ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিহি মন্তাজ: পর্ব ১৫


    শুভময় মিত্র (July 22, 2022)
     

    শক

    এখানে কোনও বাসস্ট্যান্ড নেই। তবে প্রায় সব বাস দাঁড়ায়। রাস্তার মাঝখানে আড়াআড়ি ব্যারিকেড বসেছে; বড়লোক চাষির বখাটে ছেলের উদ্দাম বাইকের উত্তেজনার পারদ নামাতে। তা সত্ত্বেও, প্রায়ই ছিটকোয় দু’একটা। রক্তের দাগ মিলিয়ে যায় একের পর এক বাস-ট্রাকের চাকার লাল ধুলোয়। একদিকে দ্বারোন্দা, বনভিলা, চৌপাহাড়ির জঙ্গল পেরিয়ে ইলামবাজার। অন্যদিকে শ্রীনিকেতন, বোলপুর, জাম্বুনি। একটা মন্দির আছে কোণে। নাম বাসস্ট্যান্ডেশ্বরী। দু’একটা দোকান। মিষ্টির দোকানে সদ্য নামা সত্ত্বেও টক রসগোল্লার যথেষ্ট কদর। বেঞ্চি আছে। গ্রামের সবার অফিস ওটা। বা ক্যাফে। জমির দালাল, পার্টির লোক, বিল্ডিং মেটিরিয়ালের সাপ্লায়ার, সবাই আসে। টুকটাক আরও দোকান। পালং শাক আর প্লাস্টিকের জুতো, একই দোকানে। রাস্তার এপার-ওপার মিলিয়ে তিনখানা ভাজাভুজির দোকান। কুমড়োর ফালি বেসন দিয়ে ভাজা হলেও ওখানে সেটিকে বেগুনি বলা রীতি। সব দোকানে কিছু-না-কিছু রিচার্জ চলছে। ডাউনলোড-ও। এখান থেকে একটা রাস্তা গ্রামে ঢুকে পড়েছে। হাঁটতে শুরু করে গন্তব্য ভুলে গেলে থামতে হবে হালসিডাঙ্গায়, অজয়ের চরে। রাস্তার সঙ্গে চলে গেছে ইলেক্ট্রিকের তার, ওপরে-ওপরে। দূরে-দূরে ল্যাম্পপোস্ট। হালে এল.ই.ডি. লেগেছে। চুরি হয়ে যাওয়া চার্জার-ব্যাটারি আবার লাগালে জ্বলে, সন্ধে হলে। সে-আলোর পথযাত্রী সংখ্যায় কম।

    ঝড়-বাদলার সময় একটা ঘটনা প্রায়ই ঘটে। গাছ, ডাল পড়ে যায়। নিশুত রাতে কোথায় যেন চিড়চিড় আওয়াজ হতে থাকে। সোর্স খুঁজে পেলে অন্ধকার আকাশে চোখে পড়ে ইলেকট্রিক আলেয়া। তার ছিঁড়ে জড়িয়ে গেলে, শর্ট হলে এমন হয়। জ্বলতে-জ্বলতে, পুড়তে-পুড়তে মেটাল গলে ফুরিয়ে যায়। ফের সব চুপচাপ। তাই কোথাও হাওয়া ওঠার খবর পেলে কারেন্ট অফ করে দেওয়া হয় ইলামবাজার কন্ট্রোল স্টেশন থেকে। প্রায়ই এমন হয়, পাতা অবধি নড়ছে না, অথচ লোডশেডিং। বুঝতে হবে, ঝড় উঠেছে অন্য কোনও গ্রামে। অনেক সময় ভুল করে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কারেন্ট এসে যায়। দেখে সবাই আহ্লাদ করে। তড়িঘড়ি চলেও যায়। এই ব্যাপারটা নিয়ে কারুর কোনও সমস্যা নেই। কারেন্ট যাক, বাড়ি উড়ে যাক, ক্ষতি নেই। মোবাইলের আলো জ্বললেই হল। রাতে এমন পরিস্থিতি হলে সম্পন্ন কিছু ঘরে মৃদু আভা দেখা যায়। টিভি চলে ইনভার্টারে। বাইরে কারা যেন ঘুরঘুর করে ঝোপেঝাড়ে। আদিবাসীদের খোঁয়াড়ে ঘুসঘুস করে ময়লা শুয়োরগুলো। একটা কুকুরও চেঁচায় না। গোয়ালে গল্প শোনে গরুদের গা ঘেঁষে বসে। চাঁদ-চেরা মেঘ না ডাকলে মাদল বাজে। মাতাল নিশ্চিন্তে ভেজে অদৃশ্য ছাউনির তলায়। এসব ঘটে রাতের অন্ধকারে।

    সেদিন দুপুর থেকে বেশ বাজে আকাশ। সকালে একটু হয়েছিল। তারপর টানা ভ্যাপসা। বিকেলে মোড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। আর কোথায় যাওয়ার নেই, তাই। দূর থেকে দেখি খুব হই হই। বেশ কিছু লোক রাস্তার দু’ধারে। প্রথমে বুঝিনি। পৌঁছতেই চিৎকার, ‘যাবেন না, যাবেন না!’ একটু পরে বুঝলাম ব্যাপারটা। ছেঁড়া তার ঝুলছে রাস্তার ওপর। ফাঁসির দড়ির মতো। গলায় দেওয়ার ফাঁসটা নেই। ওতে কারেন্ট থাকলে, এক স্পর্শেই খতম। মেইনস কোথায়? অফ করলেই পারে। একজন বলল, ‘ওই দিকে।’ অন্যজন দেখাল আর এক দিকে। কেউ এসে পড়লে সাবধান করছে সবাই। আসল কাজটা করছে না। কোথায় ফোন করলে মেরামতির লোক আসবে জানতে চাওয়ায় একজন বলল, ‘আসবে না।’ একদম বাজে কথা। আমি ফোন ঘেঁটে ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। এদিকে আমার মতো অনেকেই এসে পড়েছে দু’দিক থেকে। কেউ-কেউ ঢালু পেয়ে হড়বড় করে। বাইকে। সাইকেলে। তারটা যেখানে ঝুলছে, সেটা আরোহীর গলার হাইটে। একটু দূর থেকে নজরে পড়ার কথা নয়।

    চিৎকার শুনে, দেখে, অনেকেই বেশ বিরক্ত হয়ে তার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আরও লোকের আনাগোনা বাড়বে। বাচ্চারা ফিরবে স্কুল থেকে। যাচ্ছেতাই কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। আশেপাশের ঘরে কারেন্ট নেই, চেক করলাম। একজন বলল, ‘ওতে কিছু প্রমাণিত হয় না। তার ছিঁড়েছে বলে আলো জ্বলছে না। কিন্তু ওতে কারেন্ট নেই, তার গ্যারান্টিও নেই।’ আরও শুনলাম, ‘অন্য গ্রিড থেকেও কারেন্ট দেওয়া হয়। কোন দিক থেকে লাইনে কে কত কারেন্ট ভরে দিচ্ছে তা তো দেখে বোঝা সম্ভব নয়।’ আমি ফোন হাঁকড়ে যাচ্ছিলাম।

    কিছু ছোকরা জটলা করছিল, মজা দেখছিল। যেন অপেক্ষা করছিল লাইভ বিদ্যুৎপৃষ্ট হওয়ার একটা এপিসোড প্রত্যক্ষ করবে বলে। নতুন রঙ্গ-রসিকতা উদ্ভাবনে এদের জুড়ি নেই। সবাই সবাইকে ওই তারের দিকে ঠেলাঠেলি করতে লাগল। মিছিমিছি খেলা আর কি! ধমক দিতে চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে। এরই মধ্যে রাস্তায় একটা কেঁদো গাড়ি ঢুকেছে। এই ধরনের গাড়ির মালিককে সবাই অপছন্দ করে। কিন্তু দেখা হলে অন্য ব্যবহার। মালদার লোক যে! গাড়ি থামানো হল। ভেতরের লোক নামল না। যতটা জায়গা আছে সেখান দিয়ে গাড়ি চলে যেতেও পারে। কিন্তু যদি একটু হাওয়া দেয়? যদি তার ঠেকে যায় সাইড ভিউ মিররে? ওখানেই তো সেই কথাটা লেখা থাকে, ‘মাল যদ্দূরে ভাবছ তার চেয়ে সেটা কাছে হতে পারে বাপু।’ যেতে হলে রাস্তা থেকে একদিকে চাকা নামাতে হবে। মাটি ভিজে। কিন্তু নরম নয়। দেড় ইঞ্চি কাচ নামানো ড্রাইভারকে বলা হল, ‘যাও যাও, ভয় নাই ভয় নাই, সবাই যাচ্ছে।’ ওই সেই একই ব্যাপার। আস্ত একটা ইলেকট্রিফায়েড, দুম্বো গাড়ি যাত্রী-সহ ঝলসে উঠলে সিনেমার মতো হবে। লোক মরে তো যাবেই। মরা লোক দোষ দিতে পারবে না উপদেশদাতাকে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে মাঠে এক-আধটা গরু-ছাগল বজ্রাহত হয়। তার সঙ্গে এর কোনও তুলনা হয় না কি? অনেকেই ফোন বের করে তৈরি আছে, ভিডিও করবে। আর একটা গাড়ি ঢুকেছিল। তাকে কিছু বলার আগেই সে ব্যাক করে অন্য দিকে চলে গেল। ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি, দু’পাশে ভিড় দেখে ভয়ংকর কিছু আন্দাজ করেছিল নিশ্চয়ই। এদিকে প্রথম গাড়ি দাঁড়িয়েই আছে। ড্রাইভারের কাচ আবার উঠে গেছে। নিশ্চয়ই ডিসিশন নেওয়া হচ্ছে ভেতরে। একটা বাচ্চা মেয়ে, সঙ্গে আরও কয়েকটা, আসছিল। এখন আর বাচ্চা বলা যায় না যদিও। নির্ভয়ে গাড়িটার কাছে চলে গেল সে। সাইড মিররটা নিজের মতো একটু ঘুরিয়ে, চুল ঠিক করে পিড়িং-পিড়িং করে লাফাতে-লাফাতে বন্ধুদের ধরে নিল।

    নকল ‘আমুল’ আইসক্রিমের গাড়ি এসে গেছে। চড়কের মেলা বসে না যায়। বদ্ধভূমি রেডি। মাঝখানে গাজনের আইফেলটা নেই। আর সবই মজুদ। এবারে গাড়ি পিছতে লাগল। পিছনে যারা ছিল, তারা সরে রাস্তা ক্লিয়ার করে দিল। কেউ কিছু বলল না। সবার মুখ দেখে আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারছিলাম। অনেকে হতাশ। কেউ-কেউ তৃপ্ত। পিছু হটতে হল তাহলে! এর দু’সেকেন্ড পরে জানোয়ারের মতো একটা ডাক বেরিয়ে এল ইঞ্জিন থেকে। একপাশের লোকদের প্রায় চাপা দিয়ে, ঝোলা তার কাটিয়ে, গাঁক-গাঁক করে হর্ন বাজিয়ে চলে গেল গ্রামের দিকে। গাড়ির সাংঘাতিক দাপটে দুলে উঠল ঝোলা তারটা।

    কিছু ছাগল চলে গেল তলা দিয়ে। ওপরের দিকে তাকাল। পাতা নেই। ইন্টারেস্ট নেই। খেয়াল করলাম কুকুরগুলো জটলা করছে এদিক-ওদিক। ডাকছে না। গরগর করছে মাঝে মাঝে। ‘ওই আসছে রে, আসছে’ শুনে তাকিয়ে দেখি দক্ষিণ দিক থেকে এগিয়ে আসছে কালো এক আকাশ। গুটোনো কার্পেট খুলতে-খুলতে আসছে আটা কলের ছাদ পেরিয়ে। রোদ্দুর নেই তবু ধানক্ষেতের ওপর ছায়া ফেলতে-ফেলতে রাস্তার দু’পাশে তাল গাছের সারির ওপর পৌঁছতেই তারা ভয়ানক দোলাদুলি শুরু করে দিল। একটা মরা পাতার ঝাড় খসে পড়ল চড়চড় করে। বাজ নয়, পাতা। সবাই খুব হাসাহাসি করতে লাগল। গোবেচারা রাস্তাটা হয়ে গেল হাওয়ার টানেল। সেই হাওয়ায় কোথা থেকে যেন হু হু করে এসে পড়ল একজন। পরিধি বলে কিছু নেই, আছে শুধু একটা হাইট। মাথার ওপর উস্কোখুস্কো চুলের হেলমেট। পাঁজরের গ্রিলে প্যারালাল উল্কি। ঝকঝক করছে চোখ। ল্যান্ড করল একদম স্পটে। দেখল সবাইকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে। ভাবখানা হল, এই তোমাদের সাহস? আমার পাশে ভাঙাচোরা একটা বুড়ো অনেকক্ষণ ধরে বিড়বিড় করছিল। এবারে গলা তুলল, ‘কী রে, পারবি? পারলে জে ডি দিব।’ জে ডি বাংলা মদের ব্র্যান্ড, এখানে খুবই জনপ্রিয়। কী পারার কথা বলছে বুঝলাম না। আবহে দ্রিমি-দ্রিমি মেঘের ডাক শোনা গেল ড্রামের মতো। বৃষ্টি এসে গেছে, সিম্বালের মতো তার রিমঝিম আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ নড়ছে না নিজের জায়গা থেকে। একজন জামা খুলে মাথায় পাগড়ি করে ফেলল। দেখে একজন অন্যের লুঙ্গির দিকে দেখাতে লাগল। এখান থেকে নড়া যায় না কি? একজনের ব্যাগে ছাতা ছিল, খুলতেই তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। গণতন্ত্রে, মনতন্ত্রে টইটম্বুর সবাই।

    আবহে দ্রিমি-দ্রিমি মেঘের ডাক শোনা গেল ড্রামের মতো। বৃষ্টি এসে গেছে, সিম্বালের মতো তার রিমঝিম আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ নড়ছে না নিজের জায়গা থেকে। একজন জামা খুলে মাথায় পাগড়ি করে ফেলল। দেখে একজন অন্যের লুঙ্গির দিকে দেখাতে লাগল। এখান থেকে নড়া যায় না কি?

    এদিকে আমাদের নতুন লোক আস্কারা পেয়ে পা তুলে-তুলে লাইভ তার প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ভীষণ কাছে চলে গিয়ে এই ছুঁয়ে দিলাম, যেন রাধার ওড়না, এমন ভঙ্গি করছে। জনগণ খুশি, দ্য শো মাস্ট গো অন। কিস্যু না ঘটা জীবনে একটা শক চাই যে! বৃষ্টি, হওয়া দুই-ই বাড়ছে। ঝুলে থাকা তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব রেখে অদৃশ্য এক বলয় তৈরি হয়েছে নিশ্চয়ই। যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তুরীয় অবস্থায় থাকায় সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বলেই আমার ধারণা। বৃষ্টির ঝালরের মধ্যে এমন ইলেক্ট্রিফাইং ব্যালে দেখিনি কোনওদিন। স্ট্রিপটিজের সময়, ভিডিওতে দেখেছি যদিও, স্টেজে একটা চকচকে ডান্ডা থাকে। তা অব্যর্থভাবে একটা কিছুর প্রতীক। তাকে নিয়েই নর্তকী আদিখ্যেতা করতে-করতে নিজেকে উন্মুক্ত করে ফেলে। আমার একবার ব্যাংককে গিয়ে বৌদ্ধিক নিদর্শন দেখার অছিলায় সেই শো দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। খরচ বেশি নয়। পয়সাওয়ালা বন্ধুবান্ধব আছে ওখানে। বুড়ো বয়েসে যাতায়াতের বিত্ত জোগাড় করার পর অত্যন্ত হতাশজনক ঘটনা ঘটল। এক ব্যাটা ডাক্তার, ওষুধ কোম্পানির পয়সায় গিয়েছিল সেখানে। ফিরে এসে সে কী আক্ষেপ! ‘আরে ওগুলো মেয়ে নয় মাইরি! কী তা জানি না, মেয়ে নয়, আমি ইন্টারনেটে পড়েছি।’ শুনে, নিজেও একটু লেখাপড়া করে বুঝেছিলাম আসল ব্যাপারটা। খুব ক্ষতি হয়ে যায় আমার। যাওয়ার ইচ্ছেটাও চলে যায়। টিভি, ক্যামেরা, টেপরেকর্ডার কিনতে কে আর আজকাল ব্যাংককে যায়? এই মুহূর্তে আমাদের সামনে তেমনি এক ধাতব কিছু। স্পর্ধায় তার মাটিতে পা পড়ছে না। একে ঘিরেই চলছে আষাঢ়ে নৃত্যকলা।

    অনেক দূরে হাওয়া দিলে যেমন অন্য জায়গায় কারেন্ট চলে যায়, এখানেও সেরকম ঘটনা ঘটছিল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে এসব দেখছি সেখানেই জল ঝরতে লাগল হুড়মুড় করে। সিনেমার শুটিং না কি যে, রেন মেশিন দিয়ে ভেজাচ্ছে? রূপপুর-সুপপুরে এখন নির্ঘাত খটখট করছে। ঘটনাপ্রবাহে কিছুটা আপ্লুত হয়ে থাকায় ভুলে গিয়েছিলাম। আবার ফোন বের করলাম। এবারে একটা নম্বরে লেগে গেল। সরকারি কর্মচারী, ল্যাদখোর, ইরেস্পন্সিবল, জানি কী বলবে। খুব দ্রুত ঠিক কোথায়, কী ঘটেছে বলতেই উত্তর এল, ‘উদয়বাবু খবর দিয়েছেন; লোক যাচ্ছে, আধ ঘণ্টা, আপনি আছেন তো? একটু খেয়াল রাখুন, আসছি।’ এমনও হয়? তার মানে উদয়দা খবরটা পেয়েই কাজের কাজটা করে ফেলেছে। নিজে তামাশা দেখতে আসেনি। কী যে স্বস্তি, কী যে আরাম!

    এবারে ভিড়ের মধ্যে থেকে লাল ঝুঁটি মোরগ বেরোল। এদিক-ওদিক দেখে, কাউকে পাত্তা না দিয়ে চলে এল রাস্তার মাঝখানে, ঝোলা তারের ঠিক তলায়। পিচের রাস্তায় কীসব খুঁটে-খুঁটে খেতে লাগল। কী খাচ্ছে সে? তার থেকে লিক করা, ঝুরঝুর করে পড়ে যাওয়া ইলেক্ট্রিকের দানা? কো-অ্যাকটর পেয়ে হিরো আরও বাড়াবাড়ি শুরু করল। দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে অদৃশ্য লাল কাপড় দুলিয়ে মোরগকে টিজ করতে শুরু করল ঘুরে-ঘুরে। এই চলল কিছুক্ষণ। মোরগ চলে যেতেই একজন বলল, ‘ব্যাস, সব খেয়ে ফেলেছে, আর কারেন্ট নাই।’ বৃষ্টি ধরে এল। আমাদের মেঘটাও দাঁড়িয়ে দেখছিল কিছুক্ষণ। এবারে যাবে-যাবে করছে। সেও শেষ দেখা দেখে যেতে চায়। মাথার ওপর আকাশে একটা ফুটো হয়েছে। নীল বেরোবে-বেরোবে করছে। পশ্চিম দিকটা তখনও ভারী। তার পেটে বিদ্যুৎ দপদপ করছে। কিছু দূরে বাজ পড়ল। আওয়াজটা পৌঁছতে একটু সময় লাগল। ভিড় পিছিয়ে গেল কিছুটা। মাতাল মারল এক লাফ। তারপর ধড়াম করে মাটিতে পড়ে গিয়ে একদম চুপ মেরে গেল। প্রকৃতি বা সাপ্লাইয়ের বিদ্যুতে তড়িতাহত হবার পারফেক্ট সিমুলেশন। তালে ঠিক। সেয়ানা অভিনেতা। একটু পরে নিজের শরীর থেকে প্রথম কনুই বের করল। স্লো মোশনে। তারপর দ্বিতীয়। দু’হাতে ভর দিয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। পরমুহূর্তে তার হাতে ইনভিজিবল তির-ধনুক। বুজে আসা আকাশের নীলকে সে আবার ফুটো করে দেবে। জয়ধ্বনি উঠল।

    এই যাত্রাপালার ক্লাইম্যাক্স কী হতে পারে তা কেউ জানে না। যে-কারণে ব্যাপারটা ভয়াবহ হতে পারে, সেটা সকলেই ভুলে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে লোক এসে তার সরিয়ে, জুড়ে, পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে, অতএব ধৈর্য ধরে একটু অপেক্ষা করতে হবে, আমি জানানোয় ইনস্ট্যান্ট পথ-নাটকের উৎসাহে একটু ভাঁটা পড়ল। ভিড়টাও যেন হালকা। আর বিশেষ কিছু হবার নেই। আমাদের সোলো পারফর্মারকিন্তু একই পজিশনে ফ্রিজ হয়ে আছে। চকচকে পয়সা পড়ল তার আশেপাশে। আমি বারবার মেন রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলাম।

    দেখি হরনাথ আসছে। গ্রামের একমাত্র রেজিস্টার্ড ষাঁড়। সবাই ভয় পায়। কাউকে গুঁতোয়নি কোনওদিন। একপাশের ভিড় ফাঁকা হয়ে গেল। তার আগমন পথ ক্লিয়ার হল। সে এসে দাঁড়াল এরিনাতে। নতুন হেভিওয়েট অ্যাকটর এসে পড়ায় আগের লোক জায়গা ছেড়ে দিল। স্বাভাবিক ছন্দে হেঁটে মিশে গেল দর্শকদের মধ্যে। হরনাথের অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি। গডফাদারের মার্লন ব্র্যান্ডোর মতো। এই মুহূর্তে তার নাক তারের কয়েক ইঞ্চি দূরে। মুখ সামান্য তুলে অপাংক্তেয় বস্তুটিকে সে একবার দেখল। মুখ নামিয়ে নিল। ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়। এক-দু’বার খুর আছড়াতেই জনগণ চনমন করে উঠল। দ্বিতীয় সিন শুরু হবে। দূরে শাঁখ বেজে উঠল। ব্যাপারটা অন্য ধরনের ফিলজফিক্যাল মাত্রা পেতে চলেছে। ‘হর হর মহাদেব’ আওয়াজ উঠতেই হরনাথ মুখ তুলল। আমরা, সাধারণ মানুষ পারি না, সে পারে বুঝে নিতে, অনেক কিছুই। স্পর্শ করার দরকার পড়ে না তার। কিছু একটা সেন্স করেছে। মেপে ফেলেছে নেকেড কেবলের শরীরের ভোল্টেজ। সামনের পা দুটো একই জায়গায়, প্রায়। পিছনের ভারী পা সরতে শুরু করেছে। বিশাল দেহটা ঘুরছে চক্রবৎ। চোখের দৃষ্টি টিপ অফ দ্য ডিজাস্টারের দিকে। হাওয়ায় একবার সামান্য দুলে উঠেছিল সেটা। ক্রোধ ঝরে পড়ল সঙ্গে-সঙ্গে। ভয়াবহভাবে মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল হরনাথ। স্থির হয়ে গেল তার। শ্বাস বন্ধ করে আমরা দেখতে লাগলাম সংলাপহীন হাই টেনশন ডুয়েল।

    এমন এক ইনটেন্স পরিস্থিতিতে যে-দৃশ্যকল্প তৈরি হতে যাচ্ছিল, তার সঙ্গে মানানসই আলোকসম্পাতের প্রয়োজন ছিল। আদর্শ হত যদি ছাই-নীল আকাশের দূর দিগন্তে মাখামাখি কমলা-হলুদ জেলির মধ্যে থমকে থাকত সূর্যের এগ ড্রপ। তার কিয়দংশ স্পটলাইট হয়ে পড়তেই পারত চকচকে ছেঁড়া তারে। হরনাথের শিঙে। সবটাই যখন মিথ্যে ড্রামা, তাহলে এই মেলোড্রামাতেই বা দোষ কি? হল না তেমন কিছু। সব গুলিয়ে দিয়ে সন্ধে নেমে গেল তড়বড়িয়ে। মরা আলোয়, বিষণ্ণ মঞ্চে আল্টিমেট খেল দেখাল হরনাথ। বিপদের বাপের শ্রাদ্ধ করে, শিং দিয়ে হঠাৎ পেঁচিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে, অবজ্ঞাভরে চিবিয়ে, পোল থেকে ছিঁড়ে, হিলহিলে ধাতুর সাপটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল রাস্তায়। সবার সামনে। তারপর মাথা তুলে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook