স্তালিন গল্প বলতেন। ২৪টা তিতিরপাখির গল্প। একদিন স্তালিন ভাবলেন শিকারে যাবেন। চোগাচাপকান পরে, স্কি লাগিয়ে, লম্বা শটগান কাঁধে চাপিয়ে, তেরো কিলোমিটার পাহাড় উজিয়ে, স্তালিন চললেন। হঠাৎ দেখেন, একটা গাছের ডালে একদল তিতির বসে আছে। গুনলেন। ২৪টা তিতির। কিন্তু হায় কপাল! মাত্র ১২টা কার্তুজ আছে সঙ্গে। কী আর করা যাবে! স্তালিন গুলি করে ১২টা পাখি মেরে, ১৩ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ফিরে এসে আরও ১২টা কার্তুজ নিয়ে ফিরে গেলেন। তখনও বাকি ১২টা তিতিরপাখি ঠায় ডালে বসে আছে। অবশেষে স্তালিন সেই ১২টা তিতিরকেও নিকেশ করলেন।
এ গল্প বলে কুন্দেরার শেষ উপন্যাস ‘ফেস্টিভ্যাল অফ ইনসিগনিফিক্যান্স’-এর এক চরিত্র চার্লস অন্য এক চরিত্র ক্যালিবানকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন লাগল?’ স্বাভাবিক ভাবেই ক্যালিবান হাসে।
‘এ গল্প কোথায় পেলে?’
‘ক্রুশ্চেভ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন। এ গল্প শুনে তুমি হাসছ বটে, কিন্তু যাদের কাছে সেদিন এ গল্প বলা হয়েছিল, তারা কেউই হাসেনি। সবাই জানত স্তালিন মিথ্যে বলছেন, ভেতরে ভেতরে সবাই বিরক্ত ছিল। কিন্তু কেউই সেদিন কিছু বলেনি, এক ক্রুশ্চেভ ছাড়া।’ তিনি ঘুরিয়ে আবার স্তালিনকে প্রশ্ন করেছিলেন ঘটনার সত্যতা নিয়ে। গল্পের এখানেই শেষ নয়। এরপর সবাই টয়লেটে গিয়েছিল। কেবল এই একটাই জায়গা ছিল, যেখানে পার্টির সবাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করত। শুধু স্তালিন বাদে। স্তালিনের অন্য টয়লেট ছিল। তাই টয়লেটেই পার্টির ভেতরকার প্রতিবাদ গর্জে উঠত।
‘মিথ্যে বলছে! গোটাটাই বানিয়ে গুছিয়ে ঢপ দিচ্ছে!’ চিৎকার করে টয়লেটের মধ্যে একান্তে প্রতিবাদ করত তারা। ক্রুশ্চেভ লিখেছেন তাঁর বইতে। এই ক্রুশ্চেভ স্তালিনের পর রাশিয়ার সর্বাধিনায়ক হন।
সব শুনে ক্যালিবান আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার! এ গল্পটা শুনে ওখানে একজনেরও মনে হল না, গল্পটা গোটাটাই গুল! কেউ হাসল না!!’ কেউ যে হাসল না, বা এ কথাটা একবারের জন্যেও মাথায় এল না যে হাসি পাওয়াটা ‘স্বাভাবিক’, সেটাই ক্ষমতার লক্ষণ।
কুন্দেরার লেখার অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকে এই হাসির বিশ্লেষণ। উপরের গল্প পড়ে পাঠকও ক্যালিবানের মতো ভাবতে বসবেন, ক্ষমতার চোখ-রাঙানি কীভাবে ঠিক করে দেয়— আমাদের কাছে কোনটা হাস্যকর, কোনটা নয়। কুন্দেরার হাসিকে তামাশা না বলে বোধহয় ‘খিল্লি’ বলা অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত হবে। তাৎপর্যহীনতার উৎসবে যখন সাধারণ ক্ষমতাহীন মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, প্রতিরোধের আর কোনও উপায় থাকে না, তখন সে বেপরোয়া ভাবে হাসতে থাকে। পুঁজিপতি, সমাজপতিদের নিয়ে যখন সর্বহারারা হাসে, তখন সেটা হয়ে যায় খিল্লি। সে হাসি কখনও ভয়ঙ্কর, কখনও বীভৎস।
বিখ্যাত মার্ক্সবাদী সমালোচক টেরি ইগেল্টন তাঁর এক প্রবন্ধে অনবদ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, কীভাবে স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রে কুন্দেরার এই হাসি অর্থের উৎপাত সৃষ্টি করে। ‘দ্য বুক অফ লাফটার এন্ড ফরগেটিং’-এ এক জায়গায় দেখা যায়, রাশিয়া অধিকৃত প্রাগ শহরে এক চেক নাগরিক অসুস্থ হয়ে বমি করছে। তা দেখে আরেক চেক নাগরিক জানায়, ‘আমি একদম ঠিক ধরেছি, তুমি কী বলতে চাইছ।’ ইগেল্টন বলেন, এখানে লক্ষ করার ব্যাপারটা এই, দেশে যখন একনায়কতন্ত্র চলে তখন এই অদ্ভুত অর্থ খোঁজার বাতিক দেখা যায়। মানুষ সব কিছুতেই কোনও না কোনও গভীর অর্থ খোঁজে। হাভাতের মতো সবকিছুই বিশ্বাস করতে চায়। যা আগে হয়তো তাৎপর্যহীন মনে করত, এখন সেটার মধ্যেই গভীর কারণ খুঁজে পায়। মনে করে, নেতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রে কিছুই ঘটছে না। যেমন ২০১৭-এর ডিসেম্বরে পেইক্তু পর্বতে দাঁড়িয়ে থাকা কিম জং উনের একটা ছবি দিয়ে উত্তর কোরিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছিল, তাদের রাষ্ট্রপ্রধান নাকি আবহাওয়াও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, কিম যাওয়ার আগে সেখানে নাকি ভীষণ তুষার-ঝড় চলছিল, কিম গিয়ে পৌঁছতেই সে ঝড় থেমে যায় এবং রোদ-ঝলমলে আবহাওয়া ফুটে ওঠে। এখানে খিল্লি এটাই যে, শুধু মিডিয়া এ কথা প্রচার করে তা-ই নয়, দেশের সাধারণ মানুষ সেটিকে খিল্লি হিসেবে চিহ্নিত করতেও পারে না। তার মধ্যে গভীর অর্থ খোঁজে, তাকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে।
ষাটের দশকের একদম শেষদিকে প্রকাশিত ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’ বইয়ের এক প্রবন্ধে কুন্দেরা ৬৩টা শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর বইয়ের বিভিন্ন ভাষার অনুবাদকদের জন্য। সেখানে ‘হাসি’-র সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে আয়োনেস্কোর জবানি উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘ভয়ঙ্কর আর হাস্যকরের মধ্যে বিভেদরেখাটা আসলে খুব ক্ষীণ।’ লিখেছিলেন গোগোলের কথা, ‘মনোযোগ দিয়ে যত বেশিক্ষণ আমরা হাসির গল্পের দিকে তাকিয়ে থাকি, গল্পটা ততই করুণ মনে হতে থাকে।’ ‘বুক অফ লাফটার এন্ড ফরগেটিং’-এ লেখকের বাবা ধীরে ধীরে সব ভুলতে থাকেন। ক্রমশ ভাব প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত আলাদা আলাদা শব্দও ভুলতে আরম্ভ করেন। নিজেকে প্রকাশ করার জন্য হাতে-গোনা কিছু শব্দ পড়ে থাকে, মনের অর্থ ঠিকভাবে প্রকাশ করতে না পেরে হাসেন বাবা। দৃশ্যটা করুণ। লেখক আমাদের মনে করান, আমরা প্রথমে শব্দকে অর্থ দিই, তারপর ঘুরে এসে সে-ই আমাদের অস্তিত্বকে অর্থ দেয়। আমরা শব্দ দিয়ে নিজেদের চিনতে পারি, নিজের পরিচিতি গঠন করি। সেটা চলে গেলে পড়ে থাকে শুধু হাসিটা, অনেকটা লুইস ক্যারলের চেশায়ার ক্যাটের মতো বা সুকুমার রায়ের হ য ব র ল-র বেড়ালের মতো, যে এক চোখ বুজে ফ্যাচফ্যাচ করে বিশ্রীরকম হাসতে থাকে।
কুন্দেরার হাসি বহু ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বটে, কিন্তু গাম্ভীর্যবিরাগী। ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং’ উপন্যাসে মহান যুগান্তকারী সৃষ্টির পেছনে কারণ হিসেবে লেখক হাজির করেছেন কোনও মহৎ প্রেরণা নয়, বরং লঘু তামাশা। খিল্লি। বেঠোফেনের সঙ্গীতের সঙ্গে টমাসকে পরিচয় করিয়েছিল টেরেজা। তারপর যখন টমাসকে ফেলে রেখে টেরেজা জুরিখ থেকে প্রাগে চলে যায়, তখন টমাস ভাবতে থাকে, টেরেজাকে অনুসরণ করবে কি না। অনুসরণ করলে নিৎশের ‘ইটার্নাল রিটার্ন’-এর ফাঁদে পড়ে যাবে সে। একই কাজের পুনরাবৃত্তি অনেকটা কাফকা-বর্ণিত অন্তহীন বৃত্তাকার আমলাতন্ত্রের মতো। এ প্রসঙ্গে সে ভাবতে বসে, বেঠোফেন যখন ‘এস মুস সেইন’ শব্দবন্ধকে ব্যবহার করে অমর সুরসৃষ্টি করেন, তখন তাঁর অনুপ্রেরণা কোনও মহাকাব্যিক উৎস ছিল না। বরং একজনের কাছে টাকা ধার চাইতে গেলে সে উত্তর দিয়েছিল ‘এস মুস সেইন’। জার্মান থেকে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘তথাস্তু’। যখন বেঠোফেন শুনবে কেউ, সে তো জানবেই না এই সঙ্গীতের উৎস কী। উৎস-রহস্য জানতে পারলেই সব ফক্কা। হাসি পেয়েছিল ঘটনাটা ভেবে। কিন্তু এই আলগোছে আসা শব্দটাই কত ভারী ঠেকেছিল টমাসের জীবনে! টেরেজা কি তার নিয়তি? না কি কাকতালীয় ঘটনা?
কুন্দেরা পড়ার পর হাসির প্রতি আমাদের আচরণ বদলে যায়। কেমন বদলে যায়? হয়তো লাইব্রেরিতে বসে আপনি সুকুমার রায়ের কবিতা পড়ছেন, ‘রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা, হাসির কথা শুনলে বলে, হাসব না-না, না-না! সদাই মরে ত্রাসে— ঐ বুঝি কেউ হাসে! এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে তাকায় আশেপাশে।’ পড়ে আবার নতুন করে ভাবতে বসলেন, হাসতে মানা কেন? ‘সদাই মরে ত্রাসে’— এমনই বা হল কেন? তাহলে কি রামগরুড়ের অতীত জীবনে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে? এসব নিয়ে চিন্তা করছেন গম্ভীরভাবে, পুরোদস্তুর অর্থের অন্বেষণে নেমেছেন, এমন সময়ে হঠাৎ খেয়াল হল এ কী! সবকিছুর মধ্যে অর্থের উৎপাত খোঁজা তো…
বা এরকমও হতে পারে, কুন্দেরা পড়তে পড়তে হঠাৎ এমন কোনও জায়গায় ফিক করে হেসে ফেললেন, যেখানে কেবল অমানুষই হাসতে পারে। ডার্ক হিউমারটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন, বা নারীশরীরের বর্ণনা বা ধর্ষণের ‘সুস্বাদু’ দৃশ্য মনে এনেছে খুশির মৌতাত। এমন সময়ে মাথা তুলে দেখলেন সামনে কুন্দেরা বসে, আপনারই মুখের দিকে তাকিয়ে। মুখে তাঁর সেই বিখ্যাত শয়তানি-মাখা চোরা-হাসি। লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলেন। নাঃ! ধরা পড়ে গেছেন! খুব বিচ্ছিরি ভাবে ধরা পড়ে গেছেন! খিল্লির খোঁজে নেমে কখন যে নিজেই খিল্লি হয়ে গেছেন, টের পাননি।