‘‘To be born again,’ sang Gibreel Farishta tumbling from the heavens, ‘first you have to die.’’ (‘The Angel Gibreel’, The Satanic Verses)
বিজ্ঞজনেরা যদিও বলে গেছেন মলাট দেখে গ্রন্থবিচার না করতে, কিন্তু কোনও-কোনও ক্ষেত্রে এই বিধানের অন্যথা বোধহয় সংগত। যেমন সলমন রুশদির সাম্প্রতিকতম বই Knife: Meditations After an Attempted Murder। আর্শ রাজিউদ্দিন-এর করা অসম্ভব স্মার্ট বাহুল্যহীন প্রচ্ছদ— ক্যানভাস বা তুলোট কাগজে সূক্ষ্ম, ধারালো একটি ছুরি Knife শব্দটিকে মসৃণভাবে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে; নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিককালের অন্যতম শ্ৰেষ্ঠ জ্যাকেট পরিকল্পনা! কী অনায়াস শৈল্পিকতায় রাজিউদ্দিন বইটির বিষয়ের সঙ্গে নিপুণভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর আধুনিক মিনিমালিস্ট ডিজাইন, যা আর্জেন্টাইন-ইতালীয় শিল্পী লুসিও ফন্টানার বিখ্যাত Tagli সিরিজে ছুরির আঘাতে ফালা-ফালা করা ক্যানভাস মনে করিয়ে দেয়।
The Satanic Verses লেখার অপরাধে খোমেইনির ভয়ানক ফতোয়ার পর কেটে গেছে ৩৩ বছর; আরও ২১টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়ে গেছে লেখকের, ২০২২-এর ১২ আগস্ট ৭৫ বছর বয়সি সলমন রুশদি Chautauqua কনভেনশন সেন্টারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, বিষয়— লেখককুলকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা! ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস— আপাদমস্তক কালো পোশাকে মোড়া, কালো মুখোশে মুখ-ঢাকা এক আততায়ী ধেয়ে আসে তাঁর দিকে, হাতে খোলা ছুরি। পরবর্তী ২৭ সেকেন্ড ধরে সে এলোপাথাড়ি ছুরি চালায় ৭৫ বছর বয়সি লেখকের শরীরে। ফন্টানারের ছুরির ঘায়ে ছিন্নভিন্ন ক্যানভাসের মতোই হয়ে যায় তাঁর শরীর— চোখ, মুখ, হাত, বুক, পেট প্রাথমিকভাবে স্টেপল করে কোনওরকমে জুড়ে রাখার চেষ্টা হয় হাসপাতালে। অকল্পনীয় হিংস্র এই ধর্মান্ধ আঘাত টলিয়ে দেয় সারা বিশ্ব। দীর্ঘ হাসপাতালবাস, যন্ত্রণা, হতাশা এবং সর্বোপরি মৃত্যুকে পরাজিত করার লড়াইয়ের আখ্যান রুশদির Knife। আততায়ী ২৪ বছরের মার্কিন-লেবানিজ এক যুবক, লেখক যার নামকরণ করেন ‘A’ (assailant, assassin, assumptions, assignation, ass এবং asinine— প্রত্যেকটি শব্দের প্রথম অক্ষর ‘A’, শব্দগুলো সমনামী হয়ে ওঠে তাঁর কাছে); সম্ভবত তাঁর ১৫টি উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধের সম্ভার থেকে একটি বিশেষ (পড়ুন বিতর্কিত) উপন্যাসের দুটি মাত্র পৃষ্ঠা পড়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, এই লেখকের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই । অতএব নিউ ইয়র্কে তাঁর মায়ের বাড়ির বেসমেন্টে সে প্রস্তুত হয়, বক্সিংয়ের রিং-এ হাত পাকায়, তার ‘ইউটুবি’ গুরু তাকে পথ দেখান। ব্যাগভর্তি নানা ধরনের ছুরি নিয়ে সে হাজির হয় প্রেক্ষাগৃহে, তারপর শিথিল নিরাপত্তার সুযোগ নিয়ে মঞ্চে, ‘like a squat missile’, যেখানে রুশদি প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁর বক্তৃতা আরম্ভের। আর তারপর সেই ২৭ সেকেন্ড! রুশদি এই ২৭ সেকেন্ডের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সরস ভঙ্গিমায়: ‘In twenty-seven seconds— if you happen to be in a religious frame of mind— you can recite the Lord’s Prayer. Or, eschewing religion, you could read aloud one of Shakespeare’s sonnets… Fourteen lines of iambic pentameter, octave and sestet: that’s how long we had together…’
‘দীর্ঘ’ এই ২৭ সেকেন্ডের অভিঘাতে তাঁকে ঘিরে থাকা অনেকগুলো জীবনও লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়— তাঁর বোন সামিন, দুই পুত্র জাফর ও মিলান এবং তাঁর স্ত্রী এলাইজার জীবন। Knife এই মানুষগুলির যন্ত্রণা, তাঁদের লড়াইয়েরও গল্প বলে। কথক কখনও হয়ে ওঠেন স্নেহময় পিতা, কখনও-বা অতীতচারণে উঠে আসে মদ্যপ, অত্যাচারী পিতার রোষ সামলে বেড়ে ওঠা পিঠোপিঠি ভাইবোনদের কথা, তাদের বাঁধন। আর এ সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে তাঁর প্রেমিকসত্তা। বইটি দুই ভাগে বিভক্ত: Angel of Death, Angel of Life। দুটি ভাগেই ক্রমাগত ফিরে-ফিরে আসে এলাইজার কথা— লেখকের থেকে প্রায় দু-দশক ছোট তাঁর প্রেমিকা এবং পঞ্চম স্ত্রী। প্রতিষ্ঠিত আলোকচিত্রী, লেখক, কবি এলাইজা গ্রিফিথস তাঁর Angel of Life, প্রাণদাত্রী, মৃত্যু-উপত্যকা থেকে ফিরে আসার আশ্রয়স্থল, তাঁর মিউজ। Knife যতটা সলমনের, ততটাই এলাইজার ছিন্নভিন্ন ক্যানভাস।
তবে একটু অস্বস্তি হয়, যখন দেখি এলাইজার চরিত্রটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তাঁর প্রাক্তন সঙ্গিনীদের খাটো করতে হয় লেখককে: তাঁর পরিবারের সদস্যদের কথা বলেন— ‘And all of them loved Eliza immediately. They had not been so enthusiastic about one or two of the women who preceded her. … But when he [Milan] and all the rest of my family met Eliza, they told me, ‘Finally.’’ এই অন্তরঙ্গ কথালাপের অছিলায় তাঁর সমালোচকদের বেশ অনেককেই একহাত নিয়েছেন রুশদি; তাঁর লেখক-সহকর্মী, নেতা, রাজনীতিবিদ, মায় ইংল্যান্ড ও ভারতবর্ষের মতো গোটা দেশ, যারা তাঁর সিদ্ধান্তের, বা জীবনযাত্রার সমালোচনা করেছে কখনও।
বইটির প্রকাশকালে এক সাক্ষাৎকারে রুশদি বলছেন, এই বইটি তাঁর রুখে দাঁড়ানোর অস্ত্র , তাঁর নিজস্ব ছুরি। ছিন্নভিন্ন এক দেহ থেকে একটি গোটা বইয়ের স্রষ্টা হয়ে ওঠার সাক্ষী। ‘Words are the only victors…’ রুশদির Victory City-র নায়ক কবি পম্পা কম্পন বলে; Knife সেই শব্দের জয় ঘোষণা করে। Knife-এর ভাষা তীক্ষ্ণ, ভণিতাহীন, রুশদির স্বভাবসিদ্ধ ডার্ক হিউমারে মোড়া। আঘাত সপাট। Charlie Hebdo-র দপ্তরে ঘাতক হানা থেকে বেঁচে ফেরা সাংবাদিক, ফিলিপ লাসা-র Disturbance-এর মতো আবেগ ও দার্শনিকতায় ঠাসা, ইন্টেলেকচুয়াল স্মৃতিকথা নয় Knife, বরং তথ্যে, বিবরণে, টিপ্পনীতে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে রুশদির স্মৃতিচারণ; স্মৃতির মতোই এগিয়ে-পিছিয়ে নেয় সময়কে। দীর্ঘ অসহায় হাসপাতালবাস ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের যন্ত্রণাময় চিকিৎসাকাল ধরে রাখে সিনেমার মতো, কখনও স্পষ্ট ক্লোজ-আপ, কখনও-বা আবছা, আউট-অফ-ফোকাস লং শট। পাঠকের মনে গেঁথে যায় ছুরির আঘাতে কোটর থেকে বেরিয়ে আসা চোখ, মুখের ওপর ঝুলে থাকা, ‘like a large, soft–boiled egg’! অথবা ফুসফুস থেকে জল বের করতে উদ্যত ডাক্তারের নিজেকে ‘জল টানার চ্যাম্পিয়ন’ ঘোষণার পর অর্ধমৃত লেখকের অন্তর্কথন, ‘I didn’t know there was a championship?… A Super Bowl of fluid draining?…’ বার বার ফিরে আসে এলাইজার কথা, প্রথম দেখা থেকে সাংসারিক টুকিটাকি, যত্ন করে তুলে রাখা নিজের ও সন্তানদের বাল্যস্মৃতি।
এরই মধ্যে ঢুকে পড়ে ‘A’ র সঙ্গে এক কাল্পনিক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা, বেশ কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে। অতর্কিত এই হিংস্রতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখক প্রবেশ করেন ঘাতকের মস্তিষ্কে, শিকারি ও শিকারের দেখা হয়।এই কাল্পনিক কথোপকথনের সঙ্গেই ঝরঝরে স্মৃতিকথার স্বরটা হয়ে ওঠে তাত্ত্বিক, দার্শনিক। এবং এই না-হওয়া কথাগুলোই শেষপর্যন্ত Knife-কে স্বতন্ত্র করে তোলে; অসহিষ্ণু, ধর্মান্ধ, বিতর্কিত, বিষময় এক সময়ের শব ব্যবচ্ছেদের দলিল হয়ে ওঠে The A পরিচ্ছেদটি।
রুশদির গদ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাঁর digression বা অচেতন সংযোগ (free association)। এর বলিষ্ঠ প্রয়োগ পাই Knife-এ; শব্দ নিয়ে, ভাষা নিয়ে, ছুরি নিয়ে তাঁর চিন্তাসূত্রে— ‘During those empty sleepless nights, I thought a lot about The Knife as an idea… A knife is a tool, and acquires meaning from the use we make of it. It is morally neutral. It is the misuse of knives that is immoral.’ তাঁর শব্দরা হয়ে ওঠে তাঁর হাতিয়ার— সত্যের, সুন্দরের, লড়াইয়ের। ‘Language, too, was a knife. It could cut open the world and reveal its meaning, its inner workings, its secrets, its truths…. It could call bullshit, open people’s eyes, create beauty. Language was my knife…. maybe this was the knife I could use to fight back… to remake and reclaim my world…’
আলোচনায় Knife সম্পর্কে ‘বই’ শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করলাম— ২০৯ পৃষ্ঠার আখ্যানটিকে কোনও একটি ধারা বা জঁরে বেঁধে রাখা মুশকিল— আত্মজীবনী, দর্শন, প্রেমকাহিনি, ‘মনহীন-মননহীন-মগজহীন এক ভয়ানক হিংস্রতার’ দলিল— সব মিলেমিশে একাকার দুই মলাটের মধ্যে। তাঁরই সৃষ্ট জিব্রিল ফারিস্তার ভাষা ধার করে বলা চলে, প্রলম্বিত এক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নতুন জন্ম-লাভের আখ্যান Knife।