ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ‘সহজ পাঠ’, জটিল গল্প


    আবীর কর (August 3, 2024)
     

    ‘যে বয়সে ক-খ চিনলেই যথেষ্ট সেই বয়সেই সাহিত্যরসে দীক্ষা দেয় সহজ পাঠ; এই একটি বইয়ের জন্য বাঙালি শিশুর ভাগ্যকে জগতের ঈর্ষাযোগ্য বলে মনে করি।’    

    বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু মহাশয়ের এই উক্তিটি বহুচর্চিত। রবীন্দ্রনাথের মতো বিদগ্ধ কবি, দার্শনিক, শিক্ষাচিন্তক যখন বাঙালি শিশুর জন্য চার দশকের বেশি সময়জুড়ে তাদের প্রথম পাঠের বিষয় ও বিন্যাসের প্রস্তুতি নেন, তখন আরও বিস্মিত হতে হয়। ১৮৮৯ সালের The Pocket Book of Rabindranath Tagore-এ, ‘সহজ পাঠ’-এর প্রথম খসড়া থেকে ১৯৩০-এ প্রকাশিত ‘সহজ পাঠ’-এর এই সুদীর্ঘ প্রস্তুতিপর্বে, একাধিক পাণ্ডুলিপি ও তার কাটা-জোড়া, যোগ-বিয়োগ দেখলে অ-বাক অভিভূত হতে হয়: শিশুর প্রথম পাঠকে তিনি কতখানি অনায়াস, সহজ, সুন্দর করে তিল-তিল করে গড়ে তুলছেন। ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের বিষয় ও তার ক্রমবিন্যাস খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, শিশু-শিক্ষার্থীদের জন্য একই সঙ্গে শিক্ষণের শৃঙ্খলা ও সাহিত্য আস্বাদনের সুবন্দোবস্ত করছেন রবীন্দ্রনাথ। মনে রাখতে হবে, ‘সহজ পাঠ’ শিশুর বর্ণ-পরিচয় গ্রন্থ নয়। প্রথমত, নামকরণে এবং ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগের দোরগোড়ায় স্পষ্টতই উল্লেখ করা আছে ‘এই বই বর্ণপরিচয়ের পর পঠনীয়’/‘শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু কর্ত্তৃক চিত্রভূষিত’। অর্থাৎ, ‘সহজ পাঠ’ পড়ার আগে শিশু-শিক্ষার্থীদের বাংলা বর্ণের সঙ্গে সম্যক পরিচয় থাকা আবশ্যক। তারপরও নন্দলাল বসুর অসামান্য সাদাকালো লিনোকাটের ছবি যোগে, রবীন্দ্রনাথ অ-আ থেকে হ-ক্ষ অবধি, এগারোটি স্বরবর্ণ এবং চৌত্রিশটি ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে শিশু-শিক্ষার্থীদের পুনরায় পরিচয় করাচ্ছেন। একে পুনর্পঠন বা সাদা বাংলায় ‘ঝালাই’ বলা ভাল। তারপর শব্দ বা বানানের কোনও স্বতন্ত্র পাঠ না রেখে, রবীন্দ্রনাথ রেখেছেন ছোট-ছোট শব্দ যোগে বাক্য পাঠ। আর এই বাক্য পাঠ ক্রমে-ক্রমে গদ্য পাঠ ও গল্প পাঠে নিয়ে গেছে শিশু-শিক্ষার্থীদের। প্রথম ভাগে অসংযুক্ত বর্ণের ব্যবহার শেখাতে মাত্র দশটি পাঠ (আ-কার থেকে চন্দ্রবিন্দু) এবং দ্বিতীয় ভাগের প্রথম দশটি পাঠে অনুস্বার, য-ফলা, র-ফলা, রেফ ও যুক্তাক্ষর শিক্ষণ এবং শেষ তিনটি পাঠে সংযুক্ত বর্ণ যোগে গল্প পাঠ। ‘সহজ পাঠ’-এর দুই ভাগে মূলত গদ্য পাঠে শিক্ষণ এবং পদ্য পাঠে সাহিত্যের আস্বাদন। বিন্যাসের পাশাপাশি, ‘সহজ পাঠ’-এর বিষয়ভাবনার মূলে আছে শিশু-শিক্ষার্থীদের প্রকৃতি, পরিবেশ ও সমাজ সম্পর্কে ধারণাদান। আর বিশ্ববন্দিত কবির কলমে লেখা শিশুর স্বপ্ন, কল্পনা ও ইচ্ছে-সম্বলিত কবিতাগুলি শিশুর আনন্দ-পাঠ। ‘সহজ পাঠ’ গ্রন্থদ্বয়ের প্রতিটি পাঠে শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ এবং কবি রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটেছে।                   

    যে-গ্রন্থের জন্য পরবর্তীকালের বিশিষ্ট কবি বুদ্ধদেব বসু ‘বাঙালি শিশুর ভাগ্যকে জগতের ঈর্ষাযোগ্য’ বলে মনে করছেন, সেই ‘সহজ পাঠ’ শিশু-শিক্ষার্থীদের জন্য কতখানি উপযুক্ত, সেই নিয়েই এক বিতর্ক বেধেছিল গত শতকের আটের দশকে। ১৯৮০-র শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়— নতুন শিক্ষাবর্ষে অর্থাৎ জানুয়ারি ১৯৮১ থেকে সরকারি পরিকল্পনামতো, ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগের বিকল্প গ্রন্থ পড়ানো হবে যথাক্রমে সরকার অনুমোদিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী সত্যপ্রিয় রায়ের তত্ত্বাবধানে, ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠ্য করা হয় এবং বিশ্বভারতীর অনুমোদন নিয়ে সরকারি অর্থানুকূল্যে তা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। অন্যদিকে, বিশ্বভারতীতে ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠ্য, এবং ক্ষিতীশ রায় সম্পাদিত ‘সহজ পাঠ’ সংকলনগ্রন্থের তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ পাঠ্য যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে।

    ‘যুগান্তর’, ১০ অক্টোবর ১৯৮০

    এবার আসা যাক ১৯৮০ সালে, অর্থাৎ ‘সহজ পাঠ’ প্রকাশনার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সরকারি দৃষ্টিতে কী এমন অসঙ্গতি চোখে পড়ল, যাতে শিশু-শিক্ষার্থীদের পাঠ্যতালিকা থেকে ‘সহজ পাঠ’কে বাদ দিয়ে বিকল্প গ্রন্থের পরিকল্পনা করতে হল। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত (‘যুগান্তর’, ১০ অক্টোবর ১৯৮০) সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের ধারণা, রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ ছাত্রদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে সামাজিক চেতনা জাগাতে অক্ষম। তাই নতুন পাঠক্রমের সঙ্গে সংগতি রেখে সরকার সব বইয়ের পরিবর্তন ঘটাতে আগ্রহী। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের এহেন সিদ্ধান্তে, রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেল। শিক্ষিত সাহিত্যানুরাগীরা ক্ষুব্ধ হলেন, রবীন্দ্রপ্রেমীরা সরকারি সিদ্ধান্তের ঘোরতর বিরোধিতায় নামলেন। এই বিষয়ে প্রথম থেকে শেষ অবধি সরব হয়েছিল টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট। শান্তিনিকেতনের বিশিষ্টজনেরা নিন্দেমন্দ করলেন। শিল্পীরা সমাবেশ করে বিক্ষোভ দেখালেন। সর্বোপরি সেই সময়ে বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধীপক্ষে থাকা কংগ্রেস রাজনৈতিক ভাবে এর  লাগাতার বিরোধিতা করতে শুরু করে। অন্যদিকে সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে তৎকালীন বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা সওয়াল করেছিলেন এবং সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে অনড় ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান অনিলা দেবী, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে, এমনকী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মহাশয়। সেই সময়কালে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্রও এই বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতায় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র অবস্থান ছিল স্পষ্ট। ‘যুগান্তর’ দু’পক্ষের মতামত প্রকাশ করেছে, তবে সম্পাদকীয় স্তম্ভে ‘সহজ পাঠ’-এর পক্ষেই রায় ছিল। অন্যদিকে সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন জুগিয়েছিল ‘দৈনিক বসুমতী’ এবং ‘সত্যযুগ’। এ ছাড়াও অন্যান্য পত্রপত্রিকাতেও, ১৯৮০ সালের অক্টোবর, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে, ‘সহজ পাঠ’ বিষয়ে চাপানউতোর ছিল মুখ্য আলোচ্য বিষয়। সব কিছুর মাঝে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়াও ছিল চোখে পড়ার মতো। ‘যুগান্তর’ পত্রিকার ‘পাঠকের মতামত’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ‘সম্পাদক সমীপেষু’, ‘দৈনিক বসুমতী’তে ‘মতামত পাঠকের’ এবং ‘সত্যযুগ’ পত্রিকার ‘সম্পাদকের কাছে চিঠি’তে অসংখ্য মানুষ তাঁদের মতামত রেখেছেন। জনতার বিমিশ্র প্রতিক্রিয়ায় যদিও সহজেই ধরা পড়েছিল সরকারি সিদ্ধান্তের বিপরীতে সিংহভাগের অবস্থান। সবদিক বিচার করে, সরকারের তরফে নভেম্বরের গোড়ায় শিক্ষামন্ত্রী জানান যে, ‘সহজ পাঠ’ গ্রন্থের বিকল্প গ্রন্থ ছাপা আপাতত স্থগিত। যদিও তার কিছুদিন পরেই সিদ্ধান্ত বদলে সংবাদমাধ্যমে জানানো হয় সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা মতো ‘সহজ পাঠ’-এর বিকল্প গ্রন্থ আগামী শিক্ষাবর্ষে শিশু-শিক্ষার্থীদের পাঠ্যতালিকায় আসছে, তবে ‘সহজ পাঠ’ও বাতিল হচ্ছে না।    

    শিশুর কল্পনাশক্তির ধর্ম, ধরন শ্রেণিতত্ত্বের চলনে চলে না। আর ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার বিষয় ভাবলে, মান্য বাংলা ভাষাকেই অমান্য করা হয়।

    বিতর্কের প্রেক্ষাপটে সুকুমার সেন মহাশয় লিখছেন (‘রবীন্দ্র ভাবনা’, নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৮০), ‘শুনতে পাচ্ছি যে পশ্চিমবঙ্গ গভরমেন্টের মনস্থির হয়েছে যে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্য তালিকা থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ বাদ দেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এ মতলবের কারণ কী তা ঠিকমত শুনিনি, বুঝতেও পারছি না। কানে গেছে যে বইটি নাকি সমাজ চেতনার উদ্বোধনে কোন কাজের নয়, হয়তো অকাজের। কিন্তু ক’বছরের শিশুদের পাঠ্য ‘সহজ পাঠ’? চার থেকে পাঁচ-ছয়, বড়ো জোর সাত। এ বয়সের শিশুর কি সমাজ চেতনা হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার? না হলে কি তা বাঞ্ছনীয়? না, স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়?’ বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, ভাষাবিদ সুকুমার সেনের বক্তব্যটি সমর্থনযোগ্য। পাঁচ বছর বয়সি ‘সহজ পাঠ’ পড়ুয়াদের মন এবং মাথা তো সহজ, সরল, অনাবিল— সেখানে সমাজচেতনা, শ্রেণিবৈষম্যের স্থান কতটুকু! প্রসঙ্গত, বিকল্প গ্রন্থের পক্ষে তৎকালীন রাজ্য সরকারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাদপ্তরের মন্ত্রী পার্থ দে মহাশয়ের বক্তব্য— ‘নতুন পাঠক্রম সাধারণ মানুষকে তো বটেই এমনকি চাকর, ধোপা ও কৃষকদেরও আকৃষ্ট করবে তাদের সন্তানদের শিক্ষাদানের ব্যাপারে।’ (‘যুগান্তর’, ২০ অক্টোবর ১৯৮০) তিনি বলছেন, ‘এখন মেহনতি জনগণের পরিবারের ছেলে মেয়েরা স্কুলে আসছে। ধোপা বা নাপিতদের সম্পর্কে কোন হেয় মনোভাব পাঠ্য পুস্তকে থাকলে তাদের ছেলেমেয়েদের মনেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। পাঠ্যপুস্তকে এমন কিছু কথা থাকা উচিত নয় যাতে কোন ছাত্র মনে করতে পারে যে তার বাবা ছোট কাজ করেন।’ (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ২২ অক্টোবর ১৯৮০)— শিক্ষামন্ত্রী মহাশয়ের বক্তব্যটি স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন, ‘সহজ পাঠ’ গ্রন্থে চাষি, ধোপা, চাকর, মালি, দাসী, দারোয়ান, অন্ধ ভিক্ষুক সব মানুষই আছেন, কিন্তু তাদেরকে ‘হেয়’ করে কোনও অবজ্ঞা বা অসম্মানসূচক কোনও কথা তো নেই! সব শ্রেণির মানুষ, চারপাশের পশুপাখি, দুই বাংলার নদী-নৌকা, গ্রাম-গঞ্জ, হাট-ঘাট, চাষবাস নিয়ে ‘সহজ পাঠ’ এক অখণ্ড বাংলার খণ্ড-খণ্ড রূপচিত্রের সমাহার বলেই তো মনে হয়। সেখানে শ্রেণিবৈষম্য, খাদ্যবৈষম্যের সন্ধান নিতান্তই ছিদ্রান্বেষীর পরিচায়ক। আর ওই উহ্য থাকা বিকল্প গ্রন্থ সম্পর্কে, তৎকালীন সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান, তথা বিশ্বভারতী বিনয় ভবনের অধ্যাপক হিমাংশু মজুমদার মহাশয়ের উপলব্ধি (সূত্র: ‘সপ্তপর্ণী’, বিশ্বভারতী ছাত্র সম্মিলনীর মুখপত্র, সম্পাদক: অতনু শাসমল)— যেসব পড়ুয়া দারিদ্র্যক্লিষ্ট, সমস্যাজর্জর পরিবার থেকে আসে, তাদের বাড়িতে সহজ পাঠের ভাষায় কথা বলে এমন বাবা, মা, ভাইবোন নেই এবং অনুরূপ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নেই। তাই তাদের কাছে, ‘থাকে ওরা কান পেতে/লুকানো ঘরের কোণে।/ডাক পাড়ে বাতাসেতে,/কী করে সে ওরা শোনে!’— এই ‘ওরা’ তত স্পষ্ট নয়, ওদের কাছে যত স্পষ্ট এই ভাষা— ধান রোয়া হয়ে গেছে। মাঠে বাবার কাজ নেই। তিন মাস পরে পাকবে, ধান কাটা হবে। তখন আবার কাজে যাবে। হিমাংশুবাবুর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায়, তা হল— দীনদরিদ্র পরিবারের পড়ুয়াদের কাছে ‘সহজ পাঠ’-এর ভাষা ও চিত্রকল্প বোধগম্য নয়। প্রথমত, স্বাস্থ্য ও সম্পদের অনুপাতে কল্পনাশক্তির বাড়া-কমা ঘটে হয়তো, তবে সেটা শেষ কথা নয়। আর স্বাস্থ্য-সম্পদের প্রাচুর্যে বেড়ে ওঠা ধনীর দুলালও কি খুব অনায়াসে ‘ওরা’র চিত্রকল্প বুঝতে পারবে? শিশুর কল্পনাশক্তির ধর্ম, ধরন শ্রেণিতত্ত্বের চলনে চলে না। আর ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার বিষয় ভাবলে, মান্য বাংলা ভাষাকেই অমান্য করা হয়। গরিবগুর্বো বলে ‘সহজ পাঠ’-এর সহজ ভাষার স্বাদ থেকেও তাকে বঞ্চিত করে, আজীবন ওই চাষ-আবাদের ভাষায় ও বিষয়বস্তুতে বন্দি রাখতে হবে। এ কেমন বেয়াড়া চক্র? এ-ও তো শ্রেণিবৈষম্য বজায় রাখার এক কৌশল! আবার বিষয়গত বিচারে দেখলে দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ গ্রন্থদ্বয়ের একাধিক পাঠে চাষ করা, ধান কাটা, গোরুর গাড়িতে ধান নিয়ে ফেরা, সেই ধান থেকে খই-মুড়ি ভাজা, এমনকী মুড়ি যোগে চড়িভাতির মতো সাদামাটা গ্রামজীবনের ছবি আছে। প্রতিতুলনায় হিমাংশুবাবু যে-গদ্যপাঠের নমুনা রেখেছেন, যা রুগ্‌ণ দরিদ্র চাষিঘরের ছেলেমেয়েদের সহজবোধ্য হবে বলে তার অনুমান, সেখানে দেখি ধান রোয়া থেকে ধান কাটা অবধি এই তিন মাসে বাবা অর্থাৎ চাষির কোনও কাজ নেই— এ তো চাষি, চাষি নয় জমিদার নিশ্চয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ জমিদারপুত্র হতে পারেন, কিন্তু শিলাইদহ পর্বে তিনি সেখানকার চাষ ও চাষির সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন। শিলাইদহের মাটিতে প্রথম আলু চাষের নজির গড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। খেত-খামার নিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন চাষিদের। আর, শুধু পরকে শেখানো নয়, আপনি আচরি ধর্মে, পুত্র রথীন্দ্রনাথকে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছেন কৃষিবিজ্ঞান সংক্রান্ত পড়াশোনার জন্য।         

    ‘যুগান্তর’, ২০ অক্টোবর ১৯৮০

    যাই হোক, সেই সময়ে সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে যে সুদীর্ঘ চাপান-উতোর চলেছিল, সেখানে সুকুমার সেনের পাশাপাশি ছিলেন নীহাররঞ্জন রায়, প্রমথনাথ বিশী, সোমেন্দ্রনাথ বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব, কৃষ্ণা কৃপালনী, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, অম্লান দত্ত প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা। সংবাদমাধ্যমে বিশিষ্টজনেদের উষ্মার খবর জেনে, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী চিঠি লেখেন বেশ কয়েকজনকে। সেখানে শ্রীপার্থ দে মহাশয়ের বক্তব্য, ‘… শব্দ বাক্য ও অনুষঙ্গগুলি বাস্তব পরিবেশ অনুযায়ী না হলে শিশুদের সুস্পষ্ট মানসিকতা গড়ে তোলা যায় না বা তারা স্মরণে রাখতে পারে না। আমরা চেষ্টা করছি এই সব কিছুর কিভাবে একটা সমন্বয় করে শিশুদের ব্যবহারযোগ্য ও আকর্ষণীয় করা যায়। এ কাজ এখনও চলছে। অনুগ্রহ করে আমাদের যদি জানার সুযোগ দেন কিভাবে এ কাজটি সুষ্ঠুভাবে করা যায় তাহলে আমরা খুবই উপকৃত হবো।’ (‘রবীন্দ্র ভাবনা’, ১৪ অক্টোবর ১৯৮০) শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির উত্তরে, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে এক সুদীর্ঘ উত্তর দেন প্রমথনাথ বিশী এবং সোমেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়। সেই চিঠি থেকে, যে-প্রশ্নগুলি তাঁরা শিক্ষামন্ত্রীর সমীপে রেখেছিলেন, তা হল— ১. ‘সহজ পাঠ’ বাতিল করার কোনও সুপারিশ শিক্ষকমণ্ডলীর তরফ থেকে ছিল কি? ২. ‘সহজ পাঠ’ যে যোগ্য নয়, সে-কথা কে বিচার করলেন? ৩. নূতন পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজে কোন-কোন ভাষাবিজ্ঞানী সহায়তা করেছেন? ভাষাচার্য সুকুমার সেনের অভিমত কি জানতে চেয়েছিলেন? ৪. সমস্ত ব্যাপারটা এত গোপনে সেরে ফেলছিলেন কেন? (‘রবীন্দ্র ভাবনা’, ২০ অক্টোবর ১৯৮০) এই প্রশ্নগুলো থেকে, এক পক্ষের গোপনীয়তা, অন্য পক্ষের উষ্মা কিছুটা আঁচ করা যায়। এ ছাড়া, শ্রেণিবৈষম্য-খাদ্যবৈষম্যের সূত্রে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিদ্রুপাত্মক তুলনা তুলেছিলেন এই বলে— ‘শ্রেণী সংগ্রামী নেতারা বাতানুকূল ঘরে বসে কাজ করেন, তাদের বেয়ারারা গরমে বাইরে টুলে বসে ঘামেন— এ যাদের চোখে পড়ে না, আর বুর্জোয়া কবি রবিঠাকুর কিনা সেই শ্রেণীর ফারাক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন।’ মন্ত্রীমহাশয়ের প্রত্যুত্তরে প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস এটি অপসারণের পক্ষে কোনও যুক্তি নেই। এ কাজের ফল দেশের পক্ষে শুভ হবে না। আমার একান্ত অনুরোধ আপনারা পুনর্বার বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন।’ তৎকালীন বিশ্বভারতীর উপাচার্য অম্লান দত্ত লিখছেন, ‘সহজ পাঠ বহু বৎসর ধরে শিশুদের বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। এ শিক্ষা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভালো আর কে দিতে পারতেন।… এ ব্যাপারে সরকারী সিদ্ধান্ত আমার শোচনীয় মনে হয়। এ নিয়ে প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন।’ এ ছাড়াও ১৯৮০-র ‘সহজ পাঠ’ বিতর্কে উভয়পক্ষেই অনেক খ্যাতনামারা জড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের অবস্থান থেকে তাঁদের মতো করে মতামত দিয়েছেন। অনেক আলাপ-আলোচনা নিছকই রাজনৈতিক তরজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে যুক্তি-তর্ক ছুঁয়েছিল এক নতুন দিগন্ত।

    ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ২২ অক্টোবর ১৯৮০

    ‘সহজ পাঠ’কে কেন্দ্র করে তর্ক-বিতর্কের পরিসর পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কিছু ক্ষেত্রে একদিকে প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর তথা সরকারের অযৌক্তিক কারণ দর্শানো, যা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এক ধরনের অসূয়ারই প্রকাশ এবং অন্যদিকে ‘সহজ পাঠ’কে কেন্দ্র করে যুক্তিগ্রাহ্য বিরোধিতা ছেড়ে নিছকই রবীন্দ্র ভাবাবেগের আতিশয্য। আমরা দু’পক্ষের অতিরেক বিষয়টি সরিয়ে, খুব যুক্তিসম্মত ভাবে যদি দেখি ‘সহজ পাঠ’ কতখানি উপযুক্ত বাংলা প্রাইমার, তাহলে দেখা যাবে প্রাইমারের অন্যতম যে-বৈশিষ্ট্য— শিশুকে বর্ণের সঙ্গে সুপরিচিত করা, তা এখানে নেই। অসংযুক্ত বর্ণ, সংযুক্ত বর্ণ শিক্ষণের কোনও স্বতন্ত্র অধ্যায় এখানে নেই। বর্ণ শেখার পর, তার ব্যবহারে গড়ে ওঠা শব্দ বা বানান শেখানোরও কোনও ব্যবস্থা নেই ‘সহজ পাঠ’-এ। কেন নেই, তার স্পষ্ট কবুলত আছে ‘সহজ পাঠ’-এর প্রারম্ভেই ‘এই বই বর্ণপরিচয়ের পর পঠনীয়’। ‘সহজ পাঠ’-এর বৈশিষ্ট্যবিচারে এ-কথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। তাই বর্ণপরিচয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে ‘সহজ পাঠ’কে পাঠ্যতালিকায় রাখাটা ভুল। রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ বাংলা ভাষা শিক্ষণের সহজ পাঠ তথা প্রথম পাঠ, যা একটি আদর্শ প্রাইমারের অন্যতম অধ্যায়। এই পাঠের ক্ষেত্রটিতে ‘সহজ পাঠ’ এতখানি সুচিন্তিত, পরিশীলিত এবং শিশু-শিক্ষার্থীদের পক্ষে নিবিড় সংযোগের অধিকারী— যা শিশুর অন্যান্য পাঠ্যের তুলনায় অতুলনীয়ভাবে অনন্য। এমনকী বাংলা ও বাংলা ভাষা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী যে-কারোর পক্ষে ‘সহজ পাঠ’ সহজ, সরল, স্নিগ্ধ, সর্বোপরি এক সাবলীল পাঠ। তারপরও যে-যে যুক্তিতে ১৯৮০ সালে ‘সহজ পাঠ’কে শিশুর পাঠ্যসূচি থেকে বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল বা প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের অবস্থানকে স্পষ্ট করা হয়েছিল, তা হল— ১. শিশুর সমাজচেতনা জাগাতে এই বই যথেষ্ট নয়। ২. বেশ কিছু পাঠে প্রান্তিক মানুষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিরূপ ধারণা। ৩. ‘সহজ পাঠ’ দ্বিতীয় ভাগের একাদশ পাঠে আছে শিকারে গেছেন শক্তিবাবু, সঙ্গে তার দারোয়ান আক্রম। সেখানে সঙ্গে আনা লুচি, আলুর দম আর পাঁঠার মাংস দিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছেন শক্তিবাবু আর আক্রম খাচ্ছে শুধুমাত্র চাটনি দিয়ে রুটি। এই যে অবস্থাভেদে খাবারের ভেদাভেদ, যা শিশুমনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ৩. ‘সহজ পাঠ’ প্রথম ভাগের একটা বিশিষ্ট কবিতা, ‘কাল ছিল ডাল খালি,/আজ ফুলে যায় ভ’রে।/বল্ দেখি তুই মালী,/হয় সে কেমন ক’রে।’— এই পাঠের আড়ালে থাকা শিশু-কথকের এই যে মালিকে ‘তুই’ সম্বোধন, তা ‘সহজ পাঠ’ পড়ুয়া শিশুর পক্ষে ‘মালি’ বা সমজাতীয় মানুষ সম্পর্কে অশ্রদ্ধা জাগাবে। ৪. বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-এর পরও রবীন্দ্রনাথ ‘সহজ পাঠ’ লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন। ‘সহজ পাঠ’ বদলে পরিবর্তিত পাঠ আনলে ক্ষতি কী? ৫. ১৯৩০ সালে প্রকাশিত ‘সহজ পাঠ’কে পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ১৯৬৯-এ পাঠ্য করেছিলেন যুক্তফ্রন্টের শিক্ষামন্ত্রী সত্যপ্রিয় রায়। তার আগে কেউই ‘সহজ পাঠ’কে সরকারি স্কুলে পাঠ্য করার কথা ভাবেননি। ৬. ১৯৭৪-এ গঠিত সিলেবাস কমিটির সুপারিশেই নতুন সিলেবাসের যে-পরিকল্পনা, সেই অনুযায়ী ‘সহজ পাঠ’ বদলের সিদ্ধান্ত। যেহেতু লেখকের নাম রবীন্দ্রনাথ, তাই দিকে-দিকে এত মাতামাতি। ৭. ‘সহজ পাঠ’-এ বর্ণ-শব্দ-বাক্যের ক্রমপাঠ অনুপস্থিত, যা শিশু-শিক্ষার্থীদের জন্য ভীষণভাবে প্রয়োজনীয়। ৮. পাঠ্য বিষয়ে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট। ৯. ‘সহজ পাঠ’ বাদ দেওয়ার অর্থ রবীন্দ্রনাথকে বর্জন নয়, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই।   

    ‘কিশলয়’-এর প্রচ্ছদ

    উপরোক্ত বিষয়গুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, শিশু-শিক্ষার্থীদের অনুপযুক্ত ‘সহজ পাঠ’; এবং এ-বিষয়ে একটিই যুক্তি যে, ‘সহজ পাঠ’ বর্ণশিক্ষা ও বানানশিক্ষার বই নয়। খুব খাঁটি কথা। কিন্তু সেই কথাটা ‘সহজ পাঠ’-এর গোড়াতেই লেখকের পরামর্শমতো স্পষ্টাক্ষরে মুদ্রিত। দ্বিতীয়ত, শ্রেণিবৈষম্যের বিষয়টি তো সামাজিক বিষয়— ‘সহজ পাঠ’-এর লোকজন, চারপাশ তো আর সমাজ-বহির্ভূত নয়; তাই এখানে লোকা ধোবা কাপড় কাচে, চুনী মালী কুয়ো থেকে জল তোলে, জনৈক রাম তার বাড়িতে পূজার জন্যই ফুল তোলে। মালিক শক্তিবাবু রুটি-মাংস-চাটনি খান, তার দারোয়ান আক্রম খায় চাটনি দিয়ে রুটি, কান্ত চাকর ভোরের বেলায় পান্তা খেয়েই কাজে বেরোয়। অন্ধ কানাই পথের ধারে ভিক্ষা করে। সমাজে এই ‘শ্রেণিবৈষম্য’ তো বরাবর বিদ্যমান! এই প্রসঙ্গে যথার্থ মন্তব্য করেছেন রবীন্দ্রনাথকে কোনওদিন রেয়াত না-করা সুভো ঠাকুর, শক্তিবাবুর লুচি-মাংস আর আক্রমের রুটি-চাটনি প্রসঙ্গে; তিনি বলছেন, ‘যা সত্যি তিনি তো তাই লিখেছেন।’ আর ‘বল দেখি ‘তুই’ মালী হয় সে কেমন করে’, এই জিজ্ঞাসা তো অনুকরণপ্রিয় শিশুর সরল জিজ্ঞাসা। সে তো বাড়ির বড়দের অনুকরণে বাবা-মা’কেও দীর্ঘদিন ‘তুই’ ডাকে। ‘শিশু’ এবং ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতায়, মায়ে-পোয়ের সংলাপে মা’কে ‘তুই’ সম্বোধনে শিশু হামেশাই ডাকছে, অভিযোগ জানাচ্ছে। আর সমাজচেতনার প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, যেমন সমাজে শিশু বেড়ে উঠবে, চেতনাও সেই অনুপাতেই জাগবে। এর মধ্যে ভুল কোথায়? আর ‘সহজ পাঠ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের ছবি রেখেছেন, কিন্তু সেখানে কারও প্রতি বিরূপ, বিদ্রুপভাবের লেশমাত্র নেই। আর পরিবেশ ও সমাজ-সচেতনতা, শিশুর সামাজিকীকরণ, সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে থাকার পাঠ কি ‘সহজ পাঠ’-এ নেই? পূজা-উৎসব-বিয়েবাড়ি-যাত্রাভিনয়-হাটবাজার কি নেই? ‘তিন ভাই মিলে খেলা হবে’, ‘একা একা খেলা যায় না’, শচী, মণি, বশী, মধু, খেতু সব মিলে বিশাল বন্ধু বাহিনী। আবার সেই খেলা এতখানি নিখাদ সাদামাটা, যে বল নেই, পরিবর্তে ঢেলা মেরে বেল পেড়ে, খেলা হবে। আবার চড়িভাতির দলে আছে গুপী, নুটু, উমা, ঊষা; আর খাওয়া কী? নুন, মুড়ি, কুল। এই শিশুরা তো শহুরে, ধনী পুত্র-কন্যা নয়। ‘সহজ পাঠ’ দুই ভাগের সিংহভাগ পাঠ গ্রামকেন্দ্রিক। দুই বাংলার নদী, গ্রাম ও তার জীবনছবির সহজ অনাড়ম্বর রূপ ধরা আছে এখানে। তুলনায় এক টুকরো কলিকাতা, তা-ও আবার শিশুর স্বপ্নে দেখা লণ্ডভণ্ড শহর কলিকাতা। এ ছাড়া সাঁতরাগাছি, ত্রিবেণী, ওপারের বক্সীগঞ্জ মিলিয়ে বিভিন্ন জনপদ। আবার অনামিকা ছোট নদী থেকে পদ্মা, কর্ণফুলি, তিস্তা, আত্রাই, ইচ্ছামতী, উস্রি এবং গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর মিলিত নদী ও নগর ত্রিবেণী ছাড়িয়ে আরও অনেক খাল-বিল, জল-জঙ্গলের পরিচিতি। আছে পাড়া-গ্ৰামের ছোট-ছোট অগনিত নামের চরিত্র। দ্বিতীয় ভাগের পাঠে আছে আতিথেয়তা, সৌন্দর্যবোধ, আছে সাপ্তাহিক সাফাই অভিযান। এ তো নির্মল বাংলা বা স্বচ্ছ ভারতের ক্যামেরাবন্দিত ঘটাপটার দেখনদারি ঝাটপাট নয়, রুটিন পরিচ্ছন্নতা। সমাজ, সংসার, পরিবেশ, পরিজন সম্পর্কে শিশুর বোধের জাগরণ ঘটানোর পাঠ তো ‘সহজ পাঠ’-এর পাতায়-পাতায়।       

    তারপরও তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষাদপ্তরের বিচারে, ‘সহজ পাঠ’-এর সঠিক, সহজ, সরল পাতাগুলি জীর্ণ ঠেকেছিল। ১৯৮১-র শিক্ষাবর্ষে এল নতুন-পাতা সম্বলিত ‘কিশলয়’। পাতাজোড়া রঙিন ছবি। বর্ণ-লিপি চেনানোর ও লেখানোর আধুনিক কৌশল। খুব ভাল। জাত-ধর্মে শ্রেণিসাম্য আনতে ‘পূজা’ শব্দ বদলে ‘উৎসব’ হল। আলো-ঝলমল ঈদ উৎসবে আলম এল, অমর এল। আমন আর আকবরের সাথে রতন এল। কয়েতবেল ভাগাভাগি করে খেল আশা আর আয়েশা। খুব ভাল। আশানুরূপ সুন্দর। কিন্তু বাস্তব? বাস্তব কী বলে? শ্রেণিসাম্য ফিরল? খাদ্যবৈষম্য মিটল? না, সেসব ‘শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি’। যেমন ছিল আগে, আজও যেমন আছে।   

    ছবি সৌজন্যে: লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook