ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • যৌনসুখ, ‘সাইজ’, নৈতিকতা


    বিজলীরাজ পাত্র (September 7, 2024)
     

    Dose Size Matter— প্রশ্নটি শুনলেই যা মাথায় আসে, তা হল লিঙ্গ-দৈর্ঘ্য। ‘সাইজ’ শব্দের বিস্তার যাই থাক না কেন, এক্ষেত্রে ভাবনার স্তর পৌঁছয় লম্বালম্বি অর্থে। লিঙ্গের মাপ হয়ে ওঠে পৌরুষ প্রকাশের চাবিকাঠি। ছেলের দল আড্ডায়-মস্করায় জাহির করে বড়-ছোটর রঙ্গরসিকতা। অতঃপর ‘সাইজ’ বিষয়ক আলোচনার অভিমুখ মহিলারা হলেই বিবেচিত হয় ‘স্তন’, ‘কোমর’ বা ‘নিতম্ব/পাছা’র গঠন। পুরুষের চোখে নারীশরীরের এই পরিমাপ হয়ে ওঠার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই ইতিহাস বেঁচে আছে লোকমুখে, গল্প-উপন্যাসে, সিনেমার পর্দায়, পর্নোগ্রাফিতে, আরও হরেক পরিসরে। ১৪ মে ১৯২১ সনে হীরেন্দ্রকুমার সান্যাল বন্ধুবর সুশোভন সরকারকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন: ‘ভালো কথা— আমার বিবাহের খবরে আমি পুলকিত হয়েছি। পাত্রীর age, shape, antecendence কিছুই জানি না— নামটা তো তোমার মতে জানার দরকার নাই, কারণ সেটা accident মাত্র।’ এই পাত্রীর ‘shape’ কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে ‘স্তন’, ‘কোমর’ বা ‘নিতম্ব’র আকার। ‘সাইজ’ নেহাত অঙ্কের হিসেব নয়, তলে-তলে রয়ে যায় সমাজ-স্বীকৃত কামনাবাসনার বিভাব তথা stimuli। ঠিক কেমন আকারে-আয়তনে-যৌনকামনায় উত্তেজিত হতে হবে, আমাদের তার পূর্বনির্দিষ্ট দিকনির্দেশ থাকে ‘সাইজ’-এর ভেতর। পুরুষের একটি মেয়ের বিশেষ ‘সাইজ’ থেকে উত্তেজিত হওয়া শুধু শারীরিক প্রক্রিয়া নয়, জুড়ে আছে মানসিক নির্মিতি। উলটোপক্ষে, অনেক ক্ষেত্রে যখন মহিলাদের মাথায় আসে পুরুষের লিঙ্গ-বিষয়ক মিথিক ফ্যান্টাসি, সেখানেও সমান্তরালে রয়ে যায় দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার প্রতাপ। Koffee with Karan নামক একটি অনুষ্ঠানে একদা অভিনেত্রী করিনা কাপুরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: Does Size Matter? নায়িকার স্পষ্ট জবাব ছিল, ‘I think to me it does.’প্রশ্নটা ব্যক্তিগত চাহিদা নিয়ে নয়, বরং সেই প্রক্রিয়া, যা বানিয়ে তোলে ‘সাইজ’-এর ‘ক্ষমতা’। পুরুষ-নির্মিত এই মান্য সামাজিক যৌনকামনার কাঠামোর বাইরে যা কিছু তা পরিত্যাজ্য, বাতিল, অগ্রহণীয়। পুরুষদের ঠেকে মহিলাদের বিষয়ে যখন ‘নিমাই’ শব্দের অবতারণা হয়, তখন আসলে নেই মাই (স্তন) যার অর্থাৎ আকারে ছোট স্তন চিহ্নিত হয়। ‘ম্যানচেস্টার’ শব্দটিও একই অর্থে ব্যবহৃত। এমন পুরুষালি হাস্য-পরিহাসে মহিলাদের প্রতি রয়ে যায় চূড়ান্ত অপমান, সঙ্গে আরও-আরও সুখের খোঁজ।  

    ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ফরাসি চলচ্চিত্র Masculin Feminin যৌনচাহিদা, পুরুষ-নারীর অবস্থান এবং রাজনীতির গভীর আন্তঃসম্পর্কের পুনর্বিচার করে। জঁ-লুক গদার ছিলেন পরিচালক। দুই ছোকরা পল এবং রবার্ট, রাজনীতি-সচেতন, ভিয়েতনামে মার্কিন অগ্রাসনের বিপক্ষে, নিপীড়িতের বন্ধু, অনবরত প্রশ্ন রাখে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সেই তারা কামনাবাসনার প্রশ্নে মেনে চলে সমাজ-নির্মিত সুখের পরিকাঠামো। একটি কফির ঠেকে রবার্ট হাত বাড়িয়ে চিনির ঢেলা নেবার অছিলায় কিছু দূরে বসে থাকা মহিলার স্তন ছুঁয়ে নেয়। সুখের খবরটি ফিরে এসে বন্ধুবর পল-কে জানায়। অতএব, স্তনজোড়া কেমন দেখার শখ হয় পলের। চিনির ঢেলা নিয়ে ফিরে আসা পলের পর্যবেক্ষণ:  ‘Fabulous!’ কী দেখছিল সেদিন পল এবং রবার্ট! কীসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল তারা? উত্তরের ক্ষেত্র ‘সাইজ’কে  ঘিরে। যৌন-নৈতিকতার মিথ ভাঙা মানে শুধু বড় অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহ বা পরিবারগত মূল্যবোধের বিরোধিতা নয়, বরং যা ব্যক্তি আমার সুখের বিভাব (stimuli) তাদের আঁটোসাঁটো স্থিতিশীল ঘৃণ্য অবস্থানকে প্রশ্ন এবং কাঁটাছেড়া।

    কিন্তু এই ‘সাইজ’-সন্দর্ভ পুরুষ যেমন তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করে, মহিলারা কি আদৌ তেমন পথের পথিক? অবস্থান এবং তর্কটা বেশ জটিল। ১৯৯৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে কুলসুম আর তমিজের বাপের কথা দেখা যাক। তমিজের বাপের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কুলসুম। সেই তমিজের বাপ অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আর তার ঘুমন্ত শরীরটা নানা অছিলায় মেপে নিচ্ছে কুলসুম। কুলসুমের এই সচেতন দেখার সঙ্গে তমিজের বাপের এক ধরনের অবচেতন ইচ্ছের সমাবেশ ঘটান ইলিয়াস। লেখা হয়: ‘মাটিতে কুলসুমের ভারী পায়ের চাপে তমিজের বাপের রোগা কালো গতরে অল্প একটু হলেও সাড়া পড়ে, কী-সব বিড়বিড় করতে করতে  লুঙিটা সে তোলে আরেকটু ওপরে।’এই লুঙ্গি তোলার মধ্যে তমিজের বাপের এক ধরনের প্রদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ  পায়। কিন্তু কী দেখাতে চায় তমিজের বাপ! ইলিয়াস খোলাখুলি লেখেন: ‘লুঙি আরেকটু ওপরে উঠলেই বুড়ার কালো কালো কুচকুচে বিচির ওপর ন্যাতানো নুনুখানও বেরিয়ে পড়বে। ওটা দেখে লাভ কী কুলসুমের। কিন্তু স্বামীর লুঙি ঠিক করার চেষ্টা না করে কুলসুম চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকে। কান দুটো তার খাড়া করে রাখা, সমস্ত মনোযোগ দিয়ে সে তমিজের বাপের বিড়বিড় ধ্বনির আস্ত আস্ত শব্দগুলো শুনতে চায়।… তামিজের বাপ এখন কী স্বপ্ন দেখছে?’    

    নজর করা দরকার, লুঙ্গি তুললেও লিঙ্গের প্রদর্শন করে না তমিজের বাপ। বরং তমিজের বাপের ‘ন্যাতানো নুনু’-র  কথা আগে থেকেই জানে কুলসুম। সর্বোপরি এই লিঙ্গ ‘ন্যাতানো’ তথা যৌনশক্তিহীন বলেই কুলসুমের কাছে তা দেখা বা না-দেখা, লাভ-লোকসানের বিষয় হয়ে উঠেছে। ‘নুনু’ শব্দের ব্যবহারও খেয়াল করার মতো। ‘নুনু’ শব্দের  মধ্যে থাকতে পারে আঞ্চলিক-ভাষিক কাঠামো কিন্তু সাধারণত বাচ্চাদের অনুত্থিত লিঙ্গকেই ‘নুনু’ বলা হয়। কুলসুমের  কাছে ‘সাইজ’-এর প্রশ্নটি তাই মিথিক দৈর্ঘ্য-প্রস্থ হিসাবে নয়, কর্মক্ষমতার বিচারে বিবেচিত। কুলসুমের চাওয়া-পাওয়ার প্রসঙ্গটি বেশ জটিল। রহস্যটি লুকিয়ে আছে কুলসুমের চিন্তায় আসা তমিজের বাপের স্বপ্নের সাতকাহনে। কুলসুম কান পেতে শুনতে চায় তমিজের বাপ এমন খোয়াব দেখছে যার অর্থ সন্তানের স্নেহ, ভালবাসা। ইলিয়াস লেখেন: ‘নিজের খালি কোলে হাত রেখে স্বামীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত সে [কুলসুম] চোখ বুলায়। এই আবোর  মানুষটা কি তার বিয়ে-করা-বিবির শূন্য কোলের কথা কখনো ভাবে? তার কি হুঁশজ্ঞান কিছু আছে?’ সম্ভোগ-বাসনা এবং সন্তান-বাসনা মিলেমিশে একাকার হয়েছে কুলসুমের চিন্তায়। কিন্তু হোক না ‘ন্যাতানো নুনু’র অধিকারী, এই যে একজন পুরুষের শরীরকে অনেকক্ষণ ধরে নিজের মতো নিরীক্ষণ করে কুলসুম, নিজের মতো প্রশ্ন-সংশয়-উত্তর প্রস্তুত করে, এই পরিসর তৈরিতে ঘুমের বিশেষ ভূমিকা আছে। ‘ঘুম’ এমন এক যুগ্ম ক্ষেত্র প্রস্তুত করে সেখানে, তমিজের বাপের অবচেতনের পৌরুষ আর কুলসুমের কামনাবাসনার উদ্বেগঘটিত জিজ্ঞাসা নানান আবর্তে স্থান পায়।

    আজকের দিনে আমরা অনেকই জানি যে, সুখের প্রশ্নে ‘সাইজ’ শেষ কথা বলে না। কিন্তু তর্কটা হল, এটা জানার পরেও, বোঝার পরেও, কোনও-না-কোনও ভাবে আমরা ‘সাইজ’-জ্বরে আক্রান্ত। ‘জ্বর’ শব্দটা সচেতন ভাবেই ব্যবহার  করলাম। ‘সাইজ’ নিয়ে সারাক্ষণ আমরা পাগালামো করি না। কিন্তু এটা এমন এক উদ্বেগ, যা জ্বরের মতো আসে-যায়, অথবা থেকে যায় আসা-যাওয়ার মাঝে। ফরাসি দার্শনিক দেল্যুজ তাঁর Coldness and Cruelty (১৯৬৭) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কেমন করে ‘ফেটিসিজম’-এর সঙ্গে জুড়ে থাকে মর্ষকামী (masochism) প্রবৃত্তি। ‘ফেটিস’ অর্থাৎ কোনও বিশেষ বস্তু, লেদার-এর জ্যাকেট হতে পারে, হতে পারে জুতো, তার প্রতি যৌনআকর্ষণ। পুরুষের চোখে, মহিলা শিশ্ন-র (female phallus) অভাব থেকে জাত চালিয়ে নেওয়ার বিকল্প ‘ফেটিস’। দেল্যুজ-এর তত্ত্বকাঠামোয় বলা চলে শরীরের বিশেষ অঙ্গের ‘সাইজ’কে ঘিরে যে-ফ্যান্টাসি, তার সঙ্গে মর্ষকামী সুখের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ‘সাইজ’ ‘ফেটিস’ হয়ে ওঠে ফ্যান্টাসির হাত ধরে। ‘লিঙ্গ’ আর শুধু লিঙ্গ নয়, হয়ে পড়ে ‘ফেটিস’। উদ্বেগের পীড়া নিয়েই ব্যক্তিআমি ডুবে যাই ‘ফেটিস’-এর প্রেমে।

    তৃতীয় সাধারণাব্দে রচিত/সংকলিত বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’-এ মিলবে ‘সাইজ’ বিষয়ক বিশেষ সন্দর্ভ। লিঙ্গপ্রমাণানুসারে নায়ক তিন প্রকার— শশ (খরগোশ), বৃষ এবং অশ্ব। একইভাবে তিন নায়িকা— মৃগী, বড়বা এবং হস্তিনী। কিন্তু শুধু বাৎস্যায়ন থেকে এই নায়ক-নায়িকা বিভাজনের রহস্যভেদ মুশকিল। ত্রয়োদশ শতকের যশোধর  ইন্দ্রপাদ ‘কামসূত্র’কে অবলম্বন করে লিখলেন ‘জয়মঙ্গল’ টীকা। সেই টীকায় খোলসা করে বলা হল, ‘সাইজ’-এর ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে তিন প্রকারের নায়ক-নায়িকা। ইন্দ্রপাদের বয়ানে শশ, বৃষ এবং অশ্ব পুরুষের লিঙ্গ যথাক্রমে ছয়, নয় এবং বারো অঙ্গুলি পরিমাণ। একইভাবে মৃগী, বড়বা এবং হস্তিনী নায়িকার রন্ধ্র/ছিদ্রপথের দৈর্ঘ্য ছয়, নয়, বারো। এমতাবস্থায় বলবেন যশোধর, সমতা প্রতিষ্ঠায়, যথাযথ পরিমাপের প্রশ্নে যৌনমিলনে যথাযথ জুটি শশ এবং মৃগী (দু-পক্ষেই রইল ছয়-ছয়), বৃষ এবং বড়বা (দু-পক্ষেই রইল নয়-নয়), অশ্ব এবং হস্তিনী (দু-পক্ষেই রইল বারো-বারো)।

    অনেক পরে আঠারো শতকে যখন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি ভারতচন্দ্র ‘রসমঞ্জরী’ লিখছেন, সেখানে লিঙ্গের দৈর্ঘ্য অনুসারে নির্মিত নায়কের সংখ্যা চার— শশ, মৃগ, বৃষ এবং অশ্ব। আর তাদের লিঙ্গদৈর্ঘ্য যথাক্রমে ছয়, আট, দশ ও বারো। বাৎস্যায়নের সঙ্গে বিচার করলে এখানে জুড়ল নতুন ‘মৃগ’পুরুষ। অঙ্কের হিসাবটাও গেল বদলে। যা টীকাকার যশোধরের কাছে ছিল ছয়-নয়-বারো, সেটা নতুন রূপে হল ছয়-আট-দশ-বারো। যদি যশোধরের বয়ানকে x এবং ভারতচন্দ্রের কথাকে y ধরি, তাহলে বলতে হয় গাণিতিকভাবে x-এর ক্ষেত্রে নায়কদের লিঙ্গের ফারাক তৈরি হচ্ছে ৩ অঙ্গুলির ব্যবধানে। আর y-এর ক্ষেত্রে নায়কদের লিঙ্গদৈর্ঘ্যের ফারাক ২ রইল। তবে ভারতচন্দ্র নায়ক নিয়ে অত চিন্তিত নন, যতটা নায়িকা নিয়ে। নায়িকাও বেড়ে হল চার— পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিনী, হস্তিনী। আলাদা করে নায়িকাদের রন্ধ্র/ছিদ্রপথের দৈর্ঘ্য নিয়ে কিছু বলেননি ভারতচন্দ্র। তার মানে এই নয়, বাতিল হল ‘সাইজ’-এর প্রশ্ন। বরং ভারতচন্দ্রের লেখায় চূড়ান্ত রক্ষণশীল নৈতিকতার হাত ধরে বৈধতা পেল নারীশরীরের ‘সাইজ’ বিষয়ক সামাজিক সন্দর্ভ। লিখলেন ভারতচন্দ্র, ‘পদ্মিনী’ নারীর হবে ‘ক্ষুদ্র রন্ধ্র নাস’ এবং ‘ঘন কুচস্থল’। লোম থাকবে না, শরীর থেকে আসবে ‘পদ্মগন্ধ’। এই নারী হবে ‘সত্যবাদিনী’, থাকবে ‘দেবদ্বিজে ভক্তি’ আর স্বামীর প্রতি অনুরাগ (‘পতি অনুরক্তি’)। খেয়াল করা দরকার, নায়িকা হিসাবে পদ্মিনীকে একজন বিবাহিত নারী হিসাবে কল্পনা করছেন ভারতচন্দ্র। অগত্যা যেখানে ঘরের বউ শ্রেষ্ঠ নায়িকা, সেখানে ভারতচন্দ্রের পদ্মিনী আবশ্যিকভাবে সামজিক নৈতিকতার নিরিখে যৌনসুখের প্রশ্নে ‘অল্প রতিশক্তি’ সম্পন্না ‘নিদ্রা ভোগিনী’।

    ‘চিত্রিণী’ নায়িকা ‘প্রমাণ শরীর’, ‘নাভী সুগভীর’, ‘মৃদু হাসিনী’ এবং ‘সুকঠিন স্তন’। লোম থাকবে অল্প, শরীরে ক্ষারগন্ধ। ‘শয়ন-ভোজন’-এর ক্ষেত্রে ‘মধ্যচারিণী’। ‘শঙ্খিনী’-র লম্বা-লম্বা হাত-পা, থাকে অল্প লোম আর শরীরে মীনগন্ধ। আর একেবারে অন্তিমে ‘হস্তিনী’ নায়িকা। এমন নারীর ‘স্থূল কলেবর স্থূল পয়োধর’, ‘আহার বিস্তর নিদ্রাঘোরতর রমণে প্রখর পরগামিনী’। এই মেয়েরা হয় ‘মিথ্যাবাদিনী’, ধর্মকে ভয় পায় না, আর ‘দম্ভ নিরন্তর’। অঙ্গে লোমের ছড়াছড়ি আর শরীর থেকে আসে ‘মদগন্ধ’। নজর করা দরকার, ভারতচন্দ্রের নায়িকাভাগের মধ্যে বিপরীত যুগ্মপদ (binary opposite) তৈরির প্রক্রিয়াটি। ভারতচন্দ্র ভাল এবং মন্দত্বের ভিত্তিতে গড়লেন পদ্মিনী এবং হস্তিনীর বৈপরীত্য। চিত্রিণী বা শঙ্খিনী নিয়ে তেমন কোনও নৈতিক মানদণ্ড হাজির করা হয়নি। বরং ভারতচন্দ্রের আগ্রহ দুই বিপরীত সত্তা নিয়ে। মাঝের অবস্থান নিয়ে কোনও মূল্যবোধের প্রসঙ্গ আসেনি তাঁর লেখায়। বৈপরীত্যের ক্ষেত্রে সরাসরি  বক্তব্য: পদ্মিনী-র সাইজ তথা গঠন যথাযথ, সে সত্য এবং ধর্মের পক্ষে, কামশক্তি অল্প। আর হস্তিনীর সাইজ বেঢপ, সে মিথ্যা এবং অধর্মের পক্ষে, কামশক্তি প্রবল। বাৎস্যায়নের নায়িকাভাগে এমন নৈতিক মূল্যবোধের প্রশ্ন অনুপস্থিত। বলছি না যে বাৎস্যায়ন নৈতিক জিজ্ঞাসাকে স্থান দেননি তাঁর আলোচনায়। নিশ্চিতভাবেই নৈতিকতা রয়েছে সেখানে, কিন্তু সেই নৈতিকতা সামজিক মান্য মূল্যবোধে বিবেচিত নয়। বরং বাৎস্যায়ন বা ইন্দ্রপাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল, কেমন করে যৌনসুখের জন্য লিঙ্গদৈর্ঘ্য এবং রন্ধ্র/ছিদ্রপথের দৈর্ঘ্য মেপে গড়া হবে যথাযথ জুটি। আর সেখানে ভারতচন্দ্র ফাঁদলেন কথা: পদ্মিনীর মতো ভাল/আদর্শ নায়িকার থাকবে অল্প কামশক্তি। কার্যত যৌনসুখের প্রস্তাব করতে গিয়ে সুখের পথটাকেই ছেঁটে বাতিল করলেন তিনি।     

    প্রশ্ন এটা নয় যে ঠিক কবে বাৎস্যায়ন বা ইন্দ্রপাদ থেকে সরে এসে এমন ‘সাইজ’ এবং নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ন্ত্রিত শরীর-বিষয়ক মাপা যৌনসু্খের দিকে ঝুঁকলাম আমরা। বরং আমরা ভাবি, উনিশ শতকেই ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতায় ছেদন হল মোদের যৌনসুখের রাস্তা। তার আগে ছিলুম মোরা মুক্ত বিহঙ্গ— সে-গুড়ে বালি। কোনও বিলিতি শত্রুর প্রয়োজন নেই আমাদের যৌনকামনা কেটে-ছেঁটে সাফ করার জন্য। আমরা নিজেরাই যথেষ্ট। নিশ্চিতভাবেই ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা এক ধরনের নতুন ঔপনিবেশিক মূল্যবোধের বোঝা চাপাল আমাদের ওপর, কিন্তু খোঁজ এটাই যে, সেই বোঝা গ্রহণের জন্য বহু আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম আমরা। ঔপনিবেশিকতার প্রসঙ্গটি বেশ জটিল। ঔপনিবেশিক পর্বের একটি খণ্ড সময় নিয়ে কথা বলি।

    বাৎস্যায়ন বা ইন্দ্রপাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল, কেমন করে যৌনসুখের জন্য লিঙ্গদৈর্ঘ্য এবং রন্ধ্র/ছিদ্রপথের দৈর্ঘ্য মেপে গড়া হবে যথাযথ জুটি। আর সেখানে ভারতচন্দ্র ফাঁদলেন কথা: পদ্মিনীর মতো ভাল/আদর্শ নায়িকার থাকবে অল্প কামশক্তি। কার্যত যৌনসুখের প্রস্তাব করতে গিয়ে সুখের পথটাকেই ছেঁটে বাতিল করলেন তিনি।

    ১৮৩২। মুদ্রণ-সংস্কৃতির পক্ষ থেকে বিচার করলেও সেই সময়ে যত-না ছাপা বই ভারতে ছিল, তার থেকে হাতে লেখা পুথির পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এ ১৮৩২ সালে অনুলিখিত একটি বাংলা রতিশাস্ত্রের পুথি রয়েছে। পুথি সংখ্যা: ২১২৯। পুথির লেখকের নাম নেই, তবে অনুলিখনকারী ছিলেন রামগোপাল ঘোষ। পুথির স্পষ্ট বক্তব্য, রয়েছে চার জাতির পুরুষ। শশক [খরগোশ] জাতির পুরুষ গুণ-কর্মে মহৎ। তার লিঙ্গের সাইজ ‘ছয় অঙ্গুলি’। এমন পুরুষ: ‘পর দার পর হিংসা কদাচ না করে’। খেয়াল করি, মহৎ পুরুষ যেমন অপরকে হিংসা করবে না, তেমনই নজর করবে না পরস্ত্রীর দিকে। যৌনসুখের প্রশ্নে পরস্ত্রী তথা পরকীয়া বাতিলের খাতায় রইল। অথচ বাৎস্যায়নের কামসূত্রে পরস্ত্রী প্রসঙ্গে শৃঙ্গারসুখের নানান পথ বাতলানো হয়েছে। আর মৃগ জাতি পুরুষের লিঙ্গ ‘অষ্ট অঙ্গুলি প্রমাণ’। এমন পুরুষের মনে থাকে পাপ, নেই ধর্মজ্ঞান। নির্লজ্জ এরা। বৃষ জাতির পুরুষের লিঙ্গ ‘দশ অঙ্গুলি প্রমাণ’। পুথির কথায়, ‘লিঙ্গ কাষ্ঠের সমান’। আর অন্তিমে, অশ্ব জাতি পুরুষ, সাইজ ‘দ্বাদশ অঙ্গুলি লিঙ্গ’। এই পুরুষের শরীরে: ‘মালতী ফুলের গন্ধ বহে তার গায়’। অশ্বপুরুষ মিথ্যা কথা বলে, ধর্ম নেই তার সঙ্গে, পরনিন্দারত, ক্রোধ অপার। আর নায়িকা তথা স্ত্রী-জাতির বিবরণ এই, পদ্মিনী নারী দেখতে সুন্দর, শরীর পদ্মগন্ধ, ‘ভগ’ তথা যোনির বিস্তার ‘পঞ্চ অঙ্গুলি’। চিত্রিণী নারীর যোনি ‘ছয় অঙ্গুলি প্রমাণ’। মনে দয়া, দূরে থাকে পাপ থেকে। শঙ্খিনী নারীর যোনি ‘অষ্ট অঙ্গুলি প্রমাণ’। শঙ্খিনী ‘কামভাব বড় তার দেখিতে সুন্দর’ এবং ‘কামে মত্ত হইয়া করে হাস্য পরিহাস’। আর একদম শেষে হস্তিনী নারী। তার যোনি দশ অঙ্গুলি প্রমাণ। পুথির স্পষ্ট জবাব, হস্তিনী নারী ‘হয় বড়ই কদাচারী’। এমতাবস্থায় আদর্শ জুটি বিষয়ে অভিমত: শশক এবং পদ্মিনী লক্ষ্মী-নারায়ণের মতো। মৃগ এবং চিত্রিণী যেন শিব ও ভবানী। বৃষ এবং শঙ্খিনী হল, কামদেব-রতি। আর অশ্ব-হস্তিনী জুটি রাবণ-মন্দোদরী। পুথির এই ভাগটাই বুঝিয়ে দেয়, ‘সাইজ’কে ঘিরে সামাজিক নৈতিকতার স্বরূপ। বিশেষত দৈর্ঘ্যে একটু ছোট সাইজ-ই মান্যতা পায় ভালত্বের। আর সেই ভালত্ব স্বয়ং বিষ্ণু এবং লক্ষ্মীর সঙ্গে তুলনীয়। আর বড় দৈর্ঘ্য হয়ে ওঠে মন্দত্বের লক্ষ্মণ। জুটি হয় রাক্ষস রাজা-রানি, রাবণ-মন্দোদরী। লিঙ্গদৈর্ঘ্য-বিষয়ক উদ্বেগের প্রশ্নটি বেশ জটিল। কেউ যদি ভাবেন আকারে ছোট লিঙ্গের উদযাপন হচ্ছে বড় লিঙ্গকে বাতিল করে, তা কিন্তু নয়। এখানে বড়-ছোটর প্রশ্নটা বিশেষ গাণিতিক মাপে সীমাবদ্ধ। বলে দেওয়া হয়েছে আদর্শ লিঙ্গ কেমন হবে। তাই তিন অঙ্গুলি প্রমাণ লিঙ্গ কখনওই হবে না ভালত্বের সূচক। আমাদের দেশীয় প্রেক্ষিত থেকেই উনিশ শতক জুড়ে তৈরি হচ্ছিল যৌন-নৈতিকতার মানদণ্ড। যৌনসুখের বাড়বাড়ন্তকে তাই খারিজ করার প্রশ্নটিও দেশীয় যৌনশাস্ত্রের মধ্যেই ঘুরে ফিরে আসছিল। অবশ্যই একটা প্রশ্ন থাকবে, এই পুথি কারা পড়তেন, তাদের সামাজিক অবস্থান কী, তারা কোথায় থাকতেন ইত্যাদি।

    তবে ‘সাইজ’-এর প্রশ্নটি এত জটিল যে, আমরা যখন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ হিসাবে ভাবছি লিঙ্গ, যোনি বা স্তন-এর ‘সাইজ’— তা অনেক ক্ষেত্রে শরীরচিন্তার অঙ্গ হয়ে ওঠে বা বলা ভাল, আসলে আমরা প্রত্যক্ষ করি বিশেষ অঙ্গকেই। সামজিক স্তরে এই দেখা, এই দর্শন, বদল আনে চাওয়া-পাওয়া এবং ইচ্ছার ধরনে। সামাজিকভাবে, সামাজিক বিশ্বাস তথা বিধানে তৈরি হয় লিঙ্গ, যোনি, স্তন বা নিতম্বের ‘সাইজ’-এ মোড়া শরীরের ভবিষ্যৎ। ১৯২৬ সনে সৈয়দ আবেদর রহিম লেখা শুরু করলেন তাঁর জীবনকাহিনি। ১৮৯৭ সনে নদীয়া অঞ্চলে জন্ম আবেদরের। রহিম সাহেবের বাল্য-প্রণয়িনী, মৃতা স্ত্রী আকরামন নেছা বিবির স্মৃতিতেই রচিত হয়েছে এই জীবনকথা। আবেদরের চাচার মেয়ে ছিল আকরামন নেছা। বাল্যকাল থেকেই সবাই বলত আকরামন নেছা এবং আবেদর রহিমের বিয়ে হবে। এই বলা-শোনার দুনিয়া এবং পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ থেকে প্রেমের জন্ম। ১৯০৭ নাগাদ আকরামন নেছা-র বিয়ের কথা উঠল। রহিমের বয়স তখন তেরো, আর আকরামন নেছা-র এগারো। স্মৃতিকথায় লেখা হয়: ‘… বিবাহের কথা উঠিল, কারণ আকরামন নেছা বিবি তখন একাদশ বৎসর অতিক্রম করিলেন, বিশেষ তিনি হৃষ্টপুষ্ট বেশ স্বাস্থ্য সম্পন্ন কিশোরী… কিন্তু সমস্যার বিষয় পাত্র কোথায়?’ কিন্তু কেন হঠাৎ নতুন পাত্রের খোঁজ পড়ল? রহিম লিখছেন, দুই পরিবারের তরফ থেকেই বিবাহের সম্মতি থাকলেও মুরুব্বিদের কাছে আসল সমস্যা ছিল ‘সাইজ’ নিয়ে। লেখা হচ্ছে: ‘কিন্তু এক্ষণে প্রধান বাধা হইল যে মেয়ে যেমন হৃষ্টপুষ্ট বর্ধিতাঙ্গ হইতেছে ছেলে তেমন নহে।’ অতএব ঠিক হল, এই বিয়ে হবে না। বরং আকরামন নেছা-র ছোট বোনের সঙ্গে হবে রহিমের বিবাহ। আর এক বৃদ্ধ পাত্র মিলল, আকরামন নেছা-র সঙ্গে বিবাহের জন্য। একই দিনে সম্পন্ন হবে দুই বিবাহ। বৃদ্ধের সঙ্গে কিশোরী-র বিবাহের ঘোরতর নিন্দা করেছেন রহিম। আর সমস্যাটা তো শুধু মুললমান নয়, সমানভাবে হিন্দুসমাজেও বর্তমান। লিখছেন রহিম: ‘বঙ্গীয় হিন্দু-মুসলমান বালিকাদিগেরই এই অবস্থা, তাঁহাদের অভিভাবকগণ কোন এক স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া পাত্র পছন্দ করিতে যান বলিয়াই বোধহয় ঐরূপ বৃদ্ধকে নিজ কন্যা-ভগিনীগণের পাত্র নির্ব্বাচন করিয়া বসেন, নতুবা আজ একাদশবর্ষীয়া এক বালিকার সহিত প্রাগুক্ত বৃদ্ধের চিরবন্ধ কি হইতে পারিত?… কি-সে বালিকার দাম্পত্য প্রণয় জন্মিবে? সকলেরই একটা মনবৃত্তি আছে তাহা বুঝিয়া এবং বজায় রাখিয়া চলিলে সমাজে এত পাপের বৃদ্ধি হইত না বলিয়াই আমার ধারণা।’ রহিমের চিন্তার ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠিত নিয়মরীতিকে প্রশ্নের ক্ষেত্রে মুখ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ‘প্রণয়’। শুধু দাম্পত্য নিয়ে তাঁর ভাবনা নয়, তিনি বুঝতে চাইছেন ‘দাম্পত্য প্রণয়’। কিন্তু বাদ সাধল, কলকাতায় সওদা করতে গিয়ে কোনও এক আত্মীয় বাড়িতে বিয়ে করেছে বৃদ্ধ বর। অগত্যা সুদূর নদীয়ায় পাত্রীপক্ষের মাথায় হাত। আর উপায় নেই, ঠিক হল আকরামন নেছা এবং আবেদর রহিমের বিবাহ দেওয়া হবে। অন্যদিকে ছোট মেয়ের সঙ্গে ছোট ভাইপো জাহেদল করিমের বিবাহ দেওয়ার কথা উঠলেও তা হল না শুধু ‘সাইজ’-এর কারণে। লিখছেন রহিম: ‘কিন্তু ছোট মেয়ের সহিত ছোট ভাইপোর বিবাহ একেবারেই মানাইতে পারে না, কারণ ছোট মেয়েটিও বেশ হৃষ্টপুষ্ট—বর্ধিতাঙ্গ, মেয়ের তুলনায় ছেলে নিতান্ত অযোগ্য। শেষ সাব্যস্ত হইল ছোট মেয়ে এখন থাক, উপস্থিত বড় মেয়ের সহিত বড় ভাইপোর বিবাহ দেওয়া হউক।’  

    রহিমের বয়ানে, সমাজ যেভাবে শরীরকে দেখছে, সেই দেখার মধ্যে নিশ্চিতভাবেই রয়েছে লিঙ্গ, যোনি, স্তন বা নিতম্বের ‘সাইজ’। কিন্তু আলাদাভাবে এই বিভিন্ন অঙ্গের থাকাটা সরব নয়, বরং নীরব। আর নীরব বলেই ‘শরীর’-সন্দর্ভের আড়ালে তাদের উপস্থিতি এত জোরদার। কিন্তু এই সাইজ-ফেটিস শুধু সমাজের চোখে নয়, খোদ রহিমের চিন্তায়ও ঘুরেফিরে আসে। আকরামন নেছা-র রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বারে বারে ‘সাইজ’-এর প্রেমে পড়েন রহিম। লিখছেন রহিম: ‘[আকরামন নেছা-র] … নাতিদীর্ঘ-নাতিখর্ব্ব— মধ্য সাইজ। বেশ হৃষ্টপুষ্ট অত্যাধিক মোটা নহে। বর্ণ গৌর বর্ণ— রক্তাভ গোরবর্ণ যাহাকে দুধে আলতায় বলে।… মুখাকৃতি— লম্বাও নহে গোলও নহে মধ্য সাইজ। নাসিকা খুব উচ্চবংশীর ন্যায়ও নহে আবার খুব চ্যাপ্টাও নহে মধ্য সাইজ।… কটীদেশ— খুব সরু নহে, অত্যাধিক মোটাও নহে— মধ্য সাইজ। নিতম্ব— সুপ্রশস্ত। ঊরু— গোলাল এবং লম্বা।’ ‘সাইজ’-এর ক্ষমতাপ্রকরণটি এতই প্রবল যে, তার সূত্র যেমন সমাজের মান্য মূল্যবোধে রয়েছে, তেমন-ই শেকড় ছড়িয়ে আছে উলটোপক্ষে থাকা প্রতিবাদী ব্যক্তিস্বরেও। যে-ব্যক্তি সমাজের মান্য ‘সাইজ’ সন্দর্ভের বিরোধিতা কিরছে, সে-নিজেই জড়িয়ে পড়ছে ভিন্নভাবে ‘সাইজ’-এর প্রেমে। কিন্তু তার পরেও আবেদর রহিমের বয়ান অনন্য। সে জানে যেমন করে সে স্ত্রীর রূপবর্ণনা করল, তা সামাজিক মূল্যবোধে অনৈতিক। রহিম রূপবর্ণনার পূর্বেই বলে নেন: ‘রূপবর্ণনা আমি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আয়েসা, তিলোত্তমা, বা আসমানীর’ মত করিব না।’ রহিমের রূপবর্ণনার উদ্দেশ্য: ‘… আমার প্রিয় পুত্র সৈয়দ শাহেদল করিম জন্মাবধি দেখে নাই বলিয়া তাহার গর্ভধারিণী মাতার আকৃতি সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা জন্মাইয়া দিবার অভিপ্রায়ে উহা লিখিতে হইয়াছে। ইহা ভদ্ররুচি সঙ্গত হইল কিনা জানি না। কিন্তু তাহা না হইলেও ইহা আমাকে ঐ কারণে লিখিতে বাধ্য করিয়াছে। আমার এই পুস্তিকা লিখিবার উদ্দেশ্য সমূহের মধ্যে ইহাই একটি প্রধান উদ্দেশ্য। ইহা যদি ভদ্ররুচি বিরুদ্ধ হইয়া থাকে তজ্জন্য আমি লাচার, ক্ষমা প্রার্থনা ব্যতীত গত্যন্তর নাই।’ রহিম জানেন, তিনি যেভাবে আকরামন নেছা-র রূপবর্ণনা করেছেন তা এরোটিক। কিন্তু এই এরোটিক প্রবাহ-ই শক্তি হয়ে উঠেছে রহিমের কাছে। যে-সমাজ বেঁধে দেয় ঠিক কেমন-কেমন সাইজে হতে পারে বিবাহ, সেখানে মধুর দাম্পত্য ও ভালবাসার প্রতীক হয়ে থাকে আকরামন নেছা ও রহিম। সমাজনির্দিষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ শরীর নয়, বরং দুই তথাকথিত অসঙ্গতির শরীর নিয়েই প্রেমের উড়ান হয়েছে। বাল্য থেকে আকরামন নেছা এবং রহিমের মধ্যে  সাইজ-এর ফারাক প্রেমে বাধা হতে পারেনি। পিতা-পুত্রের প্রচলিত আচরণের মূল্যবোধও পালটে ফেলেছেন রহিম। পুত্রকে নিজের প্রেম-ভালোবাসার কথা বলতে লুকাছুপি করেননি তিনি। পুত্রের জন্য এই লেখন সমাজনির্মিত সাইজের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদবিশেষ।

    ‘সাইজ’ আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসে রাজনৈতিক হয়ে ওঠার পথে নানানভাবে দাপটের চিহ্ন হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন শুধুমাত্র সেই দাপটের ঘটানাকে জানা নয় বরং চিনতে হবে তার ‘ভাষা’। ভাষার মারফতেই ‘সাইজ’ ঘুরে ফিরে তার ক্ষমতা প্রদর্শন করে। এই ‘ভাষা’কে চেনার কাজটি মোটেই সহজ নয়। ‘ভাষা’র মধ্যেই লুকিয়ে আছে উপস্থাপনের রাজনীতি। ‘ভাষা’ ফুঁড়লেই যে মিলবে প্রশ্ন-উত্তরের ঝুলি এমন নয়। ভাষার তলদেশে কী আছে তা বলা মুশিল। কিন্তু এক্ষেত্রে কথাটা তলদেশ নিয়ে নয়। বরং ভাষা এবং ‘সাইজ’ এমন এক আন্তঃসম্পর্ক জারি করে—যা বাঁচিয়ে রাখে ‘সাইজ’কে ঘিরে আমাদের অপরিসীম ভালোবাসা। শুধুমাত্র উদ্বেগ নয়, এই ভালোবাসার পরত না বুঝলে বোঝা যাবে না ‘সাইজ’ বৃত্তান্ত। সে কথা অন্য কোন দিন বলা যাবে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook