ‘সবেতন ছুটি পেয়েছিলে তাই পড়তে পেরেছ। নিজের মাকে যে খেতে দিতে পারে না, তিনি আবার বউ জুটিয়ে বসে আছেন!’

    ‘ওঁরা কিন্তু একেবারেই দরিদ্র নয়; আর আমাকে যেমন ভালোবাসেন তেমন সম্মানও করেন।’

    ‘তাহলে তো ভালই; তোমাকে সম্মান করেই নাহয় তোমার ইনস্টিটিউটের কোয়ার্টারে তোমার সঙ্গে তাঁরা থাকবেন। দুনিয়ার পাহাড়ি-মজুর, কুলি-কামিন এবং গাছপালা-পাহাড়ের ছবি এঁকে বা ম্যাজিক দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেবেন সকলকে!’

    ‘ইনস্টিটিউটের এই চাকরিটা যত বড় মাপেরই হোক না কেন, আমি বাড়ি ফিরে যাব।’

    এই কথোপকথনের পর আবার জমাট হিম হয়ে গেল বাবা-মেয়ের সম্পর্ক। ভূতেশ কিছুতেই মানতে পারলেন না, জেনে-বুঝে মিতার ওই নিজের পায়ে কুড়ুল মারাটাকে। রাতের খাওয়া বাতিল করে, নিজের ঘরে এসে মিতা দেখল যে, সেদিনের ডাকে-আসা শাশুড়িমায়ের চিঠিটা, খাম বন্ধ অবস্থাতেই রাখা রয়েছে তার বালিশের ওপর। শাশুড়িমা লিখেছেন,

    শ্রীশঃ

    সোদপুর-৯। ১। ১৯৫৬

    প্রাণাধিকা মামনি,

    তোমরা সকলে আমার স্নেহাশীষ জানিবে।

    তোমার পত্রখানি যথা সময়ে পেয়েছি। বিয়েবাড়ির গোলমালে উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল। বড় ভাসুরপোর বিয়েতে মেলা লোক এসেছিল। ওঁরা অনেক লোককে খাইয়েছেন। কলকাতা থেকে তোমার ছোটঠাকুরঝি লীলাও এসেছিল একরাতের জন্য। ক্রিক-রো এবং গোখেল রোড থেকে সব আত্মীয়-স্বজনই এসেছিলেন। বিয়ের ‘শ্রী’ গড়িয়েছিল রনু। বউ আসবার দিনে ঘরজোড়া আল্পনাও দিয়েছিল। ওর আঁকা পিঁড়ি, কুলো, হাঁড়িও ওঁরা খুব গর্ব করে প্রত্যেককেই দেখিয়েছেন। বাড়িশুদ্ধু সকলেই তোমার কথা বলতে লাগলেন। তুমি উপস্থিত না থাকায় সকলেরই মনে খুব দুখখু হয়েছে।

    মা, তোমার জন্য, আমার মন বড়ই ব্যস্ত হয়েছে। কবে আসবে? আমার পত্র পেতে দেরী হলে, তুমিও যেন পত্র দিতে দেরী কোরো না। মা, আমি তোমার ছোট্ট মেয়ে। লেখাপড়া ভাল জানি না। চিঠি দিতেও তাই দেরী হয়ে যায়। তুমি কেমন আছ? রনুর শরীর মাঝে একটু খারাপ হয়েছিল। এখন ভাল আছে। তার জন্য ব্যস্ত হোওনা যেন। পাশ দিয়ে তুমি ফিরে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমিই তো এ-বাড়ির লক্ষ্মী। আমাদের কত আদরের।

    আজ এই পর্য্যন্ত।

    ইতি তোমার অভাগিনী মামনি

    ‘মামনি’— এই ডাকটাও বড় অদ্ভুত; তারা দুজনেই দুজনকে এই নামে ডাকে, সই পাতালে যেমন হয়, ঠিক যেন তেমনই; একই ডাকে বাঁধা তাদের সম্পর্ক। ফলে মিতার ভাইবোনেরাও তার শাশুড়িমাকে ‘মামনি’ বলেই ডাকে। এই ডাকই যেন বুঝিয়ে দেয় যে, পরস্পরের প্রতি ভালবাসা এবং মমত্ববোধ কতখানি গভীর! ‘মামনি’কে উত্তর দেবার আগে মিতা বসল, রণেনকে চিঠি দিতে। কারণ রণেন জানত যে, পরীক্ষার পর দিদি-জামাইবাবুদের সঙ্গে আগ্রা বেড়াতে যাবে মিতা। সে-যাওয়া বাতিল করেই তো মিতা চলে গিয়েছিল, সিমলা; এই প্রথম কাউকে কিছু না-জানিয়ে; এমনকী রণেনকেও না-জানিয়ে, নিজের তাগিদে কোথাও একটা চলে যাওয়া। লিখতে বসেই তাই তার মনে হল কীভাবে জানাবে সে, তার ওই সিমলা যাওয়ার কথাটা!

    শ্রীচরণেষু,                                                                   দিল্লি, ১০ জানুয়ারি ১৯৫৬

    তোমাকে জানাতে ভয় পেয়েছি; তাই না বলেই সিমলা চলে গিয়েছিলাম; দেখতে যে, বিখ্যাত সেই Institute of Advanced Study প্রতিষ্ঠানটি কেমন! গিয়েছিলাম নিকোবিন আর জনকের সঙ্গে। ওখানকার কোনও ইশকুলে কাজ খুঁজতে গিয়েছিল দুজনে। তারা এখনও কেউই জানে না যে, সুযোগ্য ভেবে, ড. বোস আমার নাম সুপারিশ করায়, পাকা চাকরির নিয়োগপত্র একেবারে বাড়িতে এসে পৌঁছে গেছে। সে-চাকরি না নিয়ে সংসার করতে ফিরে যাব শুনেই, বাবা তো আবার মারমুখী হয়ে উঠেছেন। আমি জানি যে, তুমিও চাইবে না এখানে এসে সংসার পাততে। তবু গিয়েছিলাম এই কারণে যে, এই পাশখানা দিয়ে কোথা থেকে কোথায় এসে দাঁড়াবার সুযোগ অর্জন করলাম সেটুকুই বুঝতে। এক কথায় বলতে হলে বলতেই হবে যে, আমি মুগ্ধ এবং সম্মানিত।

    আমার বাবা ঠিক যে-ভাবে এ চাকরিটাকে একটা মোটা উপার্জনের পথ বলে ভাবছেন, সে-ভাবে না দেখেও বলা যায় যে, যদি তুমি রাজি হতে, তবে কিন্তু একেবারেই বদলে যেত, আমাদের জীবন। প্রকৃতি এবং এখানকার মানুষ দুইই বড় সুন্দর। বেশ কিছু শিল্পীর স্টুডিয়োও আছে; যে যাঁর মতো মগ্ন হয়ে কাজ করেন। শিক্ষিত মানুষদের এই শিল্পমনস্কতার মধ্যে সংকীর্ণ দলবাজি নেই। তাছাড়া তোমারই বয়সি, তোমার প্রিয় শিল্পী অমৃতা শেরগিল তো বহু বছর কাটিয়েছেন এই সিমলাতেই। দেশ-বিদেশ ঘুরেও সিমলার নিসর্গরূপই ছিল তাঁর বড় প্রিয় এবং প্রথম পছন্দের। কিছু বাঙালি শিল্পীরাও তো এখানে থাকেন এবং এখান থেকেই দিল্লি-বোম্বেতেও ছবি পাঠান। সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট হবার এটাই সুবিধে।  

    এক মাস হাতে আছে; আমি বাড়ি যাই; তারপরে নাহয় দুজনে মিলে একবার এখানে এসে, সব কিছু দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

    মামনির চিঠি এসেছে। সেটা পড়েও মনে হচ্ছে যে, এখুনি বাড়ি ফেরা দরকার।

    প্রণতা

    তোমার…।

    আমি রমিতা বছর ছয়েক আগে সেই অবিবাহিত আমি, বাবার অমতে দিল্লি থেকে একবারে চলে এসেছিলাম, যাকে ভালবাসি তাকেই বিয়ে করব বলে; আজও সেই বাবার অমতেই, পছন্দের চাকরিতে যোগ নাদিয়ে, আবার দিল্লি ছেড়ে ফিরে যাচ্ছি এই আমিই, আমার সেই নিজের সংসারে এখন অবশ্য আমি বিবাহিত এবারও সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি এই দু’বছর ধরে দিল্লিতে থাকবার সময়ে আমার আর রণেনের বিরহযাপনের, রাশি রাশি চিঠি; সেইসঙ্গে পরীক্ষাপাশের সার্টিফিকেট এবং সিমলা ইনস্টিটিউটে চাকরির নিয়োগপত্র

    ট্রেনে বসেবসে ভাবছি, বাবার বলা কথাটা মনে হয় তীব্র শ্লেষ থেকে খোঁচা দিতেই বাবা সেদিন বলেছিলেন যে, শাশুড়িস্বামীসংসার এসবই নাকি আমার ছুতো! অনার্স পাশ করে এমএ পড়িনি বলেই নাকি আত্মবিশ্বাসের অভাব হচ্ছে; বাবার কথা শুনে বিয়েটা তখন নাকরে, এমএ পড়াটা শেষ করলে, রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কাজ নেওয়াটা স্বচ্ছন্দ হত! বাবার এই কথাটা কিন্তু একেবারে ফেলে দেবার নয় তীব্র ইচ্ছেতেও জোর পাচ্ছি না কেন! হয়তো কারণেই রণেনও কোনও প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে আগ্রহী হয়েও হয় না পুরোদস্তুর পড়াশোনা শেষে ডিগ্রি পাওয়াও তো একটা ট্রেনিং সাধারণ মানুষ সেটা বোঝেও সহজে চাকরি তো সাধারণ মানুষেরাই করে!

    রণেনকেভিখিরিবলে খোঁচা দেবার প্রসঙ্গে বাবাকে তখনই বলতে ইচ্ছে করেছিল, আমার শাশুড়ি তাঁর ওই ভাঙাসংসার সামলেও আমাকে যে-পরিমাণ গয়না এবং দামি বাসনপত্র দিয়েছেন, তা কিন্তু আপনি আপনার কোনও মেয়েকেই দিতে পারেননি মায়ের একশো ভরি গয়না, আমাদের মায়ের অঙ্গে নাউঠলেও তা কাজে লেগেছে আপনারই ভারী দুল পরে, মায়ের একটা কানের লতি কেটে গেলেও, সেটুকু সেলাই করিয়ে দেওয়াটাকেও ভ্রূক্ষেপ করেননি আপনি এক কানে দুল পরে, অন্য কানটা ঘোমটায় ঢেকে মা যখন আড়ষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, তখনও আপনার চোখে পড়েনি জ্যাঠাইমাপিসিমারা ঠাট্টা করে মাকে যখন বলেছে, যাক বাবা! দুকানকাটা যে নও এই ঢের’— তখন আপনার কানে কেন বাজেনি সেই ব্যঙ্গ! খুব কি বাড়াবাড়ি হত, বাবাকে যদি বলে দিতাম, আপনি কি কাউকে ভালবেসেছেন কোনওদিন নিজেকে ছাড়া!

    বাড়ির রাস্তায় নেমেই মনে হল চাকরির জায়গায় যে অপেক্ষা, তা তো মাসখানেকের আমি না গেলেও অন্য কেউ ঠিকই তা পূরণ করে দেবে; কিন্তু আমার আর রণেনের সংসারে শূন্যতা মানে শূন্যতাই; আর একজনের অভাবে যা অপূরণীয়  

    আমাকে ফিরে পেয়ে সব চাইতে খুশি হল আমাদের সোদপুরের বাড়িটা পুবের রোদ বারান্দায় গড়িয়ে এল, একটু যেন বেশি উজ্জ্বলতা নিয়ে; স্টুডিয়ো ঘরে যেন প্রতিরাতেই পূর্ণিমা; গঙ্গায় কীভাঁটা আর কীজোয়ার, একের পর এক নৌকো তো ভেসেই চলেছে! সবচেয়ে বড় কথা যে, রণেন আর আমার এক বিরাট মুক্তি হয়েছে প্রতিদিন রাশিরাশি চিঠি লেখা এবং উৎকণ্ঠায় রাত জেগে কাটানোর থেকে কত যুগ পরে, একই বিছানায় শুয়ে, একেঅন্যকে জড়িয়ে, নিভৃত আদরে ঘুমিয়ে আছি দুজনে!

    এরই মধ্যে তারিখবিহীন সেই চিঠিটা এল, দিল্লি থেকে কী আশ্চর্য! বাবার বদলে মা লিখেছে! আর আমাকে না লিখে, ওই চিঠিখানা লিখেছে জামাইকে?  

    স্নেহের রণেন, আমার আশীর্ব্বাদ লইও মিতার পত্রে শুনলাম তুমি আমার পত্র পাওনি আমি একেবারে অবাক হোয়ে যাচ্চি তুমি যে বিজ পাঠাইয়াছিলে তাহা আমি পাইয়াছি পালং শাক লাগাইয়াছি এবং গাছ প্রচুর বেরিয়েছে আরগুলির সময় নাই বলে রেখে দিয়েছি আমি তোমায় খুব আশীব্বাদ কোরছি তুমি যেন দীর্ঘজীবী হও আর আমার তো দেশে যাবার বেশি দেরী নেই, তাই গিয়ে যেন দেখি মিতার একটী খোকা হয়েছে

    পুরোটা না পড়েই, ওই চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে হাসতে-হাসতে রণেন বলল, ‘এই নাও পড়ে দেখো; এখন থেকেই আমি কিন্তু খোকার বাপ হয়ে গেলাম!’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook