ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিছিল ম্যাজিক


    শুভময় মিত্র (September 17, 2024)
     

    কেউ দেখেছেন এমন মিছিল, যেখানে বর্ষণবিমুখ কোনও এক বর্ষাশেষের ভরা শরতে সাদা কাশবন কেন আন্দোলিত হচ্ছে না, তার জবাব চাওয়া হচ্ছে? কেউ শুনেছেন কি, সবার স্রষ্টা, সব কিছুর নিয়ন্ত্রক ঈশ্বরের পদত্যাগ দাবি করা হচ্ছে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর জন্য? প্রকৃতি যে কোন দপ্তরের অধীনে, কার দায়িত্বাধীন, কেউ জানে না। ধ্বংসের মাধ্যমে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেই স্রষ্টা খালাস। কাস্টমার কেয়ার বলে কিছু নেই ওঁর। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নেই। জবাবদিহির গল্প নেই। এদিকে সাক্ষাৎ না দিয়েও তিনি সর্বত্র বিরাজমান। সেপিয়েন্স ডিজাইনের ক্ষেত্রে ওঁর অন্যতম ব্যর্থতা হল লোভ, ক্রোধ, স্বার্থপরতাকে বাদ দিতে না পারা। তাই সময়ের  বৃত্তে  দ্রোহকাল ফিরে আসে বিচিত্র চেহারায়। কেউ এর বিচার চাইতে পারে না। 

    এরপরেও আমরা বেঁচে থাকি। আসলে বেঁচে থাকা বলে কিছু হয় না। ভাল-মন্দের ধোঁয়াটে আপেক্ষিকতার মধ্যে কেউ-কেউ বেঁচে যায়। কেউ আর পেরে ওঠে না। একশো ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী থাকে ক্ষমতার দখলদারেরা। মরিয়া অবস্থা হলে ক্ষতিগ্রস্তরা সংঘবদ্ধ হয়ে একটা প্রতিবাদ, আর্জি জানানো বা নিদেনপক্ষে বক্তব্য রাখার সুযোগ খোঁজেন। শুরু হয় অর্গ্যানাইজড মুভমেন্ট। বেরোয় মিছিল। পরিস্থিতির গুরুত্ব জোরালো হলে আটকানোর চেষ্টা হয়। কখনও ব্যারিকেড ভেঙে যায়। কখনও মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। গুলি ছুটে গিয়ে মৃত্যু ঘটলে শাসক বেকায়দায় পড়বে, সরকার পড়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিক অতীতে তা আমরা দেখেছি। তাই জিন্দা রেখে ফুঁ দিয়ে মিছিলকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য অন্য রাস্তা বেছে নেওয়া হয়। সম্প্রচারমাধ্যমকে কুক্ষিগত করে ক্রমাগত মিথ্যে প্রচার চালিয়ে, ফেক নিউজ ছড়িয়ে বিষয়টা গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা আজকের কমন প্র্যাকটিস। টিয়ার গ্যাস তো আছেই, জাস্ট কাঁদিয়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আছে জলকামান, ক্রোধের উত্তাপ প্রশমনের পলিটিকালি কারেক্ট নিরাপদ ডিভাইস। কখনও মিছিলকারী প্রতিবাদীদের স্রেফ অপেক্ষা করিয়ে ক্লান্ত করে দেওয়ার প্ল্যান ভাঁজে প্রশাসন, খারাপ কাজটা করতে হয় চাকুরীজীবী পুলিশকে। সময়ের সঙ্গে থিতিয়ে আসে অনেক কিছুই। সব ক’টি ঘটনা ঘটেছে এবারে কিন্তু কোনও কুমতলবই কার্যকরী হয়নি। 

    আসলে মিছিল-ফিছিল চায় না কেউ। আসছে শুনলে দরজা-জানলা বন্ধ হয়ে যায়। তার ফাঁক দিয়ে দেখে নেওয়া হয় চলন্ত লোকগুলোর চেহারা। ব্যানারের শব্দমালা। কানে আসে ঢেউয়ের মাথায় কথার ফেনা ভাঙার কর্কশ শব্দ। মিছিল চলে যাওয়ার পরে কিছু সাহসী কুকুর বেরিয়ে আসে, গলা তোলে, ক্ষণিকের শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার প্রতিবাদে। সুখী গৃহকোণের ছায়ায় বসে মানুষ অধিকাংশ সময় ভাবে না যে, মিছিলটা মানুষেরই ছিল। শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে বিঘ্ন ঘটায়, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে তারা রোদে পুড়ে হাঁটতে আসেনি। রিলে, মলে, নেটফ্লিক্সের দাবানলে আচ্ছন্ন  অবস্থায় লোকে বৃহত্তর জনস্বার্থের কথা ভাবতেই চায় না। আসল গণশত্রু কারা নির্ধারণ করার উদ্যোগটুকু নিতে চায় না আমোদগেঁড়ে জনতা। ক্লান্তি। অপরিসীম ক্লান্তি। ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন থাকাই রীতি। কেউ চায় না ঘুম ভেঙে যাক। এরই মধ্যে কিছু বেয়াড়া লোক গেয়ে ওঠে ‘ঘুম ভাঙার গান’। কান সরানো শক্ত হয়ে ওঠে।

    মিছিল তৈরি হয়েছে চিরকাল। হচ্ছে এবং  হবেও। অন্যায় সীমা ছাড়িয়ে গেলে একদল মানুষের চোয়াল শক্ত করে রাস্তায় না নেমে উপায় থাকে না। কেউ তাদের কুচকাওয়াজের ক্র্যাশ কোর্স করায় না। কোনও ফ্যাশন ডিজাইনার তাদের পোশাকের নকশা করে দেয় না। তা সত্ত্বেও মিছিল বেরোয় মানুষ অধ্যুষিত জনপদে। জনপদ হল সেই আপাতসভ্য অঞ্চল, যেখানে জঙ্গলরাজের নিয়ম খাটে না। রাতের অন্ধকারে সেখানে হিংস্র শ্বাপদের হানা দিয়ে শিকার করার সাহস পাওয়ার কথা নয়। সেখানে যন্ত্রের মন্ত্রে রাতের ঘর দিবাসূর্যের চেয়েও বেশি ঝলমল করার কথা। নগর থেকে গ্রামে— খাদ্যে, বাদ্যে, নৃত্যে, গীতিতে মানবসভ্যতা প্রতিনিয়ত অটো আপডেটেড, আপগ্রেডেড হতে থাকে। কিছু লাল-হলুদ-সবুজ আলোর বাহারি অনুশাসন রেখে দেওয়া হয় যাতে অজানা কারণে রঙিন জীবনে বর্ণবিপর্যয় না ঘটে। কিন্তু অশান্তি ফুরোয় না। ফিরে আসে আতঙ্ক। যদিও বিজ্ঞাপিত হয়, জীবন নাকি আগের চেয়েও বেশি শাইনিং, সব ঠিকঠাক।

    ব্যক্তিবাদী সমাজ। আমাদের প্রত্যেকের আলাদা অ্যাকাউন্ট, আলাদা আধার, বেঁচে থাকার আলাদা পাসওয়ার্ড। বিবিধের মাঝে মিলন সুখ কাম্য হলেও, গ্যারান্টিযুক্ত নয়। এখানেই সূক্ষ্ম, প্রায় অদৃশ্য একটা সুতোর মতো দাগ কখনও-কখনও চিড়, পরে ফাটলে পরিবর্তিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে কখনও মনে হয় আইন, নিয়ম ও সংস্কৃতির বজ্র-গঁদে তা জোড়া লেগে গেছে। মনের ভুল। যখন হৃৎপিণ্ড পিঠে এসে ঠেকে, পিঠ কাঁটাতারে, মানুষ বাধ্য হয় পথে নেমে আসতে। ঈশ্বরকে ভুলে সংগঠিত জনস্রোত ধাবিত হয় চিহ্নিত এক জনগোষ্ঠীর দিকে। এই সময়ে একটা ‘ডাক’-এর দরকার পড়ে। আধুনিক দুনিয়ায় আহ্বান জানানোটা সহজতর হয়েছে। এক বোতামের স্পর্শে জড়ো করে ফেলা যায় সুবিশাল এক জনগোষ্ঠীকে। তারপর মুখে-মুখে শুধু নয়, স্ক্রিনে-স্ক্রিনে, চোখে-চোখে, আহ্বানের ব্যাটন ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে, দ্রুতগতিতে। ডাক সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলে জনসমাবেশে বিলম্ব হয় না। সেখানে পৌঁছে একেবারেই অপরিচিত মুখগুলো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলে, সবাই সবার পূর্বপরিচিত। বাড়তে শুরু করে মিছিলের দৈর্ঘ্য। খাঁটি মিছিলের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সহজ নয়। হ্যাভস-দের মিছিল হয় না। মিছিল হল হ্যাভনট-দের চলমান একত্রীকরণ। এর বিরোধিতা হতে বাধ্য। স্বার্থের বিরুদ্ধে পালটা স্বার্থ। অবধারিতভাবে এসে পড়ে দলীয় রাজনীতির রং। সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। মিছিলকারীরা স্পোর্টিং হলেও সাইডলাইন পেরিয়ে মাঠে ঢুকে পড়ে ভায়োলেন্স। মিছিলের মনোবল ভেঙে দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্যোগ চোখে পড়ে। যথেষ্ট অরাজনৈতিক জনসমর্থন থাকলে বিক্ষোভকারীরা এগোতে পারে। অনেক সময়ে ব্যর্থ হয়। মেনে নিতে হয় মিথ্যার জয়কে। বিজয়ীরা তখন মেতে ওঠে বিজয়োল্লাসে। ঠিক এই সময়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। যারা মিছিলে সামিল হয়নি, দর্শকের ভূমিকায় থেকেছে, মিছিলের সঙ্গে হয়তো তাদের স্বার্থও জড়িত, তারাও মেতে ওঠে জিতে যাওয়া দলটার সঙ্গে। ভুলেও ভেবে দেখে না, সদ্য পরাজিত লোকগুলো ঠিক কাদের জন্য লড়াই করতে এসেছিল। লাতিন অ্যামেরিকার স্টার টুপি উদাহরণ খুঁজতে হবে না। নিজের ঘরদুয়ারের বাইরেটা-ভেতরটা এক ঝলক দেখে নিলেই চলবে।

    মিছিলের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ধূপ-ধুনো দিয়ে যতই স্টেরিলাইজ করা হোক না কেন, মিছিলমাত্রেই রাজনৈতিক। দলীয় বা আঞ্চলিক রাজনীতির কথা বলছি না। দুনিয়ার প্রায় সমস্ত মিছিলের জন্মদাতা রাজসৃষ্ট অনৈতিকতা। তাহলে সুখের মিছিল বলে কি কিছু হয় না? দুর্গাপুজোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, দেশের ওয়ার্ল্ড কাপ জয়, জগন্নাথের রথ, খুশির সেলিব্রেশনে মানুষের পথে নামা, এগিয়ে চলা, সবই বিচিত্রধর্মী রঙিন জনপদযাত্রার জন্ম দিয়েছে। তবে, একটি ছোট্ট মিস্টেক না করলেই ভাল হয়। শোভাযাত্রা মাত্রেই মিছিল কিন্তু সব মিছিল শোভাযাত্রা নয়। মিছিলকে সুখের, ফুর্তির চাঁদোয়ার নীচে রাখা যায় না। চাতুরি করে ‘শোভা’ শব্দটি এখানে গুঁজে দিলে ভুল হবে। নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, মিছিলের চেহারা অহিংস হতে পারে কিন্তু এর সূচনার মধ্যে নিশ্চিতভাবে নিহিত রয়েছে দীর্ঘ, ভয়াবহ বঞ্চনার শিকড়। তাই মিছিলমাত্রেই একটা সম্ভ্রমের দাবি রাখে। নো ডিবেট, প্লেইন হিউম্যানিটি, ওকে? আজকের পৃথিবীতে সব খবরই তো হাতের মুঠোয়। কারুর কিছুই জানতে বাকি থাকে না। যদি মনে হয় এগিয়ে আসা দলটা সমাজ-সংস্কারের মুখোশ পরে আসছে, তাড়িয়ে দিলেই হয়। তা মনে না হলে অন্তত সহমর্মিতার হাতটুকু এগিয়ে দিতে পারেন। কিছু না জেনে একটা মিছিলকে চোখ বুঝে ঘরের খেয়ে বনের হায়না তাড়ানো, ফুটেজলোভী ঝামেলাবাজ বা সেলিব্রিটিদের লোক দেখানো ফ্যাশন প্যারেড বলে দাগিয়ে দেবেন না। 

    মিছিল আয়োজন করা, তাকে নেতৃত্ব দেওয়া, কঠিন কাজ। সচেতন, সুবুদ্ধিপ্রসূত জনযাত্রার অজস্র সার্থক মডেল দেখেছি আমরা। স্বাধীনতার সময়কালটি স্মরণ করা যেতে পারে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন শাসকের চোখে প্রায় গোটা দেশটির নাম হয়ে উঠেছিল জঙ্গিপুর। ইতিহাসে মুদ্রিত সব কিছু ঠিক, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। আলেকজান্ডারকে আমরা কেন গ্রেট বলি? দেশ দখলের লোভে খুনোখুনি করার বিপুল দলবদ্ধ চেষ্টাকে আমরা কেন গ্লোরিফাই করি? মোগলদের ক্ষেত্রে ঘেন্নাটা আজও রয়ে গেছে। একদা হিন্দু রাষ্ট্র, ইসলামিক আগ্রাসনের তিক্ততার কথা অনেকে আজও ভুলতে পারেনি। কয়েক শতক পেরিয়ে গেলেও সাম্প্রদায়িকতার বীজটি নির্মূল করা যায়নি। উলটে, ফ্যানাটিক, ফ্যাসিস্ট, ধর্মান্ধ এক নির্বাচিত সরকার একে হাতিয়ার করে চলেছে নিজ স্বার্থ কায়েম করতে। দেশাত্মবোধের নামে আত্মবিস্মৃত এক জনগোষ্ঠীকে নির্বোধ ধর্মান্ধতার ক্যাপসুলে ভরে ফেলার ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি প্রতিনিয়ত। একদা ত্যাগের প্রতীক গেরুয়া রঙের চূড়ান্ত অপব্যবহারের সাক্ষী থাকছি আমরা। তবে, এদের অশ্লীল মিছিলগুলোর অসাড়তা, নির্বুদ্ধিতার চেহারা মানুষ একটু-একটু করে বুঝতে পারছে, এটুকুই স্বস্তির ব্যাপার। তাহলে বুদ্ধিমান মানুষের নেতৃত্বে গরীয়ান কোনও মিছিলের উদাহরণ কোথায় পাব? 

    প্রাক্‌-স্বাধীনতা যুগে জাতীয়তাবোধের সংজ্ঞাটা অনেকটাই স্পষ্ট ছিল মানুষের মধ্যে। ইন্টারনেট না থাকলেও ভারতবর্ষকে অনেকখানি এক করা গিয়েছিল। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে-সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ ঘটেছিল, তা এর আগে কোনও বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে দেখা যায়নি। সদর্থক ভাবনাচিন্তা, বুদ্ধিমত্তানির্ভর রাজনীতি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গতি দিয়েছিল। সুভাষ চেষ্টা করেছিলেন সামরিক আক্রমণের। ব্যর্থ হয়েছিলেন। নেতাজির সশস্ত্র মিছিলের উপযোগিতা নিয়ে আজও তরজা চলে। কিন্তু তিনি সাহস দেখিয়েছিলেন দেশের স্বার্থে। গান্ধী ছিলেন অন্য লবির লোক। প্রাণক্ষয়ী অসম যুদ্ধের পরিবর্তে শত্রুপক্ষের ওপর মারাত্মক চাপ তৈরি করার জন্য পেশি নয়, মানুষের সেন্টিমেন্টাল প্রেশার অনেক বেশি কার্যকরী হতে পারে সেটি বুঝেছিলেন।  সামরিক উর্দি নয়, খাটো ধুতি পরিহিত ধুরন্ধর মানুষটা প্রথমেই প্রতিবাদের মডেলকে অহিংস প্যাকেজে নিয়ে এলেন। কংগ্রেসের রাজনৈতিক নেতা কর্মী নয়, আশ্রমের ৭৮জন বাসিন্দাকে নিয়ে শুরু করলেন পদযাত্রা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম প্রথমে হাসাহাসি করেছিল। গান্ধীর নেতৃত্বে সবরমতী থেকে মিছিলটা চলতে শুরু করেছিল ১২ মার্চ, ১৯৩০ সালে। লোক জড়ো হতে শুরু করে। মিছিল আরও স্ফীত হয়ে ওঠে। ৬ এপ্রিল কয়েক কিলোমিটার লম্বা  চেহারা নেয় সেই মিছিল। ওই আইন অমান্যের প্রভাব পড়েছিল দেশজুড়ে। দেশের মানুষ অনুভব করেছিল, স্রেফ হুজুগ নয়, যারা ওই দলে ভিড়েছেন, তারা ও অন্যেরা একই দেশের নিপীড়িত মানুষ। গান্ধী কোনওদিনই সমালোচনার ঊর্দ্ধে নন। কিন্তু লবণ সত্যাগ্রহের মাধ্যমে এত মানুষকে সামিল করার ওজনটা টলিয়ে দিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদীদের, এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।  লাইন করে হেঁটে না গেলেও,  একমুখী ভাবনার মিছিলও যে জবরদস্ত হতে পারে, তা অন্য মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, নজরুল। গানের মাধ্যমে দেশাত্মবোধের জাগরণ জনচেতনায় জোয়ার এনেছিল। স্লোগানে সুর সঞ্চার করে ভাবগত মিছিলে নতুন মাত্রা জুড়তে সক্ষম হয়েছিলেন বিরল ভাবনার কিছু মানুষ। 

     ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে
    … আর পারবে ভোলাতে মধুমাখা ছুরিতে
    জনতাকে পারবে না ভোলাতে।
    আর পারবে না দোলাতে মরীচিকা মায়াতে
    বিভেদের ছলনায় ছলিতে
    মিছিলের গর্জন, দুর্জয় শপথে গরজে ঐ গরজে
    আজ হরতাল, আজ চাকা বন্ধ।’ 

    গানটির শুরুতেই স্রষ্টা সলিল চৌধুরী বলছেন, ‘১৯৪৬ সালের ২৯শে জুলাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অত্যুজ্জ্বল দিন। নৌবিদ্রোহের সমর্থনে সারা ভারতব্যাপী যে ধর্মঘট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শবাধারে শেষ পেরেক ঠুকেছিল, এই গানটি রচিত হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক দিনে।’ দেশ শেষপর্যন্ত স্বাধীন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু আরব্য রজনীর ম্যাজিক ল্যাম্পের আলোয় স্বাধীন ভারতবাসী শান্তির কার্পেটে সুখনিদ্রায় আবিষ্ট হতে পেরেছিল, তা নয়। এক রাজের সমাপ্তি আর এক রাজশক্তির জন্ম দিয়েছিল। প্রয়োজন হয়েছিল নয়া প্রতিবাদের। আবার কলম ধরেছিলেন সলিল, ১৯৪৮ সালে। লিখেছিলেন— 

    ‘…আমার প্রতি নিঃশ্বাসের বিষে
    বিশ্বের বঞ্চনার ভাষা
    দারুণ বিস্ফোরণ যেন
    ধ্বংসের গর্জনে আসে
    যত বিপ্লব বিদ্রোহের আমি সাথী
    আমি মাতি যুদ্ধেও হেথায় সেথায়
    মানুষের মুক্তির বিপন্নতায়…’ 

    সলিল জানিয়েছিলেন, ‘এই গানটি একাধারে একটি প্রার্থনা। এবং প্রতিজ্ঞা। সুবিধাবাদের প্রলোভন চিরদিন দুর্বলচিত্ত বিপ্লবীকে পথ হারাবার প্ররোচনা দিয়ে থাকে। তখন তাকে মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে হয় বার বার— ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন, দ্বিগুণ যেন জ্বলে দ্বিগুণ’। চল্লিশের দশকের কোনও নিউজ রিলে এইসব গান গাইতে-গাইতে এগিয়ে আসা মিছিলের দৃশ্য আমরা কেউ দেখিনি। কারণ তেমন ঘটনা ঘটেইনি। সংখ্যায় ঠিক কত হলে এক দল এগিয়ে চলা মানুষকে মিছিলের তকমা দেওয়া যেতে পারে, আমার জানা নেই। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এমন শব্দসমৃদ্ধ গানের মিছিল মানুষের ঘুম ভাঙিয়েছিল, অন্তত কিছুটা হলেও। দুটি গানের মধ্যে কয়েকটি কি-ওয়ার্ড রয়েছে, ‘বিভেদের ছলনায় ছলিতে’, ‘বিশ্বের বঞ্চনার ভাষা’, যেখানে পরিস্থিতিকে পিন পয়েন্ট করা রয়েছে। সংস্কৃতি সুনামির দাপট কতখানি কার্যকরী হতে পারে, তা নিয়ে সে-সময়ে বিরোধীচর্চা হয়নি। আজ কিন্তু হচ্ছে। হলেও, ভেসে যাচ্ছে অকথা-কুকথা, সত্যের জয়স্তব করা সংগীতে। সম্প্রতি অরিজিৎ সিংয়ের প্রতিবাদের গান, ‘আর কবে’ ওই ট্র্যাডিশনকেই বয়ে নিয়ে চলেছে। 

    সমকালে ফিরে আসতেই হচ্ছে। অতীতে বীভৎসতার বহু রূপ একাধিকবার দেখেছি আমরা। সাম্প্রতিকতম মর্মান্তিক ঘটনার পর স্তম্ভিত জনগণ প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি অনেক কিছুই। যেহেতু খবর হল একজন অপরাধী ধরা পড়েছে, অতএব বিচার, সাজা হবে অথবা ধামাচাপা পড়ে যাবে, এর যে-কোনও একটা হতে চলেছে কিছুদিনের মধ্যে, এমনই ধরে নেওয়া গেল। ব্যাপারটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা রইল না পরবর্তী আরও কিছু ঘটনার জেরে। আভাস পাওয়া গেল বিশাল এক সংগঠিত দুর্নীতির, যা বৃহৎ অর্থে ভয়ানক জনবিরোধী। ছাত্র ডাক্তাররা জোরালো প্রতিবাদে নামলেন। খবর ছড়াল দ্রুত। প্রশাসন ও পুলিশকে কাঠগড়ায় তুলল জনগণ। আওয়াজ উঠল ‘বিচার চাই’। আহ্বান এল রাত দখলের। একটিমাত্র অপরাধীর বিরুদ্ধে শুধু নয়, জনআক্রোশ বর্ধিত হল বৃহত্তর দুর্বৃত্তগোষ্ঠীর প্রতি। প্রায় সর্বস্তরের জনগণ সামিল হলেন প্রতিবাদযুদ্ধে। এক নজিরবিহীন ব্যাপার। সাতে-পাঁচে, গোলমালে থাকতে না চাওয়া সাধারণ মানুষ ভেঙে বেরিয়ে এলেন মজ্জাগত, অলস ঔদাসীন্যের দীর্ঘ অভ্যেস থেকে। মিছিল বেরোলো একের পর এক। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলেও নিয়ন্ত্রণ রইল মিছিলে। জনসমর্থিত জুনিয়র ডাক্তাররা অভাবনীয় সংযম ও বুদ্ধিমত্তাকে সামনে রাখলেন। নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল থেকে। নজর রাখলেন আন্দোলনে, যাতে কোনও রাজনৈতিক পতাকার রং না লাগে। বিরোধী রাজনৈতিক দলেরা রাস্তায় নামল। কিন্তু মূল আন্দোলনে এদের সঙ্গ পরিহার করা হল। দলগত রাজনীতির গোলমেলে ঘোরপ্যাঁচে মুভমেন্ট বিশৃঙ্খল হয়ে যেতে পারে, অনুভব করেছিলেন সবাই। রাত দখলের অভিযানের স্মার্ট চরিত্র নতুন এক জনগর্জনের চেহারা দেখাল। 

    শুধু কলকাতায় নয়, রাজ্য ছাড়িয়ে সারা দেশে ডাক্তারদের এই সম্পূর্ণ রাজনীতির রং না মাখা কুচকাওয়াজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিলেন সবাই। দোষীর দ্রুত বিচার, শাস্তির দাবির পাশাপাশি শাসক নিয়ন্ত্রিত পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠল। ডাক্তারদের একটি মিছিল এগিয়ে গেল লালবাজারের দিকে। অস্ত্রসজ্জিত ভায়োলেন্সের সম্ভাবনা ছিল না কিন্তু সুভদ্র এই মিছিলকে থামানোর চেষ্টা হল বলপ্রয়োগ করে। রাজপথে উঠল দুর্ভেদ্য লোহার প্রাচীর। তার সামনে অনড় অবস্থায় রাস্তায় বসলেন সবাই। এই মিছিল অযথা গোলমাল পাকিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করে জনস্বার্থ বিঘ্নিত করতে চায়, এই তকমা কিছুতেই লাগান গেল না প্রতিবাদীদের ওপর। দুর্ভাগ্য পুলিশের, যারা জনগণেরই অংশ, জনমানসে রাতারাতি স্থান পেলেন অপরাধীদের সঙ্গে, একাসনে। অন্যায় যে সহে, তার বিরুদ্ধে জিহাদ দেখানোর অভাবনীয় ঘটনা দেখলাম আমরা, এই মরা শহরের বুকে। ব্যারিকেডের এপাশ আর ওপাশ। রোদে-জলে পুড়ে ক্লান্ত হলেও অদৃষ্টপূর্ব শান্তি ও দৃঢ়তার সমন্বয়ে মিছিল রইল সংযত। ভোরের আলোয় সেই মিছিল গেয়ে উঠল জাতীয় সংগীত। বাধ্য হয়ে আপাত গণশত্রু পুলিশ একই সুরে সুর মেলাতে বাধ্য হল। আসলে পুলিশ নয়, দুষ্টচক্রের প্রথম পরাজয় নথিবদ্ধ হল শহরের বুকে। ব্যারিকেড তুলে নিতে হল। মিছিল এগোল। প্রতিনিধিরা তাদের মূল দাবিগুলি আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করলেন পুলিশ-প্রধানের কাছে, অন ক্যামেরা, যার মধ্যে অন্যতম ছিল তাঁরই পদত্যাগ। স্মারক হিসেবে ওঁকেই উপহার দেওয়া হল গোলাপশোভিত একটি শিরদাঁড়ার মডেল। শেষ কবে ভয়ংকর পরিস্থিতিতে এমন সৎবুদ্ধি সম্বলিত প্রতিবাদের বিদ্রোহ চিত্র দেখেছি আমরা? প্রবল পরিস্থিতির চাপে নতিস্বীকার না করে নিজেদের শিরদাঁড়া শক্ত রেখে মনুষ্যত্বের প্রতি সমর্থনে অন্য মানুষের ভূমিকা, রিল নয়, রিয়েল লাইফে দেখলাম একের পর এক এগিয়ে আসা, মধ্যরাতের স্লোগান-মুখরিত মিছিলগুলোয়। অনেকে সঙ্গে আনলেন নাবালক-নাবালিকা সন্তানদের। শেষ কয়েকদিনে এদের নতুন শেখা শব্দভাণ্ডারে সংযোজিত হল কয়েকটি নতুন শব্দ। ধর্ষণ। খুন। জাস্টিস। বিচার।

    এই মুহূর্তে সবাই তাকিয়ে আছেন অনেকগুলো সম্ভাবনার দিকে। কেউ আশাবাদী। কেউ নন। ঈশ্বরের সুপ্রিম পাওয়ার নয়, বহু মুখ তাকিয়ে আছে সুপ্রিম কোর্টের দিকে। একটি ব্যাপারে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন, তা হল যুবসমাজের উজ্জ্বল এক অংশের সাম্প্রতিক কীর্তিকলাপ। আস্থা ফিরেছে ওই প্রজন্মের প্রতি, একদা যাদের ঘুমিয়ে পড়া বাঙালি হিসেবে দেখাই দস্তুর ছিল। কিছুতেই ভয় না পাওয়া জুনিয়র ডাক্তারদের এই মুভমেন্ট দীর্ঘদিনের বহুমাত্রিক পচন ধরা সমাজের চেহারাটা সামনে এনে দিয়েছে।জেগেছে আগ্নেয়গিরি। আগুন ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা গোপন থাকছে না। সব কিছুর চালচিত্রে রয়েছে বিচারের নামে অবিচারের প্রহসন, সাজাপ্রাপ্ত দোষীদের মুক্তির ঘটনার অতীত স্মৃতি। সবাই বুঝতে পারছেন যে তাদের লোকালয়ের নাম আর যাই হোক নিশ্চিন্দিপুর নয়। এমন খারাপ সময়েও সাধারণ মানুষ অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছেন নির্ভয়, নির্ভয়া রূপে। ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে একদল প্রতিবাদী মানুষকে রাষ্ট্রশক্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সামরিক পেশির আস্ফালনে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার পরে, জুন মাসের ৫ তারিখে দুনিয়া দেখেছিল এক ঐতিহাসিক দৃশ্য। ৫৯টি ট্যাঙ্কের সামনে শান্তভাবে পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে একটি নিরস্ত্র মানুষ। সে একাই, একটি মিছিল হয়ে থামিয়ে দিয়েছিল এগিয়ে আসা সাঁজোয়া গাড়িগুলোকে। কেউ বলবেন, ক্ষণিকের বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দুনিয়া কিন্তু একে মনে রাখবে বেনজির প্রতিবাদের সার্থক চিত্রায়ণ হিসেবে। স্বার্থপরতার বিষ যখন কিছু মানুষের কাছে অন্যের জন্য নির্ধারিত পানীয় হয়ে ওঠে, লিভ অ্যান্ড লেট ডাইয়ের আইন কায়েম করতে চায়, প্রতিরোধ ফিরে আসে অদ্ভুত চেহারায়। সম্প্রতি বার বার চোখে পড়ছে আর এক স্থির মিছিল, মোমবাতির আভায় উদ্ভাসিত আদিগন্ত হিউম্যান চেন। জানতে ইচ্ছে করছে এই অভাবনীয় জনসমর্থনের উৎস। কোন অন্তর্নিহিত শক্তির জোরে এত মানুষ অনুভব করলেন এমন এক অন্তরের তাগিদ, তুলে নিলেন আগুনের পরশমণি?  

    মনে পড়ে যাচ্ছে আর একটা ঘটনা। কিছুদিন আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উচ্ছন্নে যাওয়া এক দেশে মিছিল করে আসা একদল নিরীহ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অপমান করা, ভিক্ষাপাত্র রাস্তায় ফেলে দেওয়া, নির্বিকার পথচারীদের দেখেও না দেখার ক্লিপটি হয়তো অনেকেই দেখেছেন। এই হেনস্থার মধ্যে মানুষগুলো কাউন্টার ভায়োলেন্স করেননি। সে-ক্ষমতাও ছিল না তাদের। কিন্তু পালিয়েও যাননি। আসন্ন আঘাতে শরীর ক্ষত-বিক্ষত হতে পারে, এর বেশি কিছু নয়, জানতেন তাঁরা।  তাই বুক পেতে অপেক্ষা করে গিয়েছিলেন ওঁরা। জেনেবুঝে। ক্লান্ত অত্যাচারী এক সময়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। 

    ঘোর দুঃসময়ে অজস্রবার দেখা গেছে এক একটি প্রাণকে মিছিলসম শক্তিধর হয়ে উঠতে। অমানুষরা কোনওদিনই নির্মূল হবে না। আবার অকুতোভয় মানুষের এক হওয়া, শৃঙ্খলাবদ্ধ সততায় বলীয়ান হয়ে তাদের প্রতিহত করার পুণ্যচিত্রটিও ফিরে-ফিরে এসেছে, এ-কথা সবাই জানেন। মোহ  নয়, মিথ্যে জাদুর প্রতিশ্রুতি নয়, আজকের অজস্র মিছিল প্রমাণ দিয়েছে মনুষ্যত্বের অবিনশ্বর ম্যাজিকাল চরিত্র। এই ঐতিহাসিক প্রমাণ-প্রদীপ হাতে নিয়ে আমরা সকলেই তাকিয়ে আছি সুবিচারের আশায়। সম্প্রতি একটি কথা কানে এসেছে, ‘যত ভয় দেখাবে, আন্দোলন ততই জোরদার হবে’, আমাদের সবার মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে থাকতে পারার অন্যতম ড্রাইভিং ফোর্স এটাই।

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook